পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ধ্বসিয়া গেল। দুই দিকের উলটা চাপে ফুলিতে ফুলিতে একদিন পাহাড়ের দেমাক ফাটিয়া চৌচির হইল, এইরকমে বহুদিনের ঠাসাঠাসি ঠেলাঠেলি এক-একদিন হঠাৎ ভূমিকম্পের আকারে গা-ঝাড়া দিয়া বাহির হয়।

 ভূমিকম্পের ধাক্কা মাটির ভিতর দিয়া ঢেউয়ের মতো চারিদিকে ছড়াইয়া পড়ে। সেই ঢেউয়ের আঘাতে কেমন করিয়া পৃথিবী টল্‌মল্ করিতে থাকে, তাহার সামান্য একটু নমুনা তোমরা দেখিয়াছ। তাহাতে ঘরবাড়ি ভাঙিয়া পড়ে, পথঘাট ফাটিয়া যায়, রেলের লাইন মোচড়ইয়া বাঁকিয়া যায়। ১৭৯৭ খৃস্টাব্দে দক্ষিণ আমেরিকায় কুইটো শহরে যে ভূমিকম্প হইয়াছিল তাহাতে শহরের কোনো কোনো জায়গায় মানষগুলিকে ফুটবলের মতো ছুঁড়িয়া দিয়াছিল। তাহার একশত বৎসর পূর্বে পের্টিরয়্যালের ভূমিকম্পে বাজারের ভীড়কে ছিটাইয়া নীচে বন্দরের মধ্যে আনিয়া ফেলিয়াছিল। লিসবনের ভূমিকম্পে নদীতে বান ডাকিয়া শহরের অসংখ্য লোককে ডুবাইয়া দিয়াছিল। কয়েক বৎসর আগে সানফ্রান্সিসকো শহরে যে ভূমিকম্প হইয়াছিল সে কেবল বাড়ি ঘর ফেলিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, গ্যাসের নল আর বিদ্যুতের তার ভাঙিয়া জড়াইয়া সে শহরে আগুন লাগাইয়া দেয়। সে এমন সর্বনেশে আগুন যে শহরের সমস্ত দমকল মিলিয়াও তাহাকে কিছুমাত্র জব্দ করিতে পারে নাই। তার পরে শহরের কর্তা বোমাবারুদ ফাটাইয়া আগুনের আশেপাশে অনেকগুলা বাড়ি উড়াইয়া দিয়া মনে করিলেন আগুন আর ছড়াইতে পারিবে না। কিন্তু আগুন প্রায় সিকি মাইল ফাঁকা জমি টপকাইয়া শহরের আর একদিকে ফুটিয়া বাহির হইল। যাহা হউক, খানিক বাদে বাতাসের মুখ ঘুরিয়া গেল তাই রক্ষা, তাহা না হইলে শহরের চিহ্নমাত্র থাকিত কি না সন্দেহ।

 ভূমিকম্পে অনেক সময়ে পাখিরা ব্যস্ত হইয়া উড়িতে থাকে। ডাঙার জন্তু ভয়ে ছুটাছুটি আর চীৎকার করিতে থাকে। একটা হাতির কথা শুনিয়াছি, সে ১৭০৭ খৃষ্টাব্দের বড়ো ভূমিকম্পের সময়ে প্রথমটা অবাক হইয়া চারিদিকে তাকাইতেছিল, তার পর কাঁপুনি যখন বাড়িয়া উঠিল তখন সে প্রাণপণে চার পা ছড়াইয়া মাটি আঁকড়াইয়া চীৎকার করিতে লাগিল। গল্প শুনিয়াছি, একটা বাড়ির পাঁচিলের উপরে দুইটি বিড়াল মুখামুখি বসিয়া সুর ভাঁজিতেছিল, এমন সময়ে ভূমিকম্পের ধাক্কায় দুইজনকেই পাঁচিল হইতে ফেলিয়া দেয়। সংগীতচর্চায় হঠাৎ এরকম বাধা পাইয়া তাহারা পরস্পরকে আক্রমণ করিবার জোগাড় করিতেছিল, এমন সময়ে পাঁচিল ভাঙিয়া দু-চারখানা ইট পড়িতেই তাহাদের যুদ্ধের উৎসাহ থামিয়া গেল। আর এক নাবিকের পোষা টিয়াপাখির গল্প শুনিয়াছি, সে আশ্চর্যরকম কথা বলিতে পারিত। একবার ভূমিকম্পে সে খাঁচাসুদ্ধ ঘরচাপা পড়িয়াছিল। পরে শুনা গেল ভাঙা ঘরের তলা হইতে কে যেন চীৎকার করিয়া গালাগালি করিতেছে। তখন ইট সরাইয়া দেখা গেল, পাখিটা খাঁচার মধ্যে এক জায়গায় কোণঠাসা হইয়া বসিয়া আছে, আর বলিতেছে “বড়ো গরম, বড়ো গরম"।

সন্দেশ—আষাঢ়, ১৩২৫
নানা নিবন্ধ
২২১