পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ভাঁটার বিষম টানে পাহাড়ের গায়ে আছাড় খেয়ে খেয়ে তারের লাইন ভেঙেচুরে ভেসে গেল। আর তৃতীয়বারে তারের জাহাজ সমুদ্রের ওপারে পেঁছিবার আগেই সব তার ফুরিয়ে গেল-তারের অগাটা সমুদ্রেই পড়ে গেল—আয়ার্ল্যাণ্ড পর্যন্ত আর পৌঁছলই না। যা হোক, চতুর্থবারের চেষ্টায় আইরিশ সমুদ্রের ভিতর দিয়ে নিরাপদে তারের লাইন বসানো হল। তার পর দেখতে দেখতে পাঁচ-দশ বছরের মধ্যে ইউরোপে আমেরিকায় অনেক দেশেই সমুদ্রের ভিতরে, পঁচিশ-পঞ্চাশ বা একশো মাইল পর্যন্ত লম্বা তার বসানো হয়ে গেল। তখন ইংল্যাণ্ডের এক টেলিগ্রাফ কোম্পানি সাহস করে বলল, “আমরা অতলান্তিক মহাসাগরের ভিতর দিয়ে ইংল্যাণ্ড আর আমেরিকা পর্যন্ত টেলিগ্রাফের তার বসাব।”

 মোকে বলল, “সে কি কথা! অতলান্তিকের ওপর যে দুহাজার মাইল দূর! সেখানকার সমুদ্র যে তিন মাইল গম্ভীর! সমুদ্রের নীচটা উঁচুনিচু পাহাড়ের মতো, তাতেই যে হাজার মাইল তার খেয়ে যাবে! অসম্ভব লম্বা তার, অসম্ভবরকম ভারী, করাতে অসম্ভব খরচ—সবই অসম্ভব!” কিন্তু টেলিগ্রাফ কোম্পানির যাঁরা পাণ্ডা তাঁরা কোমর বেঁধে বসলেন, অসম্ভবকে সম্ভব করতে হবে। কোম্পানির মূলধন হল পঞ্চাশলক্ষ টাকা। একুশহাজার মাইল লম্বা তামার তারকে দড়ির মতন পাকিয়ে পাকিয়ে, তার উপর আঙুলের মতো পুরু করে রবারের প্রলেপ দিয়ে, তার উপর সাড়ে তিনলক্ষ মাইল লোহার তার পেঁচিয়ে টেলিগ্রাফের লাইন তৈরি হল। এই সমস্ত তার যদি একটানা সোজা করে বসানো হত, তা হজে পৃথিবীটাকে প্রায় চোদ্দোবার পাক দিয়ে বেঁধে ফেলা যেত-কিংবা এখান থেকে চাঁদ পর্যন্ত পৌছানো যেত! লাইনের ভিতরকার তামার তারটুকু দিয়েই বিদ্যুৎ চলে। রবারের কাজ কেবল বিদ্যুৎটাকে তারের মধ্যে আটকে রাখা। লোহার প্যাঁচালো তারটুকু হল বর্ম। ওটা না থাকলে পাহাড়ের ঘষায় স্রোতের ধাক্কায় জলজন্তুর উৎপাতে দুদিনে তার নষ্ট হয়ে যায়-গভীর জলে লাইন বসাতে গিয়ে আপনার ভারে তার আপনি ছিড়ে যায়। সমস্ত লাইনটির ওজন হল সত্তরহাজার মণ।

 ১৮৫৭ খৃস্টাব্দের ফেব্রয়ারি মাসে দুই জাহাজে বোঝাই তার আমেরিকার দিকে রওনা হল। তারের এক মাথা আয়াল্যাণ্ডের তীরের উপর রেখে কোম্পানির জাহাজ পশ্চিম মুখে তার ফেলতে ফেলতে চলল। বড়ো-বড়ো চৌবাচ্চার মধ্যে তারের কুণ্ডলী জুড়ানে। রয়েছে। ক্রমাগত ঘষায় ঘষায় তারের লাইন গরম হয়ে ওঠে, তাই চৌবাচ্চায় জল ভরে রাখতে হয়। জাহাজের উপর 'ব্রেক' বসানো, তাতে তারটাকে ওজনমতো টেনে ধরে-পাছে হুড়্‌ হূড়্ করে সব তার বেরিয়ে যায়। জাহাজ যদি ঘণ্টায় পাঁচ মাইল যায়, তা হলে সমুদ্রের উঁচুনিচু হিসাব বুঝে, ঘণ্টায় ছয় মাইল কি সাত মাইল তার ছাড়তে হয়। আবার বেশি টান পড়লে পাছে তার ছিড়ে যায় সেজন্যে তারের ‘টান’ মাপবার জন্য একটা যন্ত্র আছে। টান বেশি হলেই ব্রেক ঢিলা করে দেয়। তারের ভিতর দিয়ে দিনরাত ডাঙার সঙ্গে জাহাজের সংকেত চলতে থাকে। হঠাৎ কোথাও তার ছিঁড়ে গেলে বা জখম হলে অমনি সে সংকেত বন্ধ হয়ে যায়। তা হলেই জাহাজের লোকেরা বুঝতে পারে কোথাও কিছু গোলমাল হয়েছে। তখন আবার তার গুটিয়ে গুটিয়ে, সেই জখম জায়গা পর্যন্ত ফিরে গিয়ে, নষ্ট লাইন মেরামত করতে হয়।

নানা নিবন্ধ
২৪৩