পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

-ক্রমে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, তার চেহারাটা ঠিক অন্য গ্রহের মতো নয়। মনে হয় কেমন যেন লম্বাটে মতন-দুপাশে যেন কি বেরিয়ে আছে। আরো কাছে গিয়ে দেখ তার গায়ের চমৎকার আংটিটা ক্রমে পরিষ্কার হয়ে উঠছে। পৃথিবী থেকে ছোটোখাটো দুরবীন দিয়ে যেমন দেখেছি এখন শুধু চোখেই সেইরকম দেখতে পাচ্ছি। অংটিটা বাসনের কানার মতে, উকিলের শাম্‌লার ঘেরের মতো—খুব পাতলা আর চওড়া। শনিগ্রহকে অমিরা যে দেখি, সব সময়ে ঠিক একরকম দেখি না-কখনো একটু উঁচু থেকে, কখনো একটু নিচু থেকে, কখনো আংটির উপর দিকটা, কখনো তার তলাটা, কখনো সামনে ঝোঁকা, কখনো পিছন-হেলান। যখন ঠিক খাড়াভাবে অংটির কিনারা থেকে দেখি, তখন আংটিটাকে দেখি সরু একটি রেখার মতো-এত সরু যে খুব বড়ো দুরবীন না হলে দেখাই যায় না।

 প্রায় চল্লিশ বৎসর হল আমরা পৃথিবী ছেড়েছি-এখন আর আট-দশ বৎসর গেলে আমরা শনিতে পৌঁছব। ততদিনে তোমার চুল দাড়ি গোঁফ সব পেকে যাবে—তুমি ষাট বছরের বুড়ো হয়ে যাবে। শনিকে অনেকখানি ডাইনে রেখে আমরা ছুটে চলেছি। শনিও ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে ঐ বাঁয়ের দিকে ছুটে আসছে, আর কয়েক বৎসর পরে সে ঠিক আমাদের সামনে এসে হাজির হবে। সেও কিনা সূর্যের প্রজা, কাজেই সূর্যের চারিদিকে তাকেও প্রদক্ষিণ করতে হয়। কিন্তু আমাদের উনত্রিশটা বছরেও তার একটা পাক পুরো হয় না।

 যাক—এতদিনে পথের শেষ হয়েছে। অমির শনিগ্রহের উপরে এসে পৌঁছেছি। ‘আংটি'টার দিকে একবার তাকিয়ে দেখ, আকাশের উপর দিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত যেন আলোর খিলান গেঁথে দিয়েছে। খিলানের মধ্যে খিলান, তার মধ্যে ঝাপসা আলোর আরেকটি খিলান। তার উপর আবার শনিগ্রহের ছায়া পড়েছে। সূর্যের এই প্রকাণ্ড রাজত্বের মধ্যে যতদূর যাও, এমন দৃশ্য আর কোথাও দেখবে না—আমাদের পৃথিবীর দুরবীনের দৃষ্টি যতদূর পর্যন্ত যায়, এমন জিনিস আর দ্বিতীয় কোথাও পাওয়া যায় নি।

 আকাশে কত চাঁদ। একটি নয়, দুটি নয়, একেবারে আট-দশটা চাঁদ-ছোটো-বড়ো মাঝারি নানারকমের! সওয়া দশ ঘণ্টায় এখানকার দিনরাত-ঘুমের পক্ষে ভারি অসুবিধা। দিনটাও তেমনি—পৃথিবীর রোদ এখানকার চাইতে একশো গুণ কড়া। পৃথিবী থেকে সর্যকে যদি চায়ের পিরিচের মতো বড়ো দেখায়, তবে এখান থেকে তাকে দেখায় যেন আধুলিটার মতো। যখন তখন চন্দ্রগ্রহণ আর সূর্যগ্রহণ তো লেগেই আছে। তার উপর আবার থেকে থেকে চাঁদে চাঁদেও গ্রহণ লেগে যায়, এক চাঁদ আর-এক চাঁদকে ঢেকে ফেলে। এখানকার জন্য যদি পঞ্জিকা তৈরি করতে হয়, তবে তার মধ্যে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কেবল গ্রহণের হিসাব লিখতেই কেটে যাবে।

 আংটিগুলি যেন অসংখ্য চাঁদের ঝাঁক-ছোটো-ছোটো ঢিপির মতো, পাথরের ভেলার মতো, কাঁকরের কুচির মতো, লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি চাঁদ কেউ কারও গায়ে ঠেকে না, আশ্চর্য নিয়মে প্রত্যেকে নিজের পথে শনিকে প্রদক্ষিণ করছে। আর সমস্তে মিলে আশ্চর্য সুন্দর আংটির মতো চেহারা হয়েছে।

 এখন অসুবিধার কথাটাও একটু ভাবা উচিত। গরম বাতাস আর ধোয়ার ঝড় তো

২৪৮
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২