পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

মঞ্চের পেছন থেকে একটি লোক সেই আওয়াজটা করছে। তার যন্ত্রে একটা হাতল ঘোরালে আর কতগুলো কাঠের ডাণ্ডা খটখট করে একটা বড়ো কাঠের গায়ে গিয়ে লাগছে। তাতেই মড় মড়, গাছ ভাঙার শব্দের অবিকল নকল হচ্ছে।

 উঃ, কি জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। ঐ শোন তার শব্দ। পট্‌-পট্-পট্-পট্-জলের ফোঁটা পড়ছে! কেমন করে ঐ শব্দ হচ্ছে জান?—প্রকাণ্ড একটা ঢাকের মতো জিনিসের মধ্যে কয়েকটা মটরদানা ভরে সেটাকে একটি লোক আস্তে আস্তে ঘোরাচ্ছে। মধ্যে একটি পর্দা দেওয়া আছে, ঢাকটা ঘোরালেই সেই পর্দার উপর মটরদানাগুলো পট্ পট্ করে ঠিকরে গিয়ে লাগে আর বৃষ্টির ফোঁটার আওয়াজের মতো শোনায়।

 কড়্ কড়্, শব্দে বাজ পড়ছে! উঃ, কি ভয়ানক শব্দ! প্রাণটা হাতে নিয়ে যেতে হবে! কিন্তু গোড়ায়ই গোলমাল আওয়াজটাই নকল। দুটি লোক আড়াল থেকে একটা প্রকাণ্ড চৌকোনা ঢাকের উপর মস্ত বড়ো দুটো কাঠের হাতুড়ি পিটছে আর ঐরকম বাজ-পড়া আওয়াজ শোনা যাচ্ছে!

 দুম্ করে বন্দুকের আওয়াজ হল- ঝুপ্ করে একজন লোক পড়ে গেল আর দুজন লোকে ধরাধরি করে তাকে নিয়ে এল। যে গুলি করেছে সে কি নিষ্ঠুর। মানুষ খুন করতে কি তার একটুও বাধে না? আসলে কিন্তু ব্যাপারটা কিছুই নয়। বন্দুকও নাই, গুলিও করে নি কেউ, চোটও লাগে নি কারও। আওয়াজটা যে শোনা গিয়েছিল সেটা আড়াল থেকেই এসেছিল। একজন লোক একটা চামড়ার গদির উপর জোরে একটা মোটা বেতের বাড়ি মারতেই ঠিক বন্দুকের আওয়াজ বেরিয়েছিল, আসলে সব ফাঁকি।

 বন্দুকের গুলিতে একজন তো চিৎপটাং! যিনি গুলি মারলেন তিনিও বেগতিক দেখে ঘোড়ায় চড়ে চম্পট দিলেন। কি করে জানলে ঘোড়ায় চড়ে পালালেন তিনি?—ঐ শোন ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। এ-ও কি ভুল হতে পারে কখনো? কিন্তু, এ-ও যে ভুল। ঘোড়া-টোড়া কিছুই নাই; শুধু একটি লোক আড়াল থেকে ঐরকম আওয়াজ করছে। তার যন্ত্রপাতিও কিছুই নাই; কেবল দুখানা খুরের আকারের কাঠে দুখানা নাল লাগিয়ে নিয়ে সে দুটোকে একটা পাথরের উপর ঠক ঠক করে তালে তালে ঠুকছে।

 এইরকমের আরো কত আওয়াজ যে কতরকমে এর নকল করে, তা আর কি বলব! যে ঘরে এই-সব আওয়াজের যন্ত্রপাতি থাকে, সেটাকে রীতিমতো একটা কারখানাঘরের মতো দেখায়। চারিদিকেই নানারকম কল-কব্‌জা-কোনোটা হাতে চালায়, কোনোটা বিদ্যুতের সাহায্যে চলে, কোনোটা আবার চাবিতেও চলে। যারা এ-সব যন্ত্র ভেবে ভেবে বার করে, তারা বেশ রোজগার করে থাকে।

সন্দেশ-চৈত্র, ১৩২৮
২৮১
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২