পাতা:হারানো খাতা - অনুরূপা দেবী.pdf/১২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১৪
হারানাে খাতা।

গন্ধর্ব্বলোকের সকল জাঁকজমক ঘুমের কোলে চাপা পড়িয়াছে। কেবল জলের বুকে জাগিয়া আছে শুধু নৃত্যশীল তারার মালা, আর একখানা মহাজনী নৌকার বুকে জাগিয়া জাগিয়া একটা চাটগেঁয়ে মাঝি তাললয়বিহীন এক অপূর্ব্ব রাগিণীর সৃজন-তৎপর হইয়াছিল। নিরঞ্জন উৎকর্ণ হইয়া থাকিয়া সেই গীত সুধা উপভোগ করিল—

“এই কদম্বের মূলে নিয়ে গোপকুলে, চাঁদের হাট মিলাইত গো—
সেরূপ রয়ে রয়ে মনে পড়ে গো ও—ও—ও—।”

 রস ইহাতে যতই থাক না থাক, নিরঞ্জনের অন্তরের পিপাসা অকন্মাৎ যেন তাহাতেই ভরিয়া উঠিল। ওই যে পশ্চিম বঙ্গের নিকটে অনাদৃত উপহাসিত উহাদের পক্ষে একটুখানি দুর্ব্বোধ্য ভাষায় এই জনসম্পদশূন্য নিঃসঙ্গ রাত্রে ওই নিরক্ষর মাঝি নিজের মনের ভাবটী— কাহারও কাছে নয়, শুধু নিজের কাছেই প্রকাশ করিতেছিল; নিরঞ্জনের বোধ হইল উহার ভিতর দিয়া সে যেন সাহেবের আফিস হইতে বাহির হইয়া নিজের বাড়ীর অঙ্গনে প্রবেশ করিয়াছে। এই উচ্চারণের বৈসাদৃশ্য, এই শব্দ বিকৃতি, এ যে তার বুকের মণি, এই যে তার মায়ের দান। সে কাঙ্গালের মত উৎকর্ণ হইয়া রহিল কিন্তু গায়কের তন্দ্রাচ্ছন্ন স্বর শুধু ‘রহিয়া রহিয়া’ ঐটুকুকেই ফিরিয়া ফিরিয়া গাহিতে লাগিল। গান আর অগ্রসর হইতে পাইল না।

 নিরঞ্জন কিনারায় কিছুক্ষণ পাইচারী করিয়া বেড়াইয়া বেড়াইয়া শেষে ক্লান্ত হইয়া বসিয়া পড়িল। ততক্ষণে চাটগেঁয়ে মাঝির সঙ্গীতসাধনা সমাপ্ত হইয়া গিয়াছে। এখন সম্পূর্ণভাবেই সমুদয় বিশ্বচরাচর নিঝুম নিস্তব্ধ এবং নিদ্রিত। ভোরের আলো লাগিয়া আকাশের তারাগুলা শুদ্ধ যেন ঘুমাইয়া পড়িতেছিল। গঙ্গার জল মূর্চ্ছাতুরের ন্যায় পাণ্ডুবর্ণ ও নিস্পন্দ হইয়া পড়িয়াছে।