সোনার তরী/মানস-সুন্দরী: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
অ Mahir256 সোনার তরী/মানসসুন্দরী কে সোনার তরী/মানস-সুন্দরী শিরোনামে স্থানান্তর করেছেন |
পাতাকে '{{শীর্ষক |শিরোনাম= ../ |লেখক =রবীন্দ্রনা...' দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হল ট্যাগ: প্রতিস্থাপিত |
||
১ নং লাইন: | ১ নং লাইন: | ||
<pages index="সোনার তরী-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.djvu" from=1 to=1/> |
|||
{{শীর্ষক |
{{শীর্ষক |
||
|শিরোনাম= [[ |
|শিরোনাম= [[../]] |
||
|অনুচ্ছেদ = মানসসুন্দরী |
|||
|পূর্ববর্তী = [[../প্রতীক্ষা/]] |
|||
|পরবর্তী = [[../অনাদৃত/]] |
|||
|টীকা = |
|||
|লেখক =রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
|লেখক =রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
||
|টীকা = |
|||
|বছর = |
|বছর = |
||
|প্রবেশদ্বার = |
|প্রবেশদ্বার = |
||
|অনুচ্ছেদ=মানস-সুন্দরী|আদ্যক্ষর=ম|পূর্ববর্তী=[[../প্রতীক্ষা/]]|পরবর্তী=[[../অনাদৃত/]]}} |
|||
}} |
|||
<pages index="সোনার তরী-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.djvu" from=৯৫ to=১১০/> |
|||
<div style="padding-left:2em;"> |
|||
<poem> |
|||
আজ কোনো কাজ নয়— সব ফেলে দিয়ে |
|||
ছন্দ বন্ধ গ্রন্থ গীত— এসো তুমি প্রিয়ে, |
|||
আজন্ম-সাধন-ধন সুন্দরী আমার |
|||
কবিতা, কল্পনালতা। শুধু একবার |
|||
কাছে বোসো। আজ শুধু কূজন গুঞ্জন |
|||
তোমাতে আমাতে; শুধু নীরবে ভুঞ্জন |
|||
এই সন্ধ্যা-কিরণের সুবর্ণ মদিরা— |
|||
যতক্ষণ অন্তরের শিরা-উপশিরা |
|||
লাবণ্যপ্রবাহভরে ভরি নাহি উঠে, |
|||
যতক্ষণে মহানন্দে নাহি যায় টুটে |
|||
চেতনাবেদনাবন্ধ, ভুলে যাই সব— |
|||
কী আশা মেটে নি প্রাণে, কী সংগীতরব |
|||
গিয়েছে নীরব হয়ে, কী আনন্দসুধা |
|||
অধরের প্রান্তে এসে অন্তরের ক্ষুধা |
|||
না মিটায়ে গিয়াছে শুকায়ে। এই শান্তি, |
|||
এই মধুরতা, দিক সৌম্য ম্লান কান্তি |
|||
জীবনের দুঃখ দৈন্য অতৃপ্তির ‘পর |
|||
করুণকোমল আভা গভীর সুন্দর। |
|||
বীণা ফেলে দিয়ে এসো, মানসসুন্দরী— |
|||
দুটি রিক্ত হস্ত শুধু আলিঙ্গনে ভরি |
|||
কণ্ঠে জড়াইয়া দাও— মৃণাল-পরশে |
|||
রোমা’ অঙ্কুরি উঠে মর্মান্ত হরষে, |
|||
কম্পিত চঞ্চল বক্ষ, চক্ষু ছলছল, |
|||
মুগ্ধ তনু মরি যায়, অন্তর কেবল |
|||
অঙ্গের সীমান্ত-প্রান্তে উদ্ভাসিয়া উঠে, |
|||
এখনি ইন্দ্রিয়বন্ধ বুঝি টুটে টুটে। |
|||
অর্ধেক অঞ্চল পাতি বসাও যতনে |
|||
পার্শ্বে তব; সমধুর প্রিয়সম্বোধনে |
|||
ডাকো মোরে, বলো, প্রিয়, বলো, ‘প্রিয়তম’— |
|||
কুন্তল-আকুল মুখ বক্ষে রাখি মম |
|||
হৃদয়ের কানে কানে অতি মৃদু ভাষে |
|||
সংগোপনে বলে যাও যাহা মুখে আসে |
|||
অর্থহারা ভাবে-ভরা ভাষা। অয়ি প্রিয়া, |
|||
চুম্বন মাগিব যবে, ঈষৎ হাসিয়া |
|||
বাঁকায়ো না গ্রীবাখানি, ফিরায়ো না মুখ, |
|||
উজ্জ্বল রক্তিমবর্ণ সুধাপূর্ণ সুখ |
|||
রেখো ওষ্ঠাধরপুটে, ভক্ত ভৃঙ্গ তরে |
|||
সম্পূর্ণ চুম্বন এক, হাসি স্তরে স্তরে |
|||
সরস সুন্দর; নবষ্ফুট পুষ্প-সম |
|||
হেলায়ে বঙ্কিম গ্রীবা বৃন্ত নিরুপম |
|||
মুখখানি তুলে ধোরো; আনন্দ-আভায় |
|||
বড়ো বড়ো দুটি চক্ষু পল্লবপ্রচ্ছায় |
|||
রেখো মোর মুখপানে প্রশান্ত বিশ্বাসে, |
|||
নিতান্ত নির্ভরে। যদি চোখে জল আসে |
|||
কাঁদিব দুজনে; যদি ললিত কপোলে |
|||
মৃদু হাসি ভাসি উঠে, বসি মোর কোলে, |
|||
বক্ষ বাঁধি বাহুপাশে, স্কন্ধে মুখ রাখি |
|||
হাসিয়ো নীরবে অর্ধ-নিমীলিত আঁখি। |
|||
যদি কথা পড়ে মনে তবে কলস্বরে |
|||
বলে যেয়ো কথা, তরল আনন্দভরে |
|||
নির্ঝরের মতো, অর্ধেক রজনী ধরি |
|||
কত-না কাহিনী স্মৃতি কল্পনালহরী— |
|||
মধুমাখা কণ্ঠের কাকলি। যদি গান |
|||
ভালো লাগে, গেয়ো গান। যদি মুগ্ধপ্রাণ |
|||
নিঃশব্দ নিস্তব্ধ শান্ত সম্মুখে চাহিয়া |
|||
বসিয়া থাকিতে চাও, তাই রব প্রিয়া। |
|||
হেরিব অদূরে পদ্মা, উচ্চতটতলে |
|||
শ্রান্ত রূপসীর মতো বিস্তীর্ণ অঞ্চলে |
|||
প্রসারিয়া তনুখানি, সায়াহ্ন-আলোকে |
|||
শুয়ে আছে; অন্ধকার নেমে আসে চোখে |
|||
চোখের পাতার মতো; সন্ধ্যাতারা ধীরে |
|||
সন্তর্পণে করে পদার্পণ, নদীতীরে |
|||
অরণ্যশিয়রে; যামিনী শয়ন তার |
|||
দেয় বিছাইয়া, একখানি অন্ধকার |
|||
অনন্ত ভুবনে। দোঁহে মোরা রব চাহি |
|||
অপার তিমিরে; আর কোথা কিছু নাহি, |
|||
শুধু মোর করে তব করতলখানি, |
|||
শুধু অতি কাছাকাছি দুটি জনপ্রাণী, |
|||
অসীম নির্জনে; বিষণ্ন বিচ্ছেদরাশি |
|||
চরাচরে আর সব ফেলিয়াছে গ্রাসি— |
|||
শুধু এক প্রান্তে তার প্রলয় মগন |
|||
বাকি আছে একখানি শঙ্কিত মিলন, |
|||
দুটি হাত, ত্রস্ত কপোতের মতো দুটি |
|||
বক্ষ দুরুদুরু, দুই প্রাণে আছে ফুটি |
|||
শুধু একখানি ভয়, একখানি আশা, |
|||
একখানি অশ্রুভরে নম্র ভালোবাসা। |
|||
আজিকে এমনি তবে কাটিবে যামিনী |
|||
আলস্য-বিলাসে। অয়ি নিরভিমানিনী, |
|||
অয়ি মোর জীবনের প্রথম প্রেয়সী, |
|||
মোর ভাগ্য-গগনের সৌন্দর্যের শশী, |
|||
মনে আছে কবে কোন্ ফুল্ল যূথীবনে, |
|||
বহু বাল্যকালে, দেখা হত দুই জনে |
|||
আধো-চেনাশোনা? তুমি এই পৃথিবীর |
|||
প্রতিবেশিনীর মেয়ে, ধরার অস্থির |
|||
এক বালকের সাথে কী খেলা খেলাতে |
|||
সখী, আসিতে হাসিয়া, তরুণ প্রভাতে |
|||
নবীন বালিকামূর্তি, শুভ্রবস্ত্র পরি |
|||
উষার কিরণধারে সদ্য স্নান করি |
|||
বিকচ কুসুম-সম ফুল্ল মুখখানি |
|||
নিদ্রাভঙ্গে দেখা দিতে, নিয়ে যেতে টানি |
|||
উপবনে কুড়াতে শেফালি। বারে বারে |
|||
শৈশব-কর্তব্য হতে ভুলায়ে আমারে, |
|||
ফেলে দিয়ে পুঁথিপত্র, কেড়ে নিয়ে খড়ি, |
|||
দেখায়ে গোপন পথ দিতে মুক্ত করি |
|||
পাঠশালা-কারা হতে; কোথা গৃহকোণে |
|||
নিয়ে যেতে নির্জনেতে রহস্যভবনে; |
|||
জনশূন্য গৃহছাদে আকাশের তলে |
|||
কী করিতে খেলা, কী বিচিত্র কথা বলে |
|||
ভুলাতে আমারে, স্বপ্ন-সম চমৎকার |
|||
অর্থহীন, সত্য মিথ্যা তুমি জান তার। |
|||
দুটি কর্ণে দুলিত মুকুতা, দুটি করে |
|||
সোনার বলয়, দুটি কপোলের ‘পরে |
|||
খেলিত অলক, দুটি স্বচ্ছ নেত্র হতে |
|||
কাঁপিত আলোক, নির্মল নির্ঝর-স্রোতে |
|||
চূর্ণরশ্মি-সম। দোঁহে দোঁহা ভালো করে |
|||
চিনিবার আগে নিশ্চিন্ত বিশ্বাসভরে |
|||
খেলাধুলা ছুটাছুটি দুজনে সতত— |
|||
কথাবার্তা বেশবাস বিথান বিতত। |
|||
তার পরে একদিন— কী জানি সে কবে— |
|||
জীবনের বনে যৌবনবসন্তে যবে |
|||
প্রথম মলয়বায়ু ফেলেছে নিশ্বাস, |
|||
মুকুলিয়া উঠিতেছে শত নব আশ, |
|||
সহসা চকিত হয়ে আপন সংগীতে |
|||
চমকিয়া হেরিলাম— খেলা-ক্ষেত্র হতে |
|||
কখন অন্তরলক্ষ্মী এসেছ অন্তরে, |
|||
আপনার অন্তঃপুরে গৌরবের ভরে |
|||
বসি আছ মহিষীর মতো। কে তোমারে |
|||
এনেছিল বরণ করিয়া। পুরদ্বারে |
|||
কে দিয়াছে হুলুধ্বনি! ভরিয়া অঞ্চল |
|||
কে করেছে বরিষন নবপুষ্পদল |
|||
তোমার আনম্র শিরে আনন্দে আদরে! |
|||
সুন্দর সাহানা-রাগে বংশীর সুস্বরে |
|||
কী উৎসব হয়েছিল আমার জগতে, |
|||
যেদিন প্রথম তুমি পুষ্পফুল্ল পথে |
|||
লজ্জামুকুলিত মুখে রক্তিম অম্বরে |
|||
বধূ হয়ে প্রবেশিলে চিরদিনতরে |
|||
আমার অন্তর-গৃহে— যে গুপ্ত আলয়ে |
|||
অন্তর্যামী জেগে আছে সুখ দুঃখ লয়ে, |
|||
যেখানে আমার যত লজ্জা আশা ভয় |
|||
সদা কম্পমান, পরশ নাহিকো সয় |
|||
এত সুকুমার! ছিলে খেলার সঙ্গিনী |
|||
এখন হয়েছ মোর মর্মের গেহিনী, |
|||
জীবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কোথা সেই |
|||
অমূলক হাসি-অশ্রু, সে চাঞ্চল্য নেই, |
|||
সে বাহুল্য কথা। স্নিগ্ধ দৃষ্টি সুগম্ভীর |
|||
স্বচ্ছ নীলাম্বর-সম; হাসিখানি স্থির |
|||
অশ্রুশিশিরেতে ধৌত; পরিপূর্ণ দেহ |
|||
মঞ্জরিত বল্লরীর মতো; প্রীতি স্নেহ |
|||
গভীর সংগীততানে উঠিছে ধ্বনিয়া |
|||
স্বর্ণবীণাতন্ত্রী হতে রনিয়া রনিয়া |
|||
অনন্ত বেদনা বহি। সে অবধি প্রিয়ে, |
|||
রয়েছি বিস্মিত হয়ে—তোমারে চাহিয়ে |
|||
কোথাও না পাই অন্ত। কোন্ বিশ্বপার |
|||
আছে তব জন্মভূমি। সংগীত তোমার |
|||
কত দূরে নিয়ে যাবে, কোন্ কল্পলোকে |
|||
আমারে করিবে বন্দী গানের পুলকে |
|||
বিমুগ্ধ কুরঙ্গসম। এই যে বেদনা, |
|||
এর কোনো ভাষা আছে? এই যে বাসনা, |
|||
এর কোনো তৃপ্তি আছে? এই যে উদার |
|||
সমুদ্রের মাঝখানে হয়ে কর্ণধার |
|||
ভাসায়েছ সুন্দর তরণী, দশ দিশি |
|||
অস্ফুট কল্লোলধ্বনি চির দিবানিশি |
|||
কী কথা বলিছে কিছু নারি বুঝিবারে, |
|||
এর কোনো কূল আছে? সৌন্দর্য পাথারে |
|||
যে বেদনা-বায়ুভরে ছুটে মন-তরী |
|||
সে বাতাসে, কত বার মনে শঙ্কা করি, |
|||
ছিন্ন হয়ে গেল বুঝি হৃদয়ের পাল; |
|||
অভয় আশ্বাসভরা নয়ন বিশাল |
|||
হেরিয়া ভরসা পাই বিশ্বাস বিপুল |
|||
জাগে মনে— আছে এক মহা উপকূল |
|||
এই সৌন্দর্যের তটে, বাসনার তীরে |
|||
মোদের দোঁহের গৃহ। |
|||
হাসিতেছ ধীরে |
|||
চাহি মোর মুখে, ওগো রহস্যমধুরা! |
|||
কী বলিতে চাহ মোরে প্রণয়বিধুরা |
|||
সীমান্তিনী মোর, কী কথা বুঝাতে চাও। |
|||
কিছু বলে কাজ নাই— শুধু ঢেকে দাও |
|||
আমার সর্বাঙ্গ মন তোমার অঞ্চলে, |
|||
সম্পূর্ণ হরণ করি লহ গো সবলে |
|||
আমার আমারে; নগ্ন বক্ষে বক্ষ দিয়া |
|||
অন্তর রহস্য তব শুনে নিই প্রিয়া। |
|||
তোমার হৃদয়কম্প অঙ্গুলির মতো |
|||
আমার হৃদয়তন্ত্রী করিবে প্রহত, |
|||
সংগীত-তরঙ্গধ্বনি উঠিবে গুঞ্জরি |
|||
সমস্ত জীবন ব্যাপী থরথর করি। |
|||
নাই বা বুঝিনু কিছু, নাই বা বলিনু, |
|||
নাই বা গাঁথিনু গান, নাই বা চলিনু |
|||
ছন্দোবদ্ধ পথে, সলজ্জ হৃদয়খানি |
|||
টানিয়া বাহিরে। শুধু ভুলে গিয়ে বাণী |
|||
কাঁপিব সংগীতভরে, নক্ষত্রের প্রায় |
|||
শিহরি জ্বলিব শুধু কম্পিত শিখায়, |
|||
শুধু তরঙ্গের মতো ভাঙিয়া পড়িব |
|||
তোমার তরঙ্গ-পানে, বাঁচিব মরিব |
|||
শুধু, আর কিছু করিব না। দাও সেই |
|||
প্রকাণ্ড প্রবাহ, যাহে এক মুহূর্তেই |
|||
জীবন করিয়া পূর্ণ, কথা না বলিয়া |
|||
উন্মত্ত হইয়া যাই উদ্দাম চলিয়া। |
|||
মানসীরূপিণী ওগো, বাসনাবাসিনী, |
|||
আলোকবসনা ওগো, নীরবভাষিণী, |
|||
পরজন্মে তুমি কে গো মূর্তিমতী হয়ে |
|||
জন্মিবে মানব-গৃহে নারীরূপ লয়ে |
|||
অনিন্দ্যসুন্দরী? এখন ভাসিছ তুমি |
|||
অনন্তের মাঝে; স্বর্গ হতে মর্তভূমি |
|||
করিছ বিহার; সন্ধ্যার কনকবর্ণে |
|||
রাঙিছ অঞ্চল; উষার গলিত স্বর্ণে |
|||
গড়িছ মেখলা; পূর্ণ তটিনীর জলে |
|||
করিছ বিস্তার, তলতল ছলছলে |
|||
ললিত যৌবনখানি, বসন্তবাতাসে, |
|||
চঞ্চল বাসনাব্যথা সুগন্ধ নিশ্বাসে |
|||
করিছ প্রকাশ; নিষুপ্ত পূর্ণিমা রাতে |
|||
নির্জন গগনে, একাকিনী ক্লান্ত হাতে |
|||
বিছাইছ দুগ্ধশুভ্র বিরহ-শয়ন; |
|||
শরৎ-প্রত্যুষে উঠি করিছ চয়ন |
|||
শেফালি, গাঁথিতে মালা, ভুলে গিয়ে শেষে, |
|||
তরুতলে ফেলে দিয়ে, আলুলিত কেশে |
|||
গভীর অরণ্য-ছায়ে উদাসিনী হয়ে |
|||
বসে থাক; ঝিকিমিকি আলোছায়া লয়ে |
|||
কম্পিত অঙ্গুলি দিয়ে বিকালবেলায় |
|||
বসন বয়ন কর বকুলতলায়; |
|||
অবসন্ন দিবালোকে কোথা হতে ধীরে |
|||
ঘনপল্লবিত কুঞ্জে সরোবর-তীরে |
|||
করুণ কপোতকণ্ঠে গাও মুলতান; |
|||
কখন অজ্ঞাতে আসি ছুঁয়ে যাও প্রাণ |
|||
সকৌতুকে; করি দাও হৃদয় বিকল, |
|||
অঞ্চল ধরিতে গেলে পালাও চঞ্চল |
|||
কলকণ্ঠে হাসি’, অসীম আকাঙ্ক্ষারাশি |
|||
জাগাইয়া প্রাণে, দ্রুতপদে উপহাসি’ |
|||
মিলাইয়া যাও নভোনীলিমার মাঝে। |
|||
কখনো মগন হয়ে আছি যবে কাজে |
|||
স্খলিতবসন তব শুভ্র রূপখানি |
|||
নগ্ন বিদ্যুতের আলো নয়নেতে হানি |
|||
চকিতে চমকি চলি যায়। জানালায় |
|||
একেলা বসিয়া যবে আঁধার সন্ধ্যায়, |
|||
মুখে হাত দিয়ে, মাতৃহীন বালকের |
|||
মতো বহুক্ষণ কাঁদি স্নেহ-আলোকের |
|||
তরে— ইচ্ছা করি, নিশার আঁধারস্রোতে |
|||
মুছে ফেলে দিয়ে যায় সৃষ্টিপট হতে |
|||
এই ক্ষীণ অর্থহীন অস্তিত্বের রেখা, |
|||
তখন করুণাময়ী দাও তুমি দেখা |
|||
তারকা-আলোক-জ্বালা স্তব্ধ রজনীর |
|||
প্রান্ত হতে নিঃশব্দে আসিয়া; অশ্রুনীর |
|||
অঞ্চলে মুছায়ে দাও; চাও মুখপানে |
|||
স্নেহময় প্রশ্নভরা করুণ নয়ানে; |
|||
নয়ন চুম্বন কর, স্নিগ্ধ হস্তখানি |
|||
ললাটে বুলায়ে দাও; না কহিয়া বাণী, |
|||
সান্ত্বনা ভরিয়া প্রাণে, কবিরে তোমার |
|||
ঘুম পাড়াইয়া দিয়া কখন আবার |
|||
চলে যাও নিঃশব্দ চরণে। |
|||
সেই তুমি |
|||
মূর্তিতে দিবে কি ধরা? এই মর্তভূমি |
|||
পরশ করিবে রাঙা চরণের তলে? |
|||
অন্তরে বাহিরে বিশ্বে শূন্যে জলে স্থলে |
|||
সর্ব ঠাঁই হতে সর্বময়ী আপনারে |
|||
করিয়া হরণ, ধরণীর একধারে |
|||
ধরিবে কি একখানি মধুর মুরতি? |
|||
নদী হতে লতা হতে আনি তব গতি |
|||
অঙ্গে অঙ্গে নানা ভঙ্গে দিবে হিল্লোলিয়া— |
|||
বাহুতে বাঁকিয়া পড়ি, গ্রীবায় হেলিয়া |
|||
ভাবের বিকাশভরে? কী নীল বসন |
|||
পরিবে সুন্দরী তুমি? কেমন কঙ্কণ |
|||
ধরিবে দুখানি হাতে? কবরী কেমনে |
|||
বাঁধিবে, নিপুণ বেণী বিনায়ে যতনে? |
|||
কচি কেশগুলি পড়ি শুভ্র গ্রীবা-’পরে |
|||
শিরীষকুসুম-সম সমীরণভরে |
|||
কাঁপিবে কেমন? শ্রাবণে দিগন্তপারে |
|||
যে গভীর স্নিগ্ধ দৃষ্টি ঘন মেঘভারে |
|||
দেখা দেয় নব নীল অতি সুকুমার, |
|||
সে দৃষ্টি না জানি ধরে কেমন আকার |
|||
নারীচক্ষে! কী সঘন পল্লবের ছায়, |
|||
কী সুদীর্ঘ কী নিবিড় তিমির-আভায় |
|||
মুগ্ধ অন্তরের মাঝে ঘনাইয়া আনে |
|||
সুখবিভাবরী! অধর কী সুধাদানে |
|||
রহিবে উন্মুখ, পরিপূর্ণ বাণীভরে |
|||
নিশ্চল নীরব! লাবণ্যের থরে থরে |
|||
অঙ্গখানি কী করিয়া মুকুলি বিকশি |
|||
অনিবার সৌন্দর্যেতে উঠিবে উচ্ছ্বসি |
|||
নিঃসহ যৌবনে? |
|||
জানি, আমি জানি সখী, |
|||
যদি আমাদের দোঁহে হয় চোখোচোখি |
|||
সেই পরজন্ম-পথে, দাঁড়াব থমকি; |
|||
নিদ্রিত অতীত কাঁপি উঠিবে চমকি |
|||
লভিয়া চেতনা। জানি মনে হবে মম, |
|||
চিরজীবনের মোর ধ্রুবতারা-সম |
|||
চিরপরিচয়ভরা ওই কালো চোখ। |
|||
আমার নয়ন হতে লইয়া আলোক, |
|||
আমার অন্তর হতে লইয়া বাসনা, |
|||
আমার গোপন প্রেম করেছে রচনা |
|||
এই মুখখানি। তুমিও কি মনে মনে |
|||
চিনিবে আমারে? আমাদের দুই জনে |
|||
হবে কি মিলন? দুটি বাহু দিয়ে, বালা, |
|||
কখনো কি এই কণ্ঠে পরাইবে মালা |
|||
বসন্তের ফুলে? কখনো কি বক্ষ ভরি |
|||
নিবিড় বন্ধনে, তোমারে হৃদয়েশ্বরী, |
|||
পারিব বাঁধিতে? পরশে পরশে দোঁহে |
|||
করি বিনিময় মরিব মধুর মোহে |
|||
দেহের দুয়ারে? জীবনের প্রতিদিন |
|||
তোমার আলোক পাবে বিচ্ছেদবিহীন, |
|||
জীবনের প্রতি রাত্রি হবে সুমধুর |
|||
মাধুর্যে তোমার, বাজিবে তোমার সুর |
|||
সর্ব দেহে মনে? জীবনের প্রতি সুখে |
|||
পড়িবে তোমার শুভ্র হাসি, প্রতি দুখে |
|||
পড়িবে তোমার অশ্রুজল। প্রতি কাজে |
|||
রবে তব শুভহস্ত দুটি, গৃহ-মাঝে |
|||
জাগায়ে রাখিবে সদা সুমঙ্গল—জ্যোতি। |
|||
এ কি শুধু বাসনার বিফল মিনতি, |
|||
কল্পনার ছল? কার এত দিব্যজ্ঞান, |
|||
কে বলিতে পারে মোরে নিশ্চয় প্রমাণ— |
|||
পূর্বজন্মে নারীরূপে ছিলে কি না তুমি |
|||
আমারি জীবন-বনে সৌন্দর্যে কুসুমি, |
|||
প্রণয়ে বিকশি। মিলনে আছিলে বাঁধা |
|||
শুধু এক ঠাঁই, বিরহে টুটিয়া বাধা |
|||
আজি বিশ্বময় ব্যাপ্ত হয়ে গেছ প্রিয়ে, |
|||
তোমারে দেখিতে পাই সর্বত্র চাহিয়ে। |
|||
ধূপ দগ্ধ হয়ে গেছে, গন্ধবাষ্প তার |
|||
পূর্ণ করি ফেলিয়াছে আজি চারি ধার। |
|||
গৃহের বনিতা ছিলে, টুটিয়া আলয় |
|||
বিশ্বের কবিতারূপে হয়েছ উদয়— |
|||
তবু কোন্ মায়া-ডোরে চিরসোহাগিনী, |
|||
হৃদয়ে দিয়েছ ধরা, বিচিত্র রাগিণী |
|||
জাগায়ে তুলিছ প্রাণে চিরস্মৃতিময়। |
|||
তাই তো এখনো মনে আশা জেগে রয় |
|||
আবার তোমারে পাব পরশবন্ধনে। |
|||
এমনি সমস্ত বিশ্ব প্রলয়ে সৃজনে |
|||
জ্বলিছে নিবিছে, যেন খদ্যোতের জ্যোতি, |
|||
কখনো বা ভাবময়, কখনো মুরতি। |
|||
রজনী গভীর হল, দীপ নিবে আসে; |
|||
পদ্মার সুদূর পারে পশ্চিম আকাশে |
|||
কখন যে সায়াহ্নের শেষ স্বর্ণরেখা |
|||
মিলাইয়া গেছে; সপ্তর্ষি দিয়েছে দেখা |
|||
তিমিরগগনে; শেষ ঘট পূর্ণ ক’রে |
|||
কখন বালিকা-বধূ চলে গেছে ঘরে; |
|||
হেরি কৃষ্ণপক্ষ রাত্রি, একাদশী তিথি, |
|||
দীর্ঘ পথ, শূন্য ক্ষেত্র, হয়েছে অতিথি |
|||
গ্রামে গৃহস্থের ঘরে পান্থ পরবাসী; |
|||
কখন গিয়েছে থেমে কলরবরাশি |
|||
মাঠপারে কৃষিপল্লী হতে; নদীতীরে |
|||
বৃদ্ধ কৃষাণের জীর্ণ নিভৃত কুটিরে |
|||
কখন জ্বলিয়াছিল সন্ধ্যাদীপখানি, |
|||
কখন নিভিয়া গেছে— কিছুই না জানি। |
|||
কী কথা বলিতেছিনু, কী জানি, প্রেয়সী, |
|||
অর্ধ-অচেতনভাবে মনোমাঝে পশি |
|||
স্বপ্নমুগ্ধ-মতো। কেহ শুনেছিলে সে কি, |
|||
কিছু বুঝেছিলে প্রিয়ে, কোথাও আছে কি |
|||
কোনো অর্থ তার? সব কথা গেছি ভুলে, |
|||
শুধু এই নিদ্রাপূর্ণ নিশীথের কূলে |
|||
অন্তরের অন্তহীন অশ্রু-পারাবার |
|||
উদ্বেলিয়া উঠিয়াছে হৃদয়ে আমার |
|||
গম্ভীর নিস্বনে। |
|||
এসো সুপ্তি, এসো শান্তি, |
|||
এসো প্রিয়ে, মুগ্ধ মৌন সকরুণ কান্তি, |
|||
বক্ষে মোরে লহো টানি— শোয়াও যতনে |
|||
মরণসুস্নিগ্ধ ও শুভ্র বিস্মৃতিশয়নে। |
|||
</poem> |
|||
</div> |
১৬:৫৬, ২২ জুন ২০২০ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
মানস-সুন্দরী।
আজ কোন কাজ নয়;—সব ফেলে দিয়ে
ছন্দ বন্ধ গ্রন্থ গীত—এস তুমি প্রিয়ে,
আজন্ম-সাধন-ধন সুন্দরী আমার
কবিতা, কল্পনা-লতা! শুধু একবার
কাছে বস! আজ শুধু কূজন গুঞ্জন
তোমাতে আমাতে; শুধু নীরবে ভুঞ্জন
এই সন্ধ্যা-কিরণের সুবর্ণ মদিরা,—
যতক্ষণ অন্তরের শিরা উপশিরা
লাবণ্য প্রবাহভরে ভরি’ নাহি উঠে,
যতক্ষণে মহানন্দে নাহি যায় টুটে’
চেতনা বেদনাবন্ধ, ভুলে যাই সব
কি আশা মেটে নি প্রাণে, কি সঙ্গীতরব
গিয়েছে নীরব হয়ে, কি আনন্দ সুধা
অধরের প্রান্তে এসে অন্তরের ক্ষুধা
না মিটায়ে গিয়াছে শুকায়ে। এই শান্তি,
এই মধুরতা, দিক্ সৌম্য ম্লান কান্তি
জীবনের দুঃখ দৈন্য অতৃপ্তির পর
করুণ কোমল আভা গভীর সুন্দর!
বীণা ফেলে দিয়ে এস, মানস সুন্দরী,
দুটি রিক্তহস্ত শুধু আলিঙ্গনে ভরি’
কণ্ঠে জড়াইয়া দাও,—মৃণাল-পরশে
রোমাঞ্চ অঙ্কুরি উঠে মর্ম্মান্ত হরষে,—
কম্পিত চঞ্চল বক্ষ, চক্ষু ছলছল,
মুগ্ধ তনু মরি যায়, অন্তর কেবল
অঙ্গের সীমান্ত প্রান্তে উদ্ভাসিয়া উঠে,
এখনি ইন্দ্রিয়বন্ধ বুঝি টুটে টুটে!
অর্দ্ধেক অঞ্চল পাতি’ বসাও যতনে
পার্শ্বে তব; সুমধুর প্রিয় সম্বোধনে
ডাক মোরে, বল, প্রিয়, বল, প্রিয়তম;—
কুন্তল-আকুল মুখ বক্ষে রাখি মম
হৃদয়ের কানে কানে অতি মৃদু ভাষে
সঙ্গোপনে বলে’ যাও যাহা মুখে আসে
অর্থহারা ভাবে-ভরা ভাষা! অয়ি প্রিয়া,
চুম্বন মাগিব যবে, ঈষৎ হাসিয়া
বাঁকায়ো না গ্রীবাখানি, ফিয়ো না মুখ,
উজ্জ্বল রক্তিমবর্ণ সুধাপূর্ণ সুখ
রেখো ওষ্ঠাধরপুটে, ভক্ত ভৃঙ্গ তরে
সম্পূর্ণ চুম্বন এক, হাসি স্তরে স্তরে
সরস সুন্দর;—নবস্ফুট পুষ্পসম
হেলায়ে বঙ্কিম গ্রীবা বৃন্ত নিরুপম
মুখখানি তুলে’ ধোরো; আনন্দ আভায়
বড় বড় দুটি চক্ষু পল্লব-প্রচ্ছায়
রেখো মোর মুখপানে প্রশান্ত বিশ্বাসে,
নিতান্ত নির্ভরে! যদি চোখে জল আসে
কাঁদিব দুজনে; যদি ললিত কপোল
মৃদু হাসি ভাসি উঠে, বসি’ মোর কোলে,
বক্ষ বাঁধি বাহুপাশে, স্কন্ধে মুখ রাখি
হাসিয়ো নীরবে অর্দ্ধ-নিমীলিত আঁখি;
যদি কথা পড়ে মনে তবে কলম্বরে
বলে যেয়ো কথা, তরল আনন্দ ভরে
নিঝরের মত, অর্দ্ধেক রজনী ধরি’
কত না কাহিনী স্মৃতি কল্পনা লহরী
মধুমাখা কণ্ঠের কাকলি; যদি গান
ভাল লাগে, গেয়ো গান; যদি মুগ্ধ প্রাণ
নিঃশব্দ নিস্তব্ধ শান্ত সম্মুখে চাহিয়া
বসিয়া থাকিতে চাও, তাই র’ব প্রিয়া!
হেরিব অদূরে পদ্মা, উচ্চ তটতলে
শ্রান্ত রূপসীর মত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে
প্রসারিয়া তনুখানি, সায়াহ্ন-আলোকে
শুয়ে আছে; অন্ধকার নেমে আসে চোখে
চোখের পাতার মত; সন্ধ্যাতারা ধীরে,
সন্তর্পণে করে পদার্পণ, নদীতীরে
অরণ্যশিয়রে; যামিনী শয়ন অর
দেয় বিছাইয়া, এক খানি অন্ধকার
অনন্ত ভুবনে। দোঁহে মোরা রব চাহি’
অপার তিমিরে; আর কোথা কিছু নাহি,
শুধু মোর করে তব করতল খানি,
শুধু অতি কাছাকাছি দুটি জন প্রাণী
অসীম নির্জ্জনে; বিষন্ন বিচ্ছেদরাশি
চরাচরে আর সব ফেলিয়াছে গ্রাসি’
শুধু এক প্রান্তে তার প্রলয়-মগন
বাকি আছে একখানি শঙ্কিত মিলন,
দুটি হাত, ত্রস্ত কপোতের মত দুটি
বক্ষ দুরুদুরু, দুই প্রাণে আছে ফুটি’
শুধু এক খানি, ভয়, এক খানি আশা,
এক খানি অশ্রুভরে নম্র ভালবাসা।
আজিকে এমনি তবে কাটিবে যামিনী
আলস্য বিলাসে। অয়ি নিরভিমানিনী,
অয়ি মোর জীবনের প্রথম প্রেয়সী,
মোর ভাগ্য-গগনের সৌন্দর্য্যের শশি,
মনে আছে, কবে কোন্ ফুল্ল যুথী বনে,
বহু বাল্যকালে, দেখা হত দুই জনে
আধ চেনা-শোনা’? তুমি এই পৃথিবীর
প্রতিবেশিনীর মেয়ে, ধরার অস্থির
এক বালকের সাথে কি খেলা খেলাতে
সখি, আসিতে হাসিয়া, তরুণ প্রভাতে
নবীন বালিকা মূর্ত্তি, শুভ্রবস্তু পরি’
ঊষার কিরণ ধারে সামান্য করি’
বিকচ কুসুমদম ফুল্ল মুখখানি
নিদ্রাভঙ্গে দেখা দিতে, নিয়ে যেতে টানি’
উপবনে কুড়াতে শেফালি। বারে বারে
শৈশব-কর্ত্তব্য হতে তুলায়ে আমারে,
ফেলে দিয়ে পুঁথিপত্র, কেড়ে নিয়ে খড়ি,
দেখায়ে গোপন পথ দিতে মুক্ত করি
পাঠশালা কারা হতে; কোথা গৃহকোণে
নিয়ে যেতে নির্জ্জনেতে রহস্য-ভবনে;
জনশূন্য গৃহছাদে আকাশের তলে
কি করিতে খেলা, কি বিচিত্র কথা বলে’
ভুলাতে আমারে, স্বপ্নসম চমৎকার
অর্থহীন, সত্য মিথ্যা তুমি জান তার।
দুটি কর্ণে দুলিত মুকুতা, দুটি করে
সোনার বলয়, দুটি কপোলর পরে
খেলিত অলক, দুটি স্বচ্ছ নেত্র হতে
কাঁপিত আলোক, নির্ম্মল নির্ঝির স্রোতে
চূর্ণরশ্মিসম। দোঁহে দোঁহা ভাল করে’
চিনিবার আগে নিশ্চিন্ত বিশ্বাসভরে
খেলাধূলা ছুটাছুটি দুজনে সতত,
কথাবার্ত্তা বেশবাস বিথান বিতত।
তার পরে এক দিন—কি জানি সে কবে—
জীবনের বনে, যৌবন-বসন্তে যবে
প্রথম মলয় বায়ু ফেলেছে নিশ্বাস,
মুকুলিয়া উঠিতেছে শত নব আশ,
সহসা চকিত হয়ে আপন সঙ্গীতে
চমকিয়া হেরিলাম—খেলাক্ষেত্র হতে
কখন্ অন্তর-লক্ষ্মী এসেছ অন্তরে
আপনার অন্তঃপুরে গৌরবের ভরে
বসি আছ মহিষীর মত! কে তোমারে
এনেছিল বরণ করিয়া? পুরদ্বারে
কে দিয়াছে হুলুধ্বনি? ভরিয়া অঞ্চল
কে করেছে বরিষণ নব পুষ্পদল
তোমার আনম্ৰ শিরে আনন্দে আদরে?
সুন্দর সাহানা রাগে বংশীর সুস্বরে
কি উৎসব হয়েছিল আমার জগতে,
যে দিন প্রথম তুমি পুষ্পফুল্ল পথে
লজ্জামুকুলিত মুখে রক্তিম অম্বরে
বধূ হয়ে প্রবেশিলে চির দিন তরে
আমার অন্তর গৃহে—যে গুপ্ত আলয়ে
অন্তর্যামী জেগে আছে সুখ দুঃখ লয়ে,
যেখানে আমার যত লজ্জা আশা ভয়
সদা কম্পমান, পরশ নাহিক সয়
এত সুকুমার। ছিলে খেলার সঙ্গিনী,
এখন হয়েছ মোর মর্ম্মের গৃহিণী,
জীবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কোথা সেই
অমূলক হাসি অশ্রু, সে চাঞ্চল্য নেই,
সে বাহুল্য কথা। স্নিগ্ধদৃষ্টি সুগম্ভীর
স্বচ্ছনীলাম্বর সম; হাসিখানি স্থির
অশ্রু শিশিরেতে ধৌত; পরিপূর্ণ দেহ
মঞ্জরিত বল্লরীর মত; প্রতি স্নেহ
গভীর সঙ্গীত তানে উঠিছে ধ্বনিয়া
স্বর্ণ বীণা-তন্ত্রী হতে রনিয়া রনিয়া
অনন্ত বেদনা বহি। সে অবধি প্রিয়ে,
রয়েছি বিস্মিত হয়ে তোমারে চাহিয়ে
কোথাও না পাই অন্ত! কোন্ বিশ্বপার
আছে তব জন্মভূমি? সঙ্গীত তোমার
কত দূরে নিয়ে যাবে, কোন্ কল্পলোকে
আমারে করিবে বন্দী, গানের পুলকে
বিমুগ্ধ কুরঙ্গ সম? এই যে বেদনা
এর কোন ভাষা আছে? এই যে বাসনা
এর কোন তৃপ্তি আছে? এই যে উদার
সমুদ্রের মাঝখানে হয়ে কর্ণধার
ভাসায়েছ সুন্দর তরণী; দশ দিশি
অস্ফুট কল্লোল ধ্বনি চির দিবানিশি
কি কথা বলিছে কিছু নারি বুঝিবারে,
এর কোন কুল আছে? সৌন্দর্য্য পাথারে
যে বেদনা-বায়ু-ভরে ছুটে মনোতরী,
সে বাতাসে, কত বার মনে শঙ্কা করি
ছিন্ন হয়ে গেল বুঝি হৃদয়ের পাল,
অভয় আশ্বাস ভরা নয়ন বিশাল
হেরিয়া ভরসা পাই; বিশ্বাস বিপুল
জাগে মনে—আছে এক মহা উপকূল
এই সৌন্দর্য্যের তটে, বাসনার তীরে
মোদের দোঁহার গৃহ!
হাসিতেছ ধীরে
চাহি মোর মুখে, ওগো রহস্যমধুরা!
কি বলিতে চাহ মোরে প্রণয়বিধুরা
সীমন্তিনী মোর? কি কথা বুঝতে চাও?
কিছু বলে’ কাজ নাই—শুধু ঢেকে দাও
আমার সর্ব্বাঙ্গমন তোমার অঞ্চলে,
সম্পূর্ণ হরণ করি লহ গো সবলে
আমার আমারে; নগ্ন বক্ষে বক্ষ দিয়া
অন্তর-রহস্য তব শুনে নিই প্রিয়া!
তোমার হৃদয়কম্প অঙ্গুলির মত
আমার হৃদয়তন্ত্রী করিবে প্রহত,
সঙ্গীত তরঙ্গ ধ্বনি উঠিবে গুঞ্জরি’
সমস্ত জীবন ব্যাপি’ থর থর করি’!
নাই বা বুঝিনু কিছু, নাই বা বলিনু,
নাই বা গাঁথিনু গান, নাই বা চলিনু
ছন্দোবদ্ধ পথে, সলজ্জ হৃদয় খানি
টানিয়া বাহিরে! শুধু ভুলে গিয়ে বাণী
কাঁপিব সঙ্গীত ভরে, নক্ষত্রের প্রায়
শিহরি জ্বলিব শুধু কম্পিত শিখায়,
শুধু তরঙ্গের মত ভাঙ্গিয়া পড়িব
তোমার তরঙ্গ পানে, বাঁচিব মরিব
শুধু, আর কিছু করিব না! দাও সেই
প্রকাণ্ড প্রবাহ, যাহে এক মুহুর্ত্তেই
জীবন করিয়া পূর্ণ, কথা না বলিয়া
উন্মত্ত হইয়া যাই উদ্দাম চলিয়া!
মানসীরূপিনী ওগো, বাসনা-বাসিনী,
আলোকবসনা ওগগা, নীরবভাষিণী,
পরজন্মে তুমি কিগো মূর্ত্তিমতী হয়ে
জন্মিবে মানব গৃহে নারীরূপ লয়ে
অনিন্দ্য সুন্দরী? এখন ভাসিছ তুমি
অনন্তের মাঝে; স্বর্গ হতে মর্ত্ত্যভূমি
করিছ বিহার; সন্ধ্যার কনক বর্ণে
রাঙ্গিছ অঞ্চল; ঊষার গলিত স্বর্ণে
গড়িছ মেখলা; পূর্ণ তটিনীর জলে
করিছ বিস্তার, তলতল ছল ছলে
ললিত যৌবন খানি; বসন্ত বাতাসে
চঞ্চল বাসনা ব্যথা সুগন্ধ নিশ্বাসে
করিছ প্রকাশ; নিসুপ্ত পূর্ণিমা রাতে
নির্জ্জন গগনে, একাকিনী ক্লান্ত হাতে
বিছাইছ দুগ্ধশুভ্র বিরহ শয়ন!
শরৎ প্রত্যুষে উঠি করিছ চয়ন
শেফালি, গাঁথিতে মালা, ভুলে গিয়ে শেষে,
তরুতলে ফেলে দিয়ে আলুলিত কেশে
গভীর অরণ্য ছায়ে উদাসিনী হয়ে
বসে থাক; ঝিকিমিকি আলো ছায়া লয়ে
কম্পিত অঙ্গুলি দিয়ে বিকাল বেলায়
বসন বয়ন কর বকুল তলায়!
অবসন্ন দিবালোকে কোথা হতে ধীরে
ঘন পল্লবিত কুঞ্জে সরোবর তীরে
করুণ কপোত কণ্ঠে গাও মূলতান!
কখন্ অজ্ঞাতে আসি ছুঁয়ে যাও প্রাণ
সকৌতুকে; করি দাও হৃদয় বিকল,
অঞ্চল ধরিতে গেলে পালাও চঞ্চল
কলকণ্ঠে হাসি’, অসীম আকাঙ্ক্ষা রাশি
জাগাইয়া প্রাণে, দ্রুতপদে উপহাসি
মিলাইয়া যাও নভোনীলিমার মাঝে।
কখনো মগন হয়ে আছি যবে কাজে
স্খলিত-বসন তব শুভ্র রূপখানি
নগ্ন বিদ্যুতের আলো নয়নেতে হানি
চকিতে চমকি’ চলি যায়!—জানালায়
একেলা বসিয়া যবে আঁধার সন্ধ্যায়,—
মুখে হাত দিয়ে, মাতৃহীন বালকের
মত, বহুক্ষণ কাঁদি, স্নেহ আলোকের
তরে; ইচ্ছা করি, নিশার আঁধার স্রোতে
মুছে ফেলে দিয়ে যায় সৃষ্টিপট হতে
এই ক্ষীণ অর্থহীন অস্তিত্বের রেখা,
তখন করুণাময়ী দা! তুমি দেখা
তারকা-আলোক-জ্বালা স্তব্ধ রজনীর
প্রান্ত হতে নিঃশব্দে আসিয়া; অশ্রুনীর
অঞ্চলে মুছায়ে দাও; চাও মুখপানে
স্নেহময় প্রশ্নভরা করুণ নয়ানে;
নয়ন চুম্বন কর; স্নিগ্ধ হস্তখানি
ললাটে বুলায়ে দাও; না কহিয়া বাণী
সান্ত্বনা ভরিয়া প্রাণে কবিরে তোমার
ঘুম পাড়াইয়া দিয়া কখন্ আবার
চলে যাও নিঃশব্দ চরণে!
সেই তুমি
মুর্ত্তিতে দিবে কি ধরা? এই মর্ত্ত্যভূমি
পরশ করিবে রাঙা চরণের তলে?
অন্তরে বাহিরে বিশ্বে শূন্যে জলে স্থলে
সর্ব্ব ঠাঁই হতে, সর্ব্বময়ী আপনারে
করিয়া হরণ—ধরণীর এক ধারে
ধরিবে কি একখানি মধুর মুরতি?
নদী হতে লতা হতে আনি তব গতি
অঙ্গে অঙ্গে নানা ভঙ্গে দিবে হিল্লোলিয়া
বাহুতে বাঁকিয়া পড়ি’ গ্রীবায় হেলিয়া
ভাবের বিকাশ ভরে? কি নীল বসন
পরিবে সুন্দরী তুমি? কেমন কঙ্কণ
ধরিবে দুখানি হাতে? কবরী কেমনে
বাঁধিবে, নিপুণ বেণী বিনায়ে যতনে?
কচি কেশগুলি পড়ি’ শুভ্র গ্রীবাপরে
শিরীষ কুসুম সম সমীরণ ভরে
কাঁপিবে কেমন? শ্রাবণে দিগন্ত পারে
যে গভীর স্নিগ্ধদৃষ্টি ঘন মেঘভারে
দেখা দেয়—নব নীল অতি সুকুমার,
সে দৃষ্টি না জানি ধরে কেমন আকার
নারীচক্ষে! কি সঘন পল্লবের ছায়,
কি সুদীর্ঘ কি নিবিড় তিমির আভায়
মুগ্ধ অন্তরের মাঝে ঘনাইয়া আনে
সুখ বিভাবরী? অধর কি সুধাদানে
রহিবে উন্মুখ, পরিপূর্ণ বাণীভরে
নিশ্চল নীরব। লাবণ্যের থরে থরে
অঙ্গখানি কি করিয়া মুকুলি’ বিকশি’
অনিবার সৌন্দর্য্যেতে উঠিবে উচ্ছ্বসি’
নিঃসহ যৌবনে!
জানি, আমি জানি, সখি,
যদি আমাদের দোঁহে হয় চোখোচাখি
সেই পরজন্ম-পথে,–দাঁড়াব থমকি’,
নিদ্রিত অতীত কাঁপি’ উঠিবে চমকি’
লভিয়া চেতনা!–জানি মনে হবে মম
চির-জীবনের মোর ধ্রুবতারা সম
চিরপরিচয়-ভরা ঐ কালো চোখ!
আমার নয়ন হতে লইয়া আলোক,
আমার অন্তর হতে লইয়া বাসনা
আমার গোপন প্রেম করেছে রচনা
এই মুখখানি। তুমিও কি মনে মনে
চিনিবে আমারে? আমাদের দুই জনে
হবে কি মিলন? দুটি বাহু দিয়ে বালা
কখনো কি এই কণ্ঠে পরাইবে মালা
বসন্তের ফুলে? কখনো কি বক্ষ ভরি
নিবিড় বন্ধনে, তোমারে হৃদয়েশ্বরী
পারিব বাঁধিতে? পরশে পরশে দোঁহে
করি বিনিময়, মরিব মধুর মোহে
দেহের দুয়ারে? জীবনের প্রতিদিন
তোমার আলোক পাবে বিচ্ছেদবিহীন,
জীবনের প্রতি রাত্রি হবে সুমধুর
মাধুর্য্যে তোমার! বাজিবে তোমার সুর
সর্ব্ব দেহে মনে? জীবনের প্রতি সুখে
পড়িবে তোমার শুভ্র হাসি, প্রতি দুখে
পড়িবে তোমার অশ্রুজল! প্রতি কাজে
রবে তব শুভহস্ত দুটি। গৃহমাঝে
জাগায়ে রাখিবে সদা সুমঙ্গল জ্যোতি।
এ কি শুধু বাসনার বিফল মিনতি,
কল্পনার ছল? কার এত দিব্যজ্ঞান,
কে বলিতে পারে মোরে নিশ্চয় প্রমাণ—
পূর্ব্বজন্মে নারীরূপে ছিলে কি না তুমি
আমারি জীবন-বনে সৌন্দর্য্যে কুসুমি’
প্রণক্ষ বিকশি’? মিলনে আছিলে বাঁধা
শুধু এক ঠাঁই, বিরহে টুটিয়া বাঁধা
আজি বিশ্বময় ব্যাপ্ত হয়ে গেছ, প্রিয়ে,
তোমারে দেখিতে পাই সর্ব্বত্র চাহিয়ে!
ধূপ দগ্ধ হয়ে গেছে, গন্ধবাষ্প তার
পূর্ণ করি ফেলিয়াছে আজি চারি ধার!
গৃহের বনিতা ছিলে—টুটিয়া আলয়
বিশ্বের কবিতারূপে হয়েছ উদয়,—
তবু কোন্ মায়া-ডোরে চির-সোহাগিনী
হৃদয়ে দিয়েছ ধরা, বিচিত্র রাগিণী
জাগায়ে তুলিছ প্রাণে চিরস্মৃতিময়!
তাই ত এখনো মনে আশা জেগে রয়
আবার তোমারে পাব পরশ বন্ধনে!
এমনি সমস্ত বিশ্ব প্রলয়ে সৃজনে
জ্বলিছে নিবিছে, যেন খদ্যোতের জ্যোতি!
কখনো বা ভাবময়, কখনো মুরতি।
রজনী গভীর হল, দীপ নিবে আসে;
পর সুদূর পায়ে পশ্চিম আকাশে
কখন্ যে সায়াহ্নের শেষ স্বর্ণ-রেখা
মিলাইয়া গেছে, সপ্তর্ষি দিয়েছে দেখা
তিমির গগনে, শেষ ঘট পূর্ণ করে’
কখন্ বালিকা বধূ’ চলে গেছে ঘরে,—
হেরি’ কৃষ্ণপক্ষ রাত্রি একাদশী তিথি
দীর্ঘপথ শূন্যক্ষেত্র হয়েছে অতিথি
গ্রামে গৃহস্থের ঘরে পান্থ পরবাসী,—
কখন্ গিয়েছে থেমে কলরব রাশি
মাঠপারে কৃষি-পল্লি হতে, নদীতীরে
বৃদ্ধ কৃষাণের জীর্ণ নিভৃত কুটীরে
কখন্ জ্বলিয়াছিল সন্ধ্যা-দীপ খানি,
কখন্ নিভিয়া গেছে—কিছুই না জানি!
কি কথা বলিতেছিনু, কি জানি, প্রেয়সি,
অর্দ্ধ-অচেতন ভাবে মনোমাঝে পশি’
স্বপ্নমুগ্ধ মত! কেহ শুনেছিলে সে কি,
কিছু বুঝেছিলে প্রিয়ে, কোথাও আছে কি
কোন অর্থ তার? সব কথা গেছি ভুলে,
শুধু এই নিদ্রাপূর্ণ নিশীথের কুলে
অন্তরের অন্তহীন অশ্রু-পারাবার
উদ্বেলিয়া উঠিয়াছে হৃদয়ে আমার
গম্ভীর নিস্বনে!
এস সুপ্তি, এস শান্তি,
এস প্রিয়ে, মুগ্ধ মৌন সকরুণ কান্তি,
বক্ষে মোরে লহ টানি,—শোয়াও যতনে
মরণ-সুন্নিগ্ধ শুত্র বিস্মৃতি শয়নে!