বিষাদ-সিন্ধু/উদ্ধার পর্ব্ব/দশম প্রবাহ

উইকিসংকলন থেকে

দশম প্রবাহ

 বিশ্রামদায়িনী নিশার দ্বিযাম অতীত। অনেকেই নিদ্রার ক্রোড়ে অচেতন। এ সময় কিন্তু আশা, নিরাশা, প্রেম, হিংসা, শোক, বিয়োগ, দুঃখ, বিরহ, বিচ্ছেদ, বিকার এবং অভিমানযুক্ত হৃদয়ের বড়ই কঠিন সময়। সে হৃদয়ে শান্তি নাই—সে চক্ষে নিদ্রা নাই। ঐ এজিদের মন্ত্রণাগৃহে দীপ জ্বলিতেছে, প্রাঙ্গণে, দ্বারে, শাণিত কৃপাণহস্তে প্রহরী দণ্ডায়মান রহিয়াছে। গৃহাভ্যন্তরে মন্ত্রদাতা মারওয়ানসহ এজিদ জাগরিত, সন্ধানী গুপ্তচর সম্মুখে উপস্থিত।

 মারওয়ান আগন্তুক গুপ্তচরকে জিজ্ঞাসা করিল, “কোন্ দিকে যাইতে দেখিলে? আর সন্ধানেই বা কি জানিতে পারিলে?”

 “আমি বিশেষ সন্ধানে জানিয়াছি, তাহারা হানিফার সাহায্যে মদিনায় যাইতেছে।”

 “মোহাম্মদ হানিফা যে মদিনায় গিয়াছে, একথা তোমাকে কে বলিল?”

 “তাঁহাদের মুখেই শুনিলাম। মোহাম্মদ হানিফা প্রথমতঃ কারবালাভিমুখে যাত্রা করেন, পরে কি কারণে কারবালায় না যাইয়া মদিনায় গিয়াছেন,—সে কথা অপ্রকাশ রহিয়াছে।”

 “তবে কি যুদ্ধ বাধিয়াছে?”

 “যুদ্ধ না বাধিলে সাহায্য কিসের?”

 “আচ্ছা, কত পরিমাণ সৈন্য?”

 “অনুমানে নিশ্চিত করিতে পারি নাই; তবে তুরস্ক ও তোগান প্রদেশেরই বিস্তর সৈন্য। এই দুই রাজ্যের ভূপতিদ্বয়ও আছেন।”

 এজিদ বলিলেন, “কি আশ্চর্য্য! ওত্‌বে অলীদ কি করিতেছে? ভিন্ন দেশ হইতে হানিফার সাহায্যে সৈন্য যাইতেছে, সৈন্য-সামন্তের আহারীয় পর্য্যন্ত যাইতেছে, ইহার কি কোন সংবাদ অলীদ প্রাপ্ত হয় নাই? মোহাম্মদ হানিফা স্বয়ং মহাবীর, তাহার উপরও এত সাহায্য! শেষ যাহাই হউক, ঐ সকল সৈন্য যাহাতে মদিনায় যাইতে না পারে তাহার উপায় করিতে হইবে। ঐ সকল সৈন্য ও আহারীয় সামগ্রী যদি মদিনায় না যায়, তাহা হইলেও অনেক লাভ। এমন কোন বীরপুরুষই কি দামেস্ক-রাজধানীতে নাই যে, উপযুক্ত সৈন্য লইয়া এই রাত্রেই উহাদিগকে আক্রমণ করে, আর না হয় উহাদের গমনে বাধা দেয়?”

 সীমার করজোড়ে বলিল, “বাদশাহ্-নামদার! চির আজ্ঞাবহ দাস উপস্থিত, কেবল আজ্ঞার অপেক্ষা। যে হস্তে হোসেন-শির কারবালা-প্রান্তর হইতে দামেস্কে আনিয়াছি, সেই-ই হস্তে তােগানের ভূপতি ও তুরস্কের সম্রাটকে পরাস্ত করা কতক্ষণের কার্য্য?”

 এজিদের চিন্তিত হৃদয়ে আশার সঞ্চার হইল, মলিন মুখে ঈষৎ হাসির আভা প্রকাশ পাইল। তখনই সৈন্য-শ্রেণীর অধিনায়ককে তিনি সীমারের আজ্ঞাধীন করিয়া দিলেন।

 সীমার হানিফার সাহায্যকারীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত সৈন্য লইয়া গুপ্তচরসহ ঐ নিশীথ সময়েই যাত্রা করিল।

 এজিদ বলিলেন, “মারওয়ান! মােহাম্মদ হানিফা একাদিক্রমে শত বর্ষ যুদ্ধ করিলেও আমার সৈন্যবল ক্ষয় করিতে পারিবে না। যে পরিমাণ সৈন্য নগর হইতে বাহির হইবে, তাহার দ্বিগুণ সৈন্য সংগ্রহ করিতে পূর্ব্বেই আদেশ করিয়াছি। ওদিকে যুদ্ধ হউক, এদিকে আমরা জয়নাল আবেদীনকে শেষ করিয়া ফেলি। জয়নাল আবেদীনের মৃত্যু ঘােষিত হইলে হানিফা কখনই দামেস্কে আসিবে না। কারণ, জয়নাল-উদ্ধারই হানিফার কর্ত্তব্য কার্য্য, সেই জয়নালই যদি জীবিত না থাকিল, তবে হানিফার যুদ্ধ বৃথা। দ্বিতীয় কথা, হানিফার বন্দীদশা অথবা মৃত্যু আমাদের পক্ষে উভয়ই মঙ্গল। কিন্তু যদি জয়নাল জীবিত থাকে, আর হানিফাও জয়লাভ করে, তাহা হইলে মহা সঙ্কট ও বিপদ! এ অবস্থায় আর জয়নালকে রাখা উচিত নহে। আজ রাত্রেই হউক, কি কাল প্রত্যুষেই হউক, জয়নালের শিরশ্ছেদ করিতেই হইবে।”

 —“আমি ইহাতে অসম্মত নহি, কিন্তু ওত্‌বে অলীদের কোন সংবাদ না পাইয়া জয়নাল-বধে অগ্রসর হওয়া ভাল কি মন্দ তাই আজ আমি স্থির করিতে পারিলাম না। জয়নাল মদিনার সিংহাসনে বসিয়া দামেস্ক-সিংহাসনের অধীনতা স্বীকারপূর্ব্বক কিছু কিছু কর যােগাইলে দামেস্ক-রাজ্যের যত গৌরব, হােসেনবংশ একেবারে শেষ করিয়া একচ্ছত্ররূপে মক্কা মদিনার রাজত্ব করিলেও কখন তত গৌরব হইবে না।”

 —“সে কথা যথার্থ, কিন্তু তাহাতে সন্দেহ অনেক। কারণ, জয়নাল প্রাণরক্ষার জন্য আপাততঃ আমার অধীনতা স্বীকার করিলেও করিতে পারে, কিন্তু সে যে বংশের সন্তান, তাহাতে কালে তাহার পিতা, পিতৃব্য এবং ভ্রাতৃগণের দাদ উদ্ধার করিতে বদ্ধপরিকর হইয়া আমার বিরুদ্ধে যে যুদ্ধঘোষণা করিবে না, ইহা আমি কখনই বিশ্বাস করিতে পারি না।”

 —“যাহা হউক, মহারাজ! জয়নাল-বধ বিশেষ বিবেচনা-সাক্ষেপ, আগামী কল্য প্রাতে যাহা হয় করিব।”