পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/১৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সীতাঁরাম A গোলযোগ করিতেছে না ; নিঃশব্দ । কেবল অন্য কোন লোক সে বৃক্ষতলে দাড়াইতে আসিলে, তাহার উহাদিগকে গল টিপিয়া বাহির করিয়া দিতেছে । তাহাদিগকে বড় বড় যোয়ান ও হাতে বড় বড় লাঠি দেখিয়া সকলে নিঃশব্দে সরিয়া ঘাইতেছে। সেই বৃক্ষের শিকড়ের উপর দাড়াইয়া, কেবল এক জন স্ত্রীলোক বৃক্ষকাণ্ড অবলম্বন করিয়া উৰ্দ্ধমুখে বৃক্ষারূঢ় কোন ব্যক্তির সঙ্গে কথা কহিতেছে । তাহার চোখ মুখ ফুলিয়াছে ; বেশভূম বড় আলুথালু-মেন সমস্ত রাত্রি কাদিয়াছে । কিন্তু এখন আর কঁাদিতেছে না । যে বৃক্ষারূঢ়, তাহাকে ঐ স্ত্রীলোক বলিতেছে, “ঠাকুর । এখন কিছু দেখা যার না ?” বৃক্ষারূঢ় ব্যক্তি উপর হইতে বলিল, “না” । “তবে বোপ হয়, নারায়ণ রক্ষা করিলেন ।" পাঠক বুঝিয়া থাকিবেন যে, এই স্ত্রীলোক শ্ৰী । বৃক্ষোপরি স্বয়ঃ চন্দ্রচূড় তর্কালঙ্কার বৃক্ষশাখ। ঠিক তার উপপর্ক্স নষ্ঠে, কিন্থ তর্কালঙ্কার মনে করিতে ছেন, “আমি পৰ্ম্মাচরণ-নিসক্ত, পয়ের জন্য সকলই কৰ্ত্তব্য ।” ঐীর কথার উত্তরে চন্দ্রচূড় বলিলেন, “নারায়ণ অবগু রক্ষা করিবেন । আমার সে ভরসা আছে । তুমি উতলা হইও না । কিন্তু এখন ও রক্ষার উপায় হয় নাই বোধ হইতেছে । কতক গুল ললিপাগড়ি আসিতেছে, দেখিতে পাইতেছি ।" শ্ৰী । কিসের লালপাগড়ি ? চন্দ্রচূড় । বোধ হয় ফৌজদারী সিপাঙ্গ । বাস্তবিক গুই শত ফৌজদারী সিপাহী সশস্ত্র শ্ৰেণীবদ্ধ হইয় গঙ্গারামকে ঘেরিস লষ্টয় আসিতেছিল । দেখিয়! সেই অসংখ্য জনতা একেবারে নিস্তব্ধ হইয় দাড়াইল । যেমন যেমন দেখিতে লাগিলেন, চন্দ্রচূড় সেইরূপ শ্ৰীকে বলিতে লাগিলেন । শ্ৰী জিজ্ঞাসা করিল, “কত সিপাই ?” চন্দ্র । দুই শত হইবে । শ্ৰী । আমরা দান খী—নিঃসহায় । আমাদের মারিবার জন্য এত সিপাহী কেন ? চন্দ্র । বোধ হয়, বহুলোকের সমাগম হইয়াছে শুনিয়া সতর্ক হইয়া ফৌজদার এত সিপাহী পাঠাইয়াছেন । ঐ । তার পর কি হইতেছে ? চন্দ্র । সিপাহীরা আসিয়৷ শ্রেণী বাধিয়া, প্রস্তুত কবরের নিকট দাড়াইল । মধ্যে গঙ্গারাম । পিছনে খোদ কাজী, আর সেই ফকীর o শ্ৰী । দাদা কি করিতেছেন ? s চন্দ্র । পাপিষ্ঠেরা তার হাতে হাতকড়ি, পায়ে বেড়ী দিয়াছে । শ্ৰী । কাদিতেছেন কি ? - চন্দ্র । না । নিঃশব্দ–নিস্তব্ধ । মূৰ্ত্তি বড় গম্ভীর, বড় সুন্দর । শ্রী । আমি একবার দেখিতে পাই না ? জন্মের শোধ দেখিব । চন্দ্র। দেখিবার সুবিধ আছে । তুমি এই নীচের ডালে উঠিতে পার ? শ্ৰী। আমি স্ত্রীলোক, গাছে উঠিতে জানি না। চন্দ্র। এ কি লজ্জার সময় মা ? শিকড় হইতে হাত দৃষ্ট উচুতে একটি সরল ডাল ছিল । সে ডালটি উচু গুইয়া ন উঠিয়া, সোজা হইয়। বাহির হইয়া গিয়াছিল। হাতখানিক গিয়া ঐ ডাল দুই ভাগে বিভক্ত হুইয়াছিল। সেই গুষ্ট ডালের উপর গুইটি প। দিল্লী, নিকটস্ত আর একটি ডাল ধরিয়া গিড়াইবার বড় সুবিধা । চন্দ্রচূড় শ্ৰীকে ইহ দেখাইয়া দিলেন । শ্ৰী লজ্জ ত্যাগ করিয়া উঠিবার চেষ্ট করিল—শ্মশানে লজ্জ থাকে না । প্রথম দুই একবার চেষ্টা করিয়া উঠিতে পারিল ন!—কাদিতে লাগিল । ভার পর, কি কৌশলে কে জানে, শ্ৰী ত জানে ন!—সে সেই নিম্ন শাখায় উঠিয়া, সেই জোড়া ডালে যুগলচরণ রাখিয়া, আর একটি ডাল পরির দাড়াইল । তাতে বড় গোলযোগ উপস্থিত হইল । যেখানে শ্ৰী দাড়াইয়াছিল, সেখানে সম্মুখদিকে পাতার আবরণ ছিল না—শ্ৰী সেই অসংখ্য জনতার সম্মুখবৰ্ত্তিনী হইয়া দাড়াইল । সকলে দেখিল, সহসা অতুলনীয় রূপবর্তী বৃক্ষের ডাল ধরিয়। গ্রামলপত্ররাশিমধ্যে বিরাজ করিতেছে । প্রতিমার ঠাঁটের মত, চারিদিকে বৃক্ষশাখা, বৃক্ষপত্র ঘেরিয়া রহিয়াছে ; চুলের উপর পাত পড়িয়াছে, স্থল বাহুর উপর পাত পড়িয়াছে, বক্ষঃস্ত কেশদাম কতক কতক মাত্র ঢাকিয়া পাতা পড়িয়াছে, একটি ডাল আসিয় পা খানি ঢাকিয়া ফেলিয়াছে, কেহ দেখিতে পাইতেছে না, এ মূৰ্ত্তিমতী বনদেবী কিসের উপর দাড়াইয়াছে। দেখিয়া নিকটস্থ জনতা বাতাতাড়িত সাগরবৎ সহসা সংক্ষুব্ধ হইয়া छेठिंढा । শ্ৰী তাহ কিছুই জানিতে পারিল না। আপনার অবস্থান প্রতি তাহার কিছুমাত্র মনোযোগ ছিল না অনিমেষলোচনে গঙ্গারামের পানে চাহিয়া দেখিতেছিল, দুই চক্ষু দিয়া অবিরল জলধারা পড়িতেছিল । এমন সময়ে শাখাস্তর