পাতা:রাধারাণী-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ ്, বাঙ্গালায় আসার পর একদা কোন গ্রাম্য কুটুম্বের বাড়ী নিমন্ত্রণে গিয়াছিলাম । প্রাতঃকালে গ্রাম পৰ্য্যটনে গিয়াছিলাম। এক স্থানে অতি মনোহর নিভৃত জঙ্গল ; দুয়েল সপ্ত স্বর মিলাইয়া আশ্চৰ্য্য ঐকতানবাদ্য বাজাইতেছে ; চারি দিকে বৃক্ষরাজি ; ঘনবিন্যস্ত, কোমল খাম পল্লবদলে আচ্ছন্ন ; পাতায় পাতায় ঠেসাঠেসি মিশামিশি, শ্যাম রূপের রাশি রাশি ; কোথাও কলিক, কোথাও ফুটিত পুষ্প, কোথাও অপক, কোথাও সুপক্ক ফল। সেই বনমধ্যে আৰ্ত্তিনাদ শুনিতে পাইলাম। বনাভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, একজন বিকটমূৰ্ত্ত পুরুষ এক যুবতীকে বলপূর্বক আক্রমণ করিতেছে। দেখিবামাত্র বুঝিলাম, পুরুষ অতি নীচজাতীয় পাষণ্ড–বোধ হয়, ডোম কি সিউলি— কোমরে দা । গঠন অত্যন্ত বলবানের মত। ধীরে ধীরে তাহার পশ্চাদ্ভাগে গেলাম। গিয়া তাহার কঙ্কাল হইতে দাখানি টানিয়া লইয়া দূরে নিক্ষিপ্ত করিলাম। দুষ্ট তখন যুবতীকে ছাড়িয়া দিল—আমার সম্মুখীন হইয়া দাড়াইল। আমাকে গালি দিল। তাহার দৃষ্টি দেখিয়া আমার শঙ্কা হইল। বুঝিলাম, এ স্থলে বিলম্ব অকৰ্ত্তব্য। একেবারে তাহার গলদেশে হস্তার্পণ করিলাম। ছাড়াইয়া সেও আমাকে ধরিল। আমিও তাহাকে পুনৰ্ব্বার ধরিলাম। তাহার বল অধিক। কিন্তু আমি ভীত হই নাই—বা অস্থির হই নাই। অবকাশ পাইয়া আমি যুবতীকে বলিলাম যে, “তুমি এই সময় পলাও—আমি ইহার উপযুক্ত দণ্ড দিতেছি।” যুবতী বলিল,—“কোথায় পলাইব ? আমি যে অন্ধ। এখানকার পথ চিনি না।” অন্ধ ! আমার বল বাড়িল। আমি রজনী নামে একটি অন্ধ কন্যাকে খুজিতেছিলাম। দেখিলাম, সেই বলবান পুরুষ আমাকে প্রহার করিতে পারিতেছে না বটে, কিন্তু আমাকে বলপূর্বক টানিয়া লইয়া যাইতেছে। তাহার অভিপ্রায় বুঝিলাম, যে দিকে আমি দ। ফেলিয়া দিয়াছিলাম, সেই দিকে সে আমাকে টানিয়া লইয়া যাইতেছে। আমি তখন দুষ্টকে ছাড়িয়া দিয়া, অগ্ৰে গিয়া দা কুড়াইয়া লইলাম। সে এক বৃক্ষের ডাল ভাঙ্গিয়া লইয়া, তাহ ফিরাইয়া আমার হস্তে প্রহার করিল, আমার হস্ত হইতে দা পড়িয়া গেল । সে দা তুলিয়া লইয়া, আমাকে তিন চারি স্থানে আঘাত করিয়া পলাইয়া গেল। আমি গুরুতর পীড়াপ্রাপ্ত হইয়াছিলাম। বহু কষ্টে আমি কুটুম্বের গৃহাভিমুখে চলিলাম। অন্ধ যুবতী আমার পদশামুসরণ করিয়া আমার সঙ্গে সঙ্গে আসিতে লাগিল।