१७० “সংসার-বাসনা-বন্ধ-শৃঙ্খল বলিয়া জ্ঞান আছে, সেখানে হৃদয়ের যে আকর্ষণ তাহা শত প্রকার বিপ্রকর্ষণ দ্বারা পরাভূত হয় না। মেঘনিমুক্ত শশধরের স্তায় ইহার পুনঃ প্রকাশ যেন উজ্জ্বলতর ও সুন্দরতর বলিয়া মনে হয়। জয়দেব এই দৃশ্ন দ্বারা যে প্রয়োজন সাধন করিয়াছেন বিদ্যাপতি মাথুর ও প্রবাস, দ্বারা তাহাই করিয়াছেন। মাঝে মাঝে শ্রীরাধার মানের হেতুভূত শ্ৰীকৃষ্ণের আসক্তি র্তাহার পদাবলীতে বর্ণিত হইয়াছে বটে, কিন্তু তাহাতে এমন আকর্ষণীশক্তি অৰ্পিত হয় নাই। বৈষ্ণব কবিতায় “প্রবাস” বিদ্যাপতির মৌলিকত্ব, এবং ইহাকে অবলম্বন করিয়াই তিনি শ্রীরাধার ও শ্রীকৃষ্ণের হৃদয় পূর্ণমাত্রায় বিকশিত করিয়াছেন। তিনি সেইখানে দেখাইয়াছেন যে শ্রীরাধার টান শ্ৰীকৃষ্ণকে অন্ত শত আকর্ষণের প্রতি সহজে তাচ্ছিল্য আনিতে পারে। এমনি আকর্ষণ আছে বলিয়াই একজনের অভাবে সমস্ত শূন্তময় হইয়া যায়, এক নিমেষে অন্য সকল প্রলোভন হৃদয় হইতে দূরে অতি দূরে সরিয়া যায়। . মামিয়ং চলিত বিলোক্য বৃতং বধু নিচয়েন। সাপরাধতয়া ময়াপি ন বারিতাতি ভয়েন ॥ হরিহরি হতাদরতয়া গতা সা কুপিতেব। কিং করিষতি কিং বদিষ্যতি স চিরং বিরহেণ কিং ধনেন কিং জনেন কিং ময় জীবীতেন शृश्नि ॥ কিন্তু তিনিও জানিতেন যে শ্রীরাধ যতই রাগ করুন, যতই অভিমান করুন, তাহার হৃদয় তাহাতেই সংলগ্ন আছে। তাই আজ তাহার এত চিন্থ, এত ব্যথা, তাই জাহার প্রধান চিন্তা কেন তাহাকে অপরাধ-ভীত বঙ্গদর্শন [ ১২শ বর্ষ, চৈত্র, ১৩১৯ হইয়া যাইতে নিবারণ করি নাই ; সে কি করিবে সে কি বলিবে, সে এই দীর্ঘ বিরহ কেমন করিয়া সহ করিবে। যেমন ক্ষণকালের জন্ত হৃদয় রাধা-চিন্তা বিরহিত হইয়াছিল, তেমনি এখন সেই চিন্তার প্রথরতায় হৃদয় অবশ . ও অনন্তকৰ্ম্ম। মন আর কিছু করিতে চাহে না, শুধু তাঁহারই কথা ভাবিতে চাহে, কৃতাপরাধের শান্তিস্বরূপ ক্ষণিক ভ্ৰাস্তির প্রতিশোধস্বরূপ মন সে চিন্তা ছাড়িতেও পারে না । অথচ ভয়ে ভয়ে তাহার কাছে গিয়া অপরাধ ক্ষমা করাইতেও সাহস করে না। এই সন্ত্রস্তত, এই আকুল চিন্তা এই সৰ্ব্বগ্রাসী আকাঙ্ক বল দেখি পবিত্রপ্রণয়বাদী, যথার্থ প্রেম হইতে আসে, না ইন্দ্রিয়লোলুপতা হইতে আসে ? যাহার ভালবাসা , হৃদয়ের সমস্ত অধিকার না করিয়াছে তার কি এমন অবস্থা হয় ? অবগু মনে রাখিতে হইবে যে আমরা এখনও কৃষ্ণ ও রাধার মনুষ্যত্ব স্বীকার করিয়াই বিচার করিতেছি। মানুষ কতদূর ভালবাসিতে পারে, ভালবাসিলে কতদূর তন্ময় হইতে পারে, ভালবাসা থাকিলে, নিজেকে কতদূর খৰ্ব্ব করিতে পারে, তাহ আমরা জয়দেব ও বিদ্যাপতির রাধাকৃষ্ণ-চরিত্র হইতেই প্রথম শিখিতে পাইয়াছি। আমরা এই ক্ষণিক বিরহে রাধার অবস্থার পরিচয় পাইয়াছি, এখন শ্ৰীকৃষ্ণের অবস্থার সন্ধান করিব। ইহাও আমাদিগকে সখীর কাছ হইতে শুনিতে হইবে, কারণ সখীর মত মৰ্ম্মগ্রাহিণী ন হইলে সে অবস্থা কি তন্ন তন্ন করিয়া'আর কেহ বুঝিতে না বলিতে পারে? যেমন শ্ৰীকৃষ্ণের কাছে সখী শ্রীরাধার দশ বর্ণনা করিয়াছে,
পাতা:বঙ্গদর্শন নবপর্যায় দ্বাদশ খণ্ড.djvu/৭৬৫
অবয়ব