পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ২৭১ ভাইফোটার খাওয়া খাইলাম। আমার কপালে সেই মরণের যাত্রী দীর্ঘায়ুকামনার ফোট পরাইয়া আমার পায়ের ধুলা লইল। আমি গোপনে চোখ মুছিলাম। ঘরে আসিয়া বসিলে সে একটি টিনের বাক্স আমার কাছে আনিয়া রাখিল । বলিল, “স্ববোধের জন্য এই যা-কিছু এতদিন আগলাইয়া রাখিয়াছি তোমাকে দিলাম, আর সেই সঙ্গে স্ববোধকেও তোমার হাতে দিলাম । এখন নিশ্চিস্ত হইয়া মরিতে পারিব।” আমি বলিলাম, “অতু, দোহাই তোমার, টাকা আমি লইব না। স্ববোধের দেখা শুনার কোনো ক্রটি হুইবে না, কিন্তু টাকা আর-কারও কাছে রাখিয়ো ।” অতু কহিল, “এই টাকা লইবার জন্য কত লোক হাত পাতিয়া বসিয়া আছে। তুমি কি তাদের হাতেই দিতে বল ?” আমি চুপ করিয়া রছিলাম। অম্বু বলিল, “একদিন আড়াল হইতে শুনিয়াছি, ডাক্তার বলিয়াছে, স্ববোধের যেরকম শরীরের লক্ষণ ওর বেশিদিন বঁাচার আশা নাই । শুনিয়া অবধি ভয়ে ভয়ে আছি, পাছে আমার মরিতে দেরি হয়। আজ অন্তত আশ। লইয়। মরিব ষে, ডাক্তারের কথা ভূল হইতেও পারে । সাতচল্লিশ হাজার টাকা কোম্পানির কাগজে জমিয়াছে— আরও কিছু এদিকে ওদিকে আছে। ঐ টাকা হইতে সুবোধের পথ্য ও চিকিৎসা ভালো করিয়াই চলিতে পারিবে । আর যদি ভগবান অল্প বয়সেই উহাকে টানিয়া লন, তবে এই টাকা উহার নামে একটা কোনো ভালো কাজে লাগাইয়ো ।” আমি কছিলাম, “অমু, আমাকে তুমি যত বিশ্বাস কর আমি নিজেকে তত বিশ্বাস করি না ।” শুনিয়া অস্থ একটুমাত্র হাসিল। আমার মুখে এমন কথা মিথ্যা বিনয়ের মতো শোনায় । বিদায়কালে অতু বাক্স খুলিয়া কোম্পানির কাগজ ও কয়েক কেতা নোট বুঝাইয় দিল । তার উইলে দেখিলাম লেখা আছে, অপুত্রক ও নাবালক অবস্থায় স্থবোধের মৃত্যু হইলে আমিই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী । আমি বলিলাম, “আমার স্বার্থের সঙ্গে তোমার সম্পত্তি কেন এমন করিয়া জড়াইলে ।” অস্থ কহিল, “আমি যে জানি, আমার ছেলের স্বার্থে তোমার স্বার্থ কোনোদিন বালিবে না।” আমি কহিলাম, “কোনো মানুষকেই এতটা বিশ্বাস করা কাজের দস্তুর নয়।” অতু কহিল, “আমি তোমাকে জানি, ধর্মকে জানি, কাজের দস্তুর বুঝিবার আমার শক্তি নাই ।”