এ ছাড়াও পরে আমরা আরো অনেক সূত্রে জানতে পারি যে, মুক্তিবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ সম্বন্ধে পাকিস্তানীরা এত বেশী সন্দিহান এবং চিন্তিত হয়ে পড়েছিল যে, ১৩ই আগস্ট ঢাকা থেকে এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য এবং চারটি লাইট ট্যাঙ্ক কুমিল্লাতে আনা হয়। এই ব্যাটালিয়নটি বানাসিয়া থেকে গাজীপুর পর্যন্ত রেললাইনের পাশে প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরী করে, দুটি ট্যাঙ্ক কুমিল্লা বিমানবন্দরের নিকট মোতায়েন করে এবং বাকিগুলি কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্টে রাখা হয়। কুমিল্লার সামরিক প্রশাসক ব্রিগেডিয়ার মাসুদ ঘোষণা করেন যে, যদি কোন বাঙালী সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করে যে, মুক্তিবাহিনী তার বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে তবে তাকে সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। এইভাবে পাকবাহিনী তাদের দোষ মুক্তিবাহিনীর ওপর চাপাবার প্রচেষ্টা চালায় এবং এইসব অভিযোগকে তাদের প্রচার কাজের ব্যবহার করার চেষ্টা করে।
পাকসেনারা হোমনা থানায় একবার আক্রান্ত হবার পর এই থানাটিতে আবার পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ এবং কিছুসংখ্যক পাকসেনা মোতায়েন করে শক্তিশালী করে তোলে। থানাটিতে পাকসেনাদের অবস্থান শক্তিশালী হবার পর হোমনা এলাকায় মুক্তিবাহিনীর পক্ষে তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়াতে বাধার সৃষ্টি হয়। এই এলাকা আবার মুক্ত করার জন্য হাবিলদার গিয়াস থানাটিকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথমে থানাটির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ খবর সংগ্রহ করে। স্থানীয় গেরিলাদেরকেও তার প্লাটুনের সঙ্গে একত্রিত করে। ১৫ই আগস্ট রাত ১২টার সময় আমাদের সম্মিলিত দলটি হোমনা থানার উপর অতর্কিত আক্রমণ করে। কিন্তু ২ ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধের পর তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। যুদ্ধে তাদের ১০ জন নিহত ও ১৪ জন বন্দি হয়।
আমাদের দলটির দুজন আহত হয়। থানাতে ২৪টি রাইফেল, দুটি বন্দুক, ১৬টি বেয়োণ্টে, একটি অয়্যারলেস সেট, দুটি টেলিফোন সেট, ১০টি গ্রেনেড ও দেড় হাজার গুলি আমাদের হস্তগত হয়। বন্দিদের থানা হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। হোমনা থানার বিস্তৃত এলাকা আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। এর দুদিন পর হোমনা পতনের খবর পেয়ে পাকসেনাদের ৩টি দল মুরাদনগর থেকে হোমনার দিকে নৌকয় অগ্রসর হয়। মুরাদনগরে অবস্থিত আমাদের গেরিলারা এই সংবাদ পেয়ে যায়। স্থানীয় গেরিলা কমাণ্ডার মুসলেউদ্দিনের নেতৃত্বে দুপুর ২টার সময় নদীর পাড়ে অগ্রসরমান পাকসেনাদের জন্য এ্যামবুশ পাতে।
মুরাদনগর থেকে ৮ মাইল দূরে সন্ধ্যা ৬টার সময় পাকসেনাদের নৌকাগুলি এ্যামবুশে পড়ে যায়। আমাদের গেরিলাদের গুলিতে দুটি নৌকা ডুবে যায়। গোলাগুলিতে ১ জন ক্যাপ্টেনসহ ২৯ জন পাকসেনা এবং পাঁচজন রাজাকার নিহত হয়। আমাদের গেরিলারা ৩টি এমজি-৪২ এবং দুটি বেল্ট বক্স (৫০০ গুলিসহ), ৫০০ চাইনিজ রাইফেলের গুলি এবং ১টি ৩০৩ রাইফেল হস্তগত করে। অবশিষ্ট অস্ত্রশস্ত্র পানিতে ডুবে যাওয়ায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কুমিল্লা থেকে তিন মাইল উত্তর-পূর্বে কংসলাতে পাকসেনারা আগস্ট মাসে তাদের একটি ঘাঁটি স্থাপন করে। এই ঘাঁটিতে পাকসেনাদের অন্তত এক কোম্পানী শক্তি ছিল। পাকসেনাদের এই ঘাঁটির সংবাদ ক্যাপ্টেন মাহবুবের নিকট পৌঁছে। তিনি একটি পেট্রোল পার্টি পাঠিয়ে এই ঘাঁটি সম্বন্ধে বিস্তারিত খবর সংগ্রহ করেন। ১৬ই আগস্ট সন্ধ্যা ৭টায় ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে দুটি প্লাটুন শত্রুঘাঁটির দিকে অগ্রসর হয়। রাত ২টার ক্যাপ্টেন মাহবুবের দলটি পাকসেনাদের ঘাঁটির উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনীর সৈনিকরা পাক-ঘাঁটির ভিতরে অনুপ্রবেশ করে পাকসেনাদের হকচকিত করে দেয়। তুমুল সংঘর্ষে কিংকর্তব্যবিমূঢ় পাকসেনাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। পাকসেনারা পর্যুদস্ত হয়ে তাদের ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়ে যায়। আমাদের দলটি পলায়মান পাকসেনাদের খায়েশ বাজার এবং লক্ষ্মীপুর ঘাঁটি থেকেও হটে বাধ্য করে। সমস্ত রাতের সংঘর্ষে পাকসেনাদের একজন অফিসারসহ ৩০ জন হতাহত হয়। এরপর আমাদের দলটি নিরাপদে তাদের কেন্দ্রে ফিরে আসে।
এর তিনদিন পর কুমিল্লার ১ মাইল উত্তরে আমাদের আরও একটি দল পাকসেনাদের জন্য একটি এ্যামবুশ পেতে বসে থাকে। ২০শে আগস্ট রাত ৮টায় পাকসেনাদের একটি টহলদার প্লাটুন এই এ্যামবুশের আওতায়