বিষয়বস্তুতে চলুন

গৌড়লেখমালা (প্রথম স্তবক)/গোপালদেব-নামাঙ্কিত প্রস্তরলিপি ২

উইকিসংকলন থেকে

গোপালদেব-নামাঙ্কিত প্রস্তর-লিপি।

(২)
[শক্রসেন-প্রস্তরলিপি]।
প্রশস্তি-পরিচয়।

 ১৮৭৯ খৃষ্টাব্দে কনিংহাম [বুদ্ধগয়াধামে] এই প্রস্তরলিপিটি ভূগর্ভ হইতে উদ্ধৃত করিয়াছিলেন। ইহার একটি প্রতিকৃতিমাত্রই তাঁহার “মহাবোধি”-গ্রন্থে মুদ্রিত হইয়াছিল।[] লিপিটি এক্ষণেআবিষ্কার-কাহিনী। “শক্রসেন-প্রস্তরলিপি” নামে কথিত হইতে পারে। ইহা যে শ্রীমূর্ত্তির পাদপীঠে উৎকীর্ণ রহিয়াছে, সেই শ্রীমূর্ত্তিটি কলিকাতার যাদুঘরে রক্ষিত হইতেছে।

 এই লিপি সংস্কৃত-ভাষা-নিবদ্ধ; তিনটিমাত্র শ্লোকে সমাপ্ত। কনিংহাম ইহার পাঠোদ্ধারে কৃতকার্য্য হইতে না পারিয়া, ইহাকে গোপালদেবের শাসন-সময়ের প্রস্তরলিপি বলিয়াই পরিচয়পাঠোদ্ধার-কাহিনী। প্রদান করিয়া গিয়াছিলেন।[] পাদপীঠে এই লিপি ব্যতীত, “যে ধর্ম্মা হেতুপ্রভবা” ইত্যাদি বৌদ্ধ-মন্ত্রটিও মধ্যস্থলে উৎকীর্ণ রহিয়াছে। শ্রীযুক্ত নীলমণি চক্রবর্ত্তী, এম্ এ, এই লিপির একটি পাঠ ও প্রতিকৃতি মুদ্রিত করিয়াছেন।[]

 চক্রবর্ত্তী মহাশয় ইহার ব্যাখ্যা-কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়া, ইহাকে “শক্রসেন” নামক ব্যক্তির লিপি বলিয়া প্রকাশিত করিয়া গিয়াছেন। ইহার শ্লোক তিনটি শব্দাড়ম্বরে গৌড়ীয় রচনা-রীতিরব্যাখ্যা-কাহিনী। মর্য্যাদা রক্ষা করিয়াছে। কিন্তু দুই এক স্থলে অর্থবোধের কিঞ্চিৎ অসুবিধা আছে বলিয়াই বোধ হয়।

 এই লিপিটি ৪ পংক্তিতে বিভক্ত। সকলের শেষ পংক্তিতে কেবল “শ্রীগোপালদেব-রাজ্যে” এই কথাটি উৎকীর্ণ রহিয়াছে; সংবতের উল্লেখ নাই। ইহাকেও অনেকদিন পর্য্যন্ত প্রথম গোপালদেবেরলিপি-পরিচয়। শাসন-সময়ের প্রস্তরলিপি বলিয়াই সুধীগণ গ্রহণ করিয়াছিলেন। কিন্তু তৎকাল-প্রচলিত অক্ষরাবলীর সহিত ইহার সামঞ্জস্য নাই; বরং গরুড়স্তম্ভ-লিপির অক্ষরাবলীর সহিত সাদৃশ্য দেখিতে পাওয়া যায়। তজ্জন্য, চক্রবর্ত্তী মহাশয়, ইহাকে দ্বিতীয় গোপালদেবের শাসন-সময়ের প্রস্তর-লিপি বলিয়া সিদ্ধান্ত করায়, তাহাই সুধী-সমাজে সমাদর লাভ করিয়াছে।

 শ্রীধার্ম্মভীম নামক কোন বিখ্যাত ব্যক্তি বর্ত্তমান ছিলেন। তাঁহার প্রকৃত নাম শক্রসেন (?) “সিন্ধূদ্ভব” বলিয়া [৩ পংক্তিতে] তাঁহার বংশ-পরিচয় উল্লিখিত আছে। তিনি জগতের দুঃখশান্তিরলিপি-বিবরণ। নিমিত্ত “মুনির” [বুদ্ধদেবের] একটি প্রতিমা করাইয়াছিলেন। ইহাই এই সংক্ষিপ্ত লিপির ঐতিহাসিক বিবরণ। প্রথম শ্লোকে মঙ্গলাচরণ এবং দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্নোকে প্রতিষ্ঠাতার পরিচয় উল্লিখিত আছে।


প্রশস্তি-পাঠ।

कृत्वा मैत्रीं तनुत्रं स्फुरदुरुकरुणा-खड़्ग मालम्बयन् यः
स्फूर्ज्जत्-कन्दर्प-सेना-प्रलय-जलनिधे र्द्ध्वानभीमप्रमोषी।
कल्पान्तादीप्त-वह्निज्वलितरवपुः क्रोध-जिह्मीकृ-
तभ्रुं
जिग्ये निर्व्वान्त-हेमद्युतिः[]-ललितवपुः सोस्तु भूत्यै जिनो वः॥১॥
यः शारदेन्दु-किरणोज्वल-कीर्त्तिपुञ्जः
सम्बुद्ध-पाद-शतपत्र-मनःषड़ङ्घ्रिः।
श्रीधार्म्मभी-
म इति च प्रथितः पृथिव्यां
सिन्धूद्भवो भव[] दनल्प-कृपार्द्द(र्द्र)चित्तः॥২॥
तेनेयं शकसेनेन[] कारिता प्रतिमा मुनेः।
काङ्खताऽनुत्तरां बोधिं जगतो दुःख-शान्तये॥৩॥
श्रीगोपालदेव-राज्ये।


বঙ্গানুবাদ।

(১)

 যে নির্ব্বাণ-সুবর্ণদ্যুতিসম্পন্ন-ললিত-কলেবর জিন[] [বুদ্ধ]দেব মৈত্রীকে বর্ম্ম [রূপে আশ্রয়] করিয়া, সমুদ্ভাসিত-করুণা-খড়্গ ধারণ করিয়া, কন্দর্পসেনা-সমাকুল প্রলয়-জলধির প্রবল উচ্ছ্বাস পরাহত করিয়া, কল্পান্তাদীপ্ত-বহ্নিজ্বলিত-কলেবর ক্রোধ-কুটিলভ্রু [কামদেবকে] পরাভূত করিয়াছিলেন, তিনি তোমাদিগের কল্যাণসাধন করুন্।

(২)

 যিনি শারদেন্দু-কিরণোজ্বল-কীর্ত্তিপুঞ্জের আধার, যাঁহার মনঃষট্‌পদ বুদ্ধদেবের পদ-শতদলাসক্ত, যিনি সিন্ধু-সমুদ্ভূত[] কৃপার্দ্রচিত্ত শ্রীধার্ম্মভীম নামে ধরণিধামে সুবিখ্যাত,—

(৩)

 সেই শক্রসেন, সর্ব্বোৎকৃষ্ট সম্বোধি-লাভের আশায়, জগতের দুঃখ-শান্তি সম্পাদনের জন্য, মুনিবরের [বুদ্ধদেবের] এই প্রতিমা নির্ম্মিত করাইয়া দিয়াছেন।

শ্রীগোপালদেব-রাজ্যে।


  1. Mahabodhi, plate XXVIII, 2.
  2. Mahabodhi. P. 63.
  3. Journal and Proceedings, A. S. B. Vol. IV (New series), p. 105.
  4. দ্যুতি-শব্দে যে বিসর্গ-চিহ্ন দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা লিপিকর-প্রমাদের নিদর্শন বলিয়াই বোধ হয়।
  5. চক্রবর্ত্তী মহাশয় “ভাবদনল্প”-পাঠ মুদ্রিত করিয়াছেন;—প্রস্তরফলকে “ভবদনল্প” আছে।
  6. চক্রবর্ত্তী মহাশয় “শক্রসেন” পাঠ মুদ্রিত করিয়াছেন; প্রস্তর ফলকে তাহা স্পষ্ট দেখিতে পাওয়া যায় না।
  7. অমরকোষে [১৷১৷১৩] বুদ্ধদেবের নামাবলীর মধ্যে “জিন” নামটিও দেখিতে পাওয়া যায়।
  8. এই শ্লোকের ‘সিন্ধূদ্ভব’-শব্দ প্রতিষ্ঠাতার কুলপরিচয়-বিজ্ঞাপক, কিম্বা এতদ্বারা কেবল তাঁহার সিন্ধুদেশে জন্মগ্রহণ করিবার পরিচয় প্রকাশিত হইয়াছে, তাহা স্থির করা কঠিন। মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিতবর শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এম, এ এই শ্লোকের প্রমাণ বলে (?) শক্রসেনকে ধর্ম্মপাল নৃপতির জ্ঞাতি বলিয়া সিদ্ধান্ত করিবার কথা চক্রবর্ত্তী মহাশয় লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন।