পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ७०९ যাত্রার আরম্ভকালে স্নানচিকণ বনশ্ৰী রৌদ্রে উজ্জ্বল হাস্যময় ছিল, অনতিবিলম্বেই মেঘ করিয়া বৃষ্টি আরম্ভ হইল। তখন যে দিকে দৃষ্টি পড়ে সেই দিকই বিষন্ন এবং অপরিচ্ছন্ন দেখাইতে লাগিল। বন্যার সময়ে গোরুগুলি যেমন জলবেষ্টিত মলিন পঙ্কিল সংকীর্ণ গোষ্ঠপ্ৰাঙ্গণের মধ্যে ভিড় করিয়া করুণনেত্ৰে সহিষ্ণুভাবে দাড়াইয়া শ্রাবণের ধারাবর্ষণে ভিজিতে থাকে, বাংলাদেশ আপনার কর্দমপিচ্ছল ঘনসিক্ত রুদ্ধ জঙ্গলের মধ্যে মুকবিষন্নমুখে সেইরূপ পীড়িতভাবে অবিশ্রাম ভিজিতে লাগিল। চাষিরা টােকা মাথায় দিয়া বাহির হইয়াছে ; স্ত্রীলোকেরা ভিজিতে ভিজিতে বাদলার শীতল বায়ুতে সংকুচিত হইয়া কুটির হইতে কুটিরান্তরে গৃহকার্যে যাতায়াত করিতেছে ও পিছল ঘাটে অত্যন্ত সাবধানে পা ফেলিয়া সিক্তবস্ত্ৰে জল তুলিতেছে, এবং গৃহস্থ পুরুষেরা দাওয়ায় বসিয়া তামাক খাইতেছে, নিতান্ত কাজের দায় থাকিলে কোমরে চাদর জড়াইয়া জুতা-হস্তে ছাতি-মাথায় বাহির হইতেছে- অবলা রমণীর মস্তকে ছাতি এই রৌদ্রদগ্ধ বর্ষাপ্লাবিত বঙ্গদেশের সনাতন পবিত্র প্রথার মধ্যে নাই । বৃষ্টি যখন কিছুতেই থামে না। তখন রুদ্ধ নীেকার মধ্যে বিরক্ত হইয়া উঠিয়া শশিভূষণ পুনশ্চ রেলপথে যাওয়াই স্থির করিলেন । এক জায়গায় একটা প্রশস্ত মোহানার মতো জায়গায় আসিয়া শশিভূষণ নীেকা বাধিয়া আহারের উদ্যোগ করিতে লাগিলেন । খোড়ার পা খানায় পড়ে— সে কেবল খানার দোষে নয়, খোড়ার পটারও পড়িবার দিকে একটু বিশেষ ঝোক আছে। শশিভূষণ সেদিন তাহার একটা প্রমাণ দিলেন । দুই নদীর মোহানার মুখে বঁাশ বাধিয়া জেলেরা প্ৰকাণ্ড জাল পাতিয়াছে। কেবল একপার্থে নীেকা চলাচলের স্থান রাখিয়াছে । বহুকাল হইতে তাহারা এ কার্য করিয়া থাকে এবং সেজন্য খাজনাও দেয় । দুৰ্ভাগ্যক্রমে এ বৎসর এই পথে হঠাৎ জেলার পুলিস সুপারিন্টেন্ডেন্ট বাহাদুরের শুভাগমন হইয়াছে। তাহার বোট আসিতে দেখিয়া জেলেরা পূর্ব হইতে পার্শ্ববতী পথ নির্দেশ করিয়া উচ্চৈঃস্বরে সাবধান করিয়া দিল । কিন্তু মনুষ্যরচিত কোনো বাধাকে সম্মান প্রদর্শন করিয়া ঘুরিয়া যাওয়া সাহেবের মাঝির অভ্যাস নাই । সে সেই জালের উপর দিয়াই বোট চালাইয়া দিল । জাল অবনত হইয়া বোটিকে পথ ছাড়িয়া দিল, কিন্তু তাহার হাল বাধিয়া গেল। কিঞ্চিৎ বিলম্বে এবং চেষ্টায় হাল ছাড়াইয়া লইতে হইল । পুলিস সাহেব অত্যন্ত গরম এবং রক্তবর্ণ হইয়া বোট বাধিলেন । তাহার মূর্তি দেখিয়াই জেলে চারটে উধৰ্বশ্বাসে পলায়ন করিল । সাহেব তাহার মাল্লাদিগকে জাল কাটিয়া ফেলিতে আদেশ করিলেন । তাহারা সেই সাত-আট শত টাকার বৃহৎ জাল কাটিয়া টুকরা টুকরা করিয়া ফেলিল । জালের উপর ঝাল ঝাড়িয়া অবশেষে জেলেদিগকে ধরিয়া আনিবার আদেশ হইল। কনস্টেবল পলাতক জেলে চারিটির সন্ধান না পাইয়া যে চারি জনকে, হাতের কাছে পাইল তাহাদিগকে ধরিয়া আনিল । তাহারা আপনাদিগকে নিরপরাধ বলিয়া জোড়হন্তে কাকুতিমিনতি করিতে লাগিল । পুলিসবাহাদুর যখন সেই বন্দী দিগকে সঙ্গে লইবার হুকুম দিতেছেন, এমন সময় চশমাপরা শশিভূষণ তাড়াতাড়ি একখানা জামা পরিয়া তাহার বোতাম না লাগাইয়া চটিজুতা চটচট্ৰ করিতে করিতে উর্ধ্বশ্বাসে পুলিসের বোটের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন । কম্পিত্যুস্বরে কহিলেন, “সার, জেলের জাল ছিড়িবার এবং এই চারি জন লোককে উৎপীড়ন করিবার তোমার কোনো অধিকার নাই ।” পুলিসের বড়ো কর্তা তাহাকে হিন্দিভাষায় একটা বিশেষ অসম্মানের কথা বলিবামাত্র তিনি এক মুহুর্তে কিঞ্চিৎ উচ্চ ডাঙা হইতে বোটের মধ্যে লাফাইয়া পড়িয়াই একেবারে সাহেবের উপরে আপনাকে নিক্ষেপ করিলেন । বালকের মতো, পাগলের মতো মারিতে লাগিলেন । তাহার পর কী হইল তিনি জানেন না । পুলিসের থানার মধ্যে যখন জাগিয়া উঠিলেন তখন, বলিতে সংকোচ বোধ হয়, যেরূপ ব্যবহার প্রাপ্ত হইলেন তাহাতে মানসিক সম্মান অথবা শারীরিক আরাম বোধ করিলেন না ।