পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ইতিহাস রচনায়। এছাড়া ব্রহ্মপুত্র ও বরাক উপত্যকার চিরাচরিত বিপ্রতীপতা কীভাবে কমিউনিস্ট পার্টি সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের রাজ্যিক নেতৃত্বকে ভাষা-সংগ্রামের বাস্তবতা সম্পর্কে অসংবেদনশীল করে তুলেছিল—এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির তথ্য-সমৃদ্ধ বিশ্লেষণ করা হয়নি। ১৯৯৪ সালে শিলচরে আসাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে ইতিহাস বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতো বিভাগ প্রণালীবদ্ধ গবেষণার মাধ্যমে এই জরুরি কৃত্যটি করতে পারতেন। কিন্তু এধরনের কোনও উদ্যম আজ পর্যন্ত গ্রহণ করা হল না কেন, তা ভেবে বিস্মিত ও বিষণ্ণ হই।

 সবেমাত্র ইতিহাস প্রণয়ন শুরু হয়েছে। তাই হয়তো ১৯৭২ ও ১৯৮৬ সালে বরাক উপত্যকার ভাষা-আন্দোলনে কীভাবে দুটি পর্যায় তৈরি হল, তার বিশ্বাসযোগ্য ও বিশ্লেষণগর্ভ প্রতিবেদন এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আসামের মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যদের বিজ্ঞপ্তি ও গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যম সম্পর্কিত নির্দেশিকার প্রশ্নে গণআন্দোলন কিন্তু ১৯৬১-এর ভাষাসংগ্রাম থেকে চরিত্রগত ভাবে আলাদা। যতদিন পর্যন্ত সমস্ত পর্যায় ইতিহাসের আধেয় না হচ্ছে, নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চলমান ভাষাসংগ্রাম সম্পর্কে আমাদের ধারণা সম্পূর্ণ হবে না। আরও কিছু অনাবশ্যক জটিলতাও স্থায়ীভাবে নিরাকৃত হওয়া উচিত। ১৯৭২-এর ভাষা-শহিদ বিজন (বাচ্চু) চক্রবর্তী যেহেতু গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের নেতা ছিলেন এবং সে-সময় কোনো একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সন্দেহজনক, চরম অসহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে ওই পর্যায়ের ভাষাসংগ্রামকেও অস্বীকার করেছেন কেউ কেউ। এ ধরনের পক্ষপাতপূর্ণ ও রাজনৈতিক বিদ্বেষপ্রবণ মনোভঙ্গি চল্লিশ বছর পরেও অক্ষুণ্ণ রয়ে গেছে; নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাস রচনায় আজও তা বড়ো বাধা। উল্টো দিক দিয়ে, উদ্যমের চূড়ান্ত অভাব রয়েছে জনগণের প্রগতিশীল অংশেও। স্মৃতিকথা লিখে উৎসাহ শেষ হয়ে যাচ্ছে এঁদের, প্রণালীবদ্ধ ঐতিহাসিক প্রতিবেদন রচনার কোনো চেষ্টা করেননি এঁরা। সব মিলিয়ে, বাংলাদেশের ভাষাসংগ্রামের প্রতিতুলনায় কেবল দ্বিমেরুবিষমতাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে লাগাতার লড়াই করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উন্মোচন প্রক্রিয়া প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তানে ও সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ক্রমাগত শানিততর হয়েছে। কিন্তু আধিপত্যবাদী শক্তির প্রতিনিধিরা যেহেতু কৌশলে বরাক উপত্যকার ভাষা-আন্দোলনকে ছিনতাই করে নিয়েছে বারবার, গণতান্ত্রিক চেতনার অন্তঃসার তেমন ভাবে বিকশিত হতে পারেনি। তেমনই মৌলবাদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবেও তাকে ঠিকমতো ব্যবহার করা যায়নি।

 এই আত্মসমালোচনার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। বস্তুত খোদ বরাক উপত্যকায় প্রতিবাদী চেতনা অস্তমিত। ইণ্টারনেট জমানায় বাংলা-মাধ্যম বিদ্যালয়গুলিতে অদ্য ভক্ষ্য ধনুর্গুণ পরিস্থিতি। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে-ওঠা ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলগুলিতে হাঁসজারু ও বকচ্ছপদের বাড়বাড়ন্ত। ভাবা যায়, এরা বাংলা বই পড়ে না, বাংলা গান শোনে না, বাঙালির উত্তরাধিকার নিয়ে এদের কোনো শ্রদ্ধা নেই। যে-কোনো মূল্যে সাফল্য-মৃগয়ায় টিকে থাকাই এদের একমাত্র নীতি; এরা প্রকাশ্যে ভাষা-আন্দোলন ও

৫৬