কঙ্কাবতী/দ্বিতীয় ভাগ/একাদশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে


একাদশ পরিচ্ছেদ

ভূত-কোম্পানী

খেতু বলিতেছেন,— “রাত্রি প্রায় দুই প্রহর হইয়াছে, অতিশয় শ্রান্তিবশতঃ আমার একটু নিদ্রার আবেশ হইয়া আসিতেছে, এমন সময় মন্দিরের সোপানে কি ঠক-ঠক করিয়া শব্দ হইতে লাগিল। চাহিয়া দেখি না, ভীষণাকার শ্বেতবর্ণ এক মড়ার মাথা। একটি পৈঠা হইতে অন্য পৈঠার উপর লাফাইয়া লাফাইয়া উঠিতেছে। কঙ্কাবতি! ভয় আমার শরীরে কখনও নাই, তবুও এই মড়ার মাথার কাণ্ড দেখিয়া আমার শরীর কেমন একটু রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। আমি উঠিয়া বসিলাম। মড়ার মাথাটি লাফাইয়া সমস্ত পৈঠাগুলি উঠিল, তারপর ভাটার মত গড়াইতে গড়াইতে আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। আমার নিকট আসিয়া একটি লাফ মারিল, লাফ মারিয়া আমার ঠিক মুখের সম্মুখে শূন্যেতে স্থির হইয়া কিছুক্ষণের নিমিত্ত আমার দিকে চাহিয়া রহিল! সেইখানে থাকিয়া আকর্ণ হা করিয়া দন্তপাতি বাহির করিল।

 এইরূপ বিকটাকার হাঁ করিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিল,— “বাবু! তুমি না কি ভূত মানো না?”

 আমি উত্তর করিলাম,— “রক্ষা করুন, মহাশয়! আপনারা পর্য্যন্ত আর আমার সহিত লাগিবেন না। নানা কষ্টে, নানা দুঃখে আমি বড়ই উৎপীড়িত হইয়াছি। যান, ঘরে যান! আমাকে আর জ্বালাতন করিবেন না।”

 আমার কথায় মুণ্ডটির আরও ক্রোধ হইল। চীৎকার করিয়া সে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল,— “বাবু! তুমি নাকি ভূত মানো না? ইংরেজী পড়িয়া তুমি নাকি ভূত মানো না?”

 আমি বলিলাম,— “ইংরেজি-পড়া বাবুরা ভূত মানেন না বলিয়া কি আপনার রাগ হইয়াছে? লোকে ভূত না মানিলে কি আপনাদের অপমান বোধ হয়?”

 মড়ার মুণ্ড উত্তর করিল,— “রাষ্ট্র হইবে না তো কি, সর্ব্বশরীর শীতল হইবে? ভূত না মানিলে ভূতাদিগের অপমান হয় না তো কি আর মর্য্যাদা বাড়ে? কেন লোকে বলিবে যে, পৃথিবীতে ভূত নাই? ইংরেজি-পড়া বাবুদের আমরা কি করিয়াছি যে, তাহারা আমাদিগকে পৃথিবী হইতে একেবারে উড়াইয়া দিবে। দেবতাদিগকে তোমরা উড়াইয়া দিয়াছ, এখন এই উপদেবতা কয়টাকে শেষ করিতে পারিলেই হয়। বটে!”

 দুঃখের সময়ও হাসি পায়! দেবতাদিগকে না মানিলে, না পূজা দিলে, দেবতাদিগের রাগ হয়, দেবতারা মুখ হাঁড়ি করিয়া বসিয়া থাকেন, একথা পূর্ব্বে জানিতাম; কিন্তু লোকে ভূত না মানিলে, ভূতের রাগ হয়, ভূতের অপমান হয়, একথা কখনও শুনি নাই। আমার তাই হাসি পাইল।

 আমি বলিলাম,— “হাঁ মহাশয়! ইংরেজী-পড়া বাবুদের এটি অন্যায় বটে!”

 আমার কথায় মড়ার মাথা কিছু সন্তুষ্ট হইল, অনেকটা তাহার রাগ পড়িল। মুণ্ড বলিল,— “তুমি ছোকরা দেখিতেছি ভাল। ইংরেজি-পড়া বাবুদের মত ত্রিপণ্ড নাস্তিক নও! তোমার মাথায় টিকি আছে?”

 আমি বলিলাম,— “না মহাশয়! আমার মাথায় টিকি নাই।”

 মুণ্ড বলিল,— “এইবার ঘরে গিয়া টিকি রাখিও। আর শুন, ইংরেজি-পড়া বাবুদের আমরা সহজে ছাড়িব না। যাহাতে পুনরায় ভূতের উপর তাহাদিগের বিশ্বাস জন্মে, আমরা সে সমুদয়


আয়োজন করিয়াছি। আমরা তাহাদিগকে ভজাইব। যেখানে-সেখানে গিয়া বক্তৃতা করিব, পুস্তক ছাপাইব, সংবাদপত্র বাহির করিব। এই সকল কার্য্যের নিমিত্ত আমরা একটি কোম্পানী খুলিয়াছি। কোম্পানীর নাম রাখিয়াছি, 'স্কল, স্কেলিটন এণ্ড কোং!'

 কঙ্কাবতী! তোমার বোধ হয়, মনে থাকিতে পারে যে, “স্কল” মানে মনুষ্যের মাথার খুলি, “স্কেলিটন” মানে কঙ্কাল, অর্থাৎ অস্থি-নির্ম্মিত মনুষ্যশরীরের কাঠামো। মুণ্ড যাহা বলিল, তাহার অর্থ এই যে, ইংরেজি-পড়া লোকেরা যাহাতে ভূতের অস্তিত্ব স্বীকার করেন, তাঁহাদের মনে যাহাতে ভূতের উপর বিশ্বাস হয়, ভূতের প্রতি ভক্তি হয়, এইরূপ শিক্ষা দিবার নিমিত্ত খুলি, কঙ্কাল প্রভৃতি ভূতগণ দলবদ্ধ হইয়াছেন।

 স্কল অর্থাৎ সেই মড়ার মাথাটি আমাকে পুনরায় বলিলেন,— “আমরা কোম্পানী খুলিয়াছি। কোম্পানীর নাম রাখিয়াছি, “স্কল, স্কেলিটন এণ্ড কোং।” ইংরেজি নাম রাখিয়াছি কেন, তা জোন? তাহা হইলে পসার বাড়িবে, মান হইবে, লোকের মনে বিশ্বাস জনিবে। যদি নাম রাখিতাম “খুলি, কঙ্কাল এবং কোম্পানী” তাহা হইলে কেহই আমাদিগকে বিশ্বাস করিত না। সকলে মনে করিত, ইহারা জুয়াচোর। দেখিতে পাও না? যে, যখন মুখোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায় ও চট্টোপাধ্যায় মহাশয়েরা জুতা কি শরাপ কি হ্যাম বা শূকরের মাংসের দোকান করেন, তখন সে দোকানের নাম দেন, ‘লংম্যান এণ্ড কোং।' অথবা ‘গুডম্যান এণ্ড কোং।' দেখিয়া-শুনিয়া শত-সহস্র বার ঠকিয়া দেশী লোককে আর কেহ বিশ্বাস করে না। বরং ইংদ্রুজ পিঁদ্রুজ দোকানীর কথা লোকে বিশ্বাস করে, তবু দেশী দোকানীর কথা লোকে বিশ্বাস করে না। আবার দেখ, বেদের কথা বল, শাস্ত্রের কথা বল, বিলাতী সাহেবেরা যদি ভাল বলেন, তবেই বেদ-পুরাণ ভাল হয়। দেশী পণ্ডিতদের কথা কেহ গ্রাহ্যও করে না। এই সকল ভাবিয়া-চিন্তিয়া আমাদের কোম্পানীর নাম দিয়াছি 'স্কল, স্কেলিটন এণ্ড কোং!' স্কেলিটন ভায়া ঐখানে দাড়াইয়া আছেন। এস তো, স্কেলিটন ভায়া, একটু এদিকে এস তো!”

 হাড় ঝম-ঝম্ করিতে করিতে স্কেলিটন আমার নিকটে আসিলেন। সর্ব্বশরীরের অস্থিকে স্কেলিটন বলে, কিন্তু এক্ষণে আমার সম্মুখে যিনি আসিয়া উপস্থিত হইলেন, তিনি দেখিলাম মুণ্ডহীন স্কেলিটন।

 তখন স্কল আমাকে পুনরায় বলিলেন,— “কেমন ভূতের উপর এখন তোমার সম্পূর্ণরূপ বিশ্বাস হইয়াছে তো?”

 আমি উত্তর করিলাম,— “পূর্ব্ব হইতেই আমার বিশ্বাস আছে। কারণ ভূতের ষড়যন্ত্রেই আমি এতদিন ধরিয়া ক্লেশভোগ করিতেছি; কিন্তু সে অন্যপ্রকার ভূত। এখন হইতে আপনাদিগের মত ভূতকে মানিয়া লইলাম। প্রত্যক্ষ চক্ষের উপর দেখিয়া আর কি করিয়া না মানি? তার জন্য আর আপনারা কোনও চিন্তা করিবেন না; যান, এক্ষণে ঘরে যান। রাত্রি অধিক হইয়াছে। আপনাদিগের ঘরের লোক ভাবিবে। আর, আমাকে একটু নিদ্রা যাইতে হইবে। কারণ, কাল প্রাতঃকালে আবার আমাকে পথ চলিতে হইবে!”

 স্কল তখন স্কেলিটনকে বলিলেন,— “দেখিলে, স্কেলিটন ভায়া! কোম্পানী খুলিলে কত উপকার হয়! ইংরেজি পড়িয়া এই বাবুটির মতিগতি একেবারেই বিকৃত হইয়া গিয়াছিল। দু’কথাতেই পুনরায় ইহাকে স্বধর্ম্মে আনয়ন করিলাম। এক্ষণে চল, অন্যান্য বিকৃতমতি বাবুদিগকে অন্বেষণ করি। ভূতবর্গের প্রতি যাহাতে তাঁহাদের শ্রদ্ধা-ভক্তি হয়, চল, সেইরূপ উপায় করি।”

 স্কেলিটন হাড় ঝম্‌-ঝম্ করিলেন। আমি একটু কান পাতিয়া শুনিলাম যে, সে কেবল হাড় ঝম্‌-ঝম্ নয়। তাঁহার মুণ্ড নাই, সুতরাং মুখ দিয়া কথা কহিবার তাঁহার উপায় নাই। সেজন্য গায়ের হাড় নাড়িয়া, হাড় ঝম্‌-ঝম্ করিয়া তিনি কথাবার্ত্তা কহিয়া থাকেন। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, সে কথা আমি অনায়াসে বুঝিতে পারিলাম।

 স্কেলিটন বলিলেন,— “যদি ইনি ভুতভক্ত হইলেন, তবে ইহাকে পুরস্কার দেওয়া উচিত। লোককে ভক্ত করিতে হইলে অর্থদান একটি তাহার প্রধান উপায়। অর্থ পাইলে লোকে অতি ধর্ম্মবান, অতি ভক্তিমান মহাপুরুষ হয়। অতএব তুমি ইহাকে ধনদান কর। যখন দেশে গিয়া, ইনি গল্প করিবেন, তখন শত শত লোক অর্থলোভে ভুতভক্ত হইবে।”

 আমি বলিলাম,— “সম্প্রতি আমার অর্থের নিতান্ত প্রয়োজন আছে বটে, কিন্তু আমি অর্থলোভী নই। ধন দিয়া আমাকে ভূতভক্ত করিতে হইবে না। আপনাদের অর্থ আমি লাইব না।”

 এই কথা শুনিয়া স্কল আরও প্রসন্নমূর্ত্তি ধারণ করিলেন। তিনি বলিলেন,— “এস, আমাদের সঙ্গে এস। আমাদের সঞ্চিত ধন তোমাকে দিলে, ধনের সফলতা হইবে, ধন সুপাত্রে অর্পিত হইবে, সে ধন দ্বারা মঙ্গল সাধিত হইবে, সেইজন্য তোমাকে আমাদের সঞ্চিত ধন দিব। জীবিত থাকিতে আমরা ধনের সদ্ব্যবহার করি নাই। এক্ষণে তোমা কর্তৃক সে ধনের সদ্ব্যবহার হইলে, আমাদের উপকার হইবে।”

 স্কেলিটনও আমাকে সেইরূপ অনেক অনুরোধ করিলেন। দুই ভূতের অনুরোধে আমি তাঁহাদিগের সঙ্গে চলিলাম। স্কেলিটন হাঁটিয়া চলিলেন, আর স্কল স্থানবিশেষে লাফাইয়া বা গড়াইয়া যাইতে লাগিলেন। প্রথমে তাঁহারা আমাকে অনেকগুলি ফল-বৃক্ষের নিকট লইয়া যাইলেন। আম্র, কদলী, পনস, কেন্দু, পিয়াল, প্রভৃতি নানা ফল সেইখানে সুপক্ক হইয়াছিল। সেই ফল আমাকে তাঁহারা আহার করিতে বলিলেন। আমি আহার করিলাম। তাহার পর তাঁহারা আমাকে সুশীতল স্ফটিকসদৃশ নির্বর দেখাইয়া দিলেন। জলপান করিয়া পিপাসা দূর করিলাম। সেখান হইতে আমরা পুনরায় চলিলাম। অল্পক্ষণ পরে এই পর্ব্বতের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলাম। পর্ব্বতের একস্থানে আসিয়া স্কল বলিলেন,— “এইখানকার বন আমাদিগকে একটু পরিষ্কার করিতে হইবে। আজ সহস্ৰ বৎসর ধরিয়া এখানে জনমানব পদার্পণ করে নাই।” আমরা তিনজনে অনেকক্ষণ ধরিয়া সেই বন পরিষ্কার করিতে লাগিলাম। পরিষ্কৃত হইলে পর্ব্বতের গাঁথুনির ঈষৎ একটু রেখা বাহির হইয়া পড়িল। স্কল, স্কেলিটন ও আমি অতিকষ্টে সেই গাথুনি পাথরগুলি ক্রমে খুলিয়া ফেলিলাম। গাঁথুনি খুলিতেই আমাদের এই অট্টালিকার সুড়ঙ্গপথটি বাহির হইয়া পড়িল। সুড়ঙ্গদ্বারে ভয়ঙ্করী নাকেশ্বরীকে দেখিলাম। নাকেশ্বরী খল-খল করিয়া হাসিল। কিন্তু যেই স্কল চক্ষু-কোটর বিস্তৃত করিয়া তাহার দিকে কোপ-কটাক্ষ করিলেন, আর সে চুপ করিল। সুড়ঙ্গের পথ দিয়া আমরা এই অট্টালিকার ভিতর প্রবেশ করিলাম। এই বিপুল ধনরাশি দেখিয়া আমি চমৎকৃত হইলাম।

 স্কল বলিলেন,— “সহস্ৰ বৎসর পূর্ব্বে এই অঞ্চলের আমরা রাজা ছিলাম। প্রতিবেশী রাজগণের সহিত যুদ্ধ করিয়া এই অপরিমিত ধন অর্জ্জন করি। জীবিত থাকিতে ধর্ম্মকর্ম্ম কিছুই করি নাই, কেবল যুদ্ধ ও ধনসঞ্চয় করিয়া জীবন অতিবাহিত করিয়াছিলাম। আমাদের সন্তান-সন্ততি ছিল না। সে জন্য কিন্তু আমরা দুঃখিত ছিলাম না, বরং আনন্দিত ছিলাম। যেহেতু সন্তান-সন্ততি দ্বারা ধনের ব্যয় হইবার সম্ভাবনা। টাকা গনিয়া, টাকা নাড়িয়া-চাড়িয়া, আমরা স্বৰ্গ-সুখ উপভোগ করিতাম! আমাদের অবর্ত্তমানে পাছে কেহ এই ধন লয়, সেজন্য আমরা ইহার উপর 'যক' দিলাম, অর্থাৎ ইহার উপর এক ভূতিনীকে প্রহরীস্বরূপ নিযুক্ত করিলাম, এ-কার্য্যে যক্ষ বা যক্ষিণী নিযুক্ত করি নাই। কথায় লোকে বলে বটে, কিন্তু ধনের উপরে রক্ষা বা যক্ষিণী কেহ নিযুক্ত করিতে পারে না। যাহা হউক, আমাদিগের ধন-ঐশ্বর্যের উপর যক দিবার উদ্দেশ্যে প্রথমে পর্ব্বত-অভ্যন্তরে এই সুরম্য অট্টালিকাটি নির্ম্মাণ করিলাম। রাজবাড়ী হইতে সমুদয় টাকাকড়ি, মণি-মুক্তা, বসন-ভুষণ ইহার ভিতর লইয়া আসিলাম। যথাবিধি যাগ-যজ্ঞাদি ক্রিয়া করিয়া নবমবর্ষীয়া সুলক্ষণা একটি বালিকাকে উৎসর্গ করিয়া, তাহাকে বলিয়া দিলাম যে, একসহস্ৰ বৎসর পর্য্যন্ত তুমি এই ধনের প্রহরিণীস্বরূপ নিযুক্ত থাকিবে। এক-সহস্ৰ বৎসরের মধ্যে যদি কেহ এই ধনের এক কণা মাত্রও লয়, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ তুমি তাহার প্রাণ বধ করিবে। এক সহস্ৰ বৎসর পরে তুমি যেখানে ইচ্ছা সেইখানে যাইও, তখন যাহার অদৃষ্ট থাকিবে, সে এই ধনের অধিকারী হইবে। বালিকাকে এইরূপ আদেশ করিয়া, অট্টালিকার ভিতর একটি প্রদীপ জ্বালিয়া, আমরা সুড়ঙ্গের দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিলাম। প্রদীপটি যেই নির্ব্বাণ হইল, আর বালিকার মৃত্যু হইল, মরিয়া সে ভীষণাকৃতি অতি দীর্ঘনাসিকা-ধারিণী ভূতিনী হইল। ভূতসমাজে সেজন্য সে নাকেশ্বরী নামে পরিচিত। দ্বারে যে এই প্রহরিণীস্বরূপ রহিয়াছে, সে সেই বিকৃত-আকৃতি ভূতিনী, যাহার বিকট হাসি তুমি এইমাত্র শুনিলে। বালিকা না রাখিয়া ধনের উপর অনেকে বালক-প্রহরী নিযুক্ত করিয়া থাকে। বালক মরিয়া ভূত হয়। কিছুদিন পরে যুদ্ধে আমরা হত হই। শক্রর তরবারি আঘাতে দেহ হইতে মুণ্ড বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়। জীবিত থাকিতে ছিলাম একজন মনুষ্য; মরিয়া হইলাম দুইজন ভুত। মুণ্ডটি হইলাম আমি স্কল, আর ধড়টি হইলেন ইনি স্কেলিটন ভায়া। ৯৯৯ বৎসর পূর্ব্বে আমরা এই ধনের যক দিয়াছি। আর একবৎসর গত হইলেই সহস্ৰ বৎসর পূর্ণ হয়। তখন নাকেশ্বরী এ ধন ছাড়িয়া দিবে। গত পৌষ মাসে নাকেশ্বরীর সহিত ঘ্যাঁঘোঁ নামক ভূতের শুভবিবাহ হইয়াছে। নাকেশ্বরী আপনার শ্বশুরালয়ে চলিয়া যাইবে। তখন এ ধন লইলে আর তোমার কোনও বিপদ ঘটিবে না! কিন্তু এই একবৎসরের ভিতর কোনও মতে এ ধনের কণামাত্র স্পর্শ করিবে না, করিলেই অবিলম্বে নাকেশ্বরী তোমাকে খাইয়া ফেলিবে, অবিলম্বে তোমার মৃত্যু ঘটিবে। এই ধনসম্পত্তির প্রকৃত স্বামী আমরা দুইজন। এই ধন আমরা তোমাকে প্রদান করিলাম। কিন্তু সাবধান, এই একবৎসরের ভিতর এ ধন স্পর্শ করিবে না।”

 আমি উত্তর করিলাম,— “মহাশয়! আপনাদের কৃপায় আমি অতিশয় অনুগৃহীত হইলাম। যদি আমাকে এ সম্পত্তি দিলেন, তবে এরূপ কোন একটা উপায় করুন, যাহাতে এ ধন হইতে এখন আমি কিছু লইতে পারি। সম্প্রতি আমার অর্থের নিতান্ত প্রয়োজন। এখন যদি পাই, তবে আমার বিশেষ উপকার হয়, এমন কি, আমার প্রাণরক্ষা হয়! এখন না পাইলে, একবৎসর পরে জীবিত থাকি কি তাই সন্দেহ।”

 এই কথা শুনিয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া, স্কল ও স্কেলিটন পরামর্শ করিতে লাগিলেন। তাহারা কি বলাবলি করিলেন, আমি তাহা বুঝিতে পারিলাম না! স্কল বলিলেন,— “এস, আমাদের সঙ্গে পুনরায় বাহিরে এস।” সকলে পুনরায় যাইলাম, বনের ভিতর পুনরায় আমরা ভ্রমণ করিতে লাগিলাম। স্কল বন খুঁজিতে লাগিলেন। অবশেষে সামান্য একটি ওষধির গাছ দেখাইয়া তিনি আমাকে বলিলেন,— “এই গাছটির তুমি মূল উত্তোলন কর!” আমি সেই গাছটির শিকড় তুলিলাম। স্কলের আদেশে অপর একটি গাছের আঠা দিয়া সেই শিকড় পর সকলে পুনরায় আবার এই অট্টালিকায় ফিরিয়া আসিলাম।

 এইখানে উপস্থিত হইয়া স্কল বলিলেন,— “যে-সকল কথা তোমাকে আমি এখন বলি, অতি মনোযোগের সহিত শুন। আপাততঃ যথাপ্রয়োজন টাকা লইয়া তুমি তোমার কার্য্য সমাধা করিবে। যে শিকড় তোমাকে আমরা দিলাম, তাহার গুণ এই যে, ইহা মাথায় থাকিলে, যতক্ষণ তুমি অট্টালিকার ভিতর থাকিবে, ততক্ষণ নাকেশ্বরী তোমার প্রাণবধ করিতে পরিবে না। অট্টালিকার বাহিরে শিকড় তোমাকে রক্ষা করিতে পরিবে না। শিকড়ের কিন্তু আর একটি গুণ এই যে, ইহা মাথায় থাকিলে যে জন্তুর আকার ধরিতে ইচ্ছা করিবে, তৎক্ষণাৎ সেই জন্তু হইতে পরিবে। ব্যাঘ্র হইতেছেন নাকেশ্বরীর ইষ্টদেবতা। সেজন্য যখন তুমি অট্টালিকার বাহিরে যাইবে, তখন ব্যাঘ্ররূপ ধরিয়া যাইবে। তাহা হইলে নাকেশ্বরী তোমাকে কিছু বলিতে পারিবে না। তাহার পর অট্টালিকার ভিতর প্রত্যাগমন করিয়া ইচ্ছা করিলেই মানুষ্যের মূর্ত্তি ধরিতে পরিবে। অতএব দুইটি কথা স্মরণ রাখিও, কোনও মতেই ভুলিবে না। প্রথম, এ একবৎসর শিকড়টি যেন কিছুতেই তোমার মাথা হইতে না যায়, যাইলেই মৃত্যু। তুমি যেখানে থাক না কেন, সেইখানেই মৃত্যু। দ্বিতীয়, ব্যাঘরূপ না ধরিয়া বাহিরে যাইবে না, এক মুহূর্ত্তকালের নিমিত্তও নিজরূপে বাহিরে থাকিবে না, থাকিলেই মৃত্যু, সেই দণ্ডেই মৃত্যু। একবৎসর পরে শিকড়টি দগ্ধ করিয়া সমুদয় ধনসম্পত্তি লইয়া দেশে চলিয়া যাইবে। এ একবৎসরের ভিতর যদি তুমি ধন না লইতে, তাহা হইলে এসব কিছুই করিতে হইত না। কারণ নাকেশ্বরী-রক্ষিত ধন

না লইলে, নাকেশ্বরী কাহাকেও কিছু বলে না, বলিতেও পারে না। যাহা হউক, একবৎসর পরে ধন ছাড়িয়া নাকেশ্বরী আপনার শ্বশুরালয়ে চলিয়া যাইবে। ঘ্যাঁঘোঁ ভূতের সহিত যখন তাহার বিবাহের কথা হয়, তখন লোকে কত না ভাঙচি দিয়াছিল!”

 আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,— “ভাঙচি কেন দিয়াছিল, মহাশয়?”

 স্কল বলিলেন,— “তুমি জান না, তাই পাগলের মত কথা জিজ্ঞাসা কর। বিবাহে ভাঙচি দিলে যেমন আমোদটি হয়, এমন আমোদ আর কিছুতে হয় না। তুমি একটি পাত্র কি পাত্রী স্থির করিয়া বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের মত জিজ্ঞাসা কর; তাঁরা বলিবেন, — ‘দিবে দাও! কিন্তু—'। ঐ যে 'কিন্তু' কথাটি, উহার ভিতর একজাহাজ মানে থাকে। যাহা হউক, যাহা বলি আর যা কই, ঘ্যাঁঘ্যোঁর বিবাহে অতি চমৎকার ভাঙচি দিয়াছিল। প্রশংসা করিতে হয়!”

 আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,— “ভাঙচি আবার চমৎকার কি, মহাশয়?”

 স্কল উত্তর করিলেন,— “সাতকাণ্ড,— সেই যা আমাদের নাম করিতে নাই,— তা পড়িয়া থাকিবে, কিন্তু ভূতের কাণ্ড তুমি কিছুই জান না। কি হারিয়াছিল বলিতেছি,—শুন! ঘ্যাঁঘোঁর সহিত বিবাহের কথা উপস্থিত হইলে, নাকেশ্বরীর মাসী পাত্র দেখিতে একটি ভূত পাঠাইয়া দিলেন। ঘ্যাঁঘোঁর বাটীতে সেই ভূত উপস্থিত হইলে, ঘ্যাঁঘোর তাঁহার বিশেষ সমাদর করিলেন। আহারাদি প্রস্তুত হইলে, তিনি নিকটস্থ একটি বিলের জলে স্নান করিতে যাইলেন। সেইখানে প্রতিবেশী ভূতগণও পরামর্শ করিয়া স্নান করিতে যাইলেন। তাঁহাদের মধ্যে একজন আগন্তুক ভূতকে জিজ্ঞাসা করিলেন,— 'মহাশয়ের নিবাস?' আগন্তুকক ভূত উত্তর করিলেন,— 'আমার নিবাস একঠেঙো মুলুকের ও-ধারে, বৌ-ভুলুনি নামক আঁবগাছে।” ঘ্যাঁঘোঁর প্রতিবেশী ভূত পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন,— 'এখানে কি মনে করিয়া আগমন হইয়াছে?’ আগন্তুক ভূত উত্তর করিলেন,— 'আমি ঘ্যাঁঘোঁকে দেখিতে আসিয়াছি।’ প্রতিবেশী ভূতগণ তখন জিজ্ঞাসা করিলেন, — ‘মহাশয়, তবে কি বৈদ্য?' আগন্তুক ভূত বলিলেন,— 'কেন? বৈদ্য কেন হইব? ঘ্যাঁঘ্যোঁর কি কোনও পীড়া-শীড়া আছে না-কি?' প্রতিবেশী ভূতগণ একটু যেন অপ্রতিভ হইয়া উত্তর করিলেন,— 'না না! এমন কিছু নয়! তবে একটু একটু খুক-খুক করিয়া কাসি আছে, তাহার সহিত অল্প-অল্প আলকাতরার ছিট থাকে, আর বৈকালবেলা যৎসামান্য ঘুষ ঘুষে জ্বর হয়। তা সে কিছু নয়, গরমে হইয়াছে, নাইতে-খাইতে ভাল হইয়া যাইবে।' এই কথা শুনিয়া আগন্তুক ভূতের তো চক্ষুস্থির! আর তিনি ঘ্যাঁঘ্যোঁর কাছে ফিরিয়া যাইলেন না! সেই বিল হইতে একবারে একঠোঙো মুলুকের ও-ধারে গিয়া উপস্থিত হইলেন। নাকেশ্বরীর মাসীকে সকল কথা বলিলেন। সম্বন্ধ ভাঙ্গিয়া গেল। নাকেশ্বরী একটি সুন্দরী ভূতিনী। তাহার রূপে ঘ্যাঁঘ্যো একেবারে মুগ্ধ হইয়াছিল! কতদিন ধরিয়া পাগলের মত সে গাছে গাছে কাঁদিয়া বেড়াইয়াছিল! তারপর মৌনব্রত অবলম্বন করিয়া অন্ধকূপের ভিতর বসিয়াছিল। যাহা হউক, অবশেষে বিবাহ যে হইয়া গিয়াছে, তাহাই সুখের কথা।”

 আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,— “শ্লেষ্মার সহিত আলকাতরা কি?”

 স্কল বলিলেন,— “তোমাদের যেরূপ রক্ত, আমাদের সেইরূপ আলকাতরা। কাসরোগে আমাদের বক্ষঃস্থল হইতে আলকাতরা বাহির হয়।”

 আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,— “যদি আমাদের মত ভূতদিগের রোগ হয়, তাহা হইলে ভূতেরাও তো মরিয়া যায়? আচ্ছা! মানুষ মরিয়া তো ভূত হয়, ভূত মরিয়া কি হয়?”

 স্কল উত্তর করিলেন,— “কেন? ভূত মরিয়া মারবেল হয়? সেই যে ছোট ছোট গোল গোল ভাঁটার মত মারবেল, যাহা লইয়া ছেলেরা সব খেলা করে!"

 আমি বলিলাম,— “মারবেল হয়। পৃথিবীতে এত বস্তু থাকিতে মারবেল হয় কেন?”

 স্কল আমার এই কথায় কিছু রাগতঃ হইয়া বলিলেন— “ভুল হইয়াছে! তোমার সহিত পরামর্শ করিয়া তারপর আমাদের মরা উচিত! এখন হইতে না হয় তাই করা যাইবে।”

 আমি বলিলাম,— “মহাশয়! আমার অপরাধ ক্ষমা করুন। আমি জানি না, তাই জিজ্ঞাসা করিতেছি! যদি অনুমতি করেন তো আর একটি কথা জিজ্ঞাসা করি,—ভূত মরিয়া যদি মারবেল হয়, তাহা হইলে মারবেল লইয়া খেলা করা তো বড় বিপদের কথা?”

 স্কল উত্তর করিলেন,— “মরা ভূত লইয়া খেলা করিতে আবার দোষ কি? হাঁ! জীয়ন্ত ভূত হইত! তাহা হইলে তাহার সহিত খেলা করা বিপদের কথা বটে!”

 স্কল পুনরায় বলিলেন— “তোমার সহিত আর আমাদের মিছামিছি বকিবার সময় নাই। আমরা কোম্পানী খুলিয়াছি, এখন গিয়া কোম্পানীর কাজ করি। আমরা 'স্কল স্কেলিটন এবং কোম্পানী’। আমরা কম ভূত নই। যেসব কথা বলিয়া দিয়াছি, সাবধানে মনে করিয়া রাখিবে। তা না হইলে বিপদে পড়িবে। এখন আমরা চলিলাম। আর তোমার সহিত আমাদের, সাক্ষাৎ হইবে না।”

 এই বলিয়া স্কল ও স্কেলিটন সেখান হইতে প্রস্থান করিলেন। অট্টালিকার ভিতর আমি একেলা বসিয়া রহিলাম। তাহার পর কি করিলাম, তাহা তুমি জান, বলিবার আর আবশ্যক নাই। কঙ্কাবতী! কথা এই! এখন সকল কথা তোমাকে বলিলাম।

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “তবে আমিও যাই, গিয়া নাকেশ্বরীর টাকা লই, তাহা হইলে আমাদের দুইজনকে সে একসঙ্গে মারিয়া ফেলিবে। পতিপরায়ণা সতীর ইহার চেয়ে আর সৌভাগ্য কি?”

 এই কথা বলিয়া কঙ্কাবতী উঠিবার উপক্রম করিতেছেন, এমন সময়ে এক অতি ভয়াবহ চীৎকারে সে স্থান পরিপূরিত হইল। অট্টালিকা কাঁপিতে লাগিল। দ্বার গবাক্ষ পরস্পরে আঘাতিত হইয়া ঝন-ঝন করিয়া শব্দ হইতে লাগিল। অট্টালিকা ঘোর অন্ধকারে আচ্ছাদিত হইল। প্রজ্বলিত বাতিটি নির্ব্বাণ হইল না বটে, কিন্তু অন্ধকারে আবৃত হইয়া গেল।

 খেতু বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! ঐ নাকেশ্বরী আসিতেছে।”

 কঙ্কাবতী এতক্ষণ শয্যার ধারে বসিয়াছিলেন। এখন তাড়াতাড়ি উঠিয়া ঘরের দ্বারটি উত্তমরূপে বন্ধ করিয়া দিলেন, আর দ্বারের উপর সমুদয় শরীরের বলের সহিত ঠেশ দিয়া দাঁড়াইলেন। নাকেশ্বরীকে তিনি ভিতরে আসিতে দিবেন না!

 অতি দুর্গন্ধে, নিবিড় অন্ধকারে, ঘন ঘন ঘোর গভীর শব্দে, ঘর পরিপূরিত হইল।

 ক্রমে শব্দ থামিল, অন্ধকার দূর হইল, বাতির আলোকে পুনরায় ঘর আলোকিত হইল। তখন কঙ্কাবতী দেখিতে পাইলেন যে, মৃতপ্রায় অচেতন হইয়া চক্ষু মুদ্রিত করিয়া, খেতু বিছানায় পড়িয়া আছেন। ভীমরূপা নাকেশ্বরী পার্শ্বে দণ্ডায়মানা, কঙ্কাবতী দৌড়িয়া গিয়া নাকেশ্বরীর পায়ে পড়িলেন।  কঙ্কাবতী বলিলেন,— “ওগো! তুমি আমার স্বামীকে মারিও না। আমি বড় দুঃখিনী, আমি কাঙ্গালিনী কঙ্কাবতী। কত দুঃখ পাইয়া আমি এই প্রাণসম পতিকে পাইয়াছি। পৃথিবীতে এই পতি ভিন্ন আর আমার কেহ নাই। ওগো! আমার স্বামীকে না মারিয়া তুমি আমার প্রাণবধ কর। তোমার পায়ে পড়ি, তুমি আমার স্বামীকে মারিও না। আমরা তোমার এ ধন চাহি না, কিছু চাহি না। আমার পতিকে তুমি দাও, আমার পতিকে লইয়া আমি ঘরে যাই। তোমার যাহা কিছু টাকা লইয়াছি, সব ফিরিয়া দিব। মানুষ খাইতে যদি তোমার সাধ হইয়া থাকে, তুমি আমাকে খাও, তুমি আমার রক্তপান কর। আমার স্বামীকে তুমি কিছু বলিও না, স্বামীকে আমার ফিরিয়া যাইতে দাও।”

 নাকেশ্বরীর পা ধরিয়া কঙ্কাবতী এইরূপে কঁদিতে লাগিলেন, নানামতে কাকুতি-মিনতি করিতে লাগিলেন। সে খেদের কথা শুনিলে পাষাণও দ্রব হইয়া যায়! নাকেশ্বরীর মনে কিন্তু কিছুমাত্র দয়া হইল না, নাকেশ্বরী সে কথায় কর্ণপাতও করিল না। কঙ্কাবতী যত কাঁদেন, আর নাকেশ্বরী বামহস্ত উত্তোলন করিয়া কেবল বলে,— “দূর! দূর!”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “ও গো! আমার স্বামীকে ছাড়িয়া আমি এখান হইতে দূর হইব না। আমার স্বামীকে দাও, আমি এখান হইতে এখুনি দূর হইতেছি। স্বামী স্বামী! উঠ। চল আমরা এখোন হইতে যাই; স্বামী উঠ!”

 কঙ্কাবতী যত কাঁদেন, যত বলেন, হাত উত্তোলন করিয়া নাকেশ্বরী তত বলে,— “দূর, দূর!”

 কঙ্কাবতী উঠিয়া দাঁড়াইলেন। চক্ষু মুছিলেন। তাহার পর আরক্তনয়নে দৰ্পের সহিত নাকেশ্বরীকে বলিলেন,— “আমার স্বামীকে দিবে না? আমাকেও খাইবে না? কেবল— 'দূর দূর’! মুখে অন্য কথা নাই? বটে! তা নাকেশ্বরী হও, আর যাই হও, আজ তোমার একদিন, কি আমার একদিন!”

 এই কথা বলিয়া পাগলিনী উন্মাদিনীর ন্যায়, কঙ্কাবতী নাকেশ্বরীকে ধরিতে যাইলেন। কোনও উত্তর না করিয়া নাকেশ্বরী কেবলমাত্র একটি নিশ্বাস পরিত্যাগ করিল। সেই নিশ্বাসের প্রবল বেগে কঙ্কাবতী একেবারে দ্বারের নিকট গিয়া পড়িলেন।

 কঙ্কাবতী পুনরায় উঠিলেন, পুনরায় উঠিয়া নাকেশ্বরীকে ধরিতে দৌড়িলেন। নাকেশ্বরী আর একটি নিশ্বাস ত্যাগ করিল, আর কঙ্কাবতী একেবারে অট্টালিকার বাহিরে গিয়া পড়িলেন।

 তখন কঙ্কাবতী আস্তে-ব্যস্তে পুনরায় উঠিয়া নাকেশ্বরীকে বলিলেন,— “ওগো! তোমাকে আমি আর ধরিতে যাইব না, তোমাকে আমি মারিব না। আমি আমার স্বামীকে আর ফিরিয়া চাই না। এখন কেবল এই চাই যে, স্বামী হইতে তুমি আমাকে পৃথক করিও না। স্বামীর পদযুগল ধরিয়া আমাকে মরিতে দাও। যদি মারিবে তো আমাদের দুইজনকেই একসঙ্গে খাও। আর তোমার কাছে আমি কিছু চাই না। তোমার নিকট এখন কেবল এই প্রার্থনাটি করি। ইহা হইতে তুমি আমাকে বঞ্চিত করিও না।”

 এই বলিয়া কঙ্কাবতী পুনরায় ঘরের দিকে দৌড়িলেন। কোনও কথা না বলিয়া নাকেশ্বরী আর একটি নিশ্বাস ছাড়িল, আর কঙ্কাবতী একেবারে পর্ব্বতের বাহিরে বনের মাঝখানে গিয়া পড়িলেন।