ইয়ুরোপে তিন বৎসর/১

উইকিসংকলন থেকে

ইয়ুরোপে তিন বৎসর।

প্রথম অধ্যায়।


জলপথে গমন; ১৮৬৮ সালের ৩রা মার্চ‌ অবধি ১১ই এপ্রিল পর্য্যন্ত।

 ৩রা মার্চ প্রাতে ৮॥৹ ঘণ্টার সময় আমরা আপনাদিগকে ও কলিকাতা নগর পরিত্যাগ করিয়া গঙ্গানদী দিয়া ডায়মণ্ড হারবার (পোতাশ্রয়)-স্থিত মূলতান নামক মেল ষ্টীমার অভিমুখে যাত্রা করিলাম। আমরা স্বদেশের কুটীরাবলী, ক্ষেত্রচর, গ্রাম সমুদয়, এবং গঙ্গার উভয় তীরস্থ নারিকেল, তাল এবং সুন্দর নিবিড় বন সকলের নিকট বিদায় লইয়া যত বঙ্গসাগরাভিমুখে যাইতে লাগিলাম, গঙ্গার পরিসর ততই বৃদ্ধি হইতে লাগিল। দুই প্রহর দেড় ঘণ্টার সময় আমরা মূলতান পোতের নিকটে পৌঁছিলাম। বিকালে উক্ত পোত নঙ্গর উঠাইল এবং আমরা অনতিবিলম্বে গঙ্গাসাগর সঙ্গমে আসিয়া পৌঁছিলাম। পরদিন প্রাতে চার ঘণ্টার সময় জাহাজ পুনরায় নঙ্গর উঠাইয়া সমুদ্রাভিমুখে যাত্রা করিল। বেলা দশ ঘণ্টার সময়ে আমরা সুবিস্তৃত সাগরে উপস্থিত। গঙ্গার রক্তাক্ত বারি এবং ঈষৎ হরিদ্বর্ণ সমুদ্র-জলের মধ্যস্থিত রেখা আমরা পরিষ্কাররূপে দেখিতে পাইলাম; জলের হরিদ্বর্ণ ক্রমেই গাঢ়তর দেখাইতে লাগিল, এবং আমরা সাগর মধ্যে আসিয়া উহার নিবিড় নীল জল দেখিতে পাইলাম। এক্ষণে চতুর্দ্দিকে আর কিছুই দেখা যায় না; কেবল গভীর নীলবর্ণ সাগর ও গভীর নীলবর্ণ নভোমণ্ডল। এই দর্শন নূতন ও চমৎকার, বিশেষতঃ তারাময় নিদাঘ-রাত্রিকালে যখন অবিরল তরঙ্গমালা চতুর্দ্দিকে উঠিতে থাকে, যখন নির্মেঘ চন্দ্রালোকে শ্বেতবর্ণ ফেননিচয় ইতস্ততঃ উজ্জ্বলাকারে ক্ষণমাত্র বিরাজ করিয়া নীল জলে মিশাইয়া যায়, যখন উজ্জ্বল-কলেবর সমুদকীট সমুদয় নক্ষত্রমালার ন্যায় শুভ্র ফেণার উপর দর্শন দেয়, তখন যে উহা কি অপরূপ রূপ ধারণ করে, তাহ সমাকরূপে বর্ণন করা সুকঠিন।

 ৭ই মার্চ প্রত্যুষে আমরা জাহাজের উপর হইতে করোমেণ্ডেল উপকূলের বালুকাময় তট দেখিতে পাইলাম। ঐ কুলের নিকট দিয়া চারি পাঁচ ঘণ্টা আসার পর, প্রাতে দশ ঘণ্টার সময় মান্দ্রাজ নগরে উপনীত হইলাম। ভূমিতে অবতীর্ণ হইয়া মান্দ্রাজের দুর্গ, পিপেলস্ পার্ক, ও সুন্দর চিড়িয়াখানা সন্দর্শন করিলাম। মান্দ্রাজবাসিগণ বাঙ্গালিদিগের অপেক্ষ কৃষ্ণবর্ণ। তাহাদিগের মুখাকৃতি ও পরিচ্ছদ কলিকাতার খোট্টাদের সদৃশ। গুহ সমুদয় নীচ, অদ্ভুতগঠন এবং কুচিত্রিত অথবা কুসজ্জিত ও কলিকাতার খোট্টাগণের বাটীর ন্যায় বোধ হয়। প্রায় চারি ঘণ্টার পর, আমরা ষ্টীমারে প্রত্যাগত হইলাম। মান্দ্রাজ কলিকাতা অপেক্ষা উষ্ণ এবং বাসের পক্ষে অসুখজনক। আমরা গঙ্গানদীর মুখে ষে সকল সমুদ্রচর বিহঙ্গম দর্শন করিয়াছিলাম, তদ্রূপ পক্ষী মান্দ্রাজের নিকটে দৃষ্টিগোচর হইল। যৎকালে আমরা সাগরতরঙ্গে আন্দোলিত হইতেছিলাম, তৎকালে ঐ সকল পক্ষী সহস্র দলবদ্ধ হইয়া উত্তাল তরঙ্গের সহিত উঠিতে ও নামিতে লাগিল; বোধ হইল, যেন সাগরের নিবিড় নীলকলেবরে শুভ্র অলঙ্কাররাশি পরিশোভিত হইয়া রহিয়াছে।

 ১০ই মার্চ প্রাতে লঙ্কাদ্বীপের প্রস্তরময় উপকূল নয়নপথে পতিত হইল। যখন কেবল নির্জীব ও অচল পদার্থদ্বারা লোকে পরিবেষ্টিত থাকে, তখন সজীব ও সচল পদার্থমাত্রেই মনোহরণ করে। কি সমুদ্রচর বিহঙ্গ, কি উড্ডীন মৎস্য, কি গমনশীল ষ্টীমার, যাহা দেখা গেল তাহাই চিত্তাকর্ষণ ও মনোরঞ্জন করিতে লাগিল; এবং সে রমণীয়তা দূরদৃষ্ট ভূমিতল দেখিতে দেখিতে ক্রমেই বর্দ্ধিত হইতে লাগিল। আমি এই প্রথমে পর্ব্বত দর্শন করিলাম। সিংহলের দূরস্থ পর্ব্বত অতি মনোহর মেঘমালার ন্যায় বোধ হইল।

 ১১ই মার্চ প্রাতে প্রায় ৭ ঘণ্টার সময় আমরা গালে পৌছিলাম; এবং আহারাদি সমাপন করণানন্তর ধূমপোত হইতে নামিয়া একখানি ক্ষুদ্র তরিযোগে সিংহলে অবতরণ করলাম। ঐ স্থানটী এক অবিচ্ছিন্ন উপবন বোধ হইল। নারিকেল ও বাঁশ এবং নানাবিধ বৃক্ষ, সুন্দর ও সুগঠন পথের উপর লম্বিত রহিয়াছে, এবং সেই ছায়াময় তরুসমূহের ভিতর দিয়া সামান্য কিন্তু পরিষ্কার কুটার সকল শোভা পাইতেছে। এই স্থানকে স্বর্ণময় বর্ণনা করিয়া বাল্মীকি অত্যুক্তি দোষে দূষিত হইয়াছেন, এ কথা বলা সঙ্গত বোধ হয় না।

 প্রায় এক ঘণ্টার মধ্যেই আমরা ওয়াকালীতে উপস্থিত হইলাম। এ স্থানের এত অধিক সৌন্দর্য্য যে তাহা বর্ণনা করিতে বর্ণনাশক্তি পরাভব মানে। বহু দূরে ধূসরবর্ণ শৈলশ্রেণী আমাদিগের নয়ন-পথ অবরোধ করিল। এখান হইতে, এডামস্ পীক দেখা যায়। উহার কিয়দ্দূরে তরঙ্গমালার ন্যায় উচ্চ ও নীচ বৃক্ষশ্রেণী অবিচ্ছেদে বিরাজ করিতেছে, সন্নিকটে কতই ক্ষেত্র ও পরিষ্কার পথ আছে এবং ক্ষুদ্র নদী ও খাল সর্পের ন্যায় বক্রভাবে ক্ষেত্র দিয়া প্রবাহিত হইতেছে। বিদেশীয় লোক এখানে আসিলে দেশীয়গণ নানাবিধ সামগ্রী বিক্রয়ার্থ আনয়ন করে—যথা অঙ্গুরী, দারুচিনি ইত্যাদি। তাহারা ক্রেতাদিগকে ঠগাইবার বিস্তর চেষ্টা করে। আমি এক উদাহরণ দিতেছি—আমার এক বন্ধু একটা অঙ্গুরীয় ক্রয় করিয়াছিলেন এবং আমার যতদূর স্মরণ হয়, বিক্রেতা ও ক্রেতার মধ্যে এইরূপ কথোপকথন হইয়াছিল—

সিংহলী। মহাশয়, অঙ্গুরী চাই, অঙ্গুরী; লঙ্কার হীরা, সোণা, মহাশয়?

বন্ধু। না, আমরা চাহি না।

সিংহলী। লঙ্কার হীরা, মহাশয়, লন না মহাশয়; একবার হাতে দিয়া কেন দেখুন না মহাশয়?

বন্ধু। আচ্ছা, দাম কি?

সিংহলী। ত্রিশ টাকা।

বন্ধু। আমি লইব না।

সিংহলী। আচ্ছা আপনি কি দিবেন, বলুন না কত টাকা দিবেন, বলুন, মহাশয়?

বন্ধু। আমি লইব না।

সিংহলী। লন, মহাশয়, লন। কয় টাকা দিবেন? লঙ্কায় হীরা; বড় উত্তম; বলুন না মহাশয় কত টাকা দিবেন?

বন্ধু। আট আনা।

সিংহলী। আট আনা! আচ্ছা, লন মহাশয়।

 ওয়াকালী পরিত্যাগ করিয়া আমরা দারুচিনির বাগানে গেলাম। সেই বাগান অতি সুন্দর, তথা হইতে আমরা একটা সিংহলদেশীয় মন্দির দেখিতে গেলাম, উহার পুরোহিত আমাদিগের নিকটে সমাগত হইল এবং যাবতীয় প্রতিমা ও দর্শনযোগ্য সমস্ত বিষয় আমাদিগকে দেখাইল। এখানে গৌতম মুনির অষ্টাদশ হস্ত উচ্চ এক প্রতিমুর্ত্তি সন্দর্শন করিলাম। সিংহলীরা বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বী। কি আশ্চর্য্য যে, উল্লিখিত পুরোহিত রামরাবণের বিষয় কিছুমাত্র অবগত নহে। ঐ মন্দির যে সমস্ত পাদপপুঞ্জে আচ্ছাদিত আছে, আমরা তাহার ছায়ায় প্রস্তরখণ্ডের উপর বসিয়া সুমিষ্ট নারিকেলের জল যে কি রুচিপূর্ব্বক পান করিলাম, তাহা আমি বর্ণন করিতে পারি না।

 সন্ধ্যার সময় অতি সুখে হোটেলে আহার করিলাম, তথায় অন্যান্য খাদ্যসামগ্রীর সহিত আমাদিগের পূর্ব্ব-পরিচিত ইলিস মৎস্য পাওয়া গিয়াছিল। অনতিবিলম্বে আমরা বাষ্পপোতে আসিয়া উপনীত হইলাম।

 মার্চ মাসের ১৯ দিবসে আমরা সোকোট্রা ও আফ্রিকার মধ্য দিয়া আসিলাম। প্রত্যূষে আফ্রিকার উচ্চ শৈলশ্রেণী নয়নগোচর হইল; বোধ হইল যে, উহা এক ক্রোশ মাত্র দূরে আছে, কিন্তু শুনিলাম যে, সে পর্ব্বত দশ ক্রোশ অন্তর ও প্রায় ৮০০০ ফিট্ উচ্চ। ২১এ প্রাতঃকালে এডেন নগরস্থ পর্ব্বত ও পাহাড় দৃষ্টিগোচর হইল। প্রাতে আহারাদি করিয়া উক্ত নগর দেখিতে গেলাম; দেখিলাম নগর অতি কদর্য্য, কেবল অনুর্ব্বরা দগ্ধ পাহাড় উহার চতুঃসীমা বেষ্টন করিয়া আছে, কোন প্রকার উদ্ভিজ্জের সহিত প্রায় সাক্ষাৎ হয় না। কেবল এখানে ওখানে দূর্ব্বাদল-মণ্ডিত কিম্বা একমাত্র বৃক্ষ-আচ্ছাদিত ভূমিখণ্ড দেখিয়া নয়নযুগল তৃপ্ত হয়। এই অনুর্ব্বরা পর্ব্বত হইতে কেমন করিয়া সেই বৃক্ষ রসাকর্ষণ করিয়া থাকে, তাহা আমার বৃদ্ধির অগোচর।

 এই স্থানের অধিবাসিগণ কতক আরব ও কতক আফ্রিকা দেশস্থ; তাহারা কৃষ্ণবর্ণ ও কুগঠন; তাহাদিগের ধাতু এখানকার জলবায়ু ও মৃত্তিকার উপযোগী, বালক বালিকারাও উগ্ররশ্মি সূর্য্যের উত্তাপ ও তপ্ত বালুকাকে ভয় করে না; এমন কি কেহ কেহ প্রায় অর্দ্ধ ঘণ্টা পর্য্যন্ত আমাদিগের শকটের সঙ্গে সঙ্গে দৌড়িতে লাগিল এবং তাহাতে যে তাহাদের কিছুমাত্র কষ্ট বা শ্রম বোধ হইতেছে, তাহা বুঝিতে পারিলাম না। উহারা সন্তরণ বিদ্যায় বিলক্ষণ পটু, যখন আমরা স্টীমারের উপর ছিলাম, তখন কতিপয় বালক বালিকা সন্তরণ করিয়া জাহাজের চতুষ্পার্শ্বে পয়সা ভিক্ষা করিতে তাসিয়াছিল। সমুদ্রজলে মুদ্রাখণ্ড ফেলিয়া দিতে না দিতে তাহারা ডুব দিয়া উঠাইয়া আনে এবং আরও পাইবার প্রার্থনা করে। বস্তুতঃ তন্মধ্যে এক জন ডুব দিয়া জাহাজের এক পার্শ্ব হইতে অপর পার্শ্বে যাইতে চাহিয়াছিল; এবং আমার বোধ হয়, সে তাহা করিতে পারিত। তাহারা সমুদ্র-জল জন্তুর ন্যায় বহুক্ষণ পর্য্যন্ত ভাসিয়াছিল।

 এডেন নগরের দুর্গ অতি দুষ্প্রবেশ, কেন না ঐ স্থান প্রস্তরময়। এখানকার জলাশয় দেখিবার যোগ্য বটে। এখানে জল এত দুষ্প্রাপ্য যে নিবাসিগণ একটা চতুর্দ্দিকে প্রাচীর কি পর্ব্বতদ্বারা বেষ্টিত স্থান রাখিয়া দেয়, বর্ষাকালে উহা জলে পরিপূর্ণ হইয়া থাকে এবং যাবতীয় লোক সমস্ত বৎসর তথা হইতে জল প্রাপ্ত হয়। এই জলাশয়ে যাইবার সুগঠন পথ, পথিমধ্যে বসিবার স্থান এবং পর্ব্বতে খোদিত সোপান প্রস্তুত আছে।

 পর দিন প্রাতে এডেন পরিত্যাগ করিয়া অপরাহ্ণ প্রায় ৬ ঘণ্টার সময় বেবেলমেণ্ডেব প্রণালী দিয়া সমাগত হইলাম। এক দিকে আরবদেশীয় পাহাড়, অন্য দিকে পেরিম নামক ক্ষুদ্র দ্বীপ এবং তাহার পশ্চাতে আফ্রিকার উচ্চ পর্ব্বতশ্রেণী দৃষ্টিগোচর হইল।

 লোহিত সমুদ্রের মধ্যে কোথাও বা ক্ষুদ্র পাহাড় সকল সরোষে নীরোপরি মস্তকোত্তোলন করিয়া রহিয়াছে, কোথাও বা জলমধ্যে লুকাইয়া আছে, এই উভয় কারণে লোহিত সমুদ্রে গমনাগমন এত বিপদজনক হইয়াছে।

 ২৭শে প্রাতে আমরা সুয়েজ উপসাগরে প্রবেশ করিলাম। আমাদিগের উভয় দিকেই ভূমি, সমুদ্রের জল যারপর নাই সুস্থির; উহার উপরিভাগ একখণ্ড প্রকাণ্ড কাচের ন্যায় বোধ হইল। আফ্রিকার পীতবর্ণ পাহাড় সকল দিবাকরের লোহিত কিরণ-জালে উজ্জ্বলিত এবং তাহার অতি পশ্চাতে ধুসরবর্ণ উচ্চতর শৈলশ্রেণী আমাদিগের নয়ন-পথ অবরোধ করিল। স্থানে স্থানে প্রস্তরময় দ্বীপচয় নয়নগোচর হইল। উহা নিরালয় ও অনুর্ব্বরা; একটাও বৃক্ষ কি লতাপল্লব দেখা যায় না। রাত্রি ১১ ঘণ্টার সময় আমরা সুয়েজে উপনীত হইলাম। রজনী অন্ধকারাবৃত, কিন্তু পোতাশ্রয়স্থিত জাহাজ ও ষ্টীমার হইতে বিনির্গত অসংখ্য দীপশিখা আমাদিগের নয়নানন্দদায়িনী হইল। আমরা সুয়েজের নিকট মূলতান ষ্টীমারকে ত্যাগ করিলাম। উক্ত জাহাজ অতীব সুন্দর, উহা দীর্ঘে ২৩২ হস্ত ও প্রস্থে ২৬ হস্ত। উহা জল হইতে ১২ হাত উচ্চ বটে, কিন্তু ঝড়ের সময় সমুদ্রের ঢেউ উহার উপর দিয়া চলিয়া যায়। আমরা অপর এক ষ্টিমারযোগে সুয়েজে পৌঁছিলাম এবং অপরাহ্ণে রেলগাড়িতে আলেকজাণ্ড্রিয়া নগর অভিমুখে চলিলাম। এ মিসরদেশীয় রেল শকট, সুতরাং তাহার সমুদয় বন্দোবস্ত গোলমাল; কেহই বলিতে পারিল না যে কখন গাড়ি ছাড়িবে। আমরা শকট মধ্যে সাধ্যানুসারে সহিষ্ণুতার সহিত কালযাপন করিতে লাগিলাম, গাড়ি আর ছাড়ে না। কখন ডং ডং করিয়া ঘণ্টা বাজে, কিন্তু সে শেষ ঘণ্টা নহে; কখন বংশীধ্বনি শুনা যায়, কখন বা গাড়ি একটু নড়িয়া চড়িয়া থাকে, কিন্তু তখনও ছাড়িবার সময় উপস্থিত হয় নাই। গাড়ির প্রহরীগণ সগর্ব্ব ও গম্ভীরভাবে ইতস্ততঃ যাতায়াত করিতেছে, গাড়ি এক স্থানেই রহিয়াছে, যেন পর্ব্বতের ন্যায় অচল। পরিশেষে প্রায় দেড় ঘণ্টার পর আমাদিগের দুঃখশান্তি করিতে গাড়ি চলিতে লাগিল, এবং আমরাও মহা কুতূহলে আলেকজাণ্ড্রিয়া নগর দর্শনে যাত্রা করিলাম।

 প্রাতে আলেকজাণ্ড্রিয়া নগরের নিকট পৌঁছিয়া মাছিলা নাম্নী স্টিমারে উঠিলাম। কিন্তু উহা পরদিন প্রভাতের পূর্ব্বে যাইবে না শুনিয়া উল্লিখিত সৌন্দর্য্যশালী নগর সন্দর্শনে যাত্রা করিলাম। দেখিলাম পথ সকল প্রশস্ত, গৃহ সমুদায় বৃহৎ ও সুগঠন। আমরা শকটারোহণ পূর্ব্বক এক সুরম্য উদ্যান দিয়া পম্‌পীর স্তম্ভ দেখিতে গেলাম। উহার চতুর্দ্দিক অনাবৃত, মধ্যভাগে মর্ম্মর-প্রস্তর-বিনির্ম্মিত ৬৫ হস্ত উচ্চ সেই স্তম্ভ! উহা নির্ম্মল আকাশ স্বরূপ চিত্রপটে চিত্রিত এক গৌরবান্বিত ছবির ন্যায় বিরাজ করিতেছে। মিসরদেশীয় পৌত্তলিকতার সাক্ষ্য স্বরূপ দেবতাগণের প্রতিমূর্ত্তির কতই ভগ্নাবশেষ ঐ স্তম্ভের চতুষ্পার্শ্বে বিকীর্ণ রহিয়াছে এবং শত শত কি সহস্র সহস্র বৎসর পর্য্যন্ত তদবস্থায় পতিত আছে। যে দিকে নয়ন ফিরান যায়, সেই দিকেই কেবল ভগ্নাবশেষ ভিন্ন আর কিছুই দেখা যার না। যে জাতি একসময়ে সভ্য ও সৌভাগ্যশালী ছিল, তাহার গৌরবের পরিচয়-স্থান রাজপ্রাসাদ, মন্দির ও স্তম্ভ, রাজদরবার ও ধর্ম্মোৎসব প্রভৃতির চিহ্ন দর্শন করিয়া তৎসমুদায়ের নশ্বরত্ব মনে পড়; এবং জ্ঞান হয় যে, মনুষ্যের গৌরব রবমাত্র ও অহঙ্কার উন্মত্ততা ভিন্ন আর কিছুই নহে। যখন আমরা সেই স্থান ত্যাগ করিলাম, তখন প্রায় অন্ধকার হইয়াছে, এবং যত আমদিগের শকট চলিতে লাগিল, ততই ঐ স্তম্ভ উচ্চতর ও সন্ধ্যাকালীন ঈষৎ অন্ধকারাবৃত আকাশে খোদিত ছবির ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। এস্থান হইতে আমরা ক্লিওপেট্‌রার স্তম্ভ দেখিতে গেলাম। ইহাও মর্ম্মর-প্রস্তর-বিনির্ম্মিত, প্রায় ৫০ হস্ত উচ্চ, ও উহার অগ্রভাগ সূচাগ্রেরে ন্যায়। সন্ধ্যার সময় অতি সুখে পথে পথে ভ্রমণ করণানন্তর আমরা স্টীমারে আগত হইলাম; এ সময়ে মিসরদেশে বড় শীত, এমন কি পৌষ মাস মাসে কলিকাতায় যত শীত হইয়া থাকে, তদপেক্ষাও অধিক। মিসরের একভাগ শুদ্ধ বালুকাময় মরুভূমি, কিন্তু ডেল্‌টার ও নাইলনদীর তীরস্থ ভূমি, পৃথিবীর মধ্যে যত উর্ব্বরা ভুমি আছে, তাহাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। মীসরবাসীরা বলবান ও হৃষ্টপুষ্ট এবং গৌরবর্ণ। আলেকজাণ্ড্রিয়াতে কৃষ্ণবর্ণ ও কদাকার কাফ্রি, এবং আবিসিনিয়ান ও ইয়ুরোপীয়, বিশেষত ফরাসিদেশীয় বহুতর লোক বাস করে।

 ২রা এপ্রেল বেলা ১১॥৹ ঘণ্টার সময় আমরা মাল্‌টা দ্বীপে উপনীত হইলাম। আমার পক্ষে এই স্থানের দর্শন অভিনব পরিষ্কার প্রস্তরময় পথ, তাহার উভয় পার্শ্বে সুন্দর এবং সম নির্ম্মিত হর্ম্ম্যাবলী, বৃহৎ সুসজ্জিত দোকান এবং পথে ও বাজারে শুভ্রবদন হাজার হাজার লোকের সমাগম দেখিয়া শুনিয়া স্পষ্টই বোধ হয় যে, এ ইয়ুরোপদেশীয় নগর। এরূপ নগর আমি এই প্রথম দেখিলাম। আমরা শকটারোহণে একটা উদ্যানে গেলাম। পূর্ব্বে এই উদ্যান মাল্‌টার সুবিখ্যাত যোদ্ধা গণের নিবাসস্থান ছিল। ঘন, হরিদ্বর্ণ ও সুন্দর শ্রেণীবদ্ধ সাইপ্রেস বক্ষ বিরাজ করিতেছে, সুগঠন জলস্তম্ভ সমুদায় এখানে ওখানে বারি বর্ষণ করিতেছে, শীতল ছায়াময় এবং প্রস্তরনির্ম্মিত পথ এবং অগণনীয় লেবু ও কমলার বৃক্ষ দেখা বাইতেছে। কমলা বৃক্ষ হইতে সুপক্ব কতই কমলালেবু লম্বিত রহিয়াছে, দেখিলে নয়নের আনন্দ ও চিত্তের প্রফুল্লতা জন্মে। এখানে কমলালেবুকে রক্তকমলা কহে। উহার অভ্যন্তর সম্পূর্ণ বক্তবর্ণ। আমরা কতিপয় লেবু ভক্ষণ করিলাম, উহা কলিকাতার কমলা অপেক্ষা অধিক সুস্বাদু বোধ হইল। গবর্ণর সাহেবের প্রাসাদ দেখিবার উপযুক্ত বটে, তথায় একটি অপ্রশস্ত আগার মধ্যে মাল্‌টার অবিবাহিতা যোগিনীগণের কৃত সুশোভিত ও জীবিতের ন্যায় নানাবিধ ছবি সন্দর্শন করিলাম। ভূমণ্ডলের মধ্যে যেখানে যেরূপ বস্তু দেখিতে পাওয়া যায়, এমন কি গ্রীষ্মপ্রধান দেশজ তাল ও খর্জ্জুর বৃক্ষ ও কৃষ্ণবর্ণ মনুষ্য সকলই তন্মধ্যে চিত্রিত রহিয়াছে। ইংলণ্ডের রাজা চতুর্থ জর্জের এক প্রতিমূর্ত্তি আছে, তাহার পার্শ্বে দুইটা স্ত্রীলোকের ছবি, ইংলণ্ড ও মাল্‌টার সুরচিত প্রতিকৃতি। এই নারীদ্বয়ের অশ্বকেশর বিনির্ম্মিত তাজ ও হস্তে বর্শা আছে, ইহা দেখিতে অতি চমৎকার। আর মাল্‌টার সুবিখ্যাত বীরগণ, যাহারা দেশের দেশের স্বাধীনতারক্ষার্থে প্রাণদান করিয়াছেন, তাঁহাদিগের প্রতিমূর্ত্তিগুলি অপর এক গৃহে বিরাজিত আছে।

 মাল্‌টা দ্বীপে সেণ্ট জনের যে একটা মন্দির আছে, উহার গঠন অতীব চমৎকার; এবং পরিশ্রম ও শিল্পকর্ম্মদ্বারা যে যে উৎকৃষ্ট বস্তু নির্ম্মিত হইতে পারে, তত্তাবতই তথায় আছে। গৃহের ভিতর গিয়া দেখি যে, উহার ছাদ অতি সুচারুরূপে চিত্রিত, চতুর্দ্দিকে ইটালীর প্রধান প্রধান শিল্পকার-গঠিত প্রতিমুর্ত্তি, এবং সম্মুখে স্বর্ণ ও রৌপ্য-খচিত সিংহাসনের ন্যায় জাজ্জ্বল্যমান একটা বেদি আছে, মেঝে শ্বেত প্রস্তরে নির্ম্মিত ও উহার নীচে মাল্‌টার বীরপুরুষগণের সমাধিস্থান। রোমান কেথলিক ধর্ম্মের বাহ্যাড়ম্বরই প্রধান অবলম্বন, বিবেচনাশক্তি তত অধিক নহে। সুগঠিত প্রতিমূর্ত্তি, সুরচিত চিত্র, শিল্পকার্য্যে নৈপুণ্য, এই সকল উপায় দ্বারাই তাহাদিগের মনে অনুতাপ, শ্রদ্ধা ও ভক্তির উদ্রেক হয়। অধিকন্তু ইটালীদেশীয়েরা অত্যন্ত ভাবুক এবং শিল্পবিদ্যায় ইয়ুরোপের অন্যান্য সকল জাতি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ; এবং তাহারা জাতীয় ধর্ম্ম রক্ষার নিমিত্তে মানসিক ভাব সঞ্চালন না করিয়া আর কোথায় করিবে। এই নিমিত্তেই ইটালীদেশীয় মন্দির সমুদায় চিত্র ও ভাস্কর কার্য্যে, সজ্জা, গাম্ভীর্য্য ও গৌরবে পৃথিবীর তাবৎ মন্দির অপেক্ষা উৎকৃষ্ট।

 এই মন্দিরে দয়ার একটা প্রস্তরময় প্রতিমূর্ত্তি আছে, এক সীমন্তিনী যেন আপন শিশু সন্তানকে স্তনপান করাইতেছেন। আর আপন ক্রোড়স্থ সন্তানের মুখচন্দ্র অনিমিষনেত্রে নিরীক্ষণ করিয়া মাতার স্থির ও নিম্মলবদনে কি অনির্ব্বচনীয় সুশীলতা ও সুকুমার বাৎসল্যভাব প্রকাশ পাইতেছে। যতগুলি ছবি আছে, তন্মধ্যে মাইকেল এঞ্জিলো কর্ত্তৃক চিত্রিত খৃষ্টের জন্মস্থানের ছবি সর্ব্বোৎকৃষ্ট। ভূগর্ভস্থ এক গৃহে কএক জন সুপ্রসিদ্ধ লোকের সমাধিস্থান দেখিলাম। আরো দেখিলাম, চিরকুমারী যোগিনীগণ কোথাও বা প্রস্তর-গঠিত মূর্ত্তির নিকট, কোথাও বা চিত্রের নিকট উপবেশন করিয়া আপাদমস্তক কৃষ্ণবসনাবৃত হইয়া ও পুস্তক হস্তে লইয়া উপাসনায় নিবিষ্টা রহিয়াছে। অপরাহ্ণ ৩॥৹ ঘণ্টার সময় আমরা স্টীমারে প্রত্যাগত হইলাম এবং বেলা ৫টার সময় উহা মাল্‌টা দ্বীপ পরিত্যাগ করিল।


স্বদেশ-ভবন।

দাঁড়াইয়া জাহাজের বক্ষের উপর,
অনন্ত অর্ণব-বারি হেরি নিরন্তর।
সুদূরে ভূধর-খণ্ড নীলকান্তি ধরে,
আনন্দে সাগর-পক্ষী কলরব করে।
দেশ দেশান্তরে করি যদিও ভ্রমণ,
সতত হৃদয়ে জাগে স্বদেশ-ভবন!

হেরিয়াছি সিংহলের সুরভি কানন,
সুগন্ধেতে স্নিগ্ধ যথা বসন্ত পবন,
হেরিয়াছি এডেনের শৈলরাশি সার,
ঊর্ম্মিরাশি বৃথা বাহে করিছে প্রহার।
দেশ দেশান্তরে করি যদিও ভ্রমণ
সতত হৃদয়ে জাগে স্বদেশ-ভবন।

হেরিয়াছি পম্পীস্তম্ভ,—আকাশ ভেদিয়া
যুগ যুগান্তর হতে আছে দাঁড়াইয়া;
হেরিয়াছি মাল্‌টার মন্দির, কানন,
অনন্ত নিদ্রায় যথা সুপ্ত যোদ্ধাগণ;
দেশ দেশান্তরে করি যদিও ভ্রমণ
সতত হৃদয়ে জাগে স্বদেশ-ভবন!

যত দিন দেশে দেশে করিব ভ্রমণ
মাতৃভূমি! তব দুঃখে করিব রোদন।
হেরিয়া টেমস্‌ নদী কিম্বা দ্রুত রোন্‌
স্মরিব জাহ্ণবীকূল করিব রোদন।
দেশ দেশান্তরে করি যদিও ভ্রমণ
সতত হৃদয়ে জাগে স্বদেশ-ভবন!


সুন্দর বসন্ত।

সুন্দর বসন্ত এবে নব কান্তি ধরে
ক্ষেত্র, বৃক্ষ, পল্লবিনী, কিবা শোভা করে।
মাতৃভূমি! বসন্তেতে কিবা তব শোভা!
নিকুঞ্জ, কানন, পুষ্প, অতি মনোলোভা!
বৎসরের এই কাল অতীব সুন্দর
কোন্ ঋতু বসন্তের সম সুখকর!
বৃদ্ধের নয়ন পুনঃ প্রফুল্লিত হয়,
স্বপ্নসম বোধ হয় যৌবন সময়।

সুন্দর বসন্তকান্তি! শোভিল ধরায়
নিরানন্দ প্রবাসীর কি সুখ তাহায়!
মাতৃভূমি পরিহরি বিদেশে ভ্রমণ
অনন্ত সমুদ্র-বক্ষে করি পর্য্যটন।
চারি দিকে ঊর্ম্মিরাশি ভীষণ কল্লোলে
উল্লাসে প্রমত্ত যেন আস্ফালিয়া চলে।
প্রবল সাগর-বায়ু উচ্চরবে ধায়
প্রবাসীর কর্ণে যেন দুঃখ-গান গায়!

সুন্দর বসন্ত যথা জগতে পশিছে,
জীবন-বসন্ত মম যৌবনে উদিছে!
ঐ শোন! যশোদেবী ভৈরব নিস্বনে,
ডাকে মোরে, যুঝিবারে যশের কারণে।
সমর সময়ে কেন ভীরু চিন্তা করি,
দুরে যাক্ বিষণ্ণতা,—চিন্তা,—অশ্রুবারি।
নির্ভয়ে যুঝিব আমি যশের কারণ,
নাহি খেদ, হয় যদি শরীর পতন!

 দূর হইতে জিব্রল্‌টার নগর ও পাহাড় নয়নগোচর হইল; বোধ হইল যেন, চিত্রপটে একটা সুন্দর আলেখ্য লিখিত হইয়াছে। এই নগরের আরব্য নাম জেবেল-আল্‌তারিক অর্থাৎ তারিকের পাহাড়—তারিক নামে এক মুসলমান সেনাপতি পূর্ব্বকালে স্পেন রাজ্য অধিকার করিয়াছিলেন। তাঁহারই নামে নগরের নাম হইয়াছে। তারিক যখন স্পেন রাজ্যে পদার্পণ করেন, তখন তাহার অনুচরেরা অপরিচিত পর্ব্বতময় স্থানে ও শতগুণ অধিক সেনাদলের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া অত্যন্ত ভীত হইয়াছিল; তাহাতে তারিক আপন সেনাগণকে কহিয়াছিলেন, “তোমরা কোথায় পলাইবে, সম্মুখে দেখ শত্রুগণ, পশ্চাতে ভীষণ সমুদ্র।” মুসলমানেরা আপনাদিগের ভীরুতা হেতু লজ্জিত হইয়া মহাবেগে শত্রুগণকে আক্রমণ করিয়া জয়লাভ করিল। তারিক যেখানে যত যুদ্ধ করিয়াছিলেন, তাহাতেই এই প্রকার সাহস প্রকাশ করিয়াছিলেন; এবং পরিশেষে তিনি স্পেনের প্রায় সকলাংশই স্বায়ত্ত করিয়াছিলেন।

 জিব্রল্‌টারের পাহাড় ও দুর্গ দর্শনযোগ্য বটে। ঐ নগরের পথে পথে কিয়ৎক্ষণ ভ্রমণ করিয়া অপরাহ্ণ ৬ ঘণ্টার সময় আমরা স্টীমারে প্রত্যাবর্ত্তন করিলাম। পর দিন সেণ্টভিন্‌সেণ্ট অন্তরীপের নিকট দিয়া আসিলাম, তথায় অনেক বৃহদাকার পাহাড় এবং তাহার একটার উপর এক আলোক-স্তম্ভ আছে। রাত্রিকালে ফিনিষ্টর অন্তরীপ অতিক্রম করিয়া আসিলাম। ৯ই দিবসে ফ্রান্সের মধ্যে বেষ্ট্ নগরের নিকট উসাণ্ট অন্তরীপ জনগোচর হইল। এখানেও একটা সুগঠন আলোক-স্তম্ভ আছে। ১১ই দিবসে ওয়াইট দ্বীপের নিকট দিয়া গমন করিলাম। এই দ্বীপ দেখিতে অতি সুশ্রী, বোধ হয় যেন উহা এক বৃহৎ উপবন; উপবন বটে, কিন্তু মনুষ্যকৃত। ভারতবর্ষের ন্যায় এখানে বন, উচ্চ পল্লবময় বৃক্ষ, ঘন এবং সতেজ উদ্ভিদ দেখা যায় না। এখানে উৎকৃষ্ট উদ্যান, মনোহর হর্ম্ম্যশ্রেণী, হরিদ্বর্ণ ক্ষেত্র, সকল বস্তুই মনুষ্য-নিবাসের পরিচয় দেয়। ১১ই এপ্রেল পূর্ব্বাহ্ন ১১ ঘণ্টার সময় আমরা সৌদ্যম্‌টনে পৌঁছিলাম; এবং সন্ধ্যার সময় লণ্ডন নগরাভিমুখে যাত্রা করিলাম ও রাত্রিতে সেই সমগ্র পৃথিবীর রাজধানীতে উপস্থিত হইলাম।

 পথিবীস্থ সর্ব্বত্রই জানা আছে যে, লণ্ডন অতি প্রকাণ্ড নগর। উহার নিবাসীর সংখ্যা প্রায় ৪০ লক্ষ। গৃহ সমস্ত চারি পাঁচ তল, প্রথম তল প্রায়ই পথের তল অপেক্ষা নীচ। বাহিরের প্রাচীর সমুদয় ইষ্টকনির্ম্মিত ও গৃহের দেওয়াল সকল কাগজে মোড়া কাষ্ঠরচিত। লণ্ডনে অনেক প্রশস্ত উদ্যান আছে, উহা বিস্তৃত ও অবারিত-দ্বার। তথায় সুন্দর পথ, সুশোভন খাল, বৃক্ষ, উপবন, ও ফুলের চৌকা প্রভৃতি প্রমোদের দ্রব্য অনেক আছে। যখন অন্য কোন কায না থাকে, তখন কিয়ৎক্ষণ এই স্থানে ভ্রমণ করা আমোদজনক বোধ হয়। এতদ্ব্যতীত ছোট ছোট উদ্যান আছে, তাহা চতুর্দ্দিকে রেলের দ্বারা বেষ্টিত, মধ্যে নানাপ্রকার সুন্দর বৃক্ষ, পুষ্পের চারা ও পথ আছে। কিন্তু যাহারা উহার নিকটবাসী, তাহারাই উহার ভিতর যাইতে পারে। এই সমুদায়, লণ্ডন নগরের নিশ্বাস প্রশ্বাসের পথ বলিয়া পরিগণিত হয়, কারণ ইহারা না থাকিলে উক্ত নগর বাসের পক্ষে অস্বাস্থ্যজনক হইত। লণ্ডনের বাটী সকল পরস্পর অতি নিকট ও শ্রেণীবদ্ধ, এবং সকল ঘরই ক্ষুদ্র ও অপ্রশস্ত। বস্তুতঃ যাহা দেখা যায়, সকলই বোধ হয় যেন, কেবল শীত নিবারণের নিমিত্ত প্রস্তুত হইয়াছে। এখানে শীত অতি প্রবলপ্রতাপ এবং শুনিতে পাই যে, গ্রীষ্ম অতি অল্পায়ু। কিন্তু যখন গ্রীষ্মকাল সমাগত হয়, তখন তাহা নিবারণের কোন পন্থাই না থাকাতে এখানকার গ্রীষ্ম ঋতু অতি অসুখজনক। আকাশমণ্ডল অপরিষ্কার, দিবামান কুজ্‌ঝটিকাতে প্রায় অন্ধকারময়, এবং সর্ব্বদাই বৃষ্টিপাত হইয়া থাকে। কিন্তু অস্মদ্দেশে যেরূপ ধারাপাত হয়, এখানে সেরূপ নহে; কেবল বিরক্তিজনক গুঁড়ানি পড়িয়া থাকে। গ্রীষ্ম ব্যতীত অন্যকালে প্রায়ই সূর্য্যার মুখাবলোকন করিতে পাওয়া যায় না; উহা প্রায়ই কুজ্‌ঝটিকা বা মেঘান্তরালে লুক্কায়িত থাকে, কখন কখন স্বীয় রুগ্ন ও নিস্তেজ বদন বহির্গত করে। এখানে একটা প্রবাদ আছে যে, ফরাসিস্ দেশের কতকগুলি নিস্তেজ চন্দ্র লইয়া ইংলণ্ডের সূর্য্য সৃজিত হইয়াছে এবং তিন দিন মাত্র গ্রীষ্ম, ও একটা ঝড় হইয়া গেলে ইংলণ্ডে নিদাঘকালের অবসান হয়।

 পুনশ্চ—এক্ষণে তাপমান যন্ত্রে ৫০ ডিগ্রি দেখিতেছি, উহা প্রায় কখনই ৮০ ডিগ্রির উপর উঠে না এবং অতি শীতের সময় পারদ যে ডিগ্রিতে গেলে জল জমিয়া যায়, তাহার ১০। ১২ ডিগ্রি নীচে আসিয়া পড়ে।