মাধবীকঙ্কণ/সাতাশ

উইকিসংকলন থেকে
সাতাশ

 কয়েক দিবস ভ্রমণান্তর যশোবন্তসিংহের সেনা আগ্রা নগরে উপনীত হইল। আওরংজীবের পরাক্রম অসীম, তাঁহার সহিত সম্মুখযুদ্ধ করা যশোবন্তসিংহের সাধ্য নহে, তিনি সুযোগের জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। আওরংজীবের মিত্রবেশে পরম শত্রু আগ্রা নগরে প্রবেশ করিল।

 যমুনার অনন্ত সৌন্দর্য ও আগ্রা নগরের অপূর্ব শোভা দেখিয়া কে না বিমোহিত হইয়াছে। শ্বেতপ্রস্তর-বিনির্মিত, অপূর্ব চারুশিল্পখচিত, জগতের অতুল্য তাজমহল সন্ধ্যায় নীল-গগনে একটি প্রতিকৃতির ন্যায় বোধ হয়; তাহার চতুর্দিকে সুন্দর পথ, সুন্দর কুঞ্জবন, সুন্দর ফোয়ারা; পাশে শ্যামা যমুনা। আগ্রার প্রকাণ্ড দুর্গ; তন্মধ্যে মর্মর-প্রস্তর-বিনির্মিত সুন্দর মতি-মসজিদ, দেওয়ান-খাস, দেওয়ান-আম, রংমহল, শীসমহল। আগ্রার সৌন্দর্য কত বর্ণনা করিব পাঠকগণ! যদি এই অপূর্ব নগর না দেখিয়া থাকেন, অদ্যই যাইবার উদ্যোগ করুন। ‘তিনি’ ব্যয়ের ওজন করিবেন, তাহা শুনিবেন না, আপনাদিগের অনুরোধ অলঙ্ঘনীয়, আপনাদিগের অশ্রুজলে সকল আপত্তি ভাসিয়া যাইবে।

 প্রসিদ্ধ ময়ূর-সিংহাসনে অদ্য সম্রাট আওরংজীব উপবেশন করিয়াছেন। প্রাসাদেও শ্বেত-স্তম্ভরাশি বড় শোভা পাইতেছে। রক্তবর্ণ চন্দ্রাতপ হইতে পুষ্পমাল্যের সহিত মণি-মাণিক্য ঝুলিতেছে ও প্রাতঃকালের আলোকস্পর্শে অপূর্ব শোভা ধারণ করিয়াছে। চারিদিকে মহারাজা, রাজা, ওমরাহ, মনসবদার প্রভৃতি ভারতের অগ্রগণ্য বীর, ধনী ও মান্য লোকে অদ্য রাজপ্রাসাদকে ইন্দ্রপুরী করিয়াছে।

 সেই প্রাসাদের সম্মুখে বিস্তৃত শিবির সন্নিবেশিত হইয়াছে, শিবিবের চতুর্দিকে রৌপ্য-বিনির্মিত স্তম্ভ ঝকমক্ করিতেছে। উপরের অস্ত্র উজ্জ্বল রক্তবর্ণ, ভিতরে মসলীপত্তনের ছিট, সেই ছিটে লতা-পুষ্প এরূপ সুন্দর বিচিত্র হইয়াছে যে, শিবিরের পার্শ্বে যথার্থ পুষ্প ফুটিয়াছে, দর্শকদিগের এরূপ ভ্রম হয়। ভূমিতে অপরূপ গালিচা, তাহাতেও পুষ্পগুলি এরূপ সুন্দরভাবে বুনা হইয়াছে যে, শিবিরস্থ ব্যক্তি পূষ্প দলিত হইবে ভয়ে সহসা পদক্ষেপ করিতে সঙ্কোচ করেন।

 তাহার বাহিরে দুর্গের প্রাচীর পর্যন্ত জয়পতাকা ও পুষ্পপত্র দ্বারা দুর্গ সুশোভিত হইয়াছে। সেনাগণ শ্রেণীবদ্ধ হইয়া বিজয়বাদ্যে সকলের মন উত্তেজিত করিতেছে, নবজাত সূর্যরশ্মিতে তাহাদের বন্দুক ঝকমক্ করিতেছে। দুর্গপ্রাচীরের ওপর, ইংরেজ, ফরাসী ও ওলন্দাজ সৈনিকগণ ঘন ঘন কামান ছাড়িতেছে। তাহারা বহুদূর হইতে রত্নগর্ভ ভারতবর্ষে রত্ন কুড়াইবার জন্যে আসিয়াছে ও ‘সম্রাটের বেতনভোগী’ হইয়া অদ্য কামানের শব্দে সম্রাটের বিজয় প্রচার করিতেছে। দুর্গের বাহিরে নগরের পথে, ঘাটে, গৃহে, দ্বারে ও যমুনাতীরে রাশি-রাশি লোক নিজ-নিজ সুপরিচ্ছদে সজ্জিত ও দলবদ্ধ হইয়া প্রশস্ত আগ্রা নগর ও যমুনাতীর পরিপূর্ণ করিতেছে।

 পুরাতন রীত্যানুসারে আওরংজীব সুবর্ণের সহিত ওজন হইলেন, তাহার পর প্রধান প্রধান ওমরাহগণ ঐরূপে ওজন হইলেন। প্রত্যেক ওমরাহ রাজা ও মনসবদার সুবর্ণ, মুক্তা ও হীরক নজর দিয়া সম্রাটের মনস্তুষ্টি করিলেন।

 তাহার পর জগদ্বিমোহিনী কঞ্চনীগণ প্রৌঢ়-যৌবনমদে উন্মত্ত হইয়া অপূর্ব সঙ্গীত ও নৃত্য মায়া সভাসদগণের হৃদয় বিমোহিত করিল। কঞ্চনীগণ নর্তকী, বড় বড় ওমরাহদিগের মধ্যে বিবাহাদি কার্য হইলে তাহারা সঙ্গীত ও নৃত্য করিতে যাইত। শাজাহান তাহাদিগকে সর্বদাই নিকটে রাখিতে ভালবাসিতেন ও বেগমদিগের আলয়েও লইয়া যাইতেন। কিন্তু ইন্দ্রিয়সুখপরাঙ্মুখ আওরংজীব তাহাদিগকে প্রায় নিকটে আসিতে দিতেন না, তবে আজি আনন্দের দিনে কঞ্চনীগণ কেন না সমাদৃত হইবে?

 তাহার পর দুর্গেব পূর্বদিকে অর্থাৎ যমুনাতীরে মল্লযুদ্ধ, অসিযুদ্ধ প্রভৃতি নানারূপ যুদ্ধ হইতে লাগিল। প্রাসাদের উপর হইতে বেগমগণ দেখিতে পাইবেন, এইজন্য এইস্থলে যুদ্ধ হইত। অবশেষে দুইটি মত্ত হস্তীর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। মধ্যে আন্দাজ দুই হাত উচ্চ একটি মৃত্তিকার প্রাচীর তাহার দুইদিক হইতে দুই মত্ত হস্তী মাহুত দ্বারা পরিচালিত হইয়া রণে লিপ্ত হইল। অনেকক্ষণ যমুনার উভয় পার্শ্ব হইতে লোক সবিস্ময়ে এই ভীষণ যুদ্ধ দেখিতে লাগিল। শুণ্ডের চপেটাঘাতে ও দন্তজনিত আঘাতে হস্তীদ্বয়ের মস্তক ও শরীর ক্ষতবিক্ষত হইয়া যাইল। প্রত্যেক ইস্তীর দুইজন করিয়া মাহুত ছিল; একটি হস্তীর একজন মাহুত পড়িয়া গেল, সহসা হস্তী দ্বারা পদদলিত হইয়া জীবন ত্যাগ করিল; অপর পক্ষের একজন মাহুতের ঐরূপে জন্মের মতো হাত ভাঙিয়া গেল। এই হতভাগারা এই জীবনের আশা পরিত্যাগ করিয়াই হস্তীদ্বয়কে যুদ্ধে প্রমত্ত করিয়াছিল, বহু অর্থলোভে স্ত্রী-পুত্র-সকলের নিকট বিদায় পূর্বেই লইয়া আসিয়াছিল। অনেকক্ষণ যুদ্ধের পর একটি হস্তী অন্যকে পরাস্ত করিয়া, মৃত্তিকা-প্রাচীর উল্লঙ্ঘন করিয়া পশ্চাদ্ধাবমান হইল। তাহাদিগকে ছাড়াইবার জন্য অনেকে চরকি প্রভৃতি আগুনের বাজী ছুঁড়িল, কিন্তু সঞ্জাত-ক্রোধ হস্তী তাহাতে নিরস্ত না হইয়া অপর হস্তীর পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল, অবশেষে পরাজিত হস্তী সন্তরণ করিয়া যমুনা পার হইয়া গেল, পথিমধ্যে দুই-একজন লোক যাহার সম্মুখে পড়িল তাহারাও নিহত হইল।

 এ সমস্ত আমোদ দেখিয়া নরেন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে যমুনা-পুলিনে যাইলেন ও হস্তমুখ প্রক্ষালন করিয়া একটি সুন্দর বৃক্ষমূলে শয়ন করিলেন। যেস্থানে নরেন্দ্রনাথ শয়ন করিলেন সেটি অতি মনোহর স্থল। বিশাল তমাল-বৃক্ষ সূর্যের কিরণ নিবাবণ করিতেছে ও বৃক্ষের উপর হইতে দুই-একটি পক্ষী যেন দিনের তাপে ক্লিষ্ট হইয়া অতি মৃদুস্বরে ডাকিতেছে। নিকটে বৃক্ষের একপার্শ্বে একটি পুরাতন কবর আছে প্রস্তর স্থানে বিদীর্ণ হইয়া গিয়াছে ও অশ্বত্থ প্রভৃতি বৃক্ষলতাদি সেই কবরের উপর জন্মিয়াছে। কবরের একপাশে পারস্য ভাষায় একটি বায়েৎ লেখা আছে, অহার অর্থ “বন্ধু। আমার নাম জানিবার আবশ্যক কি? আমি জগতে অভাগা, অসুখী ছিলাম। তুমি যদি হতভাগা হও আমার জন্য একবিন্দু অশ্রুবর্ষণ করিও।” মন্দ মন্দ যমুনাবায়ু হইতে শীতল স্থানকে আরও সুশীতল করিতেছে, কল্লোলিনী যমুনা সুমধুর কল-কল শব্দে বহিয়া যাইতেছে। নরেন্দ্রনাথ অচিরাৎ নিদ্রায় অভিভূত হইলেন।

 তিনি কতক্ষণ নিদ্রিত রহিলেন তাহা স্থির করিতে পারিলেন না। নিদ্রায় একটি অপরূপ স্বপ্ন দেখিলেন। বোধ হইল, যেন অপূর্ব গোরস্থান হইতে মৃত মনুষ্য পুনর্জীবিত হইল, সে একটি মুসলমান স্ত্রীলোক। মৃত্যুর শ্বেতবর্ণ স্ত্রীলোকের মুখে এখন দেদীপ্যমান। স্ত্রীলোকের চক্ষু কোটরপ্রবিষ্ট, শরীর ক্ষীণ, সমস্ত অবয়ব দুঃখব্যঞ্জক। গোরস্থানে যে বায়েৎটি লেখা ছিল, শ্রীলোক যেন সেই বায়েৎটি গান করিল, সে দুঃখব্যঞ্জক গীতধবনিতে নরেন্দ্রের মুদ্রিত নেত্র হইতে একবিন্দু জল ভূতলে পতিত হইল। মুসলমানী যেন সহসা আর একটি গীত আরম্ভ করিল। নরেন্দ্রের বোধ হইল, যেন সে স্বর তাঁহার অপরিচিত নহে, বোধ হইল, যেন সে স্বর সেই অভাগিনী জেলেখার কণ্ঠনিঃসৃত। নরেন্দ্র, ভাল করিয়া দেখ, স্বয়ং জেলেখা গোরের উপর বসিয়া এই দুঃখগান গাইতেছে।

 নরেন্দ্রের স্বপ্নভঙ্গ হইল, চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন, কোথাও কেহ নাই। সূর্য অস্ত গিয়াছে, সন্ধ্যার ললাটে একটি উজ্জ্বল তারা বড় শোভা পাইতেছে, সন্ধ্যার বায়ু রহিয়া রহিয়া মৃদু গান করিতেছে, যমুনার জল অধিকতর নীলবর্ণ ধারণ করিয়া বহিয়া যাইতেছে।

 নরেন্দ্র বিস্মিত হইলেন। এই জেলেখার গান তিনি নিদ্রাযোগে ইতিপূর্বে তিন-চারবার শ্রবণ করিয়াছেন। জেলেখার প্রতি কি নরেন্দ্রের হৃদয় আকৃষ্ট হইয়াছে? নরেন্দ্র হৃদয় অনুসন্ধান করিয়া দেখিলেন, হৃদয় হেমলতাময়। জেলেখা কি মানবী নহে, জেলেখা কি পরী? তবে মানবের প্রেমাকাঙ্ক্ষিনী কেন? নরেন্দ্রনাথ ভাবিতে ভাবিতে সেই গোরস্থানের দিকে আসিলেন, সহসা গোরের পার্শ্ব হইতে স্বয়ং জেলেখা দণ্ডায়মান হইল। তাহার ক্ষীণ শরীর ও পাণ্ডুবর্ণ বদনমণ্ডল দেখিলে বোধ হয় যেন, যথার্থ কবর-গহ্ববরস্থ মৃতদেহ পুনর্জীবিত হইল। বদন পাণ্ডুবর্ণ বটে, কিন্তু নয়ন হইতে পূর্ববৎ তীব্র জ্যোতি বাহির হইতেছে। তীব্র জ্যোতির্ময়ী বামা সরোষে অধর দংশন করিয়া নরেন্দ্রের দিকে কটাক্ষপাত করিতেছে, বক্ষস্থলে একখানি তীক্ষ্ণ ছুরিকার অগ্রভাগ দেখা যাইতেছে। এই নারী কি দুঃখগান গাহিতেছিল? বোধ হয়, না।

 জেলেখা নরেন্দ্রকে আসিতে ইঙ্গিত করিয়া আপনি অগ্রে চলিল, অনেক দূর যাইয়া দুর্গের ভিতর প্রবেশ করিয়া রাজপ্রাসাদের একটি অন্ধকার গৃহে প্রবেশ করিল। নরেন্দ্র এতক্ষণ ইতিকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিতেছিলেন, এক্ষণে গৃহের ভিতর অন্ধকারে রমণীর সহিত যাইতে সঙ্কোচ করিয়া বলিলেন, “তুমি কে জানি না, আমি রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করিবার অনুমতি পাই নাই।”  জেলেখা। প্রাসাদে যাইবার আমার অধিকার না থাকিলে তোমাকে আসিতে বলিতাম না।

 নরেন্দ্র। তথাপি তুমি কে জানি না, অজ্ঞাত স্থানে যাইব না।

 জেলেখা কর্কশস্বরে বলিল, “মৃত্যুভয় করিতেছ? তোমাকে হনন করিবার ইচ্ছা থাকিলে, আমি তাতারদেশীয়া, আমি এই ছুরিকা এতক্ষণ ব্যবহার করিতে পারিতাম না? কিন্তু এই লও, ছুরিকা ত্যাগ করিলাম, রিক্তহস্ত স্ত্রীলোকের সহিত যাইতে বোধ হয় বীর-পুরুষের কোন আপত্তি নাই।”

 জেলেখার বিকট হাস্যধ্বনিতে নরেন্দ্রর মুখমণ্ডল ক্রোধে বক্তবর্ণ হইল। তিনি নিঃশব্দে জেলেখার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতে লাগিলেন। ক্ষণেক যাইলে পর জেলখা একস্থানে কতকগুলি বস্ত্র দেখাইয়া নরেন্দ্রকে তাহা পরিধান করিতে কহিল। নরেন্দ্র তুলিয়া দেখিলেন, তাহা তাতারদেশীয় রমণীর পরিচ্ছদ। বিস্মিত হইয়া আবার জেলেখার দিকে চাহিলেন। জেলেখা এবার গম্ভীরস্বরে বলিল, “বিলম্ব করিও না, আমরা যে দ্বার দিয়া আসিয়াছি, এক্ষণে সে দ্বার রূদ্ধ হইয়াছে, চারিদিকে খোজাগণ নিষ্কাষিত অসিহস্তে দণ্ডায়মান রহিয়াছে। এ বেগমদিগের প্রাসাদ, তুমি পুরুষ জানিলে এইক্ষণেই তোমার প্রাণ-বিনাশ করিবে।”

 নরেন্দ্র বিস্ময়াপন্ন হইয়া দেখিলেন, জেলেখার কথা সত্য। অগত্যা নরেন্দ্র কাঁচলি ও ঘাগরা পরিলেন, জেলেখা হাসিতে হাসিতে তাঁহাকে পরচুলা পরাইয়া দিয়া মস্তকের উপর খোঁপা করিয়া দিল। নরেন্দ্র এই অদ্ভুত বেশে জেলেখার সঙ্গে সঙ্গে প্রাসাদের অন্তঃপুরে চলিলেন।

 নরেন্দ্র জেলেখার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন; কত গৃহ ও পথ অতিবাহিত করিলেন তাহা গণনা করা যায় না। দ্বারে দ্বারে অসিহস্তে খোজাগণ দণ্ডায়মান বহিয়াছে ও শত-শত পরিচারিকা এদিক-ওদিক পরিভ্রমণ করিতেছে। জেলেখাকে দেখিয়া সকলেই দ্বার ছাড়িয়া দিল।

 নরেন্দ্রনাথ বেগমদিগের মহলের অভ্যন্তরে যত যাইতে লাগিলেন, ততই বিস্মিত হইলেন—ঐশ্বর্য, শিল্পকার্য ও বিলাসপ্রিয়তার পরাকাষ্ঠা দেখিয়া বিস্মিত হইলেন। শ্বেতমর্মরপ্রস্তর-বিনির্মিত কত ঘর, কত প্রাঙ্গণ, কত সুন্দর স্তম্ভসারি, কত উন্নত ছাদ, তাহা গণনা করা যায় না। সেই প্রস্তরে কী অপূর্ব শিল্পকার্য! দেওয়ালে স্তম্ভে প্রকোষ্ঠে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের প্রস্তর শ্বেতপ্রস্তরে সন্নিবেশিত হইয়া লতা, পত্র, বৃক্ষ, পুষ্পের রূপ ধারণ করিয়াছে, যেন সুন্দর শ্বেত দেওয়ালের পার্শ্বে যথার্থই পুষ্প ফুটিয়া রহিয়াছে। ছাদ হইতে যেন সেইরূপ পুষ্প লম্বিত রহিয়াছে। অথবা উজ্জ্বল সুবর্ণমণ্ডিত ও চিত্রিত হইয়া, অধিকতর শোভা ধারণ করিতেছে। শেতপ্রস্তর-বিনির্মিত সুন্দর গবাক্ষ, সুন্দর ফোয়ারা, সুন্দর পুষ্পাধার তাহার উপর মনোহর সুগন্ধ পুষ্প ফুটিয়া প্রাসাদকে আমোদিত করিতেছে। শ্বেত, পীত বর্ণের আলোকে সেই রঞ্জিত ঘরের ভিতর ও বাহির দেখা যাইতেছে। জগতে অতুল্য রূপবতী বেগমগণ কেহ বা সেই ঘরে বা প্রকোষ্ঠে ভ্রমণ করিতেছেন, কেহ বা পুষ্পচয়ন করিয়া কেশে ধারণ করিতেছেন, কেহ বা আনন্দে গান করিতেছেন। আজ আনন্দের দিন, রাজপ্রাসাদ আনন্দ ও নৃত্যগীতে পরিপূর্ণ।

 এই সমস্ত দেখিতে দেখিতে নরেন্দ্র যেখানে স্বয়ং আওরংজীব ছিলেন তথায় যাইয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন সম্রাট আওরংজীব বেগমদিগের সহিত পঁচিশী খেলিতেছেন। পঁচিশী ঘর শ্বেতপ্রস্তর-বিনির্মিত ও প্রকাণ্ড; এক-একটি রূপবতী কামিনী এক একটি ঘুঁটি। ঘুঁটি ভিন্ন-ভিন্ন বর্ণের হওয়া আবশ্যক, এইজন্যই কামিনীগণ ভিন্ন-ভিন্ন বর্ণেব পরিচ্ছদ ধারণ করিয়াছেন।

 তথা হইতে নরেন্দ্র জেলেখার সঙ্গে একটি মর্মর প্রস্তর বিনির্মিত ঘরে প্রবেশ করিলেন মর্মরপ্রস্তর-বিনির্মিত স্তম্ভসারি সাটিন ও মখমলে বিজড়িত নানাবর্ণের গন্ধদীপ আলোক ও সৎগন্ধদানে ঘর আমোদিত করিতেছে। ভিতরে তিন-চারিজন বেগম বাদ্য ও গীত করিতেছেন, সপ্তস্বর মিলিত সেই গীতধ্বনি উন্নত ছাদ উল্লঙ্ঘন করিয়া যমুনাতীরে ও নৈশগগনে প্রধাবিত হইতেছে।

 সে গৃহ হইতে কিছু দূরে যমুনা নদীর দিকে একটি শ্বেতপ্রস্তর-নির্মিত বারান্দায় সুন্দর চন্দ্রালোক পতিত হইয়াছে। এ স্থানটি নিস্তব্ধ ও রমণীয়। উপরে আকাশে নীলবর্ণ, দুই-একটি তারা দেখা যাইতেছে। শারদীয় চন্দ্র সুধাবর্ষণ করিয়া গগনকে শোভিত ও জগৎকে তৃপ্ত করিতেছে। নীচে নীলবর্ণ যমুনা নদী কল-কল শব্দে প্রধাবিত হইতেছে, তাহার চন্দ্রকরোজ্জ্বল বৃক্ষের উপর দুইখানি ক্ষুদ্র পোত ভাসমান রহিয়াছে। দক্ষিণে সুন্দর তাজমহল চন্দ্রকরে অধিকতর সুন্দর দেখা যাইতেছে। বারান্দা জনশূন্য, কেবল একজন রাজদাসী বীণাহস্তে গান করিতেছিল, এক্ষণে পরিশ্রান্ত হইয়া বারান্দায় শ্বেতপ্রস্তরে মস্তক রাখিয়া বোধ হয় সুখের বা দুঃখের স্বপ্ন দেখিতেছে। যমুনার বায়ু রমণীর চন্দ্রকরোজ্জল কেশপাশ লইয়া ক্রীড়া করিতেছে অথবা সে বীণার উপর কখন কখন সুখের গান করিতেছে। বারান্দায় দণ্ডায়মান হইয়া ও যমুনার সুন্দর গান ও শীতল বাযু ভোগ করিয়া নরেন্দ্রের হৃদয়ে নব নব ভাব উদিত হইতে লাগিল। এইরূপ নিস্তব্ধ রজনীতে এইরূপ নদীতীরে নরেন্দ্র দূরবঙ্গদেশে হেমকে শেষবার দেখিয়াছিলেন। আহা! সে সুন্দর মুখখানি চন্দ্র হইতেও সুধাপূর্ণ ও জ্যোতির্ময়। মুহূর্তের জন্য নরেন্দ্রের হৃদয় হেমলতাপুর্ণ হইল, নরেন্দ্র আকাশের দিকে চাহিয়া চাহিয়া একটি দীর্ঘশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া অন্যদিকে যাইলেন।

 যেদিকে যাইবেন, সেদিক হইতে লোকের কলরব শুনিতে পাইলেন। প্রাসাদের মধ্যে এই কলরব শুনিয়া নরেন্দ্র কিছু বিস্মিত হইলেন এবং ঔৎসুক্যের সহিত সেইদিকে গমন করিতে লাগিলেন। যত নিকট আসিলেন, ততই নারীকণ্ঠনিঃসৃত সুমধুর কথা ও হাস্যধ্বনি তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিল; তিনি আরও বিস্মিত হইয়া সেইদিকে যাইয়া অবশেষে একটি জনাকীর্ণ স্থানে উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন সম্মুখে একটি অতি বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ; প্রাঙ্গণে কত সুন্দর পুষ্পচারা পুষ্পলতিকা, তাহা বর্ণনা করা যায় না। চতুষ্পার্শ্বস্থ হর্ম্যশ্রেণী হইতে পুষ্পমালা দুলিতেছে বৃক্ষলতায় পুষ্প ফুটিয়া রহিয়াছে, স্থানে স্থানে স্তূপাপাকার পূষ্প রহিয়াছে, চারিদিকে সুগন্ধ পুষ্প-বিকীর্ণ রহিয়াছে। সুদর্শন ফোয়ারা যেন দ্রব রৌপ্যস্তম্ভ নৈশ আকাশে উত্তোলন করিয়া আবার মুক্তারূপে চারিদিকে বিকীর্ণ করিতেছে। ঝোপে, বৃক্ষের অন্তরালে, সম্মুখে, পার্শ্বে, উচ্চে, নানাবর্ণের সুগন্ধ দীপাবলী জ্বলিতেছে, যেন আজ ইন্দ্রের অমরাপুরী লজ্জিত করিয়া এই বেগমমহল অপূর্ব রূপ ধারণ করিয়াছে। সেই প্রাঙ্গণে একটি বাজার বসিয়াছে, ক্রেতা-বিক্রেতা দলে দলে বিচরণ করিতেছে। অন্যান্য বাজার হইতে এই ভেদ যে, সকলেই রমণী। বিক্রেতা ভারতবর্ষের প্রধান প্রধান রাজা, মহারাজা ওমরাহগণের মহিলাগণ,—ক্রেতা সম্রাটের বেগমগণ। যে সমস্ত অসূর্যম্পশ্যা কোমলাঙ্গী লাবণ্যময়ী যুবতীগণ ক্রয়-বিক্রয় করিতেছেন তাহাদিগের হাবভাব রসিকতা ও বাক্-প্রগল্‌ভতায় নরেন্দ্র চমকিত হইলেন।

 পাঠকগণ অবগত আছেন যে বৎসর-বৎসর নওরোজার দিন দিল্লীর সম্রাটগণ বেগমমহলে একটা করিয়া বাজার বসাইতেন, ভারতবর্ষের প্রধান প্রধান মহিলাগণ এই বাজারে দ্রব্য বিক্রয় করিতে আসিতেন। ওমরাহ ও রাজাগণ পরিবারস্থ রমণীদিগকে বেগমদিগের সহিত পরিচিত করিবার জন্য এই বাজারে পাঠাইতেন। পুরুষের মধ্যে কেবল স্বয়ং সম্রাট আসিতেন; পূর্ব প্রথামতে এই আনন্দের দিনে আওরংজীব সেইরূপ বাজার বসাইয়াছেন ও স্বয়ং দুই-একজন বেগমের সহিত এক দোকান হইতে অন্য দোকানে পরিভ্রমণ করিতেছিলেন। ভ্রাতৃযুদ্ধে আওরংজীবের ভগিনী রোশন-আরা আওরংজীবের অনেক সহায়তা করিয়াছিলেন, সে বাজারের মধ্যে রোশন-আরার ন্যায় কাহার গৌরব, কাহার প্রভুত্ব। অন্য ভগিনী জেহান-আরা দারার পক্ষাবলম্বন করিয়াছিলেন, অন্য এ মহোৎসবের মধ্যে জেহান-আরা নাই।

 বিস্ময়োৎফুল্ল লোচনে নরেন্দ্রনাথ এই মহোৎসব দেখিতে লাগিলেন। দেখিলেন সম্রাট একজন রূপবতী মোগলকন্যার নিকটে কতকগুলি অলঙ্কার ও সাটিন্ ও সুবর্ণখচিত বস্ত্রের দর করিতে আরম্ভ করিতেছেন। দর করিতে উভয়পক্ষই সমান পটু, কখন কখন এক পয়সার বিভিন্নতার জন্য মহা গণ্ডগোল উপস্থিত হইতেছে। আওরংজীব বলিলেন “—তোমার জিনিস মেকি, তুমি এখানে ঠকাইতে আসিয়াছ।” চতুরা মোগলকন্যা বলিলেন,—তুমি কিরূপ খরিদ্দার। এরূপ কখনও দেখ নাই, ইহার দর তুমি কি জানিবে? তুমি ইহার উপযুক্ত নও, অন্যস্থানে যাও—তোমার যোগ্য দ্রব্য পাইবে।” এইরূপ বহু বাগবিতণ্ডার পর মূল্য অবধারিত হইল। ক্রেতা তখন যেন ভ্রমক্রমে দুই-চারিটি রৌপ্যমুদ্রার স্থানে বিক্রেতাকে সুবর্ণমুদ্রা দিয়া চলিয়া গেলেন।

 অনেকক্ষণ এইরূপ বাজার দেখিয়া নরেন্দ্র জেলেখার আদেশানুসারে “শীশমহলে প্রবেশ করিলেন, তথায় আবার অন্যরূপ অপরূপ দৃশ্য দেখিলেন। সম্রাট ও বেগমদিগের স্নানার্থ এই মহল নির্মিত হইয়াছে। শ্বেত-প্রস্তর-বিনির্মিত শানের উপর দিয়া নির্মল জল প্রবাহিত হইতেছে, শানে অঙ্কিত প্রতিকৃতি দেখিয়া বোধ হয়, যেন জলের নীচের অসংখ্য মৎস্য ক্রীড়া করিতেছে। চতুর্দিক হইতে ফোয়ারার নির্মল জল বেগে উঠিতেছে, আবার মুক্তারাশির ন্যায় প্রস্তরের উপর পতিত হইতেছে, ছাদ হইতে অসংখ্য দীপাবলী লম্বিত রহিয়াছে ও সেই সমস্ত দীপের বিবিধ বর্ণের আলোক ফোয়ারার জলের উপর বড় সুন্দরভাবে প্রতিহত হইতেছে। চতুর্দিক হইতে অসংখ্য দর্পণ রত্নরাজিখচিত হইয়া দেওয়ালে সন্নিবেশিত হইয়াছে, কেন না, স্নানকারিণী চতুর্দিকেই আপনার সুন্দর অনাবৃত অবয়ব দেখিতে পাইবেন। বিলাসপটু সম্রাটগণ বেগমদিগকে লইয়া এই গৃহে স্নান ও জলকেলি করিতে পারিবেন, এইজন্য কত দেশ হইতে অর্থ আনীত হইয়া এই অপূর্ব বিলাসগৃহ বিনির্মিত ও সুশোভিত হইয়াছে।

 নানা দেশ হইতে অনেক মুসলমান ও হিন্দুরমণী অন্য প্রাসাদে সমবেত হইয়াছেন। তাহার মধ্যে অনেকেই শীশমহলের অপূর্ব শোভা দেখিতেছিলেন। জেলেখা তাঁহাদিগের ভিতর দিয়া নরেন্দ্রকে হাত ধরিয়া একপাশে লইয়া গিয়া একটি দর্পণের নিকট আনিল এবং সেই দর্পণের ভিতর একটি ছায়া দেখাইল। চকিত ও নিস্পন্দ হইয়া নরেন্দ্র সেই দর্পণের ভিতর সেই ছায়া দেখিতে লাগিলেন, তথা হইতে আর নয়ন ফিরাইতে পারিলেন না। আলোকে আকৃষ্ট পতঙ্গবৎ নরেন্দ্র সেই ছায়ার দিকে চাহিয়া রহিলেন, অনিমেষলোচনে সেই দর্পণস্থ প্রতিমূর্তির দিকে চাহিয়া বহিলেন। নরেন্দ্রনাথ কি স্বপ্ন দেখিতেছেন? কি উন্মত্ত হইয়াছেন? নরেন্দ্রের শরীর কঁপিতেছে, তাহার হৃদয় সজোরে আঘাত করিতেছে. তাঁহার নয়ন স্পন্দনহীন। ক্রমে সে প্রতিমূর্তি দর্পণ হইতে সরিয়া গেল, সে রমণী অবগুণ্ঠন টানিয়া শীশমহল হইতে বাহির হইলেন, উন্মত্ত নরেন্দ্র তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন।  রমণী রাজপুত বেশধারিণী। নরেন্দ্র ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিবার জন্য ক্রমে নিকটে আসিলেন, তথাপি রমণীর অনাবৃত বাহু ভিন্ন আর কিছু দেখিতে পাইলেন না, মুখমণ্ডল অবগুণ্ঠনের ভিতর দিয়া দেখা যায় না।

 নরেন্দ্রেরও নারীবেশ, একবার ইচ্ছা হইল, রমণীর নাম-ধাম জিজ্ঞাসা করেন কিন্তু নরেন্দ্রের কণ্ঠরোধ হইল। একবার ইচ্ছা হইল, রমণীর হস্তে আপন হস্ত স্থাপন করেন, কিন্তু তাঁহার হস্ত উঠিল না, হৃদয় সজোরে আঘাত করিতে লাগিল। অচিরাৎ সেই রমণী ও তাঁহার রাজপুত সঙ্গিনীগণ বাজার পরিত্যাগ করিলেন নরেন্দ্রও পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। অনেক ঘর, অনেক দ্বার, অনেক পুষ্পোদ্যান ও প্রাসাদ অতিক্রম করিয়া বাহিরে উপস্থিত হইলেন। তথায় অনেক শিবিকা ছিল, রাজপুত কামিনীগণ নিজ নিজ শিবিকায় আরোহণ করিলেন! যে রমণীর দিকে নরেন্দ্র দেখিতেছিলেন তিনিও শিবিকায় আরোহণ কবিবার উপক্রম করিলেন। বোধ হইল, যেন তিনি যমুনা নদী ও আগ্রার রাজপ্রাসাদ পুর্বে দেখেন নাই, কেন না, শিবিকায় আরোহণ করিবার পূর্বে একবার প্রাসাদ ও নদীর দিকে স্থির দৃষ্টি করিয়া দেখিতে লাগিলেন। যমুনার বায়ুতে তাঁহার অবগুণ্ঠন নড়িতে লাগিল, নরেন্দ্র তীব্রদৃষ্টি করিতে লাগিলেন, তাঁহ হৃদয় স্ফীত হইতে লাগিল। কিন্তু সে অবগুণ্ঠন উড়িয়া গেল না, নরেন্দ্র মুখ দেখিতে পাইলেন না। অচিরাৎ শিবিকাযোগে সে রাজপুতবেশ ধারিণী চলিয়া গেলেন।

 এ কি হেমলতা?—সেই গঠন, চলন, সেই বাহু। দর্পণে সেই মধুমাখা মুখখানি প্রতিফলিত হইয়াছিল। কিন্তু হেমলতা আগ্রার বেগমমহলে কেন? রাজপুত কি জন্য? নরেন্দ্রনাথ! প্রেমান্ধ হইয়া কাহাকে হেমলতা মনে করিতেছ? নরেন্দ্রনাথ! কেন দেশে দেশে সেই ছায়ার অনুধাবন করিতেছ?