সাহিত্যতত্ত্বের সহজ পাঠ
গত কয়েক বছরে বাঙালির পাঠাভ্যাস নামক অচলায়তনের প্রাচীরে বেশ কিছু ফাটল দেখা দিয়েছে। পড়ার চিরাচরিত ধরন কিছুতেই বজায় থাকছে না। চিন্তা-চর্চার কোনো ক্ষেত্রই আর সুনির্দিষ্ট দীক্ষিতজনদের মধ্যে রুদ্ধ নয়। বহুদিন যে যাঁর সীমানার মধ্যে নিশ্চিন্ত ও নিরুদ্বিগ্নভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা করে গেছেন। সামাজিক জীবনে বড়োসড়ো ভূমিকম্প বা অগ্ন্যুৎপাত ঘটলে প্রাচীরগুলি হয়তো কেঁপে উঠেছে কিম্বা পাথর খসে।; কিন্তু চিন্তার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় এইসব উৎপাত শুষে নিতেও দেরি হয়নি। সময়-স্বভাবের কথা বিদ্বজ্জনেরা বিবেচনা করেছেন হয়তো এবং বিবর্তনশীল সময়ের অনুশীলন করে নতুন কিছু উপাদানও আত্মস্থ করেছেন, কিন্তু কাঠামোর খোলনলচে পাল্টে নেওয়ার কথা ভাবেননি। মানুষের অস্তিত্বগত নির্যাস এবং তার হওয়া ও হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া কীভাবে সময়ের গ্রন্থিল বাস্তবতায় সম্পৃক্ত এবং অন্তর্বস্তু ও প্রকরণ কেন অজস্রবার বদলে যাচ্ছে—তার যথার্থ অনুশীলন হয়নি।
একুশ শতকের প্রত্যুষে আমরা দেখছি, আমাদের চেনাজানা পৃথিবী গত একশ বছরে ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে গেছে। একদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অকল্পনীয় উন্নতি অন্যদিকে নিজেরই গড়া সাজানো বাগানকে ঘাতকের নির্মমতায় উপড়ে ফেলছে। মানুষ। ইতিহাসের সংজ্ঞা ও প্রকরণ বদলে যাচ্ছে মুহুর্মুহু, সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্তঃসার খোঁজার বদলে আমরা নিজেদের অজান্তে বহিরঙ্গসর্বস্ব হয়ে পড়েছি। বাইরের জগতে তুমুল আলোড়ন-ই চলছে না শুধু, উদ্দাম গতি তৈরির তাড়নায় আজকের সব চিহ্ন ও প্রত্যয় আগামী কালই মুছে যাচ্ছে। যে-কোনো মূল্যে নতুন হওয়া ও নতুন থাকার তাগিদ সব বিশ্বাস, দায়বোধ ও মূল্য-চেতনাকে অবান্তর করে দিচ্ছে। ফলে কোথাও কোনো স্থিরতা নেই, কেন্দ্র নেই কাজে কিংবা চিন্তায়; আছে কেবল চাওয়া পাওয়ার মাদকে নিজে আচ্ছন্ন হয়ে অন্যকেও আচ্ছন্ন করার প্রক্রিয়া। বিশ শতক মানুষকে কেবল লেনিন, মাও সে তুং, চে গুয়েভারা দেয়নি—হিটলার, আইখম্যানদেরও দিয়েছে। এযুগে মহাত্মা গান্ধী-নেতাজী-সুভাষচন্দ্র-ফিদেল কাস্ত্রো যেমন রয়েছেন, তেমনি পাশাপাশি রয়েছে মুসোলিনি-গর্বাচভ-বিল ক্লিণ্টনের মতো ইতিহাসের খলনায়কেরাও। এ যুগ ফ্রয়েড-সার্স-আইনস্টাইন-রবীন্দ্রনাথ-কাম-মার্কেজের যতখানি, ঠিক ততটাই প্রতিভাবাদর্শের অজস্র স্থপতিদেরও। এই তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে পারে।
মোদ্দা কথা হল, বিশ শতকের বহুরৈখিক মানবিক উপার্জন ধ্বস্ত হয়ে গেছে হিরোশিমা নাগাসাকিতে, ইরাকে বসনিয়ায়, নাৎসি বন্দী শিবিরে, ইথিওপিয়ায়,