পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

নিজের উচ্ছ্বসিত আবেগে লজ্জিত হইয়া নীরব হইল। কিছুক্ষণ উভয়েই মৌন থাকার পর জীবানন্দ ধীরে ধীরে কথা কহিল। বলিল, একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে আমার ভারী লজ্জা করে, কিন্তু যদি পারতাম, তুমি কি তার সত্যি জবাব দিতে পারতে অলকা?

 জীবানন্দের মুখে এই অলকা নামটা ষোড়শীর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। তিন অক্ষরের এই ছোট্ট কথাটি তাহার কোনখানে যে গিয়া আঘাত করিত, সে ভাবিয়া পাইত না। বিশেষ করিয়া তাহার প্রশ্ন করার এই কৌতুককর ভঙ্গীতে ষোড়শীর হাসি পাইল; কহিল, আপনি যদি কোন একটা আশ্চর্য কাজ করতে পারিতেন, তার পরে আমি আর কোন একটা তেমনি অদ্ভুত কাজ করতে পারতাম কি না, এতবড় সত্য করবার শক্তি আমার নেই। কিন্তু সে-কাজ করবার আপনার আবশ্যক নেই আমি বুঝেচি। অপবাদ আপনারা দিয়েছেন বলেই তাকে সত্যি করে তুলতে হবে, তার অর্থ নেই। আমি কিছুর জন্যেই কখনো কারও আশ্রয় গ্রহণ করব না। আমার স্বামী আছেন, কোন লোভেই সে-কথাটা আমি ভুলে যেতে পারব না। এই ভয়ানক প্রশ্নটাই না আপনাকে লজ্জা দিচ্ছিল চৌধুরীমশায়?

 তুমি আমাকে চৌধুরীমশায় বল কেন?

 তবে কি বলব? হুঁজুর?

 না, অনেকে যা বলে ডাকে―জীবানন্দবাবু।

 ষোড়শী বলিল, বেশ ভবিষ্যতে তাই হবে।

 জীবানন্দ কহিল, ভবিষ্যতে কেন, আজই বল না?

 ষোড়শী ইহার কোন উত্তর দিল না। ভিতরে প্রদীপ স্তিমিত হইয়া আসিতেছিল। সে ঘরে আসিয়া তাহা উজ্জ্বল করিয়া দিল। জীবানন্দ ফিরিয়া আসিয়া বসিতেই ষোড়শী বিস্মিত হইয়া কহিল, রাত্রি হয়ে যাচ্ছে, আপনি বাড়ি গেলেন না? আপনার লোকজন কৈ।

 আমি তাদের পাঠিয়ে দিয়েছি।

 একলা বাড়ি যেতে আপনার ভয় করবে না?

 না, আমার পিস্তল সঙ্গে আছে।

 তবে তাই নিয়ে বাড়ি যান, আমার ঢের কাজ আছে।

 জীবানন্দ কহিল, তোমার থাকতে পারে, কিন্তু আমার নেই। আমি এখন যাবো না।

 ষোড়শীর চোখের দৃষ্টি প্রথর হইয়া উঠিল, কিন্তু শান্তভাবে বলিল, রাত হয়েছে, আমি লোক ডেকে আপনার সঙ্গে দিচ্ছি, তারা বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে।

 জীবানন্দ বুঝিল কথাটা তাহার ভাল হয় নাই। অপ্রতিভ হইয়া কহিল, ডাকতে কাউকে হবে না, আমি আপনিই যাচ্ছি। যেতে আমার ইচ্ছে হয় না, তাই শুধু আমি বলছিলাম। তুমি কি সত্যিই চণ্ডীগড় ছেড়ে চলে যাবে অলকা?

 আবার সেই নাম! জীবানন্দের মুখের পানে চাহিয়া তাহার ক্লেশ বোধ হইল,

১৩৬