বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

খাইয়ে দিয়ে তবে ছাড়বে! কথাটা উচ্চারণ করিয়াই তাহার সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল।

 ঘরের মধ্যে জীবানন্দ খোলা দ্বারের দিকে শূন্যদষ্টিতে চাহিয়া স্থির হইয়া বসিয়াছিল, প্রফুল্ল কহিল, দাদা, আবার একটা নতুন হাঙ্গামা জড়ালেন কেন, চাবিটা ওঁদের দিয়ে দিলেই ত হতো।

 জীবানন্দ তাহার মুখের প্রতি চক্ষু ফিরাইয়া কহিল, হতো না প্রফুল্ল, হলে দিতাম। পাছে এই দুঘটনা ঘটে বলেই সে কাল রাতে আমার হাতে চাবি দিয়েছে।

 প্রফুল্ল মনে মনে বোধ হয় ঠিক বিশ্বাস করিতে পারিল না, জিজ্ঞাসা করিল, সিন্দুকে আছে কি?

 জীবানন্দ একটু হাসিয়া কহিল, কি আছে? আজ সকালে তাই আমি খাতাখানা পড়ে দেখছিলাম। আছে মোহর, টাকা, হীরে, পান্না, মক্তোর মালা, মকুট, নানারকম জড়োয়া গয়না, কত কি দলিলপত্র, তাছাড়া সোনারূপোর বাসনকোসনও কম নয়। কতকাল ধরে জমা হয়ে এই ছোট্ট চণ্ডীগড়ের ঠাকুরের যে এত সম্পত্তি সঞ্চিত আছে, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। চুরি-ডাকাতির ভয়ে ভৈরবীরা বোধ করি কাউকে জানতেও দিত না।

 প্রফুল্ল সভয়ে কহিল, বলেন কি! তার চাবি আপনার কাছে? একমাত্র পুত্র সমপর্ণ ডাইনীর হাতে?

 জীবানন্দ রাগ করিল না, কহিল, নিতান্ত মিথ্যা বলনি ভায়া, এত টাকা দিয়ে আমি নিজেকেও বিশ্বাস করতে পারতাম না। ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, অথচ, এ আমি চাইনি প্রফুল্ল। আমি যতই তাকে পীড়াপীড়ি করলাম জনার্দন রায়কে দিতে, ততই সে অস্বীকার করে জামার হাতে গুঁজে দিলে।

 প্রফুল্ল নিজেও ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, এর কারণ?

 জীবানন্দ কহিল, বোধ হয় সে ভেবেছিল, এ দুর্নামের ওপর আবার চুরির কলঙ্ক চাপলে তার আর সইবে না। এদের সে চিনেছিল।

 প্রফুল্ল বলিল, কিন্তু সে আপনাকে চিনতে পারেনি।

 জীবানন্দ হাসিল, কিন্তু সে হাসিতে আনন্দ ছিল না; কহিল, সে দোষ তার, আমার নয়। তার সম্বন্ধে অপরাধ আমার আর যতদিকেই থাক, আমাকে চিনতে না পারার অপরাধ গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত আমি একটা দিনের তরেও করিনি। কিন্তু আশ্চর্য এই পৃথিবী, এবং তার চেয়েও আশ্চর্য এই মানুষের মন। এ যে কি থেকে কি ঠিক করে নেয়, কিছুই বলবার জো নেই। এর যুক্তিটা কি জানো ভায়া, সেই যে তার হাত থেকে মরফিয়া নিয়ে চোখ বুজে খাওয়ার গল্পটা তোমার কাছে করেছিলাম, সেই হলো তার সকল তর্কের শেষ তর্ক, সকল বিশ্বাসের বড় বিশ্বাস। কিন্তু সে রাত্রে আর কোন উপায় ছিল না, এদিকেও মরি, ওদিকেও মরি―সে ছাড়া আর কারও পানে চাইবার পথ ছিল না―এ-সমস্ত ষোড়শী একদম ভুলে বসে আছে, শুধু একটি কথা তার মনে জেগে রয়েছে, যে নিজের প্রাণটা নিঃসংশয়ে তার হাতে

১৪১