আমার বাল্যকথা/পূজা

উইকিসংকলন থেকে

পূজা

 আমাদের বাড়ী দুর্গা ও জগদ্ধাত্রী—এই দুই পূজা হত। দুর্গোৎসব মহাসমারোহে সম্পন্ন হত। আমাদের উঠানের উপর সামিয়ানা খাটানো আর তিন দিন ধরে নৃত্য গীত আমোদ প্রমোদ, আমাদের আনন্দের আর সীমা থাকতো না। সেই তিন দিন আমরা যেন কল্পনাপ্রসূত এক নূতন রাজ্যে বাস করতুম—নূতন দেশ, নূতন ঋতু, আলো বাতাস সব নূতন। প্রথমে যখন প্রতিমার কাঠাম নির্মাণ আরম্ভ হত তখন থেকে শেষ পর্যন্ত সমুদায় নির্মাণ-কার্য আমরা কৌতূহলের সহিত পর্যবেক্ষণ করতুম। আমাদের চোখের সামনে যেন ছোটখাট একটি সৃষ্টি কার্য চলেছে। প্রথমে খড়ের কাঠাম তার উপর মাটি, খড়ির প্রলেপ তার উপর রং, ক্রমে চিত্র বিচিত্র খুঁটি নাটি আর আর সমস্ত কার্য, সবশেষে অর্ধচন্দ্রাকৃতি চালের পরে দেবদেবীর মূর্তি আঁকা, তাতে আমাদের চোখের সামনে বৈদিক, পৌরাণিক দেবসভা উদ্ঘাটিত হত। ইন্দ্র চন্দ্র বায়ু, ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর, কৃষ্ণলীলা, রাম-রাবণের যুদ্ধ, কৈলাসে হর-পার্বতী, নন্দী ভৃঙ্গি, হনুমান ও গন্ধমাদন, বীণাহস্তে নারদ মুনি, গরুড়বাহন বিষ্ণু, বিষ্ণুর অনন্ত শয্যা, নৃসিংহ অবতার, কিন্নর-গন্ধর্ব-মিলিত ইন্দ্রসভা, গীতায় একাদশ সর্গে যেমন বিশ্বলোকের বর্ণনা আছে, আমাদের এই এই চর্ম চক্ষে সেই বিশ্বলোক আবিষ্কৃত হত। রাংতা দিয়ে যখন ঠাকুরদের দেহমণ্ডন, বসন ভূষণ সাজসজ্জা প্রস্তুত হত, আমাদের দেখতে বড়ই কৌতূহল হত। লক্ষ্মী সরস্বতীর চমৎকার বেশভূষা। লম্বোদর গজানন, গণেশ ঠাকুরের মূষিক তাঁর স্থুল দেহের আড়ালে লুকিয়ে থাকত; কিন্তু কার্তিকের প্যাখম-ধরা ময়ূরের যে বাহার তা কহতব্য নয়। কার্তিক ঠাকুরের অপূর্ব সাজসজ্জা তাঁর গুম্ফজোড়া আকৃতি, বেশভূষা, ফিনফিনে শান্তিপুরে ধুতি—দেখে মনে হত যেন একজন বাঙ্গালী বাবু ময়ূরের উপর এসে অধিষ্ঠান করেছেন। মহিষাসুর বেচারার অবস্থা বড় শোচনীয়, সিংহের কামড়ে তার দক্ষিণ হস্ত অসাড়, এদিকে আবার সিংহবাহিনী দশভুজার বর্শাবিদ্ধ হওয়ায় তার আর নড়ন চড়ন নেই, এ সত্ত্বেও তার মুখে Milton-এর সয়তান সদৃশ কেমন একটা অদম্য বীরত্ব ফুটে বেরচ্ছে।

 পূজার সময় যাত্রা হত। কত রকম যাত্রার দল এসে মহল্লা দিত, তাদের মধ্যে যা সেরা তাই বেছে নেওয়া হত। যাত্রায় বহুলোকসমাগম হত, উঠানটা লোকে লোকারণ্য। আমরা আদ্যোপান্ত সমস্তটা দেখতে পেতুম না, কেবল প্রথম ও শেষ ভাগে এসে বসতুম। প্রহ্লাদ চরিত্রে যে ছেলেটি প্রহ্লাদ সাজত তার বড় মিষ্টি গলা, তার গানে সকলে মোহিত হয়ে যেত। প্রহ্লাদ কত প্রকার উৎপীড়ন সহ্য করছে, আমরা তার দুঃখে অশ্রুপাত করতুম। এত উৎপীড়নেও তার ভক্তির স্খলন নেই। সে আপনাকে শোধরাবার কত চেষ্টা করছে কিন্তু সহস্র চেষ্টাতেও তার চিরকালের অভ্যাস কোথায় যাবে।

কালী কালী বলে ডাকি সদা এই বাসনা
অভ্যাস দোষেতে তবু কৃষ্ণ বলে রসনা।

 কিন্তু যাত্রার গানের চেয়ে আমাদের সং দেখতে বেশী আমোদ হত। রামায়ণের পালাতে সঙের আসল ঘটা—এদিকে রাবণ কুম্ভকর্ণ প্রভৃতি রাক্ষসের দল, ওদিকে আবার রামের বানর সৈন্য,— সবই সঙ্গীন ব্যাপার। আমরা সারারাত কিছু সভায় থাকতুম না, রাত্রিশেষে আমাদের ঘুম থেকে উঠিয়ে আনা হত। কোন ভাল অদ্ভুত রকম সং আসছে তাই দেখবার জন্যে আমরা তাড়াতাড়ি উঠে আসতুম। দেখতে দেখতে তিন দিন চলে গেল—বিজয়া এল, প্রতিমা ভাসান দিতে নিয়ে যাবে— কি আপশোষ! দুর্গা অশ্রুপূর্ণ নয়নে বিদায় নিয়ে চল্লেন, মনে হত সত্যিই দেবীর চক্ষে জল এসেছে। বিজয়ার দিন প্রত্যূষে আমাদের গৃহ-গায়ক বিষ্ণু আগমনী ও বিদায়ের গান করতে আসতেন। যাত্রার গান যেমন প্রাকৃত বিষ্ণুর তেমনি Classical—সে কি চমৎকার ঠেকত, শুনে শ্রোতৃমণ্ডলী মোহিত হয়ে যেত। বিষ্ণুর একটি আগমনী গান আমার এখনো মনে আছে—

আজু পরমানন্দ আনন্দ! মম গৃহে আলো।
যাও যাও সহচরী
আন ডেকে পুরনারী
বরদারে বরণ করি বিলম্বে কি ফল।

এস উমা করি কোলে,
মাকে মা কি ভুলে ছিলে,
এত দিন পরে এলে বুঝি মনে ছিল।

মা হয়ে মমতা মার,
জাননা গো উমা আমার
পাষাণ স্বভাব তোমার কিছু থাকা ভাল॥

 তখনকার পূজার আমোদ প্রমোদ যাত্রা উৎসবের মধ্যে সাত্ত্বিক ভাব, আধ্যাত্মিকতা কি ছিল এক একবার ভাবি। দালানে গিয়ে সন্ধ্যার আরতি দেখতে যেতুম, তাতে ধূপধুনা বাদ্যধ্বনির মধ্যে আমরা ঠাকুরকে প্রণাম করে আসতুম। এত বাহ্য আড়ম্বরের মধ্যে এই যা ভিতরকার আধ্যাত্মিক জিনিস। আমাদের বৈষ্ণব পরিবারে কি ভাগ্যি পশুবলির বীভৎস কাণ্ড ছিল না সেই রক্ষা—পশুর বদলে কুমড়া বলি হয় এই শুনতুম। আধ্যাত্মিক ভাবের আর যা কিছু দেখা যেত সে বিজয়া দশমীর বিসর্জন উপলক্ষে। বিজয়ার রাত্রে শান্তিজল সিঞ্চন ও ছোটবড় সকলের মধ্যে সদ্ভাবে কোলাকুলি, এই অনুষ্ঠানটি বাস্তবিক হৃদয়গ্রাহী মনে হত,—‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ এই বাক্য যেন ঠিক ফলেছে।

 এই পৌত্তলিক উপাসনার মধ্য হতে আস্তে আস্তে অলক্ষিত ভাবে আমাদের পরিবারে অমূর্তের উপাসনা প্রতিষ্ঠিত হল। অল্প বয়স থেকেই মূর্তিপূজার উপর আমার কেমন বিতৃষ্ণা ছিল—যাকে ইংরাজাতে বলে ‘Iconoclast' আমি তাই ছিলুম—তার কারণ পৈত্রিক সংস্কারই বল—আর যাই বল। এক সময়ে আমাদের বাড়ী সরস্বতী পূজা হত। মনে আছে একবার সরস্বতী প্রতিমা অর্চনায় গিয়েছি— শেষে ফিরে আসবার সময় আমার হাতে যে দক্ষিণার টাকা ছিল তাই দেবীর উপরে সজোরে নিক্ষেপ করে দে ছুট! তাতে দেবীর মুকুট ভেঙ্গে পড়ল। এই অপরাধে তখন কোন শাস্তি পেয়েছিলুম কি না মনে নাই, কিন্তু হাতে হাতে সাজা না পেয়ে থাকি তার ফলভোগ এখন বুঝতে পারছি। বাঁশীতে ছিদ্র দেখা দিয়েছে। আমার বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা ক্ষয়ে যাচ্ছে—স্মৃতিভ্রংশ হতে আরম্ভ হয়েছে। আমি যে আমার সর্বিসের সর্বোচ্চ শিখরে উঠতে পারিনি সেও ঐ কারণে। সরস্বতী প্রসন্ন থাকলে হাইকোর্টের আসন অধিকার করে পদত্যাগ করতে পাতুম—আমার ভাগ্যে আর তা হল না!