ধর্ম্মপ্রচারের সহায় হইয়াছিলেন। তাঁহারা উৎকৃষ্ট উৎকৃষ্ট সংস্কৃত গ্রন্থ রচনা এবং কাহারও কাহারও বাঙ্গালা অনুবাদ করিয়া জনসাধারণের নিকট ভাগবতাদি প্রোক্ত বৈষ্ণবধর্ম্মের বিশদ মর্ম্ম ব্যাখ্যা করিয়া যান। তাঁহাদের সেই সুললিত পদলহরী পাঠ ও গান করিয়া অনেকেই বিমুগ্ধচিত্তে শ্রীচৈতন্যের পদে আশ্রয় গ্রহণ করেন। শ্রীজীব গোস্বামী, রূপসনাতন, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, কবিকর্ণপুর, নরোত্তম দাস, বাসুঘোষ, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, বিদ্যাপতি, জয়দেব প্রভৃতি বৈষ্ণব কবিবৃন্দের জ্ঞানগাথা অদ্যাপিও বাঙ্গালার এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত প্রতিধ্বনিত হইয়া থাকে। [শ্রীচৈতন্য ও অপরাপর কবির নাম দেখ।]
বৈষ্ণব-ধর্ম্মবৃক্ষের শাখা প্রশাখারূপে কর্ত্তাভজা, গুরুসত্য, সতী-মা, হরিবোলা, রাতভিকারী এবং উৎকলের সৎকুলী, অনন্তকুলী, কবিরাজী, নিহঙ্গ, বিন্দুধারী, অতিবড়ী প্রভৃতি মতের উদ্ভব হইলেও প্রকৃতপক্ষে তাহা অভিনব ধর্ম্মমত বলিয়া গৃহীত হয় নাই। খৃষ্টীয় ১৯শ শতাব্দের প্রারম্ভকালে রাজা রামমোহন রায় বেদান্ত মত প্রতিপাদ্য ব্রাহ্মমত প্রচার করেন। তাঁহা হইতেই আদি-ব্রাহ্মসমাজের খ্যাতি। তৎপরে তাঁহার প্রবর্ত্তিত মতের সংস্কার করিয়া মহাত্মা কেশবচন্দ্র সেন নববিধান (ব্রাহ্ম) মত প্রতিষ্ঠা করিয়া যান। [রামমোহন রায়, কেশবচন্দ্র সেন ও ব্রাহ্মসমাজ শব্দে বিশেষ বিবরণ দ্রষ্টব্য।]
মহাত্মা রামমোহন যে সময়ে দক্ষিণ-বঙ্গে ব্রাহ্মমত প্রতিষ্ঠা-প্রসঙ্গে সতীদাহাদি নিবারণরূপ হিন্দুধর্ম্ম মত বিরুদ্ধ ঘোরতর সমাজ বিপ্লবকর আন্দোলন লইয়া হিন্দু অধিবাসিবর্গকে বিব্রত কবিয়া তুলিতে ছিলেন, প্রায় সেই সময়েই ১৮২৮ খৃষ্টাব্দে পূর্ব্ববঙ্গে হাজী সরিৎ উল্লা ফরাজী নামক সংস্কৃত ইস্লাম ধর্ম্মমত প্রবর্ত্তন দ্বারা সুন্নী সম্প্রদায়ের এক অভিনব শাখা বিস্তার করিয়াছিলেন[১]। [ফরাজী দেখ।]
বঙ্গের পুরাবৃত্ত।
——
- ↑ Bhattacharja’s Castes and Sects of Bengal গ্রন্থে অন্যান্য সম্প্রদায়ের সংক্ষেপ পরিচয় দ্রষ্টব্য।
বৈদিককালের বঙ্গ।
“ইমাঃ প্রজাস্তিস্রো অত্যায় মায়ং স্তানীমানি বয়াংসি।
বঙ্গাবগধাশ্চেরপাদান্যন্যা অৰ্কমভিতো বিবিশ্র ইতি”॥[৪]
‘বঙ্গাঃ’ অর্থাৎ বঙ্গদেশলাসিগণ, ‘বগধাঃ’ অর্থাৎ মগধবাসিগণ এবং ‘চেরপাদাঃ’ অর্থাৎ চেরজনপদবাসিগণ। এই ত্রিবিধ প্রজাই কি দুর্ব্বলতা কি দুরাহার ও কি বহু অপত্যতায় কাক, চটক ও পারাবতাদি সদৃশ।
বাস্তবিক বৈদিকযুগে বঙ্গদেশ অনার্য্যনিবাস বলিয়া গণ্য ছিল। এই অনার্য্যজাতিদিগকে লক্ষ্য করিয়া প্রাচীন ভাষ্যকারগণ বঙ্গাবগধের রাক্ষস অর্থ করিয়া থাকিবেন। আনন্দতীর্থ সেই প্রাচীন ভাষ্যেরই অনুবর্ত্তী হইয়াছেন।
কেবল ঐতবেয় আরণ্যক বলিয়া নহে, ঋক্সংহিতায় কীকট বা মগধ অনার্য্যনিবাস বলিয়া নিন্দিত। ঐতরেয় ব্রাহ্মণেও ‘পুণ্ড্রাঃ’ বা পুণ্ড্রজনপদবাসী ‘দস্যূনাং ভূয়িষ্ঠা’ ——
- ↑ ঋক্ সংহিতা ৩।৫৩।১৪।
- ↑ ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৭।১৮।
- ↑ অথর্ব্ব-সংহিতা ৫।২২।১৪।
- ↑ এখানে ভাষ্যকার ‘বঙ্গাঃ বনগতা বৃক্ষাঃ’ ‘অবগধাঃ ব্রীহিযবাদ্যা ওষধয়ঃ’ ‘ঈরপাদাঃ ঊরঃপাদাঃ সৰ্পাঃ’ এইরূপ অর্থ করিয়াছেন। আবার ভাষাটীকাকার আনন্দতীর্থ ‘বয়াংসি’ অর্থে পিশাচ, ‘বঙ্গাবগধঃ’ অর্থে রাক্ষস এবং ‘ঈরপাদাঃ’ অর্থে অসুর নির্দ্দেশ করিয়াছেন। সুতরাং ভাষ্যকার ও টীকাকারের মধ্যেও যথেষ্ট মতভেদ দেখা যাইতেছে। ভাষ্যকার যেখানে বৃক্ষ, ওষধি ও সৰ্প অর্থ করিলেন, তাঁহারই টীকাকার সেই স্থানে পিশাচ, রাক্ষস ও অসুর অর্থ স্বীকার করিয়াছেন। এইরূপ মতভেদ দেখিয়া অধ্যাপক মোক্ষমূলর লিখিয়াছেন—“Possibly they are all old ethnic names like Vanga, Chera &c.” (Sacred Books of the East, Vol I. p.202f.) অধ্যাপক সত্যব্রত সামাশ্রমী মহাশয়ও তাঁহার ত্রয়ীটীকায় এইরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন—
“অস্মন্মতে ত্বত্র ‘বঙ্গাবগধাশ্চেরপাদাঃ’ ইত্যস্য ব্যাখ্যানায়েদৃশং কষ্টকল্পনং নিষ্প্রয়োজনম্; অপি ‘বঙ্গা’ বঙ্গদেশীয়াঃ ‘বগধা’ মগধা, ‘চেরপাদাঃ’ চেরনামজনপদবাসিনঃ। তান্ত্রিবিধা এব প্রজাঃ ‘বয়াংসি কাকচটকপারাবতাদিসদৃশাঃ। দুর্ব্বলত্বেন চ সাদৃশ্যম্। ইহাঙ্গদেশস্যাপি মগধত্বেন পরিগ্রহঃ, কলিঙ্গসৌরাষ্ট্রয়োঃ কলিঙ্গান্ধ্রয়োর্বোভয়োরেব চেরপাদ ইতি।” (পৃ. ১৬৩)
ঐতরেয় আরণ্যকের উদ্ধৃত অংশের শেষোক্ত অর্থ সমীচীন বলিয়া গ্রহণ করিলাম।