বিষয়বস্তুতে চলুন

আখ্যানমঞ্জরী (তৃতীয় ভাগ)/যথার্থ বদান্যতা

উইকিসংকলন থেকে

আখ্যানমঞ্জরী।


তৃতীয় ভাগ।


যথার্থ বদান্যতা

ইংল্যাণ্ডের অন্তঃপাতী ফ্রোম নগরে বো নামে এক সঙ্গতিপন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তাঁহার মৃত্যু হইলে তদীয় সহধর্মিণী সমস্ত বিষযেব অধিকাবিণী হইলেন। এই কামিনী নিবতিশয় দয়াশীল ছিলেন, অন্যের দুঃখ দেখিলে, অত্যন্ত দুঃখিত হইতেন, এব সাধ্যানুসারে তাহার দুঃখ বিমোচনে যত্ন করিতেন। তাহার যে নিরূপিত আয় ছিল, গ্রাসাচ্ছাদনের উপযোণী অংশ ব্যতিবিত্ত তৎসমুদয় দীনগণেব দাবিদ্রঃখ নিবাবণে নিয়োজিত হইত ফলতঃ, তিনি সেরূপ পরোপকারীতে দীক্ষিত ছিলেন, সেরূপ সচরাচর নযনগোচর হয় না।

 বিবি বব কতকগুলি গ্রন্থেব বচনা করিয়াছিলেন। তিনি, পুস্তকবিক্রেতাদিগের নিকট হইতে প্রথমবাব যে টাকা পাইলেন এক দীন পরিবাবেব দুরবস্থা দেখি, সমুদয় তাহাদিগকে দান কবিলেন। একদা, আর একটি নিরুপায় পরিবারের দুববস্থা দেখিয়া, তাহার অত্যন্ত দয়া উপস্থিত হইল, কিন্তু যাহাতে তাহাদের যথার্থ উপকার হয়, এরূপ অর্থ তৎকালে তাহার হস্তে ছিল না। উপায়ান্তর না দেখিয়া, অবশেষে, বাসন বিক্রয় করিয়া, তিনি তাহাদেব আনুকূল্য করিলেন। তাহার এই রীতি ছিল, সঙ্গে কিছু না লইয়া, বাটী হইতে বহিগত হইতেন না, কারণ, দীন দুঃখী তাহার সম্মুখে উপস্থিত হইলে, যদি কিছু দিতে না পারিতেন, তাহা হইলে, তাহার অত্যন্ত ক্লেশবোধ হইত।

 তিনি, কেবল ধন দ্বারা সাহায্য করিয়া, ক্ষান্ত থাকিতেন না,অবসরকালে, গৃহে বসিযা, স্বহস্তে নানাবিধ পবিচ্ছদ প্রস্তুত করিয়া রাখিতেন, এবং যখন যাহাদের যেরূপ পরিচ্ছদের অপ্রতুল দেখিতেন, তাহাদিগকে সেইরূপ দিতেন। তিনি অন্যের বিপদে বিপদ জ্ঞান করিতেন, অন্যের শোকে শোক-কুল হইতেন, অন্যকে বোদন কবিতে দেখিলে, অশ্রুপাত না করিয়া থাকিতে পারিতেন না,পীড়িত বা বিপদাপন্ন ব্যক্তি-দিগের সর্বদা তত্ত্বাবধান করিতেন, এবং যে বিষয়ে তাহাদের অপ্রতুল দেখিতেন, নিজ ব্যয়ে তাহার সমাধা করিয়া দিতেন।

 পথিমধ্যে যদি তিনি অপরিচিত বালক দেখিতে পাইতেন, আর যদি, তাহার আকার দেখিলে, সুবোধ ও বুদ্ধিমান্ বলিয়া বোধ হইত, তৎক্ষণাৎ তাহার বিষয়ে সবিশেষ অনুসন্ধান করিতেন, যদি জানিতে পারিতেন, পিতা মাতার অসঙ্গতি-প্রযুক্ত তাহার বিদ্যাশিক্ষা হইতেছে না, অবিলম্বে তাহাকে উপযুক্ত বিদ্যালয়ে নিযুক্ত করিয়া দিতেন, এবং স্বয়ং সমস্ত ব্যয়ের নির্ব্বাহ করিতেন। এইরূপে তিনি অনেক দীন বালকের বিদ্যাশিক্ষার উপায় করিয়া দিয়াছিলেন। তিনি, কখনও কখনও, স্বয়ং পরিশ্রম করিয়া, তাহাদিগকে ধর্ম্ম ও নীতি বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। যখন তিনি কোনও বালককে তাহার অভিলাষানুরূপ ফললাভ করিতে দেখিতেন, আমার যত্ন ও অর্থব্যয় সার্থক হইল ভবিয়া আহ্লাদে পুলকিত হইতেন, তাহার বিপরীত দেখিলে, তাহার শোকের ও ক্ষোভের সীমা থাকিত না।

 তিনি যে কেবল নিতান্ত নিরুপায় লোকদিগকে সাহায্য কবিতেন এরূপ নহে। অপেক্ষাকৃত ভাল অবস্থার লোকেরাও,কষ্টে পড়িলে, তাঁহার নিকট যথেষ্ট আনুকূল্য প্রাপ্ত হইতেন। তিনি বলিতেন, অসঙ্গতি বা অল্প সঙ্গতি প্রযুক্ত, লোকের যে ক্লেশ ও দুর্ভাবনা ঘটে, তাহার নিবারণ করিতে পারিলেই, মানব জাতির যথার্থ উপকার করা হয়। তদনুসারে, যে সকল লোক নিতান্ত নিঃস্ব বা দুরবস্থা গ্রস্ত নহেন, তিনি, তাদৃশ ব্যক্তিদিগেও কষ্ট দেখিলে, বিলক্ষণ সাহায্য করিতেন।

 এই দয়াশীল স্ত্রীলোকের আয় অধিক ছিল না, এজন্য সকলেই, তাহার তাদৃশ দান দেখিয়া, আশ্চর্য্য জ্ঞান করিতেন, তিনি, কিরূপে এই সমস্ত ব্যয়ের নির্বাহ করেন, কিছুই বুঝিতে পারিতেন না।

 তিনি অত্যন্ত অমায়িক, নিতান্ত সরলস্বভাব, ও সর্ব্বথা অহমিকাশূন্য ছিলেন, সর্ব্বদা, সর্ব্ববিধ লোকে সহিত, সদয় ও সৌজন্যপূর্ণ ব্যবহার করিতেন। ফলতঃ, তিনি, কেবল লোকরঞ্জন ও সাধ্যানুসারে লোকের ক্লেশ-নিবাবণের জন্যই জন্ম গ্রহণ কবিয়াছিলেন।

 বিবি বোব মৃত্য হইলে, সকল লোকই যৎপবোনান্তি দুঃখিত হইয়াছিলেন। নিঃস্ব ও নিরুপায় লোকদিগের শোকের ও দুঃখের অবধি ছিল না। তাঁহার অভাবে, তাহারা পৃথিবী অন্ধকাবময় দেখিল এবং তদীয় সদনে ও সমাধিস্থানে সমবেত হইয়া, অত্যন্ত বিলাপ ও তাঁহার পারলৌকিক মঙ্গল প্রার্থন করিতে লাগিল। তিনি যে নিবতিশয় দয়া ও সৌজন্য সহকার তাহাদেব প্রার্থনা শুনিতেন এবং অকাতবে তত্তৎ প্রার্থনা পূণ করিতেন, বহুদিন পর্যন্ত তাহারা, পরস্পর সেই সমস্ত কীর্তন করিতে করিতে অবিশ্রান্ত অশ্রুবিসর্জ্জন কবিত।