আখ্যানমঞ্জরী (দ্বিতীয় ভাগ)/যেমন কর্ম্ম তেমনই ফল
যেমন কর্ম্ম তেমনই ফল
ডেন্মার্কের রাজধানী কোপন্হেগ্ন্ নগরে ক্রিষ্টিয়ন্ টূল নামে এক ব্যক্তি ছিলেন। ক্রিস্টোফর্ বোজন্ ক্রেন্জ্ নামে আর এক ব্যক্তি ঐ নগরে বাস করিতেন। ক্রিষ্টিয়ন্ টূলের মৃত্যু হইলে, তিনি তাঁহার সহধর্ম্মিণীকে বলিলেন, কিছুদিন পূর্ব্বে তোমরা স্ত্রীপুরুষে আমার নিকট যে দশ হাজার টাকা ঋণ করিয়াছ, তাহার পরিশোধ কর। ঐ স্ত্রীলোক বলিলেন, আমরা কখনও আপনার নিকট টাকা ধার করি নাই, আপনি ওরূপ কথা বলিতেছেন কেন? তখন তিনি ঐ স্ত্রীলোকের ও তদীয় স্বামীর স্বাক্ষরিত খত দেখাইলেন। খত দেখিয়া ঐ স্ত্রীলোক বলিলেন, এ খত জাল, আমি কখনও এ খতে নাম স্বাক্ষরিত করি নাই।
রোজন্ ক্রেন্জ্, টাকা আদায়ের জন্য ঐ স্ত্রীলোকের নামে নালিশ করিলেন। বিচারপতি, ঐ স্ত্রীলোকের প্রতি ঋণপরিশোধের আদেশপ্রদান করিলেন। স্ত্রীলোক, নিতান্ত নিরুপায় হইয়া, অবশেষে ডেন্মার্কের অধীশ্বর চতুর্থ ক্রিষ্টিয়নের নিকট আবেদন করিলেন, মহারাজ, আমরা কখনও অমুকের নিকট টাকা ধার করি নাই; তিনি জাল খত প্রস্তুত করিয়া, আদালতে আমার নামে নালিশ করেন। ঐ খত দেখিয়া, বিচারপতি আমার প্রতি ঋণপরিশোধের আদেশ দিয়াছেন। আমি মহারাজের নিকট ধর্ম্মপ্রমাণ বলিতেছি, আমরা উহাব নিকট কস্মিন্ কালেও টাকা ধার করি নাই। মহারাজ, দয়া করিয়া এই বিষয়ের বিচার না করিলে, আমি এ জন্মের মত উচ্ছিন্ন হই।
আবেদনপত্র পড়িয়া রাজা অঙ্গীকার করিলেন, আমি এ বিষয়ের যথোচিত বিচার করিব। অনন্তর তিনি বোজন্ ক্রেন্জ্কে আপন নিকটে আনাইলেন। এ বিষয় তাঁহাব সহিত কিয়ৎক্ষণ কথোপকথন করিয়া, রাজা বুঝিতে পারিলেন, এ দেনা বাস্তবিক নহে। তখন তিনি তাঁহাকে ক্ষান্ত হইবার নিমিত্ত অনেক বুঝাইলেন, অনেক অনুবোধ করিলেন, কিন্তু তাহাতে কোনও ফল দৰ্শিল না। সে ব্যক্তি বলিলেন, মহারাজ, উহারা খত লিখিয়া দিয়া টাকা লইয়াছে; আমি এ টাকা কোনও মতে ছাড়িয়া দিতে পারিব না। রাজা, তাঁহার নিকট হইতে খতখানি লইলেন, এবং বলিলেন, তুমি এক্ষণে এখান হইতে যাও, আমি শীঘ্রই তোমাব খত ফিবাইয়া দিব।
এই বলিযা তাঁহাকে বিদায় দিয়া, রাজা একাকী সেই খতের পরীক্ষা করিতে লাগিলেন। অনেক অনুসন্ধান ও অনুধাবনের পর তিনি দেখিতে পাইলেন, যে কাগজে খত লিখিত হইয়াছে, ঐ কাগজ যে কারখানায় প্রস্তুত হইয়াছিল, ঐ কারখানা, খতের তাবিখের অনেক দিন পরে সংস্থাপিত হইয়াছে। অনন্তর সবিস্তর অনুসন্ধান দ্বারা উহাই যথার্থ বলিযা স্থিরীকৃত হইল। অতঃপর বোজন্ ক্রেন্জ্, জাল খত প্রস্তুত কবিয়াছেন, এ বিষয়ে আর অণুমাত্র সন্দেহ রহিল না। এই বিষয় গোপন বাখিয়া, রাজা কতিপয় দিনের পর, বোজন্ ক্রেন্জ্কে ডাকাইলেন, এবং বলিলেন, আমি পুনরায় তোমায় সবিশেষ অনুরোধ করিতেছি, তুমি এই অনাথা বিধবার উপর দয়াপ্রকাশ কর, যদি না কর, জগদীশ্বর অতিশয় অসন্তুষ্ট হইবেন, এবং তোমাকে যথোপযুক্ত দণ্ড দিবেন। বোজন্ ক্রেন্জ্ বলিলেন, না মহারাজ, আমি এ বিষয়ে কোনও ক্রমে ক্ষান্ত হইতে পারিব না। বলিতে কি, মহারাজ, আমার পক্ষে বিলক্ষণ অবিচার হইতেছে। রাজা বলিলেন, এ বিষয়ের বিবেচনার নিমিত্ত তোমায় এক সপ্তাহ সময় দিতেছি, বিবেচনা করিয়া যাহা স্থির হইবে, এক সপ্তাহ পরে আমায় জানাইবে।
এই বলিয়া সে দিন রাজা তাঁহাকে বিদায় দিলেন। সপ্তাহ অতীত হইলে, সে ব্যক্তি রাজসমীপে উপস্থিত হইলেন; এবং বলিলেন, মহারাজ, আপনকার আদেশ অনুসারে সবিশেষ বিবেচনা ও আত্মীয়বর্গের সহিত পরামৰ্শ করিয়া দেখিলাম, এ টাকা না পাইলে আমার পক্ষে বড় অন্যায় হয়। আমি টাকা ছাড়িয়া দিতে পারিব না। এ বিষযে আপনকার অনুরোধরাক্ষা ও আজ্ঞাপ্রতিপালন করিতে পারিতেছি না; তজ্জন্য আমার যে অপরাধ হইতেছে, দয়া করিয়া তাহার মার্জ্জনা করিবেন।
এই সকল কথা শুনিয়া রাজার কোপানল বিলক্ষণ প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে অবরুদ্ধ ও কারাগারে নিক্ষিপ্ত করিলেন। অনন্তর নির্দ্ধারিত দিবসে জালখতেব বিষয়ে সবিশেষ অনুসন্ধান ও বিচারপূর্ব্বক সেই খত জাল, ইহা সর্ব্বসমক্ষে সপ্রমাণ করিয়া, তিনি ঐ দুবাত্মার যথোপযুক্ত দণ্ডবিধান কবিলেন, এবং সেই বিধবাকে ঋণদায় হইতে সম্পূর্ণ অব্যাহতি দিলেন।