বিষয়বস্তুতে চলুন

আজাদী সৈনিকের ডায়েরী/আজাদ হিন্দ গভর্ণমেণ্টের ঘোষণা

উইকিসংকলন থেকে

 আজ বৈকালে আজাদ হিন্দ গভর্ণমেণ্টের ঘোষণাপত্র দেখিলাম। ঘোষণার নীচে সুভাষচন্দ্র ও তাঁহার মন্ত্রীদের নাম।

 “ভারতের স্বাধীনতা আজ আসন্ন। আজ প্রত্যেক ভারতবাসীর কর্ত্তব্য হইল একটি অস্থায়ী গভর্ণমেণ্ট্ গঠন করিয়া তাহার পতাকাতলে সমবেত হইয়া স্বাধীনতার সগ্রাম করা। কিন্তু ভারতের নেতাগণ আজ কারাগারের অন্তরালে বন্দী এবং জনসাধারণও সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। এ অবস্থায় ভারতে সাময়িক গভর্ণমেণ্ট গঠন বা সেই গভর্ণমেণ্টের অধীনে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা সম্ভব নয়। এইজন্য পূর্ব এশিয়ার ভারতীয় স্বাধীনতা সঙ্ঘের কর্ত্তব্য হইল—স্বদেশ ও বিদেশের সকল দেশপ্রেমিক ভারতীয়ের সমর্থন লইয়া ভারতের অস্থায়ী গভর্ণমেণ্ট গঠন করিয়া আজাদ হিন্দ ফৌজের সাহায্যে স্বাধীনতার শেষ সংগ্রাম পরিচালনা করা।


 অস্থায়ী গভর্ণমেণ্টকে ভারত হইতে বৃটিশ ও তাহার মিত্রদের বিতাড়িত করিবার জন্য যুদ্ধ করিতে হইবে। তাহার পর এই অস্থায়ী গভর্ণমেণ্ট স্বাধীন ভারতের জনগণের ইচ্ছানুসারে এবং তাহাদের বিশ্বাসভাজন একটি স্থায়ী জাতীয় গভর্ণমেণ্ট গঠন করিবেন। ব্রিটিশ ও তাহার মিত্রদের বিতাড়িত করিবার পর স্বাধীন ভারতে স্থায়ী জাতীয় গভর্ণমেণ্ট গঠিত হওয়া পর্য্যন্ত এই অস্থায়ী গভর্ণমেণ্ট দেশের শাসন কার্য্য পরিচালনা করিবেন।

 ১৭৫৭ সালে বাংলা দেশে ব্রিটিশের নিকট প্রথম পরাজয়ের পর ভারতবর্ষের জনগণ এক শত বৎসর ধরিয়া ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিরামহীন প্রচণ্ড সংগ্রাম চালাইয়া আসিতেছেন। এই এক শত বৎসরের ইতিহাস অতুলনীয় বীরত্ব ও আত্মত্যাগের বহু দৃষ্টান্তে সমুজ্জ্বল হইয়া আছে।

 ইতিহাসের পৃষ্ঠায় সিরাজদ্দৌলা, বাঙ্‌লার মোহনলাল, হায়দার আলী, টীপু সুলতান, দক্ষিণ ভারতের ভেলু তাম্পী, আপ্পা সাহেব ভোঁস্‌লে, মহারাষ্ট্রের পেশোয়া বাজী রাও, অযোধ্যার বেগম, পাঞ্জাবের সর্দার শ্যাম সিং আত্রিওয়ন্, ঝান্সীর রাণী লক্ষ্মী বাই, আঁতিয়া টোপি, দুমরাওনের মহারাজ কুন্‌ওয়ার সিং, নানা সাহেব এবং আরও বহু বীরের গৌরবপূর্ণ নাম ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রহিয়াছে।

 আপনাদের দুর্ভাগ্য এই যে, আমাদের পূর্বপুরুষগণ প্রথমে বুঝিতে পারেন নাই যে ব্রিটিশ সমগ্র ভারতবর্ষ গ্রাস করিতে উদ্যত হইয়াছে। তাই তাঁহারা সম্মিলিতভাবে শক্রর বিরুদ্ধে কখনো দণ্ডায়মান হন নাই। তারপর শেষে যখন তাঁহারা ব্রিটিশের অভিসন্ধি বুঝিতে পারিলেন তখন তাঁহারা সম্মিলিত হইলেন। ১৮৫৭ সালে বাহাদুর শাহের নেতৃত্বে তাঁহারা স্বাধীন জাতি হিসাবে শেষ সংগ্রাম করিয়াছিলেন। যুদ্ধের প্রথম দিকে কয়েকটি জয়লাভ করাও সত্ত্বেও দুর্ভাগ্য এবং ত্রুটিপূর্ণ নেতৃত্বের ফলে তাঁহাদের পরাজয় এবং দেশের পরাধীনতা উপস্থিত হইল। তথাপি ঝান্সীর রাণী, তাঁতিয়া টোপি, কুন্‌ওয়ার্ সিং এবং নানা সাহেব জাতির গগনে চিরন্তন নক্ষত্রের ন্যায় জ্যোতিষ্মান থাকিয়া আমাদিগকে অকুণ্ঠিত আত্মত্যাগ এবং সাহসিকতার প্রেরণা দিতেছেন।

 ইহার পর ব্রিটিশ সবলে ভারতবাসীদের নিরস্ত্র করিয়া দিল। ভারতের জনগণ কিছুকাল হতাশ ও হতবাক হইয়া পড়িয়াছিল। ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে কংগ্রেসের জন্মের পর ভারতবাসীর অন্তরে নব জাগরণের বন্যা জাগিল। ১৮৮৫ হইতে প্রথম মহাযুদ্ধ পর্য্যন্ত ভারতবাসী তাহাদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য আন্দোলন, ব্রিটিশ পণ্য বর্জন প্রভৃতি এবং শেষে সশস্ত্র বিপ্লবের পথ পর্য্যন্ত ধরিয়াছে। কিন্তু সকল প্রচেষ্টাই সাময়িক ভাবে ব্যর্থ হইয়া যায়। পরিশেষে ১৯২০ সালে ব্যর্থতার গ্লানিতে আচ্ছন্ন হইয়া ভারতবাসী যখন নূতন পথের সন্ধান করিতেছিল, তখন মহাত্মা গান্ধী অসহযোগিতা এবং আইন অমান্য আন্দোলনের নুতন অস্ত্র লইয়া ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবতীর্ণ হইলেন।

 ইহার পর বিশ বৎসর চলিয়া গেল। এই সময়ের মধ্যে ভারতবাসীগণ নানা প্রকার দেশপ্রেমমূলক কার্য্য করিয়াছে। মুক্তির অমোঘ বাণী ভারতের প্রতিগৃহে পৌঁছিল। দেশবাসী স্বাধীনতার জন্য নির্য্যাতন ও কারাবরণ করিতে শিখিল, আত্মত্যাগ করিতে শিখিল এবং মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিতে শিখিল। কেন্দ্র হইতে সুদূর পল্লী পর্য্যন্ত জনগণ একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে সঙ্ঘবদ্ধ হইল। এইভাবে ভারত শুধু রাজনৈতিক চেতনাই লাভ করিল না, তাহারা একটি অখণ্ড রাজনৈতিক সত্তায় পরিণত হইল। ইহার পর তাহারা এক স্বরে কথা বলিতে পারিল এবং একই আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের জন্য এক মনে সংগ্রাম করিতে শিখিল। ১৯৩৭ হইতে ১৯৩৯ সাল পর্য্যন্ত আটটি প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রীসভা গঠন ও দক্ষতাপূর্ণ কার্য্যের দ্বারা প্রমাণ করিল মে, ভারতবাসী নিজেদের শাসন ব্যবস্থা নিজেদের হস্তে গ্রহণ করিবার ক্ষমতা অর্জ্জন করিয়াছে। এইরূপে বর্ত্তমান মহাযুদ্ধের প্রারম্ভে ভারতের মুক্তির শেষ সংগ্রামের ভূমি প্রস্তুত হইয়াছে।

 বর্ত্তমান যুদ্ধে জার্মাণী তাহার মিত্রদের সহায়তায় ইউরোপে আমাদের শত্রুদের উপর প্রচণ্ডভাবে আঘাত হানিয়াছে। এদিকে জাপানও পূর্ব এশিয়ায় আমাদের শত্রুর উপর প্রবল আঘাত করে। বিভিন্ন অবস্থার অনুকূল সমন্বয়ের ফলে ভারতের জনগণ জাতীয় মুক্তি অর্জ্জনের এক অভূতপূর্ব্ব সুযোগ লাভ করিয়াছে।

 ভারতের ইতিহাসে আর একটি নুতন ঘটনা এই যে, বিদেশে অবস্থিত ভারতীয়গণের মধ্যেও রাজনৈতিক চেতনা জাগিয়াছে এবং তাঁহারাও একটি প্রতিষ্ঠানে সঙ্ঘবদ্ধ হইয়াছেন। তাঁহারা শুধু স্বদেশবাসীর সহিত সমানভাবে চিন্তা করিতেছেন না, স্বাধীনতার পথে তাঁহারাও স্বদেশবাসীর সহিত একতালে চলিতে আরম্ভ করিয়াছেন। পূর্ব এশিয়ায় আজ ত্রিশ লক্ষের অধিক ভারতবাসী এক সুসংবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে সম্মিলিত হইয়াছেন। তাঁহারা আজ পূর্ণ সমরায়োজনে অনুপ্রাণিত। তাঁহাদের সম্মুখে রহিয়াছে ভারতের আজাদ হিন্দ্ ফৌজ এবং তাঁহাদের মুখে কেবল একটিমাত্র কথা—‘দিল্লী চলো’।

 আজ ব্রিটিশ শাসক সম্প্রদায় ভারতবাসীর শুভেচ্ছা হইতে বঞ্চিত হইয়াছে। আজ তাহারা এক সঙ্কটজনক পরিস্থিতির মধ্যে নিমগ্ন হইয়াছে। এই অপ্রীতিকর শাসনের শেষ চিহ্ন বিলুপ্ত করিবার জন্য প্রয়োজন শুধু একটি মাত্র অগ্নিস্ফুলিঙ্গের। সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করিবার ভার আজাদ হিন্দ্ ফৌজের উপর। স্বদেশের অসামরিক জনগণের ও ব্রিটিশ সরকার গঠিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর বহু লোকের বিপুল সমর্থনে এবং বিদেশে আমাদের অজেয় মিত্রবর্গের সহায়তায় ও আত্মশক্তির উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করিয়া আজাদ্ হিন্দ ফৌজ তাহার ঐতিহাসিক ভূমিকা সফলতার সহিত অভিনয় করিবে বলিয়া বিশ্বাস করে।

 ভারতীয় স্বাধীনতা সঙ্ঘ (ইণ্ডিয়ান্ ইণ্ডিপেণ্ডেন্স্ লীগ) এক্ষণে পূর্ব এশিয়ায় আজাদ হিন্দের অস্থায়ী গভর্ণমেণ্ট প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। এখন আমরা পূর্ণ দায়িত্বজ্ঞানের সহিত কর্ত্তব্যে অবতীর্ণ হইতেছি। ভগবানের নিকট আমাদের প্রার্থনা, আমাদের কার্য্য ও মাতৃভূমির মুক্তিসংগ্রামের উপর তাঁহার অনাবিল আশীর্ব্বাদ ধারা বর্ষিত হউক। আজ আমরা দেশের মুক্তির জন্য, দেশবাসীর মঙ্গলের জন্য এবং জগতের সমক্ষে আমাদের মাতৃভূমিকে উন্নত করিবার জন্য আমাদের জীবন পণ করিতেছি।

 এই অস্থায়ী গভর্ণমেণ্ট প্রত্যেক ভারতীয়ের নিকট হইতে আনুগত্য দাবী করিতেছে এবং আনুগত্য লাভের অধিকার ইহার আছে। এই গভর্ণমেণ্ট ধর্ম্মগত স্বাধীনতা এবং সকল দেশবাসীর সমান অধিকার ও সুযোগ ও সুবিধাদানের প্রতিশ্রুতি দিতেছে। ইহা আরও ঘোষণা করিতেছে যে ব্রিটিশের সৃষ্ট সকলপ্রকার বিভেদ উচ্ছেদ করিয়া ইহা সমগ্র দেশের সমস্ত অংশের সুখ সমৃদ্ধি বিধানের পথে সর্ব্বতোভাবে অগ্রসর হইতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

 ভগবানের নামে এবং অতীতে যাঁহারা ভারতীয় জনসাধারণকে সংঘবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন তাঁহাদের নামে, এবং পরলোকগত যে সকল শহীদ আমাদের সম্মুখে বীরত্ব ও আত্মোৎসর্গের মহান আদর্শ স্থাপন করিয়া গিয়াছেন তাঁহাদের নামে—আজ আমরা ভারতীয় জন সাধারণকে আমাদের পতাকাতলে সমবেত হইতে এবং ভারতের স্বাধীনতা লাভের জন্য অস্ত্রধারণ করিতে আহ্বান করিতেছি। ব্রিটিশ এবং তাহার মিত্রদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সংগ্রাম আরম্ভ করিবার জন্য আমরা তাঁহাদের আহ্বান করিতেছি। শত্রু যতদিন না ভারতভুমি হইতে চিরতরে বহিষ্কৃত হয় এবং যতদিন না ভারতবাসী আবার স্বাধীন হয়, ততদিন পর্য্যন্ত আমরা এই সংগ্রাম সাহস, অধ্যবসায় এবং চরম জয়ে বিশ্বাসের সহিত চালাইয়া যাইব।’

 আজাদ হিন্দ সামরিক গভর্ণমেণ্টের পক্ষে—

 সুভাষচন্দ্র বসু  (রাষ্ট্রপতি, প্রধান মন্ত্রী এবং সমর ও পররাষ্ট্র সচিব)

 কাপ্তেন মিসেস্ লক্ষ্মী

(নারী সংগঠন)

 এস্. এ. আয়ার

(প্রচার)

 লে. কর্ণেল এ. সি. চ্যাটার্জ্জি

(অর্থ বিভাগ)

 লে. কর্ণেল আজিজ আহম্মদ

 লে. কর্ণেল এল্ এস্ ভগৎ

 লে. কর্ণেল জে কে ভোঁসলে

 লে. কর্ণেল গুলজারা সিং

 লে. কর্ণেল এম্ জেড্ কিয়ানি

 লে. কর্ণেল এ. ডি. লোকনাথন্

 লে. কর্ণেল এহ্‌সান্ কাদির

(সৈন্য বাহিনীর প্রতিনিধি)

 এ. এম্ সহায়

(মন্ত্রীর পদমর্য্যাদাসম্পন্ন সেক্রেটারি)

 রাসবিহারী বসু

(প্রধান পরামর্শদাতা)

 করিম গণি

 দেবনাথ দাস

 ডি. এম্ খাঁ

 এ ইয়েলাপ্পা

 জে. থিবি

 সর্দ্দার ঈশ্বর সিং

(পরামর্শদাতাগণ)

 এ. এন্ সরকার

(আইন বিষয়ক পরামর্শদাতা)