আজাদী সৈনিকের ডায়েরী/জাপানী অধিকারের পর
৩রা মে ১৯৪২:
আজ সকালে রেঙ্গুন যাত্রা করিব। সবে রাত্রি শেষ হইয়া আসিয়াছে; অস্পষ্ট আলোকের ঢেউ আসিয়া রাত্রির অন্ধকারকে হাল্কা করিয়া আনিয়াছে। এমন সময় ঘরে কে আসিল?—ফয়া!—ফয়াই তো!
ফয়া ঘরের মধ্যে আসিয়া আমার বুকের উপর মাথা রাখিয়া কাঁদিতে লাগিল। বলিল—‘বল, তুমি ফিরিয়া আসিবে।’
অং-ফয়া আমায় ভালবাসিয়াছে। তাহার এ ভালবাসার মর্য্যাদা দিবার ক্ষমতা আমার কোথায়? তাহাকে বলিলাম—‘আবার ফিরিব।’ তাহার চোখের জল মুছাইয়া দিলাম।
৪ঠা মে ১৯৪২: রেঙ্গুন
রেঙ্গুনে আমার বাসায় ফিরিয়াছি। শহরে লোক খুবই কম। রেঙ্গুনের সে সৌন্দর্য্য আর নাই।
একদল জাপানী সিপাহী মার্চ্ করিয়া চলিতেছে। মাথার উপর কয়েকখানি এরোপ্লেন্ উড়িয়া গেল।
পথে ব্যানার্জির সঙ্গে দেখা।
জিজ্ঞাসা করিলাম—‘আপনিতো পূজার সময় দেশে গিয়াছিলেন; বর্মায় কবে আসিলেন?’
‘দাদা, বৌদি রেঙ্গুনে ছিলেন; খবর না পাওয়ায় ২রা জানুয়ারী অনেক কষ্টে এরােপ্লেনে ফিরিয়া আসি তাঁহাদের খোঁজে। আসিয়া জানিলাম—তাঁহারা হাঁটা পথে দেশের দিকে রওনা হইয়াছেন। আমি আর ফিরিতে পারিলাম না। যখন জাপানীরা আসে আমি তাহাদের হাতে পড়ি। ভারতীয় হিন্দু জানিয়া আমায় ছাড়িয়া দেয়।’
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম— ‘এখনো কি ব্যবসায় করিতেছেন?’
‘না। আমি ভারতীয় স্বাধীনতা সঙ্ঘের (ইণ্ডিয়ান ইণ্ডিপেণ্ডেন্স্ লীগ) কাজ করিতেছি।’
‘সে আবার কি?’
‘রাসবিহারী বসুর নাম শুনিয়াছেন তো?’
‘হাঁ শুনিয়াছি। সেই যিনি ভারতবর্ষ হইতে পলায়ন করিয়া জাপানে গিয়াছিলেন?’
‘হাঁ। রাসবিহারী বসু গত মার্চ মাসে টোকিওতে পূর্ব এশিয়ায় প্রবাসী ভারতবাসীদের একটা সম্মিলনের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। ২৮শে হইতে ৩০শে মার্চ, তিন দিন এই সম্মিলন হয়। রাসবিহারী বাবু সভাপতি ছিলেন। সেই সভায় ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য ইণ্ডিয়ান ইণ্ডিপেণ্ডেন্স্ লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়।’
‘জাপানীরা কি ভারতবর্ষ আক্রমণ করিয়াছে?’
‘না। বার্মা তাহারা দখল করিয়াছে। জাপানীরা নিজেরা ভারত আক্রমণ না করিয়া আমাদের অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থ দিয়া সাহায্য করিবে। আপনিও আসুন আমাদের সঙ্গে।’
আমি বলিলাম—‘আমার এখন দরকার অন্নের ব্যবস্থার।’
‘তাহার জন্য চিন্তা নাই। আমি সব ব্যবস্থা করিয়া দিব।’
যাক—উপস্থিত অনাহার হইতে রক্ষা পাইলাম।