আজাদী সৈনিকের ডায়েরী/নাগা পল্লীর নিকটে যুদ্ধ

উইকিসংকলন থেকে

৪ঠা এপ্রিল ১৯৪৪: কোহিমার পথে:

 পার্বত্য পথে চলিয়াছি। পথ প্রদর্শক লালতুই। চারিদিক নিস্তব্ধ। উচ্চ নীচ টিলা, উপত্যকা, বনরাজি, পার্বত্য তটিনী পার হইয়া চলিয়াছি। পথে একটি ছোট ঝরণা পড়িল—ঝির্ ঝির্ করিয়া স্বচ্ছ জল ধারা পাহাড়ের উপর হইতে নামিয়া আসিতেছে। পথ ক্রমে দুর্গম হইয়া আসিয়াছে। সঙ্কীর্ণ পথ—একদিকে খাড়া পাহাড়, অন্য দিকে গভীর খাদ; পদস্খলন হইলে নীচে যে কোথায় গিয়া পড়িব তাহার ঠিক নাই। রানার্ সংবাদ দিয়াছে—শত্রু নিকটেই আছে, সুতরাং আমরা খুব সাবধানে চলিতেছি। সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে—রাত্রির পুঞ্জীভূত অন্ধকার তাহার কালো চাদর খানি দিয়া গাছপালা পাহাড় পর্বত সব ঢাকিয়া ফেলিতেছে। লালতুই বলিল—কাছেই একটি গ্রাম আছে, পথের দুর্গম অংশ শেষ হইয়াছে। অন্ধকারে এরকম পথে চলা কঠিন; আজ রাত্রির মতন এক জায়গায় থাকিবার ব্যবস্থা করিতে হইবে। গ্রামের কাছে আসিয়াছি—কুটীরগুলি অস্পষ্ট দেখা যাইতেছে।

 অর্দ্ধেক রাত্রে কামানের শব্দে জাগিয়া উঠিলাম—গুম্-গুম্। লালতুই বলিল—বোধ হয় কোন গ্রামের লোক আমাদের অবস্থানের সংবাদ দিয়াছে। একটী কুটির জ্বলিতেছে; তাহার আলোকে অনেকটা স্থান আলোকিত হইয়া উঠিয়াছে। সেই আলোকে দেখা গেল শত্রুর সংখ্যা বেশী নয়।

 আমরা গ্রামের শেষপ্রান্তে পাহাড়ের ধারে ছিলাম। শত্রু যেখানে আছে সেই স্থান আমাদের অনেক নীচে। সুবিধা আমাদের দিকে। শত্রু আমাদের ব্রেন্ গানের গণ্ডীর মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছে। আমাদের কামানগুলি এক সঙ্গে গর্জন করিয়া উঠিল। গুম্-গুম্, পট্-পট্-পট্-পট্—মরণের তাণ্ডবলীলা চলিয়াছে। গ্রামের মধ্য হইতে কান্নার শব্দ ভাসিয়া আসিতেছে। শক্রর লক্ষ্য গ্রাম—আমাদের অবস্থান বুঝিতে পারে নাই।

 আগুনের আলোকে দেখিলাম—শত্রু গ্রামের দিকে অগ্রসর হইতেছে। আমাদের মেসিন গান্ তাহাদের উত্তপ্ত আমন্ত্রণ জানাইল।

 শত্রুর অগ্রগতি ব্যাহত হইয়াছে। তাহাদের দিক হইতে কামানের—শব্দ নীরব হইয়া গেল। থাপা বলিল উহার পলায়ন করিল। উভয়পক্ষেই হতাহত হয় নাই।

৫ই এপ্রিল ১৯৪৪:

 আমাদের অগ্রগামী দল কোহিমার কাছে পৌঁছিয়াছে। কোহিমার কাছে যুদ্ধ চলিতেছে।

 আমি ও লালতুই কোহিমার দিকে চলিয়াছি অগ্রগামী সেনাদলের সহিত যোগদানের জন্য।

 বরাক নদী পার হইলাম। বরাকের আর এক নাম—সুরমা। লাল্‌তুই বলিল—এই নদী নাগা পাহাড় হইতে বাহির হইয়া ব্রহ্মপুত্র নদের সহিত মিশিয়াছে। দূরে মণিপুরের সর্ব্বোচ্চ শৃঙ্গ যাপ্‌ডো (৯৮৯০ ফিট্) নীল আকাশে মাথা তুলিয়া যেন ধ্যান করিতেছে।

 পথে পড়িল মাও নামে একটি গ্রাম। এই জায়গাটীও পাহাড়ের উপর। মাও পাহাড় প্রায় ছয় হাজার ফিট উচ্চে।

 ঝাকামা ও কোহিমার মধ্যে পথে নাগা পুরুষ ও নারী দেখিলাম। নাগাদের আকৃতি মঙ্গোলীয়; গায়ের রঙ্ ফর্সা; কলোও দেখা গেল। নাগা মেয়েদের মাথার চুলে বৈচিত্র্য দেখিলাম। লালতুই বলিল— কুমারী মেয়েরা মাথার চুল কপালের দিকে ছোট করিয়া ছাঁটে; বিবাহের পর মাথায় লম্বা চুল রাখে।

৬ই এপ্রিল ১৯৪৪: কোহিমার সম্মুখে:

 আজ এরোপ্লেনে পর্য্যবেক্ষণ করা হইল। দূরে অভ্রভেদী পাহাড়ের উপর কোহিমা পাহাড় (৪৭৩৮ ফিট উচ্চ)। কোহিমা শহরে বেশী ভাগ বাড়ীই টিনের—খেলা ঘরের মত দেখাইতেছিল। মাঝখানে একটি বাগান রহিয়াছে বলিয়া মনে হইল।