আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়)/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

কলিকাতায় শিক্ষালাভ

 ১৮৭০ খৃষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে আমার পিতামাতা স্থায়ীভাবে কলিকাতায় আসিলেন এবং ১৩২নং আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাড়ী ভাড়া করিলেন। আমরা এই বাড়ীতে প্রায় দশ বৎসর বাস করিয়াছিলাম।[১] আমার বাল্যকালের সমস্ত স্মৃতিই ঐ বাড়ী এবং চাঁপাতলা নামে পরিচিত সহরের ঐ অঞ্চলের সঙ্গে জড়িত। আমার পিতা আমাকে ও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে হেয়ার স্কুলে ভর্তি করিয়াছিলেন। হেয়ার স্কুল তখন ভবানীচরণ দত্তের লেনের সম্মুখে একটি একতলা বাড়ীতে অবস্থিত ছিল। এখন ঐ বাড়ী প্রেসিডেন্সী কলেজের রসায়ন বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে।

 আমার সহাধ্যায়ীরা যখন জানিতে পারিল যে, আমি যশোর হইতে আসিয়াছি, তখন আমি তাহাদের বিদ্রুপ ও পরিহাসের পাত্র হইয়া উঠিলাম। আমাকে তাহারা ‘বাঙাল’ নাম দিল এবং মন্দভাগ্য পূর্ববঙ্গবাসীদের যে সব ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে বলিয়া শোনা যায়, তাহার সবই আমার ঘাড়ে চাপানো হইল। এক শতাব্দী পূর্বে স্কটল্যাণ্ডের বা ইয়র্কশায়ারের কোন গ্রাম্য বালক তাহার কথার বিশেষ ‘টান’ এবং ভাব-ভঙ্গীর বিশেষত্ব লইয়া যখন লণ্ডন সহরের বালকদের মধ্যে উপস্থিত হইত, তখন তাহার অবস্থাও কতকটা এই রকমই হইত। তখনকার দিনে জাতীয় জাগরণ বলিয়া কিছুই হয় নাই; সুতরাং অল্প লোকেই জানিত যে, আমার জেলা এমন দুই জন মহাযোদ্ধাকে জন্ম ও আশ্রয় দিয়াছে—যাঁহারা মোগল বাদশাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা উড্ডীন করিয়াছিলেন। অন্যথা বিদ্রুপকারীদিগকে আমি এই বলিয়া নিরুত্তর করিতে পারিতাম যে, রাজা প্রতাপাদিত্যের সামরিক অভিযানের ক্ষেত্রসমূহ আমার গ্রামের অতি নিকটে এবং রাজা সীতারাম রায়ের রাজধানী মহম্মদপুর আমার জেলাতেই অবস্থিত। বাঙ্গলার তদানীন্তন সর্বশ্রেষ্ঠ জীবিত কবি এবং অমিত্রাক্ষর ছন্দের জন্মদাতা “বাংলার মিল্‌টন” আমাদেরই গ্রামের দৌহিত্র এবং তৎকালীন সর্বশ্রেষ্ঠ জীবিত নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র আমাদের জেলাতেই জন্মগ্রহণ করেন এবং স্তন্যপানে পুষ্ট হন—এসব কথা বলিয়াও আমি বিদ্রুপকারীদের নিরস্ত করিতে পারিতাম।

 কলিকাতা আসিবার পূর্বে আমার মানসিক উন্নতি কিরূপ হইয়াছিল, সেকথা এখানে একটু বলিব। পিতার সঙ্গে আমাদের (আমি ও আমার ভাইদের) সম্বন্ধ সরল ও সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল। বই পড়া অপেক্ষা পিতার সঙ্গে কথা বলিয়া আমরা অনেক বিষয় বেশী শিখিতাম। তাঁহার নিকটে গিয়া কথাবার্তা বলিতে ও গল্পাদি করিতে তিনি আমাদের সর্বপ্রকার সুযোগ দিতেন। আমি অনেক সময় দেখিয়াছি, পিতা ও পুত্রের মধ্যে একটা দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান, পুত্র পিতাকে ভয় করিয়া চলে, দুই জনের মধ্যে যেন একটা রুক্ষ্ম নীরবতার সম্বন্ধ বর্তমান। মাতা অথবা পরিবারের কোন বন্ধু পিতা ও পুত্রের মধ্যে অনেক সময়ই মধ্যস্থের কার্য করেন। আমার পিতা সৌভাগ্যক্রমে চাণক্য পণ্ডিতকেও অতিক্রম করিয়াছিলেন।

লালয়েৎ পঞ্চবর্ষাণি দশবর্ষাণি তাড়য়েৎ।
প্রাপ্তে তু ষোড়শে বর্ষে পুত্রমিত্রবদাচরেৎ॥

 ইহাই চাণক্যের উপদেশ। কলিকাতা আসার পূর্বে আমি যখন গ্রাম্য স্কুলে পড়িতাম এবং আমার বয়স মাত্র নয় বৎসর, সেই সময়ে ইতিহাস ও ভূগোলের প্রতি আমার অনুরাগ ছিল। একদিন পিতার ভূগোলের জ্ঞান পরীক্ষা করিতে আমার মনে ইচ্ছা হইল। আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, সিবাস্টপুল কোথায়? তিনি বলিলেন,—‘কি সিবাস্টপুলের কথা বলিতেছ? ইংরাজেরা ঐ সহর কিরূপে অবরোধ করিল, তাহা আমি যেন চোখের সম্মুখে দেখিতেছি।’ এই উত্তর শনিয়া আমি নীরব হইলাম।

 আর একবার ইংরাজের দেশপ্রেম ও কর্ত্তব্যবোধের কথা বলিতে গিয়া তিনি একটি ঘটনার উল্লেখ করেন, যাহা আমাদের যুবকদের সর্বদা স্মরণ রাখা উচিত। সিপাহী বিদ্রোহ আরম্ভ হইয়াছে। স্যর কলিন কাম্প্‌বেল (পরে লর্ড ক্লাইভ) তখন ছুটিতে আছেন এবং এডিনবার্গ ফিলজফিক্যাল ইনষ্টিটিউটে বসিয়া সংবাদপত্র পড়িতেছেন। ইণ্ডিয়া অফিস হইতে তারযোগে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করা হইল, তিনি ভারতে যুদ্ধে যাইতে প্রস্তুত আছেন কিনা? তিনি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন—“হাঁ”। কয়েক মিনিট পরেই আবার তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করা হইল, কখন তিনি যাত্রা করিবার জন্য প্রস্তুত হইবেন? তিনি উত্তর দিলেন “এই মুহূর্তে!”

 আমার পিতার মুখ হইতেই আমি প্রথম শিখি যে, প্রাচীন ভারতে গো-মাংস ভক্ষণ বেশ প্রচলিত ছিল এবং সংস্কৃতে অতিথির এক নামই হইল “গোঘ্ন” (যাঁহার কল্যাণার্থ গোহত্যা করা হয়)।[২] আমার মনে পড়ে তাঁহার মুখেই এই দুইখানি বহির নাম আমি প্রথম শুনি (Young’s ‘Night Thoughts’ and Bacon’s ‘Novum Organum’)। নাম দুইটি আমার কাছে অর্থহীন বোধ হইয়াছিল, ইহা আমি স্বীকার করিতেছি। কয়েক বৎসর পরে আলবার্ট স্কুলে আমি যে সব গ্রন্থ পুরস্কার পাই, তাহার মধ্যে একখানি ছিল এই ‘Night Thoughts’, আমার মন কৌতুহলপ্রবণ ছিল। পড়োশানাতেও আমার অনুরাগ ছিল। সেইজন্য আমি প্রায়ই পিতার গ্রন্থাগারের বইগুলি নাড়াচাড়া করিতাম। জন্‌সনের ডিক্সনারী দুই কোয়ার্টো ভালম, টড কর্তৃক সম্পাদিত এবং ১৮১৬ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত এই বইখানি আমার চিত্ত আকৃষ্ট করিয়াছিল। ইহার মধ্যে প্রাচীন ও বিখ্যাত সাহিত্যিকদের লেখা হইতে যে সব উদ্ধৃতাংশ ছিল, তাহা আমার খুব ভাল লাগিত। আমি এই গ্রন্থের পাতা উল্টাইতাম এবং উদ্ধৃতাংশ মঞ্চস্থ করিতাম, যদিও “Shak.” ‘Beau. and Fl’. এই সব সাঙ্কেতিক চিহ্নের অর্থ আমি বুঝিতাম না। একদিন আমি নিম্নলিখিত পংক্তিগুলি মুখস্থ করিলাম—

 “Ignorance is the curse of God, knowlege the wing wherewith we fly to heaven.”—Shak. আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শুনিয়া বিস্মিত ও আনন্দিত হইলেন।

 সেক্সপীয়রের সঙ্গে আমার পরিচয় ক্রমে ঘনিষ্ঠ বন্ধত্বে পরিণত হইয়াছিল এবং বাল্যকালে আমি যেটকু পড়িয়াছিলাম, তাহার ফলেই অমর কবির নাটকের প্রতি—বিশেষতঃ, বিয়োগান্ত নাটকের প্রতি—আমার অনুরাগ বৃদ্ধি পাইল। স্কুলে আমার ছাত্রজীবনের কতকগুলি ঘটনা এখনও আমার মনে আছে। ক্লাশের বার্ষিক পরীক্ষায়, প্রেসিডেন্সী কলেজের অধ্যাপকেরা আমাদের পরীক্ষক থাকিতেন। প্যারীচরণ সরকার আমাদের ভূগোলের এবং মহেশচন্দ্র ব্যানার্জি ইতিহাসের পরীক্ষক ছিলেন। এই দুইটি বিষয় আমার খুব প্রিয় ছিল, এবং সহাধ্যায়ীদের মধ্যে আমিই এই দুই বিষয়ে বেশী নম্বর পাইতাম। পর পর দুই বৎসর মৌখিক পরীক্ষায় মহেশ বাবুর নিকট আমি পুরা নম্বর পাইলাম। প্রশ্ন করা মাত্র আমি সন্তোষজনক ভাবে তাহার উত্তর দিতাম। একবার তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন,—“তোমার বাড়ী কোথায়?” আমি বলিলাম “যশোর”। এই উত্তরে তিনি বেশ সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন, মনে হয়।

হেয়ার স্কুল

 বর্তমানে যেখানে প্রেসিডেন্সী কলেজ অবস্থিত, পূর্বে সেখানে খোলা ময়দান ছিল এবং এটি আমাদের খেলার মাঠরূপে ব্যবহৃত হইত। স্থানের সঙ্কুলান না হওয়াতে ১৮৭২ খৃষ্টাব্দে হেয়ার স্কুল নূতন বাড়ীতে (এখন যে বাড়ীতে আছে) স্থানান্তরিত হয়। বিদ্যালয় গৃহের একটি ক্লাশের দেয়ালে গাঁথা মর্মরফলকে ডেভিড হেয়ারের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিম্নলিখিত কয়েক লাইন ইংরাজী কবিতা আছে। উহা ডি, এল, রিচার্ডসনের রচিত।

“Ah! warm philanthropist, faithful friend,
Thy life devoted to one generous end:
To bless the Hindu mind with British lore,
And truth’s and nature’s faded lights restore!”

 —হে পরোপকারী বিশ্বস্ত বন্ধু, তোমার জীবন একমাত্র মহৎ উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত হইয়াছিল। সে উদ্দেশ্য, ব্রিটিশ জাতির জ্ঞান বিজ্ঞান দ্বারা হিন্দু জাতির মনকে জাগ্রত করা এবং সত্যের—তথা প্রকৃতির যে আলোক তাহাদের মনে ম্লান হইয়া গিয়াছে, তাহাকে পুনঃ প্রদীপ্ত করা।

 কবিতাটি আমার বড় ভাল লাগিয়াছিল এবং এখনও আমি উহা অক্ষরে অক্ষরে আবৃত্তি করিতে পারি।

 তখন গিরিশচন্দ্র দেব হেয়ার স্কুলের এবং ভোলানাথ পাল প্রতিদ্বন্দ্বী হিন্দু স্কুলের হেড মাষ্টার ছিলেন। গভর্ণমেণ্ট কর্তৃক পরিচালিত এই দুই স্কুল তখন বাংলাদেশের মধ্যে প্রধান বিদ্যালয় ছিল এবং উভয়ের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলিত। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় কোন স্কুলের ছাত্র প্রথম স্থান লাভ করিবে তাহা লইয়া বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলিত। তখনকার দিনে কলিকাতায়, শুধু কলিকাতায় কেন, সমস্ত বাংলায় বে-সরকারী স্কুলের সংখ্যা খুব কম ছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রিন্সিপালরূপে জেমস সাট্‌ক্লিফ হেয়ার ও হিন্দু উভয় স্কুলের কর্তা ছিলেন এবং তিনি প্রতি শনিবার নিয়মিত ভাবে আমাদের স্কুল পরিদর্শন করিতে আসিতেন। আমার পড়াশুনার বেশ অভ্যাস ছিল, কিন্তু তাই বলিয়া আমি পুস্তক-কীট ছিলাম না। স্কুলের নির্দিষ্ট পাঠ্য পুস্তকে আমার জ্ঞান-তৃষ্ণা মিটিত না। আমার বই পড়ার দিকে খুব ঝোঁক ছিল এবং যখন আমার বয়স মাত্র ১২ বৎসর সেই সময় আমি শেষরাত্রে ৩টা, ৪টার সময় উঠিয়া কোন প্রিয় গ্রন্থকারের বই নির্জনে বসিয়া পড়িতাম। পরে আমি এই অভ্যাস ত্যাগ করি; কেননা, ইহাতে স্বাস্থ্যের ব্যাঘাত হয়, লাভও বিশেষ কিছু হয় না। এখন পর্যন্ত ইতিহাস ও জীবনচরিত আমার খুব প্রিয় জিনিষ। চেম্বারের জীবনচরিত আমি কয়েকবার আগাগোড়া পড়িয়াছি, নিউটন ও গ্যালিলিওর জীবনী আমার বড় ভাল লাগিত, যদিও সে সময়ে জ্ঞান-ভাণ্ডারে তাঁহাদের দানের মহিমা আমি বুঝিতে পারিতাম না। সার উইলিয়াম জোন্স, জন লেডেন এবং তাঁহাদের ভাষাতত্ত্বের অগাধ জ্ঞান আমার মনকে প্রভাবান্বিত করিত। ফ্রাঙ্কলিনের জীবনীও আমার অত্যন্ত প্রিয় ছিল। জোন্সের প্রশ্নের উত্তরে তাঁহার মাতার সেই উক্তি— ‘পড়িলেই সব জানিতে পারিবে’—আমি ভুলি নাই। আমার বাল্যকাল হইতেই বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন আমাকে খুব আকৃষ্ট করিতেন এবং ১৯০৫ সালে আমি যখন দ্বিতীয়বার ইংলণ্ডে যাই, সেই সময় তাঁহার একখানি ‘আত্মচরিত’ সংগ্রহ করিয়া বহুবার পাঠ করি। পেন্সিলভেনিয়া প্রদেশের এই মহৎ ব্যক্তির জীবনী চিরদিনই আমার নিকট আদর্শ স্বরূপ ছিল— কিরূপে সামান্য বেতনের একজন কম্পোজিটার হইতে তিনি নিজের অদম্য অধ্যবসায় ও দুর্জয় শক্তির দ্বারা দেশের একজন প্রধান ব্যক্তিরূপে গণ্য হইয়াছিলেন, তাহা আমি সবিস্ময়ে স্মরণ করিতাম।

ব্রাহ্ম সমাজ

 কতকটা আশ্চর্যের বিষয় হইলেও, বাল্যকাল হইতেই আমি ব্রাহ্মসমাজের দিকে আকৃষ্ট হইয়াছিলাম। নানা কারণে ইহা ঘটিয়াছিল। আমার পিতা বাহ্যতঃ প্রচলিত হিন্দুধর্মে নামমাত্র বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু অন্তরে পূর্ণরূপে সংস্কারবাদী ছিলেন। আমার পিতার গ্রন্থাগারে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার খুব সমাদর ছিল। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন, রাজনারায়ণ বসু, অযোধ্যানাথ পাকড়াশী, অক্ষয়কুমার দত্ত প্রভৃতির রচনা ও উপদেশ ক্রমে ক্রমে আমার মনে ধর্মভাবের বীজ বপন করিয়াছিল। কোন শক্তিশালী ব্যক্তিবিশেষের প্রভাব আমার মনের ধর্মবিশ্বাস গড়িয়া তোলে নাই। কোন অপৌরুষেয় ধর্মে আমি স্বভাবতই বিশ্বাস করিতাম না। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ফ্রান্সিস উইলিয়াম নিউম্যানের রচনাবলী, ফ্রান্সেস পাউয়ার কব্ এবং রাজনারায়ণ বসুর পত্রাবলী, আমার মনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। ‘জর্মাণ স্কুলের’ অন্যতম প্রতিনিধি ট্রস বাইবেলের যে নব্য সংস্কারমূলক আলোচনা করিয়াছিলেন, তাহাও আমার মনে লাগিত। ট্রস প্রণীত ‘Life of Christ the Man’ গ্রন্থে খৃষ্টের জীবনের অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃত ঘটনাবলী বর্জিত হইয়াছে। এই গ্রন্থ ব্রাহ্মসমাজের পূর্বাচার্যগণের বিশেষ প্রিয় ছিল। রেনানের ‘Life of Jesus’ গ্রন্থকেও এই পর্যায়ে ফেলা যায়। আমার পরিণত বয়সে মার্টিনের Endeavours After the Christian Life’ এবং ‘Hours of Thought’ থিওডোর পার্কার ও চ্যানিংএর রচনাবলী আমার নিত্য সহচর ছিল। বিশপ কোলেনসোর The Pentateuch Critically Examined’ নামক গ্রন্থ আমার পড়িবার সুযোগ হয় নাই। কিন্তু অন্য গ্রন্থে এই পুস্তকের যে উল্লেখ আছে, তাহাতেই আমি ইহার উদ্দেশ্য ও মর্ম উপলব্ধি করিতে পারিয়াছি। পরবর্তী কালে, মুসা কর্তৃক প্রচারিত সৃষ্টির সময়পঞ্জী এবং পৃথিবীর বয়স সম্বন্ধে ভূবিদ্যার আবিষ্কার এই উভয়ের মধ্যে গভীর অনৈক্য অপৌরুষেয় ধর্মে আমার বিশ্বাস আরও নষ্ট করে। হিন্দু সমাজের প্রচলিত জাতিভেদ এবং তাহার আনুষঙ্গিক ‘অস্পৃশ্যতা’ আমার নিকট মানুষের সঙ্গে মানুষের স্বাভাবিক সম্বন্ধের ঠিক বিপরীত বলিয়া মনে হইত। বাধ্যতামূলক বৈধব্য, বাল্য বিবাহ এবং ঐ শ্রেণীর অন্যান্য প্রথা আমার নিকট জঘন্য বলিয়া বোধ হইত। আমার পিতা প্রায়ই বলিতেন যে, তাঁহার অন্ততঃ একটি ছেলে বিধবা বিবাহ করিবে এবং আমাকেই তিনি এই কার্যের উপযুক্ত মনে করিতেন। ব্রাহ্ম সমাজের সমাজ-সংস্কারের দিকটাই আমার মনের উপর বেশী প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল।

 কেশবচন্দ্র সেন ১৮৭১ খৃষ্টাব্দে বিলাত হইতে ফিরিয়া “সুলভ সমাচার” নামক এক পয়সা মূল্যের সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। এই কাগজে অনেক নূতন ভাব থাকিত। কেশবচন্দ্রের নূতন সমাজ—ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে প্রতি রবিবার সন্ধ্যায় আমি তাঁহার ধর্মোপদেশ শুনিতে যাইতাম। আদি ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর কেশবচন্দ্রই এই নূতন সমাজ স্থাপন করেন। কেশবচন্দ্রের গম্ভীর ওজম্বিনী কণ্ঠস্বরের ঝঙ্কার এখনও আমার কানে রাজিতেছে। টাউন হলে কিম্বা ময়দানে বা অ্যালবার্ট হলে কেশবচন্দ্রের বক্তৃতা শনিবার সুযোগ আমি কখনই ত্যাগ করিতাম না।

 ১৮৭৪ সাল আমার জীবনের একটি গুরুতর ঘটনাপূর্ণ বৎসর। আমি সেই সময় ৪র্থ শ্রেণীতে পড়িতাম। আগষ্ট মাসে আমার গুরুতর রক্তামাশয় রোগ হইল এবং ক্রমে ঐ রোগ এত বাড়িয়া উঠিল যে, আমাকে স্কুলে যাওয়া ত্যাগ করিতে হইল। এ পর্যন্ত আমার স্বাস্থ্য ভাল ছিল, পরিপাকশক্তি বা ক্ষুধারও কোন গোলযোগ ছিল না। আমি পৈতৃক অধিকারে সবল ও সুগঠিত দেহ পাইয়াছিলাম। কিন্তু আমার ব্যাধি ক্রমে স্থায়ী রোগ হইয়া দাঁড়াইল এবং যদিও সাত মাস পরে তাহার তীব্রতা কিছু হ্রাস পাইল, তথাপি আমার স্বাস্থ্য ভাঙ্গিয়া গেল এবং পরিপাকশক্তি নষ্ট হইল। আমি ক্রমে দুর্বল হইয়া পড়িলাম এবং তরুণ বয়সেই আমার শরীর আর বাড়িল না। আমি বাধ্য হইয়া আমার আহার সম্বন্ধে কড়াকড়ি নিয়ম মানিয়া চলিতে কৃতসংকল্প হইলাম।

 এক বিষয়ে এই ব্যাধি আমার পক্ষে আশীর্বাদ স্বরূপ হইল। আমি সব সময়েই লক্ষ্য করিয়াছি যে, ক্লাশে ছেলেদের পড়াশনা বেশীদদূর অগ্রসর হয় না। কতকগুলি ছেলের বুদ্ধি প্রখর নহে, কতকগুলির বুদ্ধি মাঝারি গোছের, আর অল্পসংখ্যক ছেলের বুদ্ধিই উচ্চশ্রেণীর থাকে। এই সব রকম ছেলেকেই একসঙ্গে শিক্ষা দেওয়া হয়, ফলে ইহাদের সকলের বুদ্ধি ও মেধার গড়পড়তা অনুসারে পড়াশুনার উন্নতি হয়; তার বেশী হয় না। ক্লাশে এক ঘণ্টা বক্তৃতা ৪৫ মিনিটের বেশী নহে, তার মধ্যে ছেলেদের হাজিরা ডাকিতেই প্রায় ১০ মিনিট সময় যায়। ইটন, রাগবী, হ্যারো প্রভৃতির মত ইংরাজী স্কুলে এমন অনেক সুবিধা আছে, যাহার ফলে এই সব ত্রুটির অন্য দিক দিয়া সংশোধন হয়। ঐ সব স্কুলে ছেলেরা এমন অনেক বিষয় শিখে, যাহা অমূল্য এবং যাহার ফলে তাহাদের চরিত্র গঠিত হয়। বই পড়িয়া যাহা শেখা যায় না, এরূপ সব বিষয়ে সেখানে তাহারা শিখে। ‘ওয়াটারলুর যুদ্ধ ইটন স্কুলের ক্রীড়াক্ষেত্রেই জিত হইয়াছিল’— ওয়েলিংটনের এই উক্তির মধ্যে অনেকখানি সত্য নিহিত আছে। এই সব স্কুলের হেডমাষ্টারদের অনেক সময় বিশপের পদে অথবা অক্সফোর্ড´ বা কেম্ব্রিজের মাষ্টারের পদে উন্নতি হয়। এইরূপ স্কুল একজন আর্নল্ড—অন্ততপক্ষে বাটলারের—গর্ব করিতে পারে।[৩] কিন্তু বাঙ্গালী ছেলেরা সাধারণতঃ যে সব স্কুলে পড়ে, তাহাদের এমন কোন সুবিধা নাই। এখানে তাহাকে এমন এক ভাষায় শিক্ষালাভ করিতে হয়, যাহা তাহার মাতৃভাষা নহে এবং ইহাই তাহার উন্নতির পক্ষে একটা প্রধান বাধা স্বরূপ।

 ছেলে যদি ক্লাশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছাত্র হয়, তাহা হইলেও ক্লাশে তাহার পড়াশুনার উন্নতি ধীর গতিতে হইতে বাধ্য। অজ্ঞাতসারে তাহার মনে একটা গর্ব হয়, কোন কোন সময়ে সে আত্মম্ভরী হইয়া উঠে। বাস্তবিক পক্ষে সে কতটুকু শিখে— অতি সামান্যই। অনেক সময় সে ভাবে যে, যাহা তাহাকে শিখিতে হইবে, তাহা তাহার পাঠ্য পুস্তকের সঙ্কীর্ণ গণ্ডীর মধ্যেই আছে। তাহার জ্ঞান-ভাণ্ডার অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। এতদ্ব্যতীত, প্রখর বুদ্ধিশালী ছাত্র যেটকু তাহার পক্ষে একান্ত প্রয়োজন, সেইটুকু আয়ত্ত করিবার কৌশল শিখে। ক্লাশের প্রধান ছাত্রই যে সব সময়ে সর্বোৎকৃষ্ট ছাত্র, ইহাও সত্য নহে; যদিও কোন কোন সাধারণ শিক্ষক তাঁহার সঙ্কীর্ণ দৃষ্টির দ্বারা সেইরূপ মনে করিতে পারেন বটে।

 লর্ড বায়রণ এবং আমাদের রবীন্দ্রনাথ—অঙ্কে অত্যন্ত কাঁচা ছিলেন এবং সেই কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁহাদের সাফল্যের পথ রুদ্ধ হইয়াছিল। স্যর ওয়াল্টার স্কটের শিক্ষক ভবিষ্যৎ বাণী করিয়াছিলেন যে, তিনি (স্কট) একজন গর্দ্দভ এবং চিরজীবন গর্দ্দভই থাকিবেন। এডিসনের শিক্ষক তাঁহাকে তাঁহার মাতার নিকট এই বলিয়া পাঠাইয়া দিয়াছিলেন যে, তিনি (এডিসন) অত্যন্ত নির্বোধ।

 শিক্ষার আরও উচ্চ স্তরে যাওয়া যাক। প্রায় দেড় শত জন “সিনিয়ার র‍্যাংলারের” জীবন আলোচনা করিয়া দেখা গিয়াছে যে, পরবর্তী জীবনে তাঁহাদের অধিকাংশের কৃতিত্ব সম্বন্ধে কোন কথা শোনা যায় নাই, তাঁহারা বিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষকরূপে জীবনযাপন করিয়াছেন মাত্র।

 যাহা হউক, এইরূপে স্কুলের বৈচিত্র্যহীন শুষ্ক পাঠ্যপ্রণালী হইতে মুক্ত হইয়া আমি মনের সাধে নিজের ইচ্ছানুযায়ী অধ্যয়ন করিবার সুযোগ লাভ করিলাম। আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা এই সময়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলেন, তিনি পিতার লাইব্রেরীতে আরও বহু মূল্যবান পস্তক সংগ্রহ করিলেন। লেথব্রিজের ‘Selections from Modern English Literature’ তখন প্রবেশিকা পরীক্ষার্থীদের পাঠ্য ছিল। এই বহি আমার এত প্রিয় ছিল যে ইহা আগাগোড়া কয়েকবার পড়িয়াছি। Selections পড়িয়া আমার জ্ঞানতৃষ্ণা মিটিল না, কিন্তু ইহা ইংরাজী সাহিত্যের সঙ্গে আমার পরিচয়ের সোপানস্বরূপ হইল। গোল্ডস্মিথের ‘Vicar of Wakefield’ আমি পুনঃপুনঃ পাঠ করিলাম এবং উহার প্রত্যেক চরিত্রই আমার নিকট পরিচিত হইয়া উঠিল। স্কোয়ার থর্ণহিল, মিঃ বার্চেল, অলিভিয়া, সোফিয়া, মোসেস এবং সেই অননুকরণীয় গীতি—‘দি হারমিট’ এবং অলিভিয়ার সেই বিলাপ-গীতি— ‘When lovely woman stoops to folly’ —অর্ধ্বশতাব্দী পূর্বে আমার যেরূপ মনে ছিল, এখনও সেইরূপ আছে। ইহা বিশেষরূপে উল্লেখযোগ্য, কেন না ইংরাজ পাদরীর পারিবারিক জীবন সম্বন্ধে আমার কোন অভিজ্ঞতাই ছিল না। বহু বৎসর পরে ইংলণ্ডে অবস্থানকালে জর্জ ইলিয়টের ‘Scenes from Clerical Life’ ঐ ভাবে আমাকে মুগ্ধ করিয়াছিল। বস্তুতঃ মানব-প্রকৃতি দেশ-কাল-জাতিধর্মনির্বিশেষে, সর্বত্রই এক এবং কবির প্রতিভা যেখানে মানব-প্রকৃতির গভীর রহস্য ব্যক্ত করে, তখন তাহা সকলেরই হৃদয় স্পর্শ করে। “স্পেক্টেটর” হইতে কতকগুলি প্রবন্ধ এবং জন্‌সনের ‘রাসেলাস’ও আমি পড়িয়াছিলাম। ‘রাসেলাসের’ প্রথম প্যারা— Ye, who listen with credulity ইত্যাদি আমি এখনও অক্ষরে অক্ষরে আবৃত্তি করিতে পারি। শীঘ্রই আমি উচ্চশ্রেণীর ইংরাজী সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়িলাম। নাইটের ‘Half-hours with the Best Authors’ এই বিষয়ে আমাকে সহায়তা করিয়াছিল। সেক্সপীয়রের জুলিয়াস সীজর, মার্চেণ্ট অব ভিনিস এবং হ্যামলেটের কতকগুলি নির্বাচিত অংশ (যথা—Soliloquy) আমার সম্মুখে নূতন জগতের দ্বার খুলিয়া দিল এবং পরবর্তী জীবনে মহাকবির বহিগুলি যতদূর পারি পড়িব, ইহাই আমার অন্যতম আকাঙ্ক্ষা হইল।

 এই সময়ে বাঙ্গলা সাহিত্যে নবযুগের প্রবর্তক “বঙ্গদর্শন” মাসিক পত্র প্রকাশিত হইল। ইহাতে বঙ্কিমচন্দ্রের “বিষবৃক্ষ” ধারাবাহিকরূপে বাহির হইতেছিল। যদিও সেই অল্পবয়সে নিপুণহস্তে অঙ্কিত মানব-চরিত্রের ঐ সব সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ আমি বুঝিতে পারিতাম না, তবুও কেবল গল্পের আকর্ষণে আমি ঐ প্রসিদ্ধ উপন্যাস অসীম ঔৎসুক্যের সঙ্গে পড়িতাম। প্রফল্লচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের— ‘বাল্মীকি ও তাঁহার যুগ’ এবং রামদাস সেনের ‘কালিদাসের যুগ’ আমার মন পুরাতত্ত্বের দিকে আকৃষ্ট করিল। এখানে বলা আবশ্যক যে, “বিবিধার্থ-সংগ্রহে” রাজেন্দ্রলাল মিত্রের ‘বাঙ্গলার সেনরাজগণ’ ও ঐ শ্রেণীর অন্যান্য প্রবন্ধ বাংলার পুরাতত্ত্ব আলোচনার সূত্রপাত করে। তখন কল্পনা করি নাই যে, পুরাতত্ত্বের প্রতি আমার এই আকর্ষণ পরবর্তিকালে “হিন্দু রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাস” রচনাকার্যে আমাকে সহায়তা করিবে।

 ‘বঙ্গদর্শনের’ দৃষ্টান্তে যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ কর্তৃক সম্পাদিত ‘আর্যদর্শন’ প্রকাশিত হইল। এই পত্রিকার প্রধান বিশেষত্ব ছিল, জন ষ্টুয়ার্ট মিলের আত্মচরিতের অনুবাদ। উহা আমার মনের উপর গভীর রেখাপাত করিল। একটা বিষয় আমি বিশেষভাবে লক্ষ্য করিলাম। জেমস্ মিল তাঁহার প্রতিভাশালী পুত্রকে কোন সাধারণ স্কুলে পাঠান নাই এবং নিজেই তাহার বন্ধু ও শিক্ষক হইয়াছিলেন। অল্পবয়সে জন ষ্টুয়ার্ট মিলের বুদ্ধিবৃত্তির অসাধারণ বিকাশের ইহাই কারণ মনে করা যাইতে পায়ে। মাত্র দশ বৎসর বয়সে জন ষ্টুয়ার্ট মিল লাটিন ও গ্রীক ভাষা, পাটীগণিত এবং ইংলণ্ড, স্পেন ও রোমের ইতিহাস শিখিয়া ফেলিয়াছিলেন।

পাঠে অনুরাগ

 আমি তখনকার দিনের তিনখানি প্রধান সাপ্তাহিক পত্রের নিয়মিত পাঠক ছিলাম— দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত ‘সোমপ্রকাশ’, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ (তখন ইংরাজী ও বাংলা উভয় ভাষায় প্রকাশিত হইত) এবং কৃষ্ণদাস পাল কর্তৃক সম্পাদিত ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’। ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’র শ্লেষপূর্ণ মন্তব্য এবং সরকারী কর্মচারীদের স্বেচ্ছাচারের তীব্র সমালোচনা আমি খুব উপভোগ করিতাম। নরেন্দ্রনাথ সেনকৃষ্ণবিহারী সেনের যুগ্ম সম্পাদকতায় প্রকাশিত ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’ তখন এ অঞ্চলে সম্পূর্ণরূপে ভারতীয়দের কর্তৃত্বে পরিচালিত একমাত্র ইংরাজী দৈনিক ছিল। এই কাগজ পাইবার জন্য আমার এত আগ্রহ ছিল যে, ক্লাশ আরম্ভ হইবার একঘণ্টা পূর্বে আমি অ্যালবার্ট হলে উহা পড়িবার জন্য যাইতাম ৷

 এখানে এমন একটি ঘটনা বর্ণনা করিব, যাহা আমার জীবনের গতি ও প্রকৃতি পরিবর্তিত করিয়া দিয়াছিল। একদিন আমি আমাদের গ্রন্থাগারে স্মিথের Principia Latina নামক একখানি বহি দেখিলাম। বহিখানি নিশ্চয়ই আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কোন পুরাতন পুস্তকের দোকান হইতে কিনিয়া আনিয়াছিলেন। কয়েকপাতা উল্টাইয়াই আমি বিস্মিত ও আনন্দিত হইলাম। ইহাতে যে সব পদ ও বাক্য ছিল, চেষ্টা করিয়া তাহার অর্থবোধ আমার হইল। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা আমার পড়া ছিল। আমি দেখিলাম ল্যাটিন ও সংস্কৃত এই দুই প্রাচীন ভাষায় আশ্চর্য সাদৃশ্য। দৃষ্টান্ত স্বরূপ ল্যাটিন ভাষায় Recuperata pace, artes efflorescunt (শান্তি প্রতিষ্ঠিত হইলে শিল্পকলার বিকাশ হয়) এই বাক্যটির উল্লেখ করা যাইতে পারে। সংস্কৃতে অনুরূপ পদকে ভাবে ৭মী বলে। ইহাতে আমার মন বিস্ময়ে পূর্ণ হইল। সেই অল্পবয়সে এই দুই ভাষার মধ্যে আশ্চর্য সাদৃশ্য সম্পর্কে সমস্ত বিষয় বুঝিবার মত জ্ঞান বা বুদ্ধি আমার হয় নাই, অথবা উহারা যে একটী মূল ভাষা হইতেই উৎপন্ন (Grimm’s Law, Bopp’s Comparative Grammar of the Indo-Aryan Languages প্রভৃতিতে যেরূপ ব্যাখ্যাত হইয়াছে), তাহা ধারণা করিবার শক্তিও আমার ছিল না। কিন্তু আমি তখনই ল্যাটিন শিখিবার সঙ্কল্প করিয়া ফেলিলাম এবং সে সঙ্কল্প অবিলম্বে কার্যে পরিণত করিলাম। শিক্ষকের সাহায্য ব্যতীত এই আমার ল্যাটিন ভাষা শিখিবার সুযোগ। আমি Principia র পাঠগুলি নূতনভাবে মনোযোগ সহকারে দেখিতে লাগিলাম এবং শীঘ্রই Principia র প্রথমভাগ শেষ করিয়া ফেলিলাম। তার পর দ্বিতীয়ভাগ এবং ব্যাকরণ ও পড়িলাম।

 প্রায় সাত মাস আমাশয়রোগে ভুগিবার পর আমি অনেকটা ভাল হইলাম কিন্তু ঐ রোগ একেবারে সারিল না, ১৮৭৫ সাল হইতে জীর্ণব্যাধি রূপে উহা আমার সঙ্গের সাথী হইয়া আছে। উহার ফলে অজীর্ণ, উদরাময় এবং পরে অনিদ্রা রোগেও আমি আক্রান্ত হইলাম। আমি আহারাদি সম্বন্ধে খুব কড়াকড়ি নিয়ম পালন করিতে বাধ্য হইলাম। ক্ষুধাবৃদ্ধি করিবার জন্য সকালে ও সন্ধ্যায় ভ্রমণ করার অভ্যাস করিলাম। যখন গ্রামে থাকিতাম, তখন মাটি কাটিতাম বা বাগানের কাজ করিতাম। সাঁতার দেওয়া এবং নৌকা চালনাও আমার প্রিয় ব্যায়ামের মধ্যে ছিল।

 একটা কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়াকে কেন যে আমি প্রকারান্তরে আশীর্বাদ স্বরূপ মনে করিয়াছিলাম, তাহা এখন বুঝা যাইবে। আমি অনেক সময় লক্ষ্য করিয়াছি, সবলদেহ যুবকেরা তাঁহাদের ‘বাঘের ক্ষুধার’ গর্ব করেন এবং প্রচুর পরিমাণে আহার করেন। কিছু দিন পর্যন্ত তাঁহাদের বেশ ভালই চলে। কিন্তু প্রকৃতি একদিকে যেমন যাহারা তাহার নিয়ম পালন করে তাহাদের উপর সদয়, অন্যদিকে তেমনি নিয়ম লঙ্ঘনকারীদের কঠোর হস্তে শাস্তিদান করিয়া থাকে। এই সমস্ত লোক গর্ববশতঃ স্বাস্থ্যের সাধারণ নিয়ম ভঙ্গ করে, ফলে বহুমূত্র, বাত, স্নায়বিক বেদনা প্রভৃতি রোগে ভুগিয়া থাকে। সম্প্রতি কলিকাতার কয়েকটী জমিদার পরিবারে আমার যাইবার প্রয়োজন হইয়াছিল। যদিও তখন বেলা দশটা, তথাপি তাঁহাদের কেহ কেহ শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করেন নাই। অন্য কেহ কেহ তাঁহাদের বিশাল দেহ লইয়া বসিতে অসমর্থ হইয়া মেজের কার্পেটের উপর অজগর সর্পের মত পড়িয়া ছিলেন। আমি তাঁহাদের মুখের উপর বলিলাম যে, তাঁহাদের সমস্ত ঐশ্বর্যের সঙ্গেও আমি আমার সাদাসিধা অভ্যাস ও কর্মময় জীবন বিনিময় করিতে পারি না। কিন্তু কেবল এই শ্রেণীর লোককে দোষ দিয়া লাভ কি? আমাদের কোন কোন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, যাঁহাদের জন্য সমস্ত ভারত গৌরবান্বিত, স্বাস্থ্যের প্রাথমিক নিয়মগুলি উপেক্ষা করাতে অকালে ইহলোক ত্যাগ করিতে বাধ্য হইরাছেন। অতিরিক্ত মানসিক পরিশ্রম অথচ শরীর চালনার অভাব—ইহারই ফলে কেশবচন্দ্র সেন, কৃষ্ণদাস পাল, বিচারপতি তেলাঙ্গ, বিবেকানন্দ, গোখেল প্রভৃতি বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত হইরা অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছেন। ৪৪ বৎসর হইতে ৪৬ বৎসর বয়সের মধ্যে তাঁহাদের অধিকাংশের মৃত্যু হইয়াছে; অথচ ঐ বয়সে একজন ইংরাজ-মাত্র জীবন-মধ্যাহ্নে উপনীত হইয়াছে বলিয়া মনে করে। ইহার দ্বারা দেশের যে কত বড় ক্ষতি হয়, তাহার ইয়ত্তা করা যায় না। মনে ভাবুন, গোখেল যদি আরও দশ বৎসর বাঁচিয়া থাকিতেন, তবে দেশের লাভ হইত! গোখেল যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইনের খসড়া উপস্থিত করিয়াছিলেন, তাহা গবর্ণমেণ্টের সহানুভূতির অভাবে এমনভাবে উপেক্ষিত হইত না। এতদিনে উহা নিশ্চয়ই দেশের আইনে পরিণত হইত।

 ফ্রুড কৃত কার্লাইলের জীবন চরিত যাঁহারা পড়িয়াছেন তাঁহারা স্মরণ করিতে পারিবেন, যে, উক্ত স্কচ দার্শনিক ও মনীষী যখন এডিনবার্গে ছাত্র ছিলেন, তখন তিনি বিষম উদরের বেদনায় ভুগিতেন। অনিদ্রারোগও তাঁহার চিরসহচর ছিল। অথচ স্বাস্থ্যের বিধি কঠোরভাবে পালন করিয়া এবং নিয়মিতভাবে ব্যায়াম করিয়া তিনি কেবল দীর্ঘজীবন লাভ করেন নাই, জ্ঞানের ক্ষেত্রেও অসাধারণ পরিশ্রম করিতে পারিয়াছিলেন। হারবার্ট স্পেনসার কার্লাইলের অপেক্ষাও রোগে বেশি ভুগিয়াছিলেন। আমি এরূপ আরও অনেক দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিতে পারি। কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক বোধে তাহা হইতে বিরত হইলাম।

 ল্যাটিন সামান্য কিছু শিখিয়া আমি দেখিলাম যে স্মিথের French Principia (Parts I & II) কাহারও সাহায্য ব্যতীত আমি বেশ পড়িতে পারি। ফরাসী, ইটালীয়ান ও স্পেনিশ এই তিন ভাষাই ল্যাটিন হইতে উদ্ভূত; সুতরাং মূল ভাষা ল্যাটিন জানিলে, ঐ তিন শাখা ভাষা অনায়াসেই আয়ত্ত করা যায় এবং এক একটি নূতন ভাষা শিক্ষা করিতে পারিলে যেন এক একটি নূতন জগতের দ্বার উন্মুক্ত হইয়া যায়। সুতরাং আমার জীবনের এই অংশের কথা এখনও যে আমি আনন্দের সঙ্গে স্মরণ করি, তাহার বিশেষ কারণ আছে। কিন্তু যত সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হই না কেন, ইংরাজী সাহিত্য আমাকে যেন যাদু করিয়াছিল। কে. এম্. ব্যানার্জির Encyclopaedia Bengalensis—আমার পিতা যৌবনে পড়িয়াছিলেন। ঐ বহিতে Arnold's Lectures of Roman History, Rollin's Ancient History, এবং Gibbon's Roman Empire হইতে নির্বাচিত অংশ ছিল। ঐগুলি আমার মনের উপর আপনি প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। কয়েক বৎসর পরে বিখ্যাত রোম সম্রাটের Meditations পড়ি। গিবনের প্রসিদ্ধ রোমকসম্রাটত্রয়ের চরিত্রচিত্র (হাড্রিয়ান, এণ্টোনিনাস পিয়াস এবং মার্কাস আরেলিয়াস—ইহারা যেন ভগবানের আদেশে পর পর আবির্ভূত হইয়াছিলেন)—আমার চিন্তাক্লিষ্ট মস্তিষ্ককে অনেক সময় শান্ত করিয়াছে। আমার এই পরিণত বয়সেও, ল্যাবরেটরীতে সমস্ত দিন কাজ করিবার পর আমি লাইব্রেরীতে গিয়া একঘণ্টা ইতিহাস বা জীবনচরিত পড়িয়া বিশ্রাম লাভ করি, তার পর ময়দানে ভ্রমণ করিতে যাই।

 পূর্বোক্ত চেম্বারের Biography ব্যতীত মণ্ডারের Treasure of Biographyও আমার বড় প্রিয় ছিল। আমি ঐ বইয়ের যেখানে ইচ্ছা খুলিয়া পড়িতে আরম্ভ করিতাম এবং পাতার পর পাতা পড়িয়া যাইতাম। একদিন ঐ বইতে আমি রামমোহন রায় সম্বন্ধে প্রবন্ধটি পাইলাম এবং দেখিলাম যে ঐ প্রবন্ধটিই স্কুল বুক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত Reader No. IV এ অবিকল উদ্ধৃত হইয়াছে—যদিও তাহা স্বীকার করা হয় নাই। এই রীডারই হেয়ার স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীতে পাঠ্য ছিল। Treasury of Biographyতে বহু মহৎ লোকের জীবনী আছে, তন্মধ্যে কেবলমাত্র একজন বাঙ্গালীর জীবনী সন্নিবিষ্ট করিবার যোগ্য বিবেচিত হইয়াছে। ইহা দেখিয়া আমার মনে বেদনাও হইল।

 যখন আমাশয় ব্যাধি হইতে আমি অনেকটা মুক্ত হইলাম, তখন আবার নিয়মিত ভাবে স্কুলে পড়িতে আমার ইচ্ছা হইল। আমি কোন্ স্কুলে ভর্তি হইব, তৎসম্বন্ধে আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিলাম। আমার পিতা এ সব বিষয়ে মাথা ঘামাইতেন না। আমার উপর তাঁহার পূর্ণ বিশ্বাস ছিল, এবং আমার পছন্দমত যে কোন স্কুলে ভর্তি হইবার জন্য তিনি আমাকে স্বাধীনতা দিয়াছিলেন। আমি প্রায় দুই বৎসর স্কুলে অনুপস্থিত ছিলাম, সুতরাং সে হিসাবে আমি আমার সহপাঠীদের পিছনে পড়িয়াছিলাম। স্কুলের সেসনও তখন অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছে। বৎসরের অবশিষ্ট সময়ের জন্য আমি অ্যালবার্ট স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হইলাম। ঐ স্কুল তখন সবেমাত্র কেশবচন্দ্র সেন এবং তাঁহার সহকর্মীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে এবং স্বভাবতই ইহার প্রতি আমার বিশেষ আকর্ষণ ছিল। কেশবচন্দ্রের কনিষ্ঠ ভ্রাতা কৃষ্ণবিহারী এই স্কুলের ‘রেকটর’ (কার্যতঃ হেড মাষ্টার) ছিলেন। কিন্তু সে সময়ে তিনি অল্প কিছুকালের জন্য জয়পুরে মহারাজার কলেজের প্রিন্সিপাল হইয়া গিয়াছিলেন। কৃষ্ণবিহারীর স্থানে শ্রীনাথ দত্ত কাজ করিতেছিলেন। শ্রীনাথ দত্ত লণ্ডনে এবং সাইরেনচেষ্টারে কৃষি-বিদ্যার শিক্ষা সমাপ্ত করিয়া কিছুদিন হইল দেশে ফিরিয়াছেন। এই স্কুলে আমি আমার মনের মত পারিপার্শ্বিক অবস্থা পাইলাম। শিক্ষকেরা সকলেই ব্রাহ্ম সমাজের লোক। কেশবচন্দ্র যখন জাতিভেদ ত্যাগ করিয়া আদি ব্রাহ্ম সমাজ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া নূতন সমাজ স্থাপন করিলেন, তখন এই শিক্ষকেরা তাঁহার পতাকাতলে আসিয়া সমবেত হইলেন। এই সব সংস্কারের অগ্রদূতগণকে কিরূপ সামাজিক নির্যাতন সহ্য করিতে হইয়াছিল, তাহা এখনকার যুবকগণ ধারণা করিতে পারিবেন না। যাঁহারা পিতামাতার প্রিয় সন্তান, তাঁহাদের আশাভরসার স্থল, তাঁহাদিগকে অনেক ক্ষেত্রে পিতৃগৃহ ত্যাগ করিয়া অন্যত্র আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইয়াছিল। কিন্তু তাঁহারা সাহসের সঙ্গে সানন্দচিত্তে কোন দ্বিধা বা আপত্তি না করিয়া এই সমস্ত সহ্য করিয়াছিলেন। এই স্কুলে ভর্তি হইবার পর দুই মাস যাইতে না যাইতেই, সকলে আমার কথা লইয়া আলোচনা করিতে লাগিল। আমার শিক্ষকেরা শীঘ্রই বুঝিতে পারিলেন যে আমার সহপাঠীদের অপেক্ষা আমি সকল বিষয়েই শ্রেষ্ঠ এবং অল্পবয়সে আমার এই অনন্যসাধারণ কৃতিত্ব সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। যখনই Etymology বা শব্দরূপ সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন উঠিত, আমি তৎক্ষণাৎ তাহার মৌলিক অর্থ বলিয়া দিতে পারিতাম। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, হোয়াইটের Natural History of Selborne হইতে উদ্ধৃত একটি লাইনে nidification এই শব্দটী ছিল। আমার ল্যাটিনের সামান্য জ্ঞান হইতে ঐ ভাষার সহিত সংস্কৃতের সাদৃশ্য উপলব্ধি করিয়াছিলাম।

Nidus = Nidas (সংস্কৃত নীড়)
Decem = Dasam (সংস্কৃত দশম)

 কিন্তু পরবর্তী সেসন হইতে হেয়ার স্কুলে ফিরিয়া যাইবার জন্য আমি মনে মনে আশা পোষণ করিতেছিলাম। ইহার প্রতিষ্ঠাতার নামের সঙ্গে বহু গৌরবময় স্মৃতি জড়িত ছিল এবং শিক্ষাজগতে এই স্কুল একটা নিজস্ব ধারাও গড়িয়া তুলিয়াছিল। পক্ষান্তরে অ্যালবার্ট স্কুল নূতন স্থাপিত হইয়াছিল এবং এই স্কুল হইতে কোন প্রতিভাশালী খ্যাতনামা ছাত্রও বাহির হয় নাই। সুতরাং আমি ক্লাশের বার্ষিক পরীক্ষা দিলাম না। পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করিয়া পুরস্কার লাভ করিব, এ বিশ্বাস আমার ছিল; কিন্তু পুরস্কার লাভ করিবার পর ঐ স্কুল ছাড়িয়া যাওয়া আমার পক্ষে অন্যায় মনে হইয়াছিল। এই সব কথা ভাবিয়াই আমি পরীক্ষা দিলাম না। আমি আমার নিজ গ্রামে গিয়া দীর্ঘ ছুটী ভোগ করিলাম এবং নিজের ইচ্ছামত গ্রন্থ অধ্যয়নের সঙ্গে সঙ্গে কৃষিকার্যের দিকেও মন দিলাম।

 বাল্যকাল হইতেই আমি একটু লাজুক ছিলাম এবং সমবয়সী ছেলেদের সঙ্গে মিশিতাম না। অধ্যয়ন, কৃষিকার্য ও ব্যায়ামই আমার প্রিয় ছিল। আমার বরাবর এইরূপ অভিমত যে, যেসব ছেলেরা সহরে মানুষ, তাহারা সহরের বদভ্যাসগুলির হাত হইতে মুক্ত হইতে পারে না। তাহারা কৃত্রিম আবহাওয়ার মধ্যে লালিত পালিত হয়। ফলে নিজেদের তাহারা শ্রেষ্ঠ জীব মনে করে এবং গ্রাম্য বালকদের কথাবার্তা, ভাবভঙ্গী, আচার ব্যবহার লইয়া তাহারা নানারূপ শ্লেষ বিদ্রুপ বর্ষণ করে। তাহারা গ্রামের লোকদের প্রতি সহানুভূতিও বোধ করে না। জনৈক ইংরাজ কবি তাঁহার সময়ে গ্রাম্য জীবনের প্রতি সহুরে লোকদের এইরূপ অবজ্ঞার ভাব লক্ষ্য করিয়া, ক্ষুব্ধচিত্তে লিখিয়াছিলেন—

Let not Ambition mock their useful toil,
Their homely joys, and destiny obscure;
Nor Grandeur hear with a disdainful smile
The short and simple annals of the poor.

 বর্তমানে, যাহারা চিরজীবন সহরে বাস করিয়া আসিয়াছে, তাহাদের মুখে “গ্রামে ফিরিয়া যাও” এই ধূয়া শুনিতে পাই। কিন্তু তাহাদের মুখে এসব তোতাপাখীর বুলি, কেননা তাহাদিগকে যদি ২৪ ঘণ্টার জন্যও সরল অনাড়ম্বর গ্রাম্যজীবন যাপন করিতে হয়, তবে তাহারা দিশাহারা হইয়া পড়ে। কৃষক ও জনসাধারণের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সংসর্গের জন্যই আমি ১৯২১ ও ১৯২২ সালে দুর্ভিক্ষ ও বন্যাপীড়িতদিগের সেবায় আত্মনিয়োগ করিতে পারিয়াছিলাম।[৪]

 আমি বৎসরে দুইবার গ্রামে যাইতাম—শীতে ও গ্রীষ্মের অবকাশে। ইহার ফলে আমার মন সহরের অনিষ্টকর প্রভাব হইতে অনেকটা মুক্ত হইত। আমার এই বৃদ্ধবয়সেও, শৈশবস্মৃতি জড়িত গ্রামে গেলে আমি যেমন সুখী হই এমন আর কিছুতেই হই না।

 আমার পিতার বৈঠকখানায় যাঁহারা আসিতেন, তাঁহাদের সঙ্গ আমি স্বভাবতঃ এড়াইয়া চলিতাম। কিন্তু সরল গ্রাম্যলোকদের সঙ্গে আমি খুব প্রাণ খুলিয়া মিশিতাম। আমি অনেক সময়ে তাহাদের পর্ণকুটীরে যাইতাম, সেকালে গ্রামে মুদীর দোকান খুব কমই ছিল; সাগু, এরারুট, মিছরী প্রভৃতি রোগীর প্রয়োজনীয় পথ্য গ্রামে অর্থব্যয় করিয়াও পাওয়া যাইত না। আমি রুগ্ন গ্রামবাসীদের মধ্যে এই সকল জিনিষ বিতরণ করিতে ভালবাসিতাম। মাতার ভাণ্ডার হইতেই আমি এই সব দ্রব্য গ্রহণ করিতাম, এবং আমার মাতাও সানন্দে এবিষয়ে আমাকে সাহায্য করিতেন।

 ১৮৭৬ সালের জানুয়ারী মাসের প্রথমভাগে আমি কলিকাতায় ফিরিলাম। অ্যালবার্ট স্কুলের কর্তৃপক্ষের নিকট, যতদূর পর্যন্ত আমি পড়িয়াছি, তাহার জন্য সার্টিফিকেট চাহিলাম। উদ্দেশ্য হেয়ার স্কুলে অনরূপ শ্রেণীতে ভর্তি হইব। কিন্তু কালীপ্রসন্ন ভট্টাচার্য[৫] প্রমুখ আমার শিক্ষকেরা সকলে মিলিয়া আমাকে এই কার্য হইতে নিবৃত্ত করিতে চেষ্টা করিলেন। কৃষ্ণবিহারী সেন মহাশয়েরও শীঘ্রই জয়পুর হইতে ফিরিবার কথা ছিল। সুতরাং আমি মত পরিবর্তন করিলাম। আমার জীবনে এই আর একটী শুভ ঘটনা। হেয়ার স্কুলে শিক্ষকদের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ অনেকটা কৃত্রিম ছিল। ক্লাসের বাহিরে তাঁহাদের সঙ্গে আমাদের কোন সম্বন্ধ ছিল না, সেস্থলে তাঁহারা যেন আমাদের অপরিচিত ছিলেন।

 হেয়ার স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে আমাদের প্রধান শিক্ষক ছিলেন চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি মুখভঙ্গী করিতেন। তাঁহার অট্টহাস্য ও মুখভঙ্গী, আমাদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করিত। তাঁহার বিশাল বলিষ্ঠ দেহ, ঘন গুম্ফ এবং মুখাকৃতির জন্য তাঁহাকে বাঘের মত দেখাইত। সেই জন্য আমরা তাঁহার নাম দিয়াছিলাম ‘বাঘা চণ্ডী’। পক্ষান্তরে অ্যালবার্ট স্কুলে আমাদের শিক্ষকেরা শান্ত ও মধুর প্রকৃতির আদর্শস্বরূপ ছিলেন। আদর্শ শিক্ষকের যে সব গুণ থাকা উচিত, আদিত্যকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সে সবই ছিল। আমি যেন এখনও চোখের উপর দেখিতেছি, তাঁহার অধরে মৃদু হাস্য এবং মুখ হইতে শান্ত জ্যোতি বিকীর্ণ হইতেছে! মহেন্দ্রনাথ দাঁকেও আমরা সমান ভালবাসিতাম। ইঁহারা উভয়েই সামাজিক নির্যাতন হাসিমখে সহ্য করিয়া ব্রাহ্মসমাজে যোগ দিয়াছিলেন। আমি এবং আমার দুই একজন সহাধ্যায়ী তাঁহাদের বাড়ীতে প্রায়ই যাইতাম এবং তাঁহাদের সঙ্গে সকল বিষয়ে খোলাখুলি আলাপ করিতাম। ব্রাহ্ম সমাজের তত্ত্বসমূহ তাঁহারা আমাদের নিকট ব্যাখ্যা করিতেন; অন্য ধর্মের সঙ্গে ইহার প্রধান পার্থক্য এই যে ইহা অপৌরুষেয় নহে; ইহার প্রধান ভিত্তি প্রজ্ঞা ও বোধি (Rationalism and Intuition)। জীবনে এই আমি প্রথম Intuition বা বোধির অর্থ অনুধাবন করিতে চেষ্টা করিলাম। আদর্শ শিক্ষকের ব্যক্তিগত সংসর্গের প্রভাব কিরূপ তাহা আমি বুঝিতে পারিলাম। ইহার বহুদিন পরে যখন আমি Tom Brown's School Days নামক বইখানি পড়ি, তখন আমার পুরাতন শিক্ষকের কথা মনে হইয়াছিল; রাগবী স্কুলের আর্নল্ড কেন যে ছাত্র পরম্পরাক্রমে সকলের হৃদয় জয় করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, তাহাও আমি বুঝিতে পারিয়াছিলাম।

 অর্দ্ধশতাব্দী পূর্বের কথা স্মরণ করিলে, আমি অ্যালবার্ট স্কুলের শিক্ষকদের কথা— তাঁহাদের সঙ্গে আমাদের স্নেহ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্বন্ধের কথা সকৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি। পুরস্কার বিতরণের সময় আমি অবশ্য পুরস্কার পাইলাম না, কেননা আমি বহুদিন স্কুলে অনুপস্থিত ছিলাম। কিন্তু শিক্ষকেরা ব্যাপারটি অশোভন হয় দেখিয়া পরামর্শ করিয়া আমাকে সকল বিষয়ে উৎকর্ষতার জন্য একটী বিশেষ পুরস্কার দিলেন। পর বৎসর আমি পরীক্ষায় প্রথম হইলাম এবং বহু পুস্তক পুরস্কার পাইলাম। ঐ সব পুস্তকের মধ্যে হ্যাজ্‌লিট কর্তৃক সম্পাদিত সেক্সপীয়রের সমস্ত গ্রন্থাবলী, ইয়ংয়ের Night Thoughts ও থ্যাকারের English Humorists ছিল।

 কৃষ্ণবিহারী সেন জয়পুর হইতে ফিরিয়া স্কুলের ‘রেক্টরের’ কর্তব্যভার গ্রহণ করিলেন। তিনি সুপণ্ডিত ছিলেন—ইংরাজী সাহিত্যে তাঁহার প্রগাঢ় অধিকার ছিল, তবে তিনি বক্তৃতা করিতে পারিতেন না। এ বিষয়ে তাঁহার ভ্রাতা কেশবচন্দ্র সেনের তিনি বিপরীত ছিলেন। কেশবচন্দ্রের বাগ্মিতা বহু সভায় ব্রিটিশ শ্রোতৃমণ্ডলীকে পর্যন্ত বিচলিত করিয়াছিল। কৃষ্ণবিহারীর ছিল লিখিবার ক্ষমতা এবং সে ক্ষমতা তিনি উত্তমরূপেই চালনা করিতে পারিতেন। তিনি “ইণ্ডিয়ান মিররের” যুগ্মসম্পাদক ছিলেন, অন্যতম সম্পাদক ছিলেন তাঁহার খুল্লতাতভ্রাতা নরেন্দ্রনাথ সেন। ‘মিররে’ যে রবিবার সংখ্যা প্রকাশিত হইত, কৃষ্ণবিহারী একাই তাহার সম্পাদক ছিলেন। এই সংখ্যায় কেবলমাত্র ধর্ম সম্বন্ধেই আলোচনা থাকিত। বস্তুতঃ ইহা ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম মুখপত্র ছিল।

 কেশবচন্দ্র এবং তাঁহার সহকর্মীদের উদ্যোগে অ্যালবার্ট হল তখন সবেমাত্র স্থাপিত হইয়াছে। হলের নীচের তলায় স্কুলের ক্লাস বসিত, উপর তলার হলে এবং রিডিং রুমের পাশের কয়েকটি ঘরেও ক্লাস বসিত। রিডিং রুমের টেবিলের উপর প্রধান প্রধান সাময়িক পত্র, দৈনিক পত্র প্রভৃতি রক্ষিত হইত। আমি ক্লাস বসিবার এক ঘণ্টা পূর্বে রিডিং রুমে যাইয়া ঐসব সাময়িক পত্র প্রভৃতি যতদূর পারি পড়িতাম।

 এই সময় রুশ-তুর্ক যুদ্ধ বাধিয়াছিল। ওসমান পাশা প্লেভ্‌না এবং আহম্মদ মুক্তার পাশা কার্‌স কিভাবে শত্রুহস্ত হইতে রক্ষা করিতেছিলেন জগৎবাসী, বিশেষতঃ, এসিয়াবাসীরা তাহা সবিস্ময়ে লক্ষ্য করিতেছিল। দিনের পর দিন সংবাদপত্র পাঠ করিয়া আমি যুদ্ধের গতি প্রকৃতি অনুধাবন করিতাম। বলা বাহুল্য আমার সহানুভূতি সম্পর্ণরূপে তুর্কদের প্রতিই ছিল, কেননা তাহারাই একমাত্র এসিয়াবাসী জাতি—যাহারা ইউরোপের উপর তখনও প্রাধান্য বিস্তার করিয়াছিল। মনে পড়ে, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সঙ্গে যুদ্ধের নৈতিক আদর্শ লইয়া আমার তুমুল তর্কবিতর্ক হইত। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা প্ল্যাডষ্টোনের বাক্যের দ্বারা প্রভাবান্বিত হইয়াছিলেন এবং প্ল্যাডষ্টোনের অনুকরণ করিয়া বলিতেন—তুর্কীরা “অপাংক্তেয়” এবং তাহাদিগকে মালপত্র সমেত ইউরোপ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দেওয়া উচিত।

 কৃষ্ণবিহারীর শিক্ষকতায় ইংরেজী সাহিত্যের প্রতি আমার অনুরাগ বৃদ্ধি পাইল। যাহারা কতকগুলি পদের প্রতিশব্দ দিয়া এবং কতকগুলি শব্দের ব্যাখ্যা করিয়াই কর্তব্য শেষ করে, কৃষ্ণবিহারী সেই শ্রেণীর সাধারণ শিক্ষক ছিলেন না। তাঁহার শিক্ষাদানের প্রণালী সম্পর্ণ স্বতন্ত্র ছিল। তিনি যে বিষয়ে পড়াইতেন তৎসম্বন্ধে নানা নূতন তথ্য সংগ্রহ করিয়া বিষয়টি চিত্তাকর্ষক করিয়া তুলিতেন। একদিন পড়াইতে পড়াইতে তিনি বলিলেন যে বায়রণ স্কটকে Apollo's venal son এই আখ্যা দিয়াছেন। এই কথা শুনিয়া আমার কবি বায়রণ সম্বন্ধে জানিতে ইচ্ছা হইল। বায়রণ গ্রীকদিগকে তুরস্কের বন্ধনশৃঙ্খল ছিন্ন করিবার জন্য যে উদ্দীপনাময়ী বাণী শুনাইয়াছিলেন আমি ইতিপূর্বেই তাহা কণ্ঠস্থ করিয়াছিলাম। স্কটের Ivanhoe উপন্যাসে যে পরিচ্ছেদে লড়াই দ্বারা বিচার মীমাংসা করিবার বর্ণনা আছে, তাহাও আমি পড়িয়াছিলাম। আমি এখন আমাদের লাইব্রেরী হইতে বায়রণ ও স্কটের অন্যান্য কাব্য গ্রন্থাবলী খুঁজিয়া পড়িতে আরম্ভ করিলাম। বাল্যবয়সের আমার এই প্রয়াস যদিও বামন কর্তৃক দৈত্যের অস্ত্রসম্ভার হরণের মতই বোধ হইতে পারে বটে, কিন্তু আমি “English Bards and Scotch Reviewers” নামক রচনায় বায়রণ এডিনবার্গের সাহিত্য সমালোচকদের প্রতি যে তাঁর শ্লেষ বর্ষণ করিয়াছিলেন, তাহা পড়িয়া বেশ আনন্দ উপভোগ করিলাম।

 আমি আমার জীবনের এই অংশের কথা বিস্তৃতভাবেই বর্ণনা করিলাম, কেননা দুই এক বৎসরের পরেই এমন সময় উপস্থিত হইল, যখন আমাকে সাহিত্য ও বিজ্ঞান এই দুইটির মধ্যে একটিকে বাছিয়া লইতে হইল। আমি সাহিত্যের মায়া ত্যাগ করিয়া বিজ্ঞানেরই আনুগত্য স্বীকার করিলাম এবং বিজ্ঞান নিঃসংশয় একনিষ্ঠ সেবককেই চাহিল।

 আমি প্রবেশিকা পরীক্ষা দিলাম। আমার শিক্ষকদের আমার সম্বন্ধে খুব উচ্চ আশা ছিল। তাঁহারা আমার পরীক্ষার ফল দেখিয়া একটু নিরাশ হইলেন। কেননা আমার নাম বৃত্তিপ্রাপ্তদের তালিকার মধ্যে ছিল না। আমি নিজে এই বিষয় শান্তভাবেই গ্রহণ করিলাম। যাহারা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতিষ্করূপে মুহূর্তকাল উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়া পরমুহূর্তেই নিবিয়া যায়, যাহারা আজ খুবে যশের অধিকারী, কিন্তু কালই বিস্মৃতির গর্ভে বিলীন হইবে, সেরূপ ছেলেদের কথা মনে করিয়া আমি বরাবরই মনে মনে হাসি।

 বিদ্যালয়ের পরীক্ষা দ্বারা প্রকৃত মেধা বা প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় কিনা, এ বিষয় লইয়া অনেক লেখা যাইতে পারে। শিক্ষকের কার্যে আমার ৪৫ বৎসর ব্যাপী অভিজ্ঞতায়, আমি বহু ছাত্রের সংস্পর্শে আসিয়াছি। যাহারা বিদ্যালয়ে পরীক্ষায় খুব কৃতিত্ব দেখাইয়া বৃত্তি প্রভৃতি পাইয়াছিল, তাহাদের অনেকের পরবর্তী জীবন ব্যর্থতার মধ্যে পর্যবসিত হইয়াছে। এমন কি সেকালের প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি প্রাপ্ত (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সম্মান) ছাত্রেরা পর্যন্ত জীবনে বিশেষ কৃতিত্ব দেখাইতে পারেন নাই, তাঁহারা অধিকাংশই বিস্মৃতির গর্ভে বিলীন হইয়া গিয়াছেন অবশ্য প্রত্যুত্তরে আমাকে বলা হইবে অমুক অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য উচ্চপদ লাভ করিয়াছেন, কিন্তু এইজন একাউণ্টাণ্ট জেনারেল বড় দরের কেরাণী ভিন্ন আর কিছুই নহেন। নিউটনকে টাকশালের কর্তা করিয়া দিলে হয়ত তাঁহার পদার্থবিদ্যার জ্ঞানের বলে তিনি টাকশালের বহু সংস্কার সাধন করিতে পারিতেন। রাণী অ্যান যদি ‘ক্যালকুলাসের’ আবিষ্কারকর্তাকে রাজস্বসচিব পদে নিযুক্ত করিতেন, তবে কি তিনি যোগ্য নির্বাচন করিতেন? আশঙ্কা হয়, কোষাধ্যক্ষের কর্তারূপে নিউটন ব্যর্থ হইতেন। যাঁহারা গত অর্ধশতাব্দীর মধ্যে কলিকাতা ‘বারে’ আইনজীবীরূপে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন, তাঁহাদের ছাত্রজীবন খুব কৃতিত্বপূর্ণ ছিল না। ডবলিউ, সি, ব্যানার্জী, মনোমোহন ঘোষ, তারকনাথ পালিত, সতীশরঞ্জন দাশ এবং আরও অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ কৃতিত্ব না দেখাইলেও, আইনজীবীরূপে সাফল্যলাভ করিয়াছিলেন। প্রথম ভারতীয় 'র‍্যাংলার' এবং প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তিধারী আনন্দমোহন বসু ব্যারিষ্টাররূপে বিশেষ প্রতিষ্ঠালাভ করেন নাই।

 কোন একটি বিষয়ে জীবনব্যাপী নিষ্ঠা ও সাধনাই গৌরবের মূল। যে ছাত্র সকল বিষয়েই ‘ভাল’ সেই সাধারণতঃ পরীক্ষায় প্রথম হয়। কিন্তু কবি পোপ সত্যই বলিয়াছেন— একজন প্রতিভাশালীর পক্ষে একটি বিষয়ই যথেষ্ট।

 যাহা হউক, এ বিষয়ে এখন আমি আর বেশী বলিতে চাই না। আমার পিতা এই সময়ে গুরুতর আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে পতিত হইতেছিলেন। তাঁহার জমিদারী একটির পর একটি করিয়া বিক্রয় হইতেছিল। মহাজন হইতে দেনদারের অবস্থায় উপনীত হইতে বেশী সময় লাগে না। আমার পক্ষে গর্ব ও আনন্দের কথা এই যে, তাঁহার ঋণ “সম্মানের ঋণ” এবং তিনি তাহা একান্ত সততার সঙ্গে পরিশোধ করিয়াছিলেন।[৬] আমার এখনও সেই শোচনীয় দৃশ্য মনে পড়ে—মাতা কাঁদিতে কাঁদিতে তাঁহার সম্পত্তির বিক্রয় কবালার দস্তখত করিতেছেন। এই সম্পত্তি তাঁহারই অলঙ্কার বিক্রয় করিয়া কেনা হইয়াছিল এবং প্রকৃতপক্ষে ইহা তাঁহার স্ত্রীধন[৭] ছিল। আমাদের পরিবারের ব্যয় সঙ্কোচ করা এখন প্রয়োজন হইয়া পড়িল,—এবং ইহার ফলে আমাদের কলিকাতার বাসা উঠাইয়া লওয়া হইল। আমার পিতামাতা গ্রামের বাড়ীতে গেলেন এবং আমি ও আমার ভ্রাতৃগণ ছাত্রাবাসে আশ্রয় লইলাম।

 আমি পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটান ইনষ্টিটিউশানে ভর্তি হইলাম। উহার কলেজ বিভাগ নূতন খোলা হইয়াছিল। উচ্চশিক্ষা মাধ্যমিক শিক্ষার মতই সুলভ করিবার সাহসপূর্ণ চেষ্টা ভারতে এই প্রথম। স্কুল বিভাগের মত কলেজ বিভাগের ‘বেতন’ও তিনটাকা মাত্র ছিল। আমার বিদ্যাসাগরের কলেজে ভর্তি হইবার পক্ষে কয়েকটি কারণ ছিল। প্রথমতঃ মেট্রোপলিটান ইনষ্টিটিউশান জাতীয় প্রতিষ্ঠান—যাহাকে আমাদের নিজস্ব বস্তু বলিয়া মনে করা যাইতে পারিত। দ্বিতীয়তঃ, এই কলেজে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (যিনি আমাদের সময়ে ছাত্রদের নিকট ‘দেবতা’ ছিলেন বলিলেই হয়) ইংরাজী গদ্য সাহিত্যের এবং প্রসন্নকুমার লাহিড়ী (প্রেসিডেন্সী কলেজের অধ্যাপক সেক্সপীয়র সাহিত্যে সুপণ্ডিত টনী সাহেবের প্রসিদ্ধ ছাত্র) ইংরাজী কাব্য সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। আমি কিন্তু ফার্স্ট আর্টস্ পড়িবার সময় রসায়নে এবং বি, এ, পড়িবার সময় পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন উভয় বিষয়ে, প্রেসিডেন্সী কলেজে বাহিরের ছাত্র হিসাবে অধ্যাপকদের বক্তৃতা নিতাম। এফ, এ, কোর্সে সেই সময় রসায়নশাস্ত্র অবশ্যপাঠ্য বিষয় ছিল। মিঃ (পরে স্যার আলেকজেণ্ডার) পেড্‌লার গবেষণামূলক পরীক্ষা কার্যে (Experiment) বিশেষ দক্ষ ছিলেন। আমি প্রায় নিজের অজ্ঞাতসারেই রসায়ন শাস্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়িলাম। ক্লাসে ‘এক্সপেরিমেণ্ট’ দেখিয়া সন্তুষ্ট না হইয়া আমি এবং আমার একজন সহাধ্যায়ী বাড়ীতে একটী ছোটখাট ‘লেবরেটরী’ স্থাপন করিলাম এবং আমরা সেখানে কোন কোন ‘এক্সপেরিমেণ্টও’ করিতে লাগিলাম। একবার আমরা সাধারণ টিনের পাত দিয়া একটি oxy-hydrogen blow-pipe তৈয়ারী করিয়াছিলাম। এই স্থূল যন্ত্রদ্বারা পরীক্ষা করিতে গিয়া একদিন উহা ভীষণশব্দে ফাটিয়া গিয়াছিল। সৌভাগ্যক্রমে আমরা আহত হই নাই। রস্কোর Elementary Lessons তখন পাঠ্য থাকিলেও, আমি যতদূর সম্ভব আরও অনেকগুলি রসায়ন বিদ্যার বহি পড়িয়াছিলাম।

 রসায়ন শাস্ত্রের প্রতি আমার আকর্ষণের ফলে আমি “বি” কোর্স লইলাম। বি, এ পরীক্ষায় তখন ইংরাজী অবশ্যপাঠ্য ছিল। গদ্য পাঠ্যতালিকার মধ্যে মর্লির “Burke” এবং বার্কের Reflection on the French Revolution ছিল। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় খুব পাণ্ডিত্যের সহিত চিত্তাকর্ষক করিয়া এই সব বহি পড়াইতেন।

 ছাত্র জীবনের এই সময়ে আমি সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ সংযত করিতে বাধ্য হইয়াছিলাম। কেননা অন্য অনেক প্রতিযোগী বিষয়ে আমাকে মন দিতে হইয়াছিল। আমি নিজের চেষ্টায় ল্যাটিন ও ফ্রেঞ্চ মোটামটি শিখিয়াছিলাম; সংস্কৃত কলেজ পাঠ্য হিসাবেই শিখিয়াছিলাম। এফ, এ, পরীক্ষায় রঘুবংশের প্রথম সাত সর্গ এবং ভট্টিকাব্যের প্রথম পাঁচ সর্গ পাঠ্য ছিল। একজন পণ্ডিতের সহায়তায় কালিদাসের আর একখানি অপূর্ব কাব্য “কুমারসম্ভবম্”-এরও রসাস্বাদ আমি করিয়াছিলাম। এই সময়ে আমি “গিলক্রাইষ্ট” বৃত্তি পরীক্ষা দিতে মনস্থ করিলাম। এই পরীক্ষা লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের “ম্যাট্রিকুলেশন” পরীক্ষার অনুরূপ ছিল, এবং ইহাতে পাশ করিতে হইলে ল্যাটিন, গ্রীক অথবা সংস্কৃত, ফরাসী বা জার্মান ভাষা জানা অপরিহার্য ছিল। আমি গোপনে এই পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইতেছিলাম। আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা এবং একজন গ্রামসম্পর্কীয় জ্যাঠতুতো ভাই ভিন্ন আর কেহ এ সম্পর্কে সংবাদ জানিতেন না। আমি বিশেষ ভাবে এই সংবাদ গোপন রাখিয়াছিলাম, কেননা পরীক্ষায় ব্যর্থ হইলে, সহাধ্যায়ীগণের শ্লেষ ও বিদ্রুপ সহ্য করিতে হইত। কিন্তু ক্রমে ক্রমে এই গুপ্ত সংবাদ প্রকাশ হইয়া পড়িল; এবং আমার একজন সহপাঠী—(যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষায় খুব উচ্চ স্থান অধিকার করিয়াছিলেন) বিদ্রূপ করিয়া বলিলেন, আমার নাম লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যালেণ্ডারের বিশেষ সংস্করণে বাহির হইবে। পরীক্ষায় সাফল্যলাভের বিশেষ আশা আমি করি নাই এবং পরীক্ষার ফল বাহির হইতে কয়েক মাস অতীত হইল দেখিয়া আমি সকল আশা ত্যাগ করিলাম। একদিন কলেজে পড়া আরম্ভ হইবার পূর্বে ‘ষ্টেটসম্যানের’ একটী প্যারাগ্রাফের প্রতি একজন আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। উহাতে সংবাদ ছিল “গিলক্লাইষ্ট” বৃত্তি পরীক্ষায় দুইজন উত্তীর্ণ হইয়াছে, বাহাদুরজী নামক বোম্বায়ের জনৈক পার্শী এবং আমি। প্রিন্সিপাল একটু পরেই আমাকে ডাকিয়া পাঠাইয়া অভিনন্দিত করিলেন। “হিন্দু পেট্রিয়ট” (তখন কৃষ্ণদাস পাল সম্পাদক) লিখিলেন—আমি ইনষ্টিটিউশনের জন্য নূতন কীর্তি সঞ্চয় করিয়াছি। কিন্তু ঐ কলেজের পড়ার সঙ্গে আমার “গিলক্রাইষ্ট বৃত্তি” পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সম্বন্ধ কতটুকু তাহা আমি ঠিক বুঝিতে পারিলাম না।

 আমার পিতা তখন যশোরে থাকিয়া যশোর ষ্টেশনের নিকটবর্তী ধোপাখোলা পত্তনী তালুক বিক্রয়ের ব্যবস্থা করিতেছিলেন; তাঁহার দেনা শোধের জন্য ইহা প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছিল। তিনি আমার বিলাত যাওয়ার ইচ্ছায় সহজেই সম্মত হইলেন। আমি রাড়ুলিতে আমার একজন দূরসম্পর্কে পড়তুতো ভাইকেও “ষ্টেটসম্যানের” কর্তিত অংশসহ একখানি ইংরাজী চিঠি লিখিলাম। চিঠির শেষে নিম্নলিখিত কথাগুলি ছিল,—উহা এখনও আমার স্মৃতিপটে মুদ্রিত আছে। “আমার মাতাকে এই সংবাদ জানাইবে। তিনি প্রথমে বিলাপ করিবেন, কিন্তু পরে আমার চার বৎসরের বিদেশ বাসের ব্যবস্থায় নিশ্চয়ই সম্মত হইবেন।”

 এখানে বলা যাইতে পারে যে, সেকালে কলেজের শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে ইংরাজীতে পত্র লেখা ‘ফ্যাশন’ বলিয়া গণ্য হইত। কিন্তু বর্তমান সময়ে ঐরূপ পত্রলেখকের প্রতি লোকের মনে অবজ্ঞার ভাবই উদয় হইবে, এবং তাহাকে লোকে আত্মম্ভরী বলিবে।

 আমার মাতা আমার বিলাত যাওয়ায় আপত্তি করিলেন না। তিনি আমার পিতার নিকট হইতে উদার ভাব পাইয়াছিলেন এবং বিলাত গেলে জা’ত যাইবে, তখনকার দিনের এই ধারণা তাঁহার মনে স্থান পাইল না। আমি মার নিকট বিদায় লইবার জন্য বাড়ীতে গেলাম। আমি মাকে খুব ভাল বাসিতাম, সুতরাং বিদায় দৃশ্য অত্যন্ত করুণ হইল, এবং আমি বিষণ্ণচিত্তে তাঁহার নিকট হইতে চলিয়া আসিয়াছিলাম। আমি তাঁহাকে এই বলিয়া সান্ত্বনা দিলাম যে, আমি যদি জীবনে সাফল্য লাভ করি, তবে আমি প্রথমেই পারিবারিক সম্পত্তির পুনরুদ্ধার এবং ভদ্রাসন বাটীর সংস্কার করিব। আমি স্বীকার করি যে, আমার মনের আদর্শ তদানীন্তন সামাজিক আবহাওয়ার প্রভাবে সঙ্কীর্ণ ছিল। বিধাতা অন্যরূপ ব্যবস্থা করিলেন এবং পরবর্তী জীবনে আমি এই শিক্ষাই লাভ করিলাম যে, ভূসম্পত্তিতে আবদ্ধ রাখা অপেক্ষা উপার্জিত অর্থ ব্যয় করিবার নানা উৎকৃষ্টতর উপায় আছে।

  1. ঐ বাড়ীর এখনও সেই পুরাতন নম্বর আছে।
  2. রাজেন্দ্রলাল মিত্রের কয়েকটি প্রবন্ধ পুস্তকাকারে প্রকাশিত হইয়াছে “Beef Eating in Ancient India” (চক্রবর্তী, চাটার্জি এণ্ড কোং); “প্রাচীন ভারতে গো-মাংস” নামক গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।
  3. সাম্রাজ্যের প্রথম বার্ষিক বিশ্ববিদ্যালয় সম্মিলনীতে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরূপে গিয়া সার দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী এবং আমি কেম্ব্রিজ ট্রিনিটি কলেজের মাষ্টার ডাঃ বাটলারের গৃহে অতিধি হইয়াছিলাম।
  4. তথাকথিত অবনত সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে অনেকে জেলা সম্মিলনীর জন্য সামান্য চাঁদা দিয়া থাকে। ইহারা প্রায়ই অভিযোগ করে যে, “বাবুরা কেবল টাকার দরকার পড়িলে আমাদের কাছে আসেন কিন্তু তাঁহারা আমাদের স্বার্থ দেখেন না বা আমাদের সঙ্গে সমানভাবে মিশেন না।” দুর্ভোগ্যক্রমে তাহাদের এই অভিযোগ সত্য। জাতিগত শ্রেষ্ঠতা হইতে যে অহঙ্কারপূর্ণ দূরত্বের ভাব জন্মে তাহাই শিক্ষিত ভদ্রলোক ও জনসাধারণের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করিয়াছে। এই বিষয়ে চীনাছাত্রদের আচরণ আমাদের অনুকরণীয়।
  5. সংস্কৃতের অধ্যাপক, অল্পদিন পূর্বে ইঁহার মৃত্যু হইয়াছে।
  6. শ্রীযুত অক্ষয়কুমার চট্টোপাধ্যায় সম্প্রতি নিম্নলিখিত বিষয়টির প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছেন (সম্ভবতঃ ইহা অক্ষয়বাবুর নিজের লেখা)।
     “রামতারণ চট্টোপাধ্যায় ইষ্টার্ণ ক্যানেল ডিবিসনের খুলনা জেলায় ডিবিসনাল অফিসার ছিলেন। সুরখালিতে তাঁহার কর্মস্থান ছিল। তিনি খুলনার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গৌরদাস বসাক, ঈশ্বরচন্দ্র মিত্র এবং মুন্সেফ বলরাম মল্লিক, রাড়লি-কাটিপাড়ার জমিদার হরিশ্চন্দ্র রায় (ডাঃ পি, সি, রায়ের পিতা) প্রভৃতির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। প্রথম বয়সে তাঁহার একমাত্র পুত্র অক্ষয়কুমার কলিকাতায় পড়িবার সময়ে হরিশ্চন্দ্রের বাসায় থাকিতেন। হরিশ্চন্দ্রের পরামর্শ ও সহায়তায় সন্দরবন অঞ্চলে বিস্তর জমির মৌরসী ইজারা লইয়াছিলেন; ঐ জমি খুব লাভজনক সম্পত্তি হইয়াছে। হরিশ্চন্দ্রের সাধুতার উপর বিশ্বাস করিয়া রামতারণ হরিশ্চন্দ্রকে অনেক টাকা বিনা দলিলে ধার দিয়াছিলেন। হরিশ্চন্দ্র যোগ্যপুত্রের পিতা ছিলেন।...... যখন তিনি রামতারণের ঋণ পরিশোধে অক্ষমতা বোধ করিলেন, তখন তিনি নিজের বাড়ীর নিকটবর্তী একটি মূল্যবান সম্পত্তি রামতারণের নামে রেজেস্ট্রী দলিল দ্বারা কবালা করিয়াছিলেন। রামতারণ কিন্তু এবিষয়ে অনেকদিন পর্যন্ত কিছুই জানিতেন না। একদিন রামতারণের সঙ্গে হরিশ্চন্দ্রের সাক্ষাৎ হইলে, হরিশ্চন্দ্র দলিলগুলি রামতারণের হাতে দিয়া হাতে দিরা ঋণের দায় হইতে অব্যাহতি প্রার্থনা করিলেন। (“বংশ পরিচয়”, দ্বিতীয় খণ্ড, ৩৬৬ পৃঃ)
  7. কমলাকর “বিবাদতাণ্ডবে” বলিয়াছেন—আইনজ্ঞেরা “স্ত্রীধন”এর অর্থ লইয়া তুমল যুদ্ধ করেন। ‘স্ত্রীধন’ সম্বন্ধে গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের The Hindu Law of Marriage and Stridhana দ্রষ্টব্য।