আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়)/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

গ্রামে শিক্ষালাভ—কলিকাতায় গমন—কলিকাতা—অতীত ও বর্তমান

 আমার নিজের জীবনের কথা আবার বলিতে আরম্ভ করিব। আমার দুই জ্যেষ্ঠভ্রাতা এবং আমি আমার পিতার প্রতিষ্ঠিত গ্রাম্যস্কুলে বাল্য শিক্ষালাভ করি। আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা যখন মাইনর বৃত্তি পরীক্ষায় পাশ করেন, তখন এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হইল যে আমার পিতার ভবিষ্যৎ জীবনের গতি একেবারে পরিবর্তিত হইয়া গেল। সে কথা পরে বলিব। আমার নয় বৎসর বয়স পর্যন্ত আমি গ্রাম্য বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করি।

 ১৮৭০ খৃষ্টাব্দে আমি প্রথম কলিকাতায় আসি। তখন আমার মনে যে ভাব জাগিয়াছিল, তাহার স্মৃতি এখনও আমার মনে স্পষ্ট হইয়া আছে। আমার পিতা ঝামাপুকুর লেন এবং রাজা দিগম্বর মিত্রের বাড়ীর বিপরীত দিকে বাড়ী নেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদি ব্রাহ্মসমাজ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া কেশবচন্দ্র সেন তখন সবেমাত্র তাঁহার নতুন ব্রাহ্মসমাজ প্রতষ্ঠিা করিয়াছেন। পিতার বাসা ঐ সমাজের খুব নিকটে ছিল। দিগম্বর মিত্রের অতিথিপরায়ণতা বিখ্যাত ছিল। তাঁহার বন্ধুরা সর্বদাই সেখানে সাদরে অভ্যর্থিত হইতেন এবং কয়েক বৎসর পর্যন্ত আমার পিতা প্রায়ই সেখানে আতিথ্য গ্রহণ করিতেন। পিতা পরবর্তী জীবনে প্রায়ই আমাদের নিকট দিগম্বর মিত্র এবং রাজেন্দ্রলাল মিত্র, হেমচন্দ্র কর, মুরলীধর সেন প্রভৃতি তখনকার দিনের অন্যান্য বিখ্যাত ব্যক্তির কথা বলিতেন।

 আমি আগষ্ট মাস মহানন্দে কলিকাতায় কাটাইলাম এবং প্রায় প্রতিদিনই নূতন নূতন দৃশ্য দেখিতাম। আমার চক্ষুর সম্মুখে এক নূতন জগতের দৃশ্য আবির্ভূত হইল। তখন নূতন জলের কল কেবল প্রবর্তিত হইয়াছে এবং সহরবাসীরা পরিষ্কৃত জল ব্যবহার করিতে আরম্ভ করিয়াছে। গোঁড়া হিন্দুরা অপবিত্রবোধে ঐ জল ব্যবহার করিতে তখনও ইতস্ততঃ করিতেছে। কিন্তু জলের বিশুদ্ধতা ও উৎকর্ষই শেষে জয়ী হইল। ক্রমে ক্রমে ন্যায়, যুক্তি এবং সুবিধা বোধ কুসংস্কারকে দূরীভূত করিল ও সর্বত্র উহার ব্যবহার প্রচলিত হইল। মাটির নীচের পয়ঃনালী নির্মাণ কেবলমাত্র আরম্ভ হইয়াছে।

 ১৮৭০ খৃষ্টাব্দে কলিকাতার অবস্থা কেমন ছিল তাহার চিত্র যদি এখনকার লোকের নিকট কেহ অঙ্কিত করে, তবে তাহারা হয়তো তাহা চিনিতেই পারিবে না। সহরের উত্তরাংশে দেশীয় লোকের বসতিস্থানে রাস্তার দুইধারে খোলা নর্দমা ছিল, আর তাহা হইতে জঘন্য দর্গন্ধ উঠিত। বাড়ীর সংলগ্ন পায়খানাগলি গলিত মলকুণ্ড ছিল বলিলেই হয়। ঐ গুলি পরিষ্কার করিবার ভার গৃহের অধিবাসীদের উপরই ছিল, আর সে ব্যবস্থা ছিল একেবারে আদিম যুগের। সহরবাসীরা অসীম ধৈর্য সহকারে মশা ও মাছির উপদ্রব সহ্য করিত।

 সুয়েজ খাল তখন সবেমাত্র খোলা হইয়াছে। কিন্তু হুগলী নদীতে মাত্র কয়েকখানি সাগরগামী ষ্টিমার ছিল, তখনও অসংখ্য পালের জাহাজ ও তাহার মাস্তুলে হুগলী নদী আচ্ছন্ন। হাইকোর্ট এবং মিউজিয়ামের নূতন বাড়ী প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে। তখনও কলিকাতায় কোন চিড়িয়াখানা হয় নাই। তবে “মার্বেল প্রাসাদের” রাজা রাজেন্দ্র মল্লিকের বাড়ী একটা ছোটখাট চিড়িয়াখানা ছিল এবং বহু দর্শকের ভিড় সেখানে হইত। হুগলী নদীর ধারে তখন আধ ডজনেরও কম জুটমিল ছিল।[১]

 মাড়োয়ারী কর্তৃক বাঙ্গলার অর্থনৈতিক বিজয়ের লক্ষণ তখনও স্পষ্ট দেখা দেয় নাই। এই বিজয় অবশ্য একটি প্রবল যুদ্ধে করা হয় নাই, ক্রমে ক্রমে ধীরে, শান্তভাবে তাহারা বাঙ্গলা দেশকে আর্থিক যুদ্ধে পরাস্ত করিয়াছে।

 এক শতাব্দী পূর্বে মতিলাল শীল, রামদুলাল দে, অক্রুর দত্ত এবং আরও অনেকে আমদানী-রপ্তানীর ব্যবসায়ে ক্রোড়পতি হইয়াছিলেন। পরবর্তীকালে শিবকৃষ্ণ দাঁ এবং রাজা হৃষীকেশ লাহার পূর্বপুরুষ—প্রাণকৃষ্ণ লাহা যথাক্রমে আমদানী লৌহ ব্যবসায়ে এবং বস্ত্র ব্যবসায়ে প্রভূত ঐশ্বর্য সঞ্চয় করিয়াছিলেন। পুরাতন হিন্দু কলেজের অন্যতম প্রতিভাশালী ছাত্র ডিরোজিওর শিষ্য রামগোপাল ঘোষ, প্রসিদ্ধ বক্তা এবং রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তাঁহাকে বিলাতের এক পত্র “ভারতীয় ডেমস্‌থেনিস” এই আখ্যা দিয়াছিলেন। রামগোপাল ঘোষ তাঁহার অধিকাংশ সহাধ্যায়ীর মত সরকারী চাকুরী গ্রহণের জন্য ব্যগ্র হন নাই। তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য আরম্ভ করেন এবং একজন ইংরাজ অংশীদারের সঙ্গে ‘কেলসাল ও ঘোষ’ নামে ফার্ম খুলেন।[২] রামগোপাল ঘোষের বন্ধু ও সতীর্থ প্যারীচাঁদ মিত্র সরকারী চাকুরী অপেক্ষা ব্যবসা-বাণিজ্যই বরণীয় মনে করিয়াছিলেন। তাঁহার আমেরিকার সঙ্গে ব্যবসায় ছিল। ব্রিটিশদের আগমনের প্রথম সময় হইতেই বাঙ্গালীরা ইউরোপীয় ব্যবসায়ী ফার্মসমূহের ‘বেনিয়ান’ (মুৎসুদ্দি) ছিলেন এবং এই উপায়ে তাঁহারা বহু অর্থ সঞ্চয় করিয়াছেন। আমি যখন প্রথম কলিকাতায় আসি, তখন পর্যন্ত গোরাচাঁদ দত্ত, ঈশান বসু এবং অন্যান্য বিখ্যাত ‘বেনিয়ান’দের স্মৃতি বাঙ্গালীদের মধ্যে জাগ্রত ছিল। কিন্তু এই সব প্রথম আমলের বাঙ্গালী মহাজন এবং বেনিয়ানেরা নিজেদের বংশাবলীর জন্য ধ্বংসের বীজ বপন করিয়া গিয়াছিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদারী কিনিবার প্রলোভনে সহজেই তখনকার ধনীদের মন আকৃষ্ট হইত। আর এক দিকে “সূর্যাস্ত আইন” এবং অন্য দিকে মালিকদের আলস্য, বিলাসিতা ও উচ্ছৃঙ্খলতার জন্য জমিদারীও সর্বদা নীলামে চড়িত। জমিদারীর প্রতিষ্ঠাতারা সাধারণতঃ স্বনামধন্য ব্যক্তি ছিলেন, নিজেদের শক্তিতে জমিদারী করিতেন, সুতরাং তাঁহারা প্রায়ই উচ্ছৃঙ্খল স্বভাবের লোক হইতেন না। কিন্তু তাঁহাদের বংশধরেরা “রূপার ঝিনুক” মুখে লইয়াই জন্মগ্রহণ করিত, নিজের চেষ্টায় কিছুই তাহাদের করিতে হইত না এবং ইহাদের চারিদিকে মোসাহেব ও পরগাছার দল ঘিরিয়া থাকিত। সুতরাং তাহারা যে বিলাসী ও উচ্ছৃঙ্খল হইত, ইহা আশ্চর্যের বিষয় নহে। তাহারা নিজেদের মানসিক উন্নতির জন্য কোন চেষ্টা করিত না, কেবল বিলাস-ব্যসনে ডুবিয়া থাকিত। “অলস মস্তিষ্ক সয়তানের কারখানা।” ডাঃ জনসনকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়,—“জ্যেষ্ঠাধিকারের পরিণাম কি?” তিনি উত্তর দেন যে, “ইহার ফলে পরিবারে কেবল একজন নির্বোধকেই সৃষ্টি করা হয়।” কিন্তু হিন্দুদের এবং ততোধিক মুসলমানদের মধ্যে উত্তরাধিকার ব্যবস্থায় পৈতৃক সম্পত্তি অসংখ্য সমান অংশে বিভক্ত হয় এবং তাহার ফলে অসংখ্য মূঢ়, নির্বোধ এবং উচ্ছৃঙ্খলের আবির্ভাবের পথ প্রস্তুত হয়।

 যাঁহারা ইউরোপীয়দের গদীর বেনিয়ান ছিলেন, অথবা যাঁহারা ব্যবসা বাণিজ্যে সাফল্য লাভ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের বংশধরেরা যে পরিশ্রমী, কর্মঠ, উদ্যোগী ও সহিষ্ণু মাড়বার, যোধপর ও বিকানীরের অধিবাসীদের দ্বারা ক্রমে ক্রমে বাণিজ্যক্ষেত্র হইতে বহিষ্কৃত হইবে, ইহা স্বাভাবিক। ১৮৭০ খৃষ্টাব্দের সময়েই বড়বাজারের অনেক অংশ তাহাদের হাতে যাইয়া পড়ে। কিন্তু তখনও কতকগুলি বড় বড় বাঙ্গালী ব্যবসায়ী ছিল, যাহাদের পূর্বপুরুষরা ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর সহিত কারবার করিয়াছিলেন।

 কিন্তু সুয়েজ খাল খোলার পর হইতে প্রাচ্যের সঙ্গে ব্যবসায়ক্ষেত্রে যুগান্তর উপস্থিত হইল। ইহার ফল কিরূপ হইয়াছে, তাহা কলিকাতার ১৮৭০ সালের আমদানী রপ্তানীর হিসাবের সঙ্গে ১৯২৭—২৮ সালের হিসাবের তুলনা করিলেই বুঝা যায়।[৩] লণ্ডন, লিভারপুল এবং গ্লাসগো বোম্বাই ও কলিকাতার নিকটতর হইল। আর রেলওয়ের দ্রুত বিস্তৃতি ও তাহার সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরের ষ্টিমার সার্ভিস—সেই নৈকট্য আরও বৃদ্ধি করিল। বড়বাজার ও ক্লাইভ ষ্ট্রীট এখন মাড়োয়ারী ও ভাটিয়া ব্যবসায়ীতে পূর্ণ এবং বাঙ্গালীরা বলিতে গেলে স্বেচ্ছাক্রমেই বাণিজ্যজগত হইতে সম্পূর্ণ বহিষ্কৃত হইয়াছে। বড়বাজারের দক্ষিণ অংশের যেখানে রয়েল এক্সচেঞ্জ, ব্যাঙ্ক ও শেয়ার বাজার আছে, সেখানে ইউরোপীয় বণিকদের প্রাধান্য, কিন্তু সেখানে প্রত্যহ যে কোটি কোটি টাকার কারবার চলিতেছে তাহার সঙ্গে মাড়োয়ারী ও ভাটিয়াদের ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। এই অঞ্চলের, তথা বড়বাজারের জমির স্বত্ব পর্যন্ত বাঙ্গালীদের হাত হইতে চলিয়া গিয়াছে। অভাবে পড়িয়াই বাঙ্গালীকে পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রয় করিতে হইয়াছে। একটা জাতির জীবনে যে দুর্ল্লভ সুযোগ আসে, তাহা এইভাবে কাড়িয়া লইতে দেওয়া হইল। বাংলা তাহার সুযোগ চিরকালের জন্য হারাইয়াছে। তাহার প্রাচীন অভিজাত বংশের বংশধরগণ এবং ভদ্রলোক সম্প্রদায় তাহাদের নিজের জন্মভূমিতেই গৃহহীন ভবঘুরে হইয়া দাঁড়াইয়াছে; তাহারা হয় অনশনে আছে, অথবা সামান্য বেতনে কেরাণীগিরি করিয়া জীবিকানির্বাহ করিতেছে।

 এখন আমার নিজের কথা বলি। আমার সর্বজ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মাইনর ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষা পাশ করাতে, তাঁহাকে শিক্ষা শেষ করিবার জন্য কলিকাতায় আসিতে হইল। আমার অগ্রজ এবং আমি এম, ই, পরীক্ষা দিবার জন্য প্রস্তুত হইতেছিলাম। আমার পিতার পক্ষে এখন একটা গুরুতর অবস্থার সৃষ্টি হইল। তিনি সাধারণ পল্লীবাসী ভদ্রলোকের চেয়ে বেশী শিক্ষিত ছিলেন এবং কাব্য সাহিত্য প্রভৃতি উত্তমরূপে অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। সুতরাং তাঁহার ছেলেরাও যাহাতে তৎকালীন উচ্চতম শিক্ষা পায়, এজন্য তিনি ব্যগ্র ছিলেন। তখনকার দিনে আমাদের গ্রাম হইতে কলিকাতায় আসিতে নৌকার ৩।৪ দিন লাগিত। কিন্তু বর্তমান রেলওয়ে ও ষ্টীমারযোগে পথের দূরত্ব কমিয়া গিয়াছে, এখন ১৪ ঘণ্টায় আমাদের গ্রাম হইতে কলিকাতায় আসা যায়। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিদর্শনাধীনে কোন প্রাসাদতুল্য হোটেল বা ‘মেস’ ছিল না। আমার পিতার সম্মুখে দুইটি মাত্র পথ ছিল। প্রথম, একজন শিক্ষক অভিভাবকের অধীনে কলিকাতায় তাঁহার ছেলেদের জন্য একটি পৃথক্ বাসা রাখা; দ্বিতীয়, গ্রাম হইতে নিজেরাই কলিকাতায় আসিয়া বাস করা এবং স্বয়ং ছেলেদের তত্ত্বাবধান করা। কিন্তু এই শেষোক্ত পথেও অত্যন্ত অসুবিধা ছিল। আমার পিতা বড় জমিদার ছিলেন না এবং উপযুক্ত বেতন দিয়া কোন বিশ্বস্ত কর্মচারীর উপর গ্রামের সম্পত্তির ভার ন্যস্ত করা তাঁহার পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। তাঁহার জমিদারী কতকগুলি ছোট ছোট তালুকের সমষ্টি ছিল এবং তিনি ব্যাঙ্কিং ও মহাজনীর কারবারও আরম্ভ করিয়াছিলেন। এই শেষোক্ত কারবারে তিনি সম্পত্তি বন্ধক রাখিয়া বহু লোককে টাকা ধার দিয়াছিলেন। সুতরাং তাঁহার পক্ষে গ্রামে থাকিয়া ঐ সমস্ত সম্পত্তি ও কারবার নিজে দেখা অপরিহার্য ছিল। দীর্ঘকালের জন্য গ্রাম ছাড়িয়া দূরে বাস করা তাঁহার পক্ষে স্বভাবতই ঘোর ক্ষতিকর। কোন্ পথ অবলম্বন করা হইবে, তাহা লইয়া আমাদের পরিবারে আলোচনা চলিতে লাগিল। আমার মনে আছে, পিতা ও মাতার মধ্যে ইহা লইয়া প্রায়ই আলোচনা হইত এবং এ বিষয়ে কোন নিশ্চিত মীমাংসা করা তাঁহাদের পক্ষে কঠিন ছিল। অবশেষে স্থির হইল যে, পিতামাতাই ছেলেদের লইয়া কলিকাতায় থাকিবেন, অন্যথা অল্পবয়স্ক ছেলেদের পক্ষে বিদেশে বাসা প্রভৃতির বন্দোবস্ত করিয়া থাকা অসম্ভব।

 আমার পিতা তাঁহার পল্লীজীবনের একটি অভাবের কথা বলিয়া প্রায়ই ক্ষোভ প্রকাশ করিতেন। পল্লীর যে ভদ্রসমাজের মধ্যে তাঁহাকে বাস করিতে হইত, তাহার বিরুদ্ধে তিনি অনেক সময়ই অভিযোগ করিতেন। পল্লীর ভদ্রলোকেরা সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতে বাস করিতেন। হাফেজ, সাদি এবং বিখ্যাত ইংরাজ সাহিত্যিকদের গ্রন্থ পাঠে যাঁহার মন ও চরিত্র গঠিত হইয়াছিল, যিনি রামতনু লাহিড়ীর পদমূলে বসিয়া শিক্ষালাভ করিয়াছিলেন, তিনি শিক্ষায় অর্ধশতাব্দী পশ্চাৎপদ, কুসংস্কারগ্রস্ত ও গোঁড়ামিতে পূর্ণ লোকদের সংসর্গে আনন্দলাভ করিবেন, ইহা প্রত্যাশা করা যায় না। দুই একটি দৃষ্টান্ত দিলে আমার বক্তব্য পরিস্ফুট হইবে।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় যে বিধবা-বিবাহ আন্দোলন আরম্ভ করেন, তাহা নব্য বাঙ্গলার মন অধিকার করিয়াছিল এবং আমার পিতা এ বিষয়ে তাঁহার উৎসাহ কার্যতঃ প্রমাণ করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছিলেন। আমাদের গ্রামের স্কুলে মোহনলাল বিদ্যাবাগীশ নামক একজন পণ্ডিত ছিলেন। টোলে-পড়া শিক্ষিত ব্রাহ্মণ হইলেও, তিনি তাঁহার পৈতা ত্যাগ করিয়াছিলেন। এই পণ্ডিত সহজেই বিধবা বিবাহ করিতে সম্মত হইলেন।

প্রাচীন ও নবীন

 এই “ধর্ম-বিরুদ্ধ” বিবাহের কথা দাবানলের ন্যায় চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল এবং শীঘ্রই যশোরে আমার পিতামহের কাণে যাইয়া পৌঁছিল। পিতামহ গোঁড়া হিন্দু ছিলেন, সুতরাং এই ‘ঘোর অপরাধের’ কথা শুনিয়া তিনি স্তম্ভিত হইলেন। তিনি পাল্কীর ডাক বসাইয়া তাড়াতাড়ি যশোর হইতে রাডুলিতে আসিলেন এবং বিধবা বিবাহ বন্ধ করিতে আদেশ দিলেন। আমার পিতাকে বাধ্য হইয়া এই আদেশ মানিতে হইল এবং বিধবা বিবাহ দেওয়া আর ঘটিল না।

 আমার পিতামহের শ্রাদ্ধে, পার্শ্বস্থ গ্রামের বহ‍ুলোক ঐ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে অস্বীকার করিল; কেননা, আমার পিতা তাহাদের মতে ‘ম্লেচ্ছ' হইয়া গিয়াছিলেন। এমন কথাও প্রচারিত হইল যে, জনৈক প্রতিবাসীর হারাণো বাছরটিকে প্রকৃতপক্ষে হত্যা করিয়া চপ কাটলেট ইত্যাদি সুখাদ্য রন্ধনপূর্বক টেবিলে পরিবেষণ করা হইয়াছে। সাতক্ষীরার জমিদার উমানাথ রায় একটা ছড়া বাঁধিয়াছিলেন, তখনকার দিনে ঐ ছড়া খুব লোকপ্রিয় হইয়াছিল। ছড়ার প্রথম অন্তরাটি এইরূপঃ—

“হা কৃষ্ণ, হা হরি, এ কি ঘটাইল,
রাডুলি টাকীর[৪] ন্যায় দেশ মজাইল।”

  1. ১৮৬০—৭০ এই দশ বৎসরে ৫টা মিল ৯৫০টি তাঁতসহ কার্য করিতেছে।—ওয়ালেশ, “রোমান্স অব জুট,” ২৬ পৃঃ।
  2. ছাত্রাবস্থাতেই অবকাশ সময়ে ঘোষ বাজারের অবস্থা এবং দেশের উৎপন্ন দ্রব্যজাতের বিষয় আলোচনা করিতে থাকেন। ২০ বৎসর বয়সের পূর্বেই তিনি মাল আমদানী শুল্কের সম্বন্ধে কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেন। প্রথমে বেনিয়ান, পরে অংশীদার রূপে একটি ইউরোপীর ফার্মে অভিজ্ঞতা লাভ করিয়া তিনি নিজের ব্যবসা আরম্ভ করেন। তাঁহার ফার্মের নাম হইল আর, জি, ঘোষ এণ্ড কোং—রেঙ্গুনে ও আকিরাবে তাঁহার কোম্পানীর শাখা ছিল। তিনি ব্যবসায়ে সাফল্য লাভ করেন এবং বহু অর্থ উপার্জন করেন। বাকলাণ্ড— “Bengal under the Lt. Governors”—১০২৪ পৃঃ।
  3. কলিকাতার বন্দরে মোট আমদানী পণ্যজাতের মূল্য (গবর্নমেণ্ট ষ্টোর্স ব্যতীত):—
    টাকা টাকা
    ১৮৭০-৭১ ১৬,৯৩,৯৮,১৮০ ১৯২৭-২৮ ৮৩,৫৯,২৪,৭৩৪

    কলিকাতার বন্দর হইতে মোট রপ্তানী পণ্যজাতের মূল্য (গবর্ণমেণ্ট ষ্টোর্স ব্যতীত):—

    ২২,৫৭,৮২,৯৩৫১৮৭০-৭১ ১৩৭,৬৭,৩৮,৭৭৯১৯২৭-২৮
    ভারতীয় পণ্যদ্রব্য ২২,৫৭,৮২,৯৩৫ ১৩৭,৬৭,৩৮,৭৭৯
    বিদেশী পণ্যদ্রব্য ২৯,৩৮,৫৫৩ ৭০,৯৫,৮২২
    ——————— ————————
    বিদেশী পণ্যদ্রব্যমোট— ২২,৭৭,২১,৪৮৮ ১৩৮,৩৮,৩৪,৬০১

    উহা হইতে দেখা যাইবে যে, আমদানী ও রপ্তানী পণ্যদ্রব্যের মূল্য প্রায় ছয় গুণ বাড়িয়াছে।

  4. টাকীর (২৪ পরগণা) কালীনাথ মুন্সী রামমোহন রায়ের সংস্কার আন্দোলনের একজন সমর্থক ছিলেন এবং সেই কারণে গ্রামের গোঁড়ারা তাঁহার উপর খড়্গ-হস্ত ছিল।