আমার আত্মকথা/গৌরচন্দ্রিকা

উইকিসংকলন থেকে

গৌরচন্দ্রিকা

 দ্বীপান্তর থেকে ফিরে এসে সংকল্প করেছিলুম আমার বিপ্লব যুগের কাহিনী লিখব তিন ভাগে; তার সব শেষের ভাগটা—‘দ্বীপান্তরের কথা’ই বেরোয় আগে। তারপর বিজলীতে ‘দ্বীপান্তরের পথে’ বলে যে ধারাবাহিক ইতিবৃত্ত বের হচ্ছিল সেইটেই শেষটা আত্মকাহিনী নামে বইএর আকারে বের হয়। তাতে ছিল আমার জীবনের সেই অংশ যা’ আরম্ভ হয় মাণিকতলার বাগানে গুপ্ত সমিতি-স্থাপনার পর গুরু অন্বেষণে গুর্জ্জর অভিমুখে যাত্রায় এবং শেষ হয় এখানকার জেলে বন্দী-জীবন কাল পূর্ণ করে দ্বীপান্তর দণ্ডাদেশে; তারপর বিজলীতে “বোমার যুগের কথা” শীর্ষক লেখা—আসল বিপ্লব কাহিনীটি বের হতে আরম্ভ হয়। তখন বাঙলার মস্‌নদে রোনাল্ডসে সাহেব বিরাজ করছেন ও সার সুরেন্দ্রনাথ মন্ত্রী হয়েছেন। আমি দ্বীপান্তর থেকে মুক্ত হয়ে দেশে আসার পর চিত্রশিল্পী গগনেন্দ্র ঠাকুরের কাছে রোনাল্ডসে সাহেব আমার সঙ্গে পরিচয় করবার বাসনা জানান। গগনেন্দ্র ঠাকুর তাঁকে সমবায় ম্যান সনে ভারতীয় চিত্রকলাশালায় নিয়ে আসেন ছবি দেখাবার অছিলায়। সেইখানে আমার সঙ্গে তাঁর দেশের সম্বন্ধে এক ঘণ্টা আলাপ হয়।

 যখন বিজলীতে ‘বোমার যুগের কথা’ বের হতে আরম্ভ হলো তখন ভারতে প্রিন্স অব ওয়েলস্ আসছেন, অশান্ত ভারতকে রাজপুত্র দেখিয়ে শান্ত করবার বিরাট আয়োজন চলছে। সার সুরেন্দ্রনাথ সঞ্জীবনী-সম্পাদক শ্রীকৃষ্ণকুমার মিত্রের দ্বারা আমায় ডেকে পাঠিয়ে অনুরোধ করলেন ‘বোমার কথা’ বন্ধ রাখতে যে পর্যন্ত রাজপুত্র বহাল তবিয়তে বাপ মায়ের কোলে ফিরে না যান। আমি বিজলীর পাঠকদের এমন ভাবে প্রতিশ্রুতি দেখার পর বন্ধ রাখতে নারাজ হওয়ায় চতুরচূড়ামণি সুরেন্দ্রনাথ আমায় রোনাল্ডশে সাহেবের শরণাপন্ন হতে উপদেশ দিলেন এবং খুব সম্ভব ভিতরে ভিতরে কলকাটিটিও টিপে রাখলেন। আমি ডাক পেয়ে একদিন লাটভবনে গিয়ে উপস্থিত হই। বাহিরে অপেক্ষা করবার সময় দেখি সার সুরেন্দ্রনাথ কাছাকাছি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। রোনাল্ডসে সাহেবের ঘরে আমার ডাক পড়বার পরই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন ষ্টেট্সম্যানের সম্পাদক জোন্স সাহেব। আমি এই অনুরোধের বিরুদ্ধে রোনাল্ডসে সাহেবকে জানাই; বলি, যে, পাঠকদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এখন আর ওটা বন্ধ করা যায় না। লাট সাহেব হেসে বলেন—“গভর্ণমেণ্ট আপনাকে বন্ধ করতে বাধ্য করছেন না, অনুরোধ করছেন মাত্র।” অগত্যা ‘বোমার কথা’ বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশে বোমার সূত্রপাত ও চণ্ডলীলা আবার হওয়ায় আর তা’ এ পর্য্যন্ত বের হয় নি।

 এর আগে আর একটু ঘটনা ঘটে; আমার বিশ্বাস সার সুরেন্দ্র ও রোনাল্ডসে সাহেবের উদ্যোগী হয়ে এ কাহিনীটি বন্ধ করবার মূলে সেই ব্যাপারটিই হেতুরূপে ছিল। বিজলীতে বোমার যুগের কথা বের হবার সময় আমার কোন ইঞ্জিনীয়ার বন্ধুর মারফৎ ‘ষ্টেট্‌সমান’ আমাকে দশ হাজার টাকা দিতে চান এই কাহিনীর ইংরাজি অনুবাদ তাঁদের কাগজে বার করবার বিনিময়ে। এই সুত্রে পি এন গুহ আমার কাছে আসা যাওয়া করছিলেন। তখন জোন্স সাহেব ষ্টেট্সম্যানের এডিটার। তাঁরা ভারতব্যাপী বিজ্ঞাপন দিয়ে সচিত্র এই কাহিনী বের করবার আয়োজন করছিলেন। আমি প্রথমে রাজি হই, তারপর কয়েকজন দেশপ্রাণ নেতা বিশেষতঃ দেশবন্ধুর অনুরোধে আমার প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করি। জোন্স সাহেব রেগে বলেছিলেন, “All right, I shall see that it does not see the light of day,”— আমার খুবই বিশ্বাস জোন্স সাহেবের চক্রান্তে ও প্ররোচনায় গভর্ণমেণ্ট আমার কাহিনী বন্ধ করেছিলেন।

 জন্ম থেকে বরোদার জীবন অবধি এ জন্মকথা এখনও বলা হয় নি, এ অংশটুকু সেই সময়ের কাহিনী। তারপর ‘বোমার যুগের কথা’ও বের করবার ইচ্ছা আছে। দেশে বোমার ব্যাধি সংক্রামক হয়েই আজও টিঁকে আছে, হয়তো স্বরাজ স্থাপনা অবধি থাকবে। বোমার জন্মদাতা আমার এতদিন পরে এ সম্বন্ধে কি বলবার আছে, এ বস্তুটি দেশে কি করে এলো, এ সব দেশের মানুষের শোনবার প্রয়োজন আছে বলেই আমার বিশ্বাস।

 আমার জীবনের শেষ অংশ সাধন জীবনের কাহিনী, এই সাধন জীবন আরম্ভ হয় সুরাটে লেলের দর্শন থেকে আর শেষ হয় গত ১৯২৯ অব্দের ডিসেম্বর মাসে যখন পণ্ডিচারী শ্রীঅরবিন্দ যোগাশ্রম ছেড়ে বাঙলায় আসি। এ গল্পও খুবই চিত্তাকর্ষক হবে। কেবল এত কথা বলবার জন্যে সামর্থ্য ও পরমায়ুতে কুলবে কি না জানি না।

 পারিবারিক জীবনেরও সব ঘটনা প্রকাশ্যে বলা সম্ভব নয়, কারণ আমার জীবনের গতি চিরদিনই বাঁধা পথের বাইরে চলেছে, আমি স্বভাব-বিদ্রোহী। যাদের নিয়ে এই সব খেলা চলেছিল তাদের অনেকে এখনও জীবিত। তবু যতদূর বলা যায় সবই অকপটে বলবো, নিজেকে চূণ-কাম করে সাদা দেখাবার কোন প্রয়াসই এতে থাকবে না। আমি নীতিশাস্ত্রটা একটা উপসর্গ বলে মনে করি, শক্তিমানের জন্যে ও-শাস্ত্রটা আদৌ নয়, আর লোকমতের ভয় আমার কাছে বড় হীনতার ও লজ্জার কথা মনে হয়। লোকের আমি ধারি কি? যারা পরের বিচার করে তারা নিজেরা ক’জন নিখুঁৎ? নিজের পাপটি লুকিয়ে মানুষ পরের ঠিক সেই পাপেরই সাজা দিতে উদ্যত হয়, এই তো সর্ব্বত্র দেখে আসছি। যার সতীত্বের বড় জাঁক ও আড়ম্বর সে হচ্ছে চিরদিনই সব জায়গায় দীঘল-ঘোমটা নারী।