আমার আত্মকথা/এক

উইকিসংকলন থেকে

আমার আত্মকথা

এক

 আত্মকাহিনী লিখেছিলাম আন্দামান থেকে ফিরে। তাতে শৈশব ও কৈশোরের দিকটি আদৌ লেখা হয় নি। এখন যা লিখতে বসেছি তা হচ্ছে জন্ম থেকে বরোদা জীবন অবধি ঘটনা। সে সবের একেবারে নিখুঁৎ চিত্র ও সঠিক বিবরণ দেওয়াও শক্ত; তার প্রথম বাধা আমার ক্ষীণ স্মৃতি-শক্তি। ঘটনা-বহুল বিচিত্র আমার জীবনে ছায়াচিত্রের মত কত ছবি যে উপুর্য্যুপরি এসেছে ও গেছে, তাদের আগের গুলিকে কতক অস্ফুট করে, কিছু বা মুছে দিয়ে। স্মৃতির দড়িতে জটের ওপর জট পাকিয়ে ক্রীড়ারত শিশু মহাকাল আজ এমন এককাণ্ড করে বসেছে, যে, সে জট আর ছাড়ানো অসম্ভব। তার পর জীবনের শৈশব কৈশোর ও যৌবনের রঙ্গমঞ্চে অন্তরাল থেকে কত মানুষ দলের পর দলে এসে ঢুকেছে তার বেরিয়ে গেছে তাদের ভূমিকা অভিনয় করে, হাসিয়ে কাঁদিয়ে, আনন্দের হাট বসিয়ে, করুণ রসের অশ্রুতে তার তখনকার আকাশ বাতাস ভিজিয়ে; সেই সব দলের অনেকেই আর ইহ-জগতে নেই—বিশেষ করে গোড়ার শৈশব ও কৈশোরের মানুষ-গুলি। তারা সব আজ আমার চারদিকে ঘিরে থাকলে হতো ভাল, আমার ক্ষীণ স্মৃতির তাঁরা খোরাক জোগাতেন, তার বিলুপ্ত মোছা পাতাগুলি নিজেদের ভাণ্ডার থেকে ভরে তুলতেন কত না চিত্তাকর্ষক দ্রব্য-সম্ভারে।

 যাই হোক, বলতে যখন বসেছি তখন এ গল্প আমাকে বলতেই হবে। আমার মনে হয় উঁচু ধরণের কবিতা বা ছবির মত গল্পও যদি হয় আধখানা ব্যক্ত এবং আধখানা অব্যক্ত, থানিকটা যার চোখের সামনে ভাসছে রূপে রঙে রেখায় আর খানিকটা পিছনে ফুটি-ফুটি হয়ে সারা চিত্রখানাকে রহস্যে করে রেখেছে থমথমে, তা’ হলে সেই গল্পই জমে ভাল। সবটাই যদি খুঁটিয়ে যথাযথ ফুটয়ে তুললুম তা’ হলে সে তো হ’লো ফটোগ্রাফ প্রকৃতির হুবহু অণুকরণ; হাজার ভাল হলেও তা কখন সৃষ্টি নয়, তা’তে আর্টও নেই, প্রাণও নেই— যেমন গ্রামোফোনের গান।

 খুব আগেকার—প্রায় শৈশব-ঘেষা কথা বলতে গেলে বেশি যে কিছু বলতে পারবো তা মনে হয় না। পৈতৃক বাস কোন্নগরে, সে ভিটা শুনেছি এখনও আছে, তবে আমি কখনো চোখে দেখি নি। আমার ঠাকুরদা’র মৃত্যুর পরে বাবা ও কাকা নিজের নিজের কর্মক্ষেত্রে চলে গেলে ঠাকুরমা কাশীবাস করেন; সেই থেকে কোন্নগরের বাস আমাদের উঠলো। অবোধ শৈশবের সেই অজ্ঞানের কুহেলী ভেদ করে প্রথম যখন জগত আমার অনভান্ত শিশুচোখে রূপ নিতে লাগল, স্মৃতির সাদা পাতাগুলিতে প্রথম যে ক’টির কালির আঁচড় পড়লো তা’তে চোখের ওপর খুব পুরাণ অস্পষ্ট ফটোর মত জাগে একখানা বাংলো ফ্যাসানের বাড়ী; সামনে রেল লাইন, এখানে ওখানে কালো কালো পাথর, তার ওপর কোঁকড়ানো কোঁকড়ানো হাতাজুড়ি ফার্ণ, দূরে আকাশের গায় নীল পর্ব্বতমালা, পূবে আর পশ্চিমে— একদিকে ত্রিকূট আর একদিকে দিগড়িয়া। বাড়ীখানি ছিল এক সাহেবের, বাবা সেখানি ভাড়া নিয়ে জামার পাগলী মাকে সেখানে রেখেছিলেন। স্থানটি রোহিণী গ্রাম, দেওঘর থেকে দু’মাইল দূরে। রোহিণীতে মাকে রাখার কারণ বোধহয় এই যে, তার কাছেই দেওঘরে দাদাবাবু (মাতামহ) শ্রীরাজনারায়ণ বসুর বাড়ী। তাঁরা সময়ে অসময়ে তাঁদের পাগলী মেয়েকে দেখবেন।

 আমার বাবা ডাক্তার কে ডি ঘোষ (কৃষ্ণধন ঘোষ) ছিলেন পুরো দস্তুর সাহেব, থাকতেনও সেই ষ্টাইলে। বড় বাড়ী, খানসামা, বাবুর্চ্চি, বয়, আয়া, আসবাব-পত্র কোন অনুষ্ঠানেরই ত্রুটি ছিল না। এখনও এই রোহিণীর বাড়ীর বাবুর্চ্চিখানাটা আমার লুব্ধ মনের স্মৃতিতে জ্বল জ্বল করছে, বোধ হয় অনেক কাটলেট চপ অমলেটেরই রস ওটাকে করে রেখেছে আজও অমন উজ্জ্বল ও ঘোরাল। নিজকে আমার মনে আছে— এই বয়সে নিকার-বকার পরা রোগা ছোট্ট ছেলে। দিদিও (শ্রীসরোজিনী ঘোষ) সঙ্গে ছিলেন আমার নিত্য-সঙ্গিনী খেলার সাথী হয়ে; পিঠোপিঠি বলে আমরা ঝগড়া করতাম বিস্তর কিন্তু একজনকে না হ’লেও আর একজনের এক দণ্ড চলতো না। এই বাড়ীতে কাটানো শৈশবের অংশটুকুর সব কিছুই ভুলে গেছি, একটি তুচ্ছ ঘটনা ছাড়া। একদিন একজন খানসামার সহিত খেলতে খেলতে তাকে ঢিল ছুড়ে মেরেছিলুম। সে নাকে ঝুঁজিয়ে পড়া রক্ত মুছতে মুছতে ভয় দেখিয়েছিল মেম সাহেবকে (মাকে) বলে দেবে বলে। বোধ হয় শিশুর কোমল প্রাণে সেই মার খাবার আতঙ্কের স্মৃতি দুরপনেয় হয়ে মনের পটে বসে গেছিল বলেই আজও চিত্রটি টিঁকে আছে।

 আমাদের জীবনে যত ঘটনা ঘটে তাকে বাটালী দিয়ে কুঁদে গভীর করে দেয় কারা জানো? যাদের জগতে বড়ই বদনাম সেই ভর্ৎসিত লাঞ্ছিত কাম ক্রোধ লোভ আদি ছয়টি রিপু। আসলে বোধ হয় ওরা আমাদের রিপুর চেয়ে বন্ধু, সচিব সখী ও গৃহিণীই বেশী। আগেই বলেছি সেটা ছিল সাহেবের বাড়ী। সাহেব তখন সপরিবারে ছিলেন বিলেতে আর তাঁর অনেক আসবাব পত্র নীচের তলায় সামনের ঘরটায় ছিল সাজানো। খুব বড় একটা টেবিলে (বোধ হয়, বিলিয়ার্ড টেবিল) বেলোয়ারী কাচের, পেতলের ও সোণার মত ঝকঝকে রঙীন কত কি যে ছিল একটি সাজানো মনোহারী দোকানের মত। রহস্যে অভিনবত্বে মাধুর্য্যে সেগুলো আমার শিশুচিত্তকে টানতো যাদুঘরের অপূর্ব্ব সাজ সরঞ্জামের মত, ভানুমতীর ভেল্কির ঝাঁপীর মত। মা যখন দুপুর বেলা ঘুমোতেন তখন তার দু’ একটা ভেঙে নিয়ে আত্মসাৎ করে কি আনন্দই যে হতো সে আজ আর বলে বোঝাবার নয়।

 কবে যে আমরা এই বাড়ী ছেড়ে লালা তারিণীপ্রসাদের বাড়ীতে এলাম তা’ আমার এখন আর স্মরণ নেই। শুনেছি প্রথম যৌবনে মা আমার ছিলেন ডাকসাইটে রূপসী, মা ও বাবার মিলন ছিল গভীর প্রেমের মিলন। সেই প্রেমে ক্রমে ক্রমে চিড় খেয়ে গেল—মা দাদার জন্মের পর শনৈঃ শনৈঃ পাগল হতে লাগলেন। তবু বাবার সে ভালবাসা আমার পাগলী মাকে আরও অনেক দিন ঘিরে রেখেছিল—সযত্ন বাহুর বন্ধনে। আমরা চার ভাই ও এক বোন, বড় শ্রীবিনয়ভূষণ ঘোষ, মেজ শ্রীমনোমোহন ঘোষ, সেজ শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ, তার পরেই দিদি সরোজিনী ঘোষ, এবং সব শেষে সর্ব্বকনিষ্ঠ আমি। আর একটি ভাই শ্রীঅরবিন্দের পর জন্ম নিয়ে মারা যায়; সে যে কেন এসেছিল, কেনই বা একটা উঁকি দিয়ে অমন করে কোন্ অচিন জগতের উদ্দেশে চলে গেল তা বলা কঠিন। কে বা জানে এই জন্ম ও মরণের অতল রহস্য, মানুষের বুদ্ধির মাপ জোকে তার কোন হিসাব হদিস আছে কি না সন্দেহ।

 মায়ের প্রতি বাবার ভালবাসার অমন প্রবল নদীতে ঠিক কবে থেকে যে ভাটা পড়লো সে ইতিহাস আমার অজ্ঞাত; মানুষের হৃদয়ের কাহিনী চির দিনই গোপন-পুরীর কথা, ক’জন তার দুয়ার খুলে জগতের রূঢ় কৌতূহলী চোখের উপর ধরতে পেরেছে? মায়ের এমন করে পাগল হওয়ায় বাবা যে খুব ব্যথা পেয়েছিলেন, আর সেই মর্ম্মন্তুদ দুঃখ ভোলার জন্যেই মদ খাওয়া ধরেছিলেন তা আমার দিদিমার (শ্রীমতী নিস্তারিণী বসু) মুখে শুনেছি। অত বড় ঋষিতুল্য রাজনারায়ণ বসুও যৌবনে মদ গরু থেতেন—সে সময়টাই ছিল ঐ রকম-সাহেব-ঘেষা যুগ! পাশ্চাত্যের মৌতো-গোরী নেশায় সবাই তখন পাগল ও উন্মার্গগামী। প্রথম ইংরাজি শিক্ষার আবহাওয়া, হিন্দুসমাজের গোঁড়ামীর বিরুদ্ধে প্রথম তরুণ মনের অভিযান, অধঃপতিত দেশের চোখে পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্য-কলার প্রথম তীব্র জ্যোতিঃ—তখন কি পা সামলে হিসাব করে চলার কাল? আর অতশত হিসাব যারা করে জীবনের পথে তারা চলে না আদৌ, তারা পিতৃ-পিতামহের ভূপর্য্যটনের, দিগ্বিজয়ের ও দুর্গম স্বর্গারোহণের ফল বসে বসে ভাঙিয়ে খায় আর বৃথা গর্ব্ব ও আস্ফালন করে ব্যর্থ দিনগুলো কাটায়। মদ খাওয়া বা উচ্ছৃঙ্খল হওয়া ওগুলো হচ্ছে মানুষের জীবনের মাত্রা, খুব মারাত্মক একটা কিছুই এসব নয়, মানুষের নৈতিক শুচিবায়ুই এ সবকে এমন ভীষণ করে তুলেছে।

 দাদাবাবু বলতেন বাবা ছিলেন আদর্শ চরিত্রের ছেলে, ধর্ম্মে তাঁর ছিল খুব টান, তাঁর ছেঁড়া খোঁড়া কাগজের মাঝে এই সেদিন অবধি তাঁর রচিত ভক্তি গদগদ শ্যামা সঙ্গীত আমি দেখেছি। হিন্দুর ঘরে জন্মেও মাকে আমার একান্তই খুব ভালবেসে বাবা ব্রাহ্ম-পরিবারে বিয়ে করেছিলেন। আমার ঠাকুরমা অতিবড় গোঁড়া নিষ্ঠাবতী মেয়ে ছিলেন বলে তাঁকে লুকিয়েই এই বিধর্ম্মী বিয়ে বাবাকে করতে হয়েছিল। কাকা শ্রীবামাচরণ ঘোষ কেবল দাদার এই কাণ্ডটার খবর রাখতেন, হয়তো উদ্যোগ আয়োজন করে সাহায্যও করেছিলেন। তার পর ঠাকুরমা যখন জানতে পারলেন তখন কাকাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন এই বলে, যে, “ঐ ভাইয়ের হয়ে তুই যেমন আমাকে ঠকালি তেমনি ঐ ভাইয়ের তুই হবি চক্ষুশূল।” কয়েক মাস যেতে না যেতে এই ভীষণ অভিশাপ ফলেছিল। কি সূত্রে জানি নে, বাবাতে ও কাকাতে মনান্তর হয় এবং বাবার জীবিতকাল অবধি তাঁদের মুখ দেখাদেখি ছিল না। বাবা মারা যাবার পর কাকা যখন আমাদের গোমেস লেনের বাড়ীতে দেখা করতে এলেন তখনই আমরা জানতে পারলাম যে আমাদের কাকা বলে কেউ একজন এই ধরাধামে আছে।

 মানুষ একটা অসীম অতল ওতপ্রোত বিরাজিত শক্তির সমুদ্রে বাস করছে, সেই শক্তিতেই তার জন্ম, তার গতিবিধি ও তার লয়। কৌশলটি জানা থাকলে স্বেচ্ছামত সেই শক্তি-সমুদ্র থেকে সে অজস্র শক্তি নিতে ও বিকীরণ করতে পারে। আমরা সারা জীবন সজ্ঞানে নয় কিন্তু অজ্ঞানে করছিও তাই, আমাদের বাসনা কামনা হচ্ছে সেই শক্তি টানবার— আকর্ষণ করে নিজের নিজের আধারে নামাবার একরকম কাঁচা ও নিরেট কৌশল। এর পাকা ও উত্তম উপায়টি জানে যোগীরা যারা শান্ত হয়ে পিছনের সেই পরম সত্যের সঙ্গে এক হয়ে truer harmony of life জীবনের প্রকৃত ছন্দে পৌঁছেছে! আমাদের মা বাপ বা অতিবড় আত্মজনের অভিশাপ বা আশীর্ব্বাদ যে কখন কখন আশ্চর্য্য রকম ফলে যায় তার কারণই ঐ পিছনের শক্তি; সেই শক্তিকে হৃদয়ের প্রবল ভাবের জোরে তাঁরা টেনে আধারে নামান এবং হাতের অস্ত্রের মত প্রয়োগ করেন,—কখন কল্যাণ কামনায়, কখন অকল্যাণ কামনায়। অসি নিয়ে আমরা যেমন আর্ত্তত্রাণও করি আবার নরহত্যাও করি।

 আমার অর্থ হোক, সন্তানের রোগ সারুক, অমুক কাজটা উদ্ধার হোক এই যে সব বিচিত্র কামনা আমাদের মনে ও প্রাণে নিরন্তর আসছে ও যাচ্ছে, সাংসারিক জীবন এইতেই চলেছে। খুব নিরেট অসম্পূর্ণ উপায় হলেও বাসনাই মানুষের আপাততঃ জীবন চালাবার একমাত্র উপায়, where there is a will there is a way,—সংকল্প মনে ও প্রাণে দানা বাঁধলেই উপায় একটা না একটা আপনিই আসে। চাইবার ব্যাকুলতা, অধীরতা, ছটফটানী যেমন শক্তিকে কেন্দ্রীভূত করে তার জোরে কামনার পিছনের ইচ্ছাশক্তিটিকে অনেকখানি ব্যাহত করে, বিক্ষিপ্ত করে, লক্ষ্যভ্রষ্ট করে, নইলে শান্ত ভাবে চাইতে জানলে মানুষের ইচ্ছাশক্তি হ’তো অমোঘ সর্ব্বার্থসাধিকা। শ্রীঅরবিন্দ যে মানব আধারে দেবজীবনের কথা বলেন তার মূল কথাই এই ইচ্ছাশক্তির বিশুদ্ধ, শান্ত ও বিরাট রূপ এবং তার অমোঘ প্রয়োগ। মান প্রাণ বিশুদ্ধ ও শান্ত হয়ে যতই ঊর্দ্ধের বৃহৎ সত্তার সঙ্গে tuned হয় ততই তারা হয় অভ্রান্ত ও অব্যর্থ, ততই পিছনের দেবসত্তা—(মানুষ যার ছায়া) জীবনের হয় কর্ণধার। এ সম্বন্ধে বিস্তৃত করে লেখবার ইচ্ছা রইল সাধন জীবনের ইতিহাসে, সামর্থ্যে ও পরমায়ুতে ও অবসরে যদি কুলোয় তা’ হলে একদিন এ ইচ্ছাটিও পূর্ণ হবে।

 যাই হোক, ঠাকুরমার অভিশাপ ফললো। বাবা গেলেন নিজের কর্ম্মস্থলে, কাকা গেলেন ভাগলপুরে কমিশনারের হেড ক্লার্ক হয়ে। জীবনের শেষ অবধি তিনি ভাগলপুরেই ছিলেন। তাঁর অনেকগুলি মেয়ে, তাঁদের সন্ধান আমি—গৃহহারা লক্ষ্মীছাড়া সংসারসম্পর্কহীন আমি এক রকম রাখিনে, একথা বলাই বাহুল্য।

 বাবা প্রথমে ছিলেন রংপুরের এসিষ্টাণ্ট সার্জ্জন। যে বছর কেশব সেন, বি দে প্রভৃতি বড় বড় একদল বাঙালী জাহাজে চড়ে বিলেতে যান সেই বছর তাঁদের সঙ্গে গেছিলেন এই রংপুরের ডাক্তারটি, এবাডিনের য়ুনিভারসিটিতে তিনি এম্ ডি পাশ করে হয়ে এলেন পুরোদস্তুর সিভিল সার্জ্জন। বাবার এই প্রথম বিলাত যাত্রার সময় তাঁর দুই সন্তান মাত্র হয়েছে—দাদা ও মেজদা, এই দুই ছেলে ও মাকে নিজের বন্ধু মিস্ পিগটের কাছে রেখে তাঁর এই নীল সমুদ্রে ভাগ্যান্বেষণে প্রথম পাড়ি জমানো। পুরো মাত্রায় সাহেব ডাক্তার হয়ে ফিরে এসে কিছু দিন তিনি ভাগলপুরের সিভিল সার্জ্জন হন, তার পরে আসেন রংপুরে। এখানে তাঁর অনেক বৎসর কাটে। রংপুরে তাঁর এত ক্ষমতা ও ও জনপ্রিয়তা হয়েছিল যে একটি সমগ্র জেলার এই হর্ত্তা কর্ত্তা বিধাতাটিকে জেলার সর্ব্বময় অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হতে দেখে গভর্ণমেণ্ট ভয় পেয়ে যান এবং তাঁকে কিছুদিনের জন্যে ভাগলপুরে বদলী করে তার পর খুলনায় সিভিল সার্জ্জন করে পাঠান। শ্যামবর্ণ, আকর্ণবিস্তৃত চোখ, সৌম্যদর্শন এই মানুষটি শীঘ্রই খুলনারও হয়ে উঠলেন প্রাণ। সেখানকার পুলিশ ম্যাজিষ্ট্রেট, স্কুল,জমিদার, আমলা, প্রজা কারুর ডাক্তার কে ডি ঘোষকে বিনা এক দিনও চলতো না। ম্যালেরিয়া প্রধান খুলনাকে ম্যালেরিয়াশূন্য করে হাসপাতাল, স্কুল, মিউনিসিপালিটি সমস্ত নিজের হাতে গড়ে এই মুকুটহীন রাজা বহু বৎসর খুলনায় রাজত্ব করেছিলেন। আজও খুলনা বা রংপুরবাসী তাঁকে ও তাঁর কীর্ত্তি কলাপকে ভোলে নি।

 বাবা দ্বিতীয়বার বিলাত যান তাঁর তিন ছেলে, এক মেয়ে ও আমার মাকে নিয়ে, শিক্ষার জন্য ছেলেদের সেখানে রেখে আসবার উদ্দেশ্যে। আমাকে গর্ভে নিয়ে মায়ের আমার এই প্রথম ও শেষ নীল সমুদ্রে ডোঙা ভাসানো! বিলাতে পৌঁছিয়ে সেখানে (Crystal Palace) মর্ম্মর প্রাসাদের সামনে লণ্ডনের উপকণ্ঠে নরউডে আমার জন্ম। প্রায় সমুদ্র গর্ভে জন্ম বলে নাম হ’লো বারীন্দ্রকুমার। আগেই বলেছি দাদার জন্মের পর থেকে মা অল্পে অল্পে পাগল হচ্ছিলেন। মায়ের ডাক্তারের নাম ছিল ম্যাথিউ, আর ক্রাইষ্টের জন্মের পরই ৫ই জানুয়ারী আমার জন্ম বলে পাগলী মা আমার এক উদ্ভট বাইবেলী নাম রাখলেন ইম্যানিউয়েল ম্যাথিউ ঘোষ। ক্রয়ডনের বার্থ্ রেজেষ্ট্রী অফিসে লিখলে এখনও ঐ নামে জন্মের সার্টিফিকেট পাওয়া যায়।

 দাদা শ্রীযুক্ত বিনয়ভূষণ ঘোষ জন্মেছিলেন ভাগলপুরে, মেজদা’ শ্রীমনোমোহন ঘোষের ও জন্ম সেইখানে। শ্রীঅরবিন্দ—আমার সেজদা’ জন্মেছিলেন কলকাতায়। দিদি শ্রীসরোজিনী ঘোষের জন্ম রংপুরে এবং আমার জন্ম বিলাতে নরউডে। ছেলেপুলে নিয়ে সস্ত্রীক বাবা বিলাত যান এবং একা ফিরে আসেন ১৮৭৯ সালের আগষ্ট মাসে, মাও আমাকে ও দিদিকে নিয়ে একা দেশে আসেন আমার জন্মের তিন মাস পর ১৮৭০ সালের মার্চ্চ মাসে। দেশে ফিরে এসে কত দিন মা ও বাবা একত্র ছিলেন, কবেই বা আমাকে ও দিদিকে নিয়ে মা রোহিণীতে বাস করতে গেলেন এসব ইতিবৃত্ত জানে এমন মানুষ বোধ হয় এখন আর কেউ বেঁচে নেই। পাগল মায়ের কোলে সুখে ও দুঃখে আমি ও দিদি বাড়তে লাগলুম। তিন দাদা বিলাতে শ্বেতদ্বীপের মায়াপুরীতে মানুষ হ’তে লাগল। সেখানে তাঁরা ছিলেন চৌদ্দ বৎসর। রংপুরের ম্যাজিষ্ট্রেট গ্লেজিয়ার (Glazier) সাহেব ছিলেন বাবার বন্ধু, তাঁরই আত্মীয় non-conformist পাদ্রী ড্রইড সাহেবের পরিবারে ম্যাঞ্চেষ্টারে তিন ভাই থাকতেন। সেজদার নাম যে হয়েছিল অরবিন্দ অক্রয়েড ঘোষ সেই অত্রুয়েড Akroyd পরিবার, এই ড্রইডদের আত্মীয় ও তাঁরাও বাবার পরম বন্ধু ছিলেন।