আমার আত্মকথা/চার

উইকিসংকলন থেকে

চার

 আমার সারা শৈশবটা জুড়ে চার পাশের ধূসর নীল পাহাড়, সবুজ ধান ক্ষেত, রাঙা মাটির উধাও দিকচক্রবাল-ছোঁয়া মাঠ, গাঢ় ঘন সবুজ বন ও পাখীর কাকলির কি যে সে প্রাণকাড়া ডাক শুনতে পেতুম! প্রকৃতির কোলের শিশুকে ঘিরে প্রকৃতিরাণীর মাটির বুকের টান কি আকুল প্রেমে লক্ষ অদৃশ্য বাহু মেলে যে কেঁদেছে তা বলে বোঝান শক্ত! মানুষের শত শত শতাব্দীর আগেকার সে বন্ধন, আর এই সভ্যতা ও শিক্ষার কৃত্রিম সম্বন্ধ এতো এই সে দিনের। সত্যই, মানুষকে মানুষ করবার জন্যে প্রকৃতির কোলের মত অমন বিদ্যালয়, অমন গুরুগৃহ, অমন মাতৃকোল আর নেই। সহরের ইটের পাঁজার এই আবদ্ধ জীবন—কলহ অশান্তিতে, হাটের হট্টগোলে উদ্ব্যস্ত জীবন কেন যে মানুষ স্বেচ্ছায় মাথায় তুলে নেয় তা জানি নে। এরও মাঝে অবশ্য একটা মদ্যপের উত্তেজনাময় আনন্দ আছে, দশজনের সঙ্গে থাকার (herd-consciousnessএর) মায়া আছে, কৃত্রিম বিলাস-বিপণীর ও নৃত্যশালার টান আছে, ভোগের ঘূর্ণ্যাবর্ত্তে আপনাকে ক্ষয় করে ফেলার—উড়ে চলার মোহ আছে। কিন্তু অবুঝ শিশুর কি তাই? সে তো কৃত্রিমতার স্বাদ এখনও পায় নি, তার স্মৃতির পাতায় জন্মজন্মান্তরের প্রকৃতি মায়ের রূপই যে সবার আগে বেশি করে জাগে। এতথানি বয়স হয়ে এখন তো বেশ বুঝতে পারি প্রকৃতির ঐ বিচ্ছিন্ন কোলে আবার ফিরে গিয়ে আমি কতখানি মানুষ হয়েছি আর কতটুকুই বা শিখেছি তোমাদের এই কৃত্রিম শিক্ষার তাড়নায়।

 আগেই বলেছি দশ বছর বয়স পর্য্যন্ত আমার অক্ষর পরিচয় অবধি হয় নি! পাগল মায়ের কাছে আমার সে ছিল এক বন্য জীবন। বইএর মুখ সেখানে কখন দেখতে পেতুম না। শুধু যে বর্ণ-জ্ঞানই হয় নি তা নয়, বাইরের জগতের সম্বন্ধে আমার মত অত বড় আনাড়ী এক গভীর লোকালয়হীন বনে ছাড়া আর কোথায়ও সম্ভব নয়। সহর কি, গ্রাম কি, নদী নালা পর্ব্বত আকাশ কোন্‌টা কি তার জ্ঞান ছিল একেবারে অস্পষ্ট, চোখে দেখা অধিকাংশ বস্তুর আসল নামই আমরা জানতুম না, খেয়াল মত নিজে যা হোক একটা নাম দিতুম। ছেলে মেয়েকে লেখা পড়া শেখাতে হ’লে যে অতি শৈশবে বই নিয়ে মাষ্টারের শাসনের তলায় বসাতে হবে এ ধারণা যে কতখানি ভুল তার এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত আমি স্বয়ং। মায়ের কাছ থেকে ফিরে এসেও স্কুল কলেজে যে কত সামান্য শিক্ষাই পেয়েছি তা শুনলে নিয়মিত শিক্ষার পক্ষপাতী মানুষরা অবাক হয়ে যাবেন।

 এক দিন সকাল বেলা রোহিণীর বাড়ীর পূবের বারাণ্ডায় আমি একা খেলা করছি, একজন মোটা কসমের ওভারকোটপরা ভদ্রলোক এলেন। আমি ত অবাক্। আমাদের বাড়ীতে জন মানুষ কখনও আসতো না, সে অঞ্চলে প্রসিদ্ধ পাগলী মেম সাহেবের ভয়ে ও-বাড়ীর ত্রিসীমানায় কাউকে ঢুকবার সাহস রাখতে দেখি নি। মা মাঝে মাঝে রেগে উগ্রচণ্ডা হয়ে থাকতেন; তখন বাড়ীর হাতার মধ্যে অপরিচিত মানুষ দেখলে চীৎকার করে গালাগাল দিতেন, ছোরা দেখাতেন, দরকার হ’লে তাড়াও করতেন। তারা তখন প্রাণ ভয়ে পালাতে পথ পেতো না। তারিণী বাবুর একজন মালী ছিল, সে থাকতো ভয়ে তটস্থ হয়ে, মাঝে মাঝে তরকারী ও ফলের ভেট দিয়ে আমার মাকে তুষ্ট রাখতো; বকসিস্‌টা আসটাও মায়ের প্রসন্ন অবস্থায় আদায় করতো কম নয়। বাবুটি এসে মাকে ডেকে কি আলাপ পরিচয় করলেন। আমাকে ফল মেঠাই কি সব দিলেন আর যাবার সময় চুপি চুপি অনেক তথ্য তালাস নিলেন, তারপর চুপি চুপি চাপা গলায় বললেন, “তুমি কোথায় শোও?”

 আমি। এ-ঘরে।

 বাবু। আর মা?

 আমি। ঐ ও ঘরে।

 বাবু। রাত্রে এই দরজাটা ভেতর থেকে খুলে রেখো, তা’লে তোমার রাঙা মায়ের কাছে নিয়ে যাব। কেমন, যাবে?

 আমি। যাব, কিন্তু আমায় যে মা খাটের সঙ্গে হাত পা বেঁধে রাখে। দরজা খুলবো কি করে?

 বাবুটি অবাক হয়ে খানিক কি ভাবলেন, তার পর বললেন, “আচ্ছা, তুমি যাবে তো? তা হ’লেই হলো, আমি ব্যবস্থা করছি।” তিনি সে দিন চলে গেলেন। পরে শুনেছিলুম আমাকে বাবার কাছে নিয়ে যাবার জন্য মাকে বলেছিলেন, অনেক টাকার লোভ দেখিয়েছিলেন; মা কিন্তু রাজী হন নি। তাঁর কোলের ছেলেটিকে অমন করে ছেড়ে দিতে। আমার বেশ মনে আছে তখন শীতকাল, বোধ হয় অগ্রহায়ণ কি পৌষ মাস। পরের দিন সকালে পূর্ব্বাচলে সবে সোণার থালার মত সূর্য্য উঠছে। মা বেরিয়ে বারাণ্ডায় রোদে দাঁড়িয়ে বিড় বিড় করে আপন মনে কি সব বকছেন আর আমি তাঁর কাছ থেকে একটু দূরে বসে রোদ পোহাচ্ছি।

 বারাণ্ডাটার যে মুখটা পশ্চিমের দিকে ঘুরে গেছে সেইখানে কার যেন পায়ের খস্ খস্ শব্দ পাচ্ছি আর কোঁকড়টি হয়ে বসে বসে রোদ পোহাচ্ছি। হঠাৎ একটা গুণ্ডা কসমের গাঁট্টা গোঁট্টা মানুষ এসে মাকে বললো, “মেম সাহেব, ফুল লেগা?” সে এককোঁচড় ফুল মায়ের সামনে ঝপ করে ছুঁড়ে দিয়ে আমার দু’হাত চেপে ধরলো, তার পর আমাকে টানতে টানতে নিয়ে দে দৌড়! পিছনে পিছনে রৈ রৈ রবে হল্লা করতে করতে ছুটলো আরও দশ বার জন জোয়ান। মা তো রেগে কাঁই, দৌড়ে ভিতরে গিয়ে ছোৱা এনে উর্দ্ধশ্বাসে গুণ্ডার পালকে তাড়া! আর মাটিতে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে টানতে টানতে আমাকে নিয়ে গুণ্ডার পালের প্রাণ হাতে করে ছুট। পা’ দু’খানা আমার মাটিতে কাঁটা বনে কত জায়গায় ছড়ে গেল। আমাকে যে কোলে তুলে নেয় তাদের তার অবসরটুকু এবং একটুখানি থামবার সাহস অবধি ছিল না, ও-অঞ্চলে মায়ের এমনি ছিল দোর্দ্দণ্ড প্রতাপ।

 রোহিণীর বাড়ীর কম্পাউণ্ডটা প্রকাণ্ড ব্যাপার, প্রায় ১৫।২০ বিঘের ওপর জমিতে বাড়ীখানা। এতখানি পথ পার হয়ে যেখানে আম বাগানে আমাকে ওরা ছেড়ে দিয়ে হাঁপ ছাড়লো, সেখানে দেখলুম সেই মোটা বাবুটি দাঁড়িয়ে, সামনে একটা আট-বেহারার পাল্কি হাজির রয়েছে। বাবুটি আমাকে তাড়াতাড়ি পাল্কির মধ্যে দিলেন পুরে, পাল্কি লোক লস্কর ঘেরাও হয়ে চললো উড়ে সোজা উত্তর মুখো; বাবুটি হাঁপাতে হাঁপাতে পাশে পাশে ছুটলেন, আমাকে ভয়ে আড়ষ্ট দেখে বললেন, “ভয় কি, তোমার রাঙ্গা মায়ের কাছে যাচ্ছ। সে মস্ত সহর, কলকেতা, কত ঘোড়। গাড়ী।” আমি তখন শুধু সভয়ে রোহিণীর বাড়ীর দিকে চাইছিলুম, মায়ের চীৎকার শুনছিলুম আর বার বার জিজ্ঞেস করছিলুম, “মা কি আসছে নাকি, আমাদের ধরে ফেলবে নাকি?”

 বাবু। উঁহু! সেটি আর পারছে না। আমরা এথনি গিয়ে গাড়ীতে উঠে হুস্ হুস্ করে দেব পাড়ি কলকেতামুখো।

 এই ভাবে রাবণ রাজার দ্বারা বনবাসিনী সীতাহরণের মত আমার হরণ দিয়ে হ’লো আমার নতুন জীবনের সূত্রপাত। সেই প্রথম রেলে চড়লুম—জসিডি জংশনে এসে। প্রথম দফায় বাবুটি একঠোঙা জল খাবার দিলেন হাতে। সে কি বিপুল মুক্তির আনন্দ! সে কি আনন্দ সমারোহের নবীন জগৎ আমার চারিদিকে! বোধ হয় বেলা দশটা বা এগারটার একটা গাড়ীতে আমরা চড়ি আর সেই দিন সন্ধ্যার পর রাত্রের অন্ধকারে কলকেতায় পৌঁছাই। সমস্ত রাস্তা এই অজ্ঞাত অপরিচিত রাঙ্গা মার সম্বন্ধে নানা প্রশ্নে বাবুটিকে উস্তোম ফুস্তোম করে মেরেছি। আমার সমস্ত শিশুচিত্ত ও কল্পনা জুড়ে তখন রূপ নিচ্ছে ঠাকুরমার গল্পের রাজরাণীর মত এই রাঙ্গা মা। বালকের মত সহজ আর কি আছে, তাই তার কাছে ভাল মন্দের হিসাব বুদ্ধি নেই। মানুষকে সে হৃদয় দিয়ে প্রাণের তত্ত্ব দিয়ে ঠিক অবুঝ লতার মতই আঁকড়ে নেয়

 আর, তার পর কলকেতা। দশ বছর অবধি যে বনে জনকোলাহলের বাইরে একেবারে অজ্ঞানে, মানুষ হয়েছে সেই বালকের চোখে হঠাৎ-দেখা এই মুখর নগরীর আলোর হাজারনরী হার, এই সমারোহ, এই জন-কোলাহল, এই বিচিত্র সারি গাঁথা বাড়ীর ভিড় কি যে যাদু করতে পারে তা বলে বোঝান সহজ নয়।—লেনের একটা দোতলা বাড়ীতে নিয়ে ওরা আমায় তুললো। তখনকার দিনে মটরকার ছিল না, ছিল অগুন্তি ছ্যাকরা গাড়ী। নীচে ছুটে এসে আমায় কোলে করে নিলেন এতক্ষণের রহস্যে ঘেরা রাঙা মা।

 দীর্ঘছন্দ সবল বলিষ্ঠ দেহ, অপূর্ব্ব রূপ সারা যৌবনসুঠাম অঙ্গ বয়ে ঝরে পড়ছে। বয়স আন্দাজ ১৮।১৯ —অন্ততঃ এখন তাই মনে হয়। আমার জরাজীর্ণ শতছিদ্র কাপড় ছাড়িয়ে মা আমায় গরম জলের গামলায় ফেলে সাবান ও স্পঞ্জ দিয়ে ধুয়ে মুছে তুললেন, ধোয়া কাপড় পরিয়ে বুকে চেপে ধরে সে কি আদরের ঘটা। সন্তানহীনা সেই বালিকার প্রাণ হৃদয় মন সব অন্তরটুকু আমি এক মুহূর্ত্তে হরণ করে নিয়েছিলুম। দিদি এসে মুখটি চূণ করে সামনে দাঁড়াল। রাঙা মায়ের সঙ্গে দিদির আমার বনতো না, চির অভিমানিনী সহজে কোপনা দিদির সঙ্গে কারই বা তখন বনতো!

 এই—গলির বাড়ীটি দিয়ে আরম্ভ হ’লো আমার কলকেতার জীবন। আমার ৫০ বছর বয়স ধরে পটের পর পট পড়েছে আর উঠেছে, বিয়োগে মিলনে অশ্রুতে নৃত্যে—জমকালো কত না ঘটনার রসবৈচিত্র্যে এ অভিনয় পরিপূর্ণ। সমুদ্রের পরপারে আমার জন্ম—সেই-ই শ্বেতদ্বীপের যক্ষপুরীতে—তাই বলছিলাম এ অভিনব জীবনের একেবারে গোড়া থেকেই অসাধারণ ও উদ্ভট, যা কারু হয় না বা খুব কম লোকের হয় তাই দিয়ে পরিচ্ছেদের পর পরিচ্ছেদ আমার জীবন-নাটিকাটি লেখা হয়েছে। বাহির থেকে দেখতে গেলে যেন এর কোন ছন্দ নেই, কোন কল্পনা-বিলাসিনী ঠাকুরমা যেন নিতান্ত অবুঝ নাতি নাতনীর জন্যে অতি উদ্ভট আরব্য কাহিনীর মনগড়া গল্প জোড়াতালি দিয়ে বলে যাচ্ছে, যাকে কখন কোন সমালোচকের কাছে জবাবদিহী করতে হবে না। রাজনারায়ণ বসুর প্রতিভায় জাত তাঁর পাগলী মেয়ে আমার মা, প্রকাণ্ড শক্তিধর পুরুষ অথচ ভালবাসায় সৌন্দয্যের মোহে সহজে আকৃষ্ট নারীর অধিক কোমল উন্মার্গগামী কৃষ্ণধন আমার বাবা, যাঁদের ঔরসে ও গর্ভে জন্মেছেন মেজদা——মনোমোহনের মত অপূর্ব্ব কবি, সেজদা শ্রীঅরবিন্দের মত শতমুখী প্রতিভার বিরাট পুরুষ; সেই শক্তির চঞ্চল ইতস্ততঃ বিশপী শিখায় আমার জন্ম। তাঁদের সব দুর্ব্বলতা ও কিছু কিছু শক্তি ও প্রতিভার স্ফুলিঙ্গ নিয়ে ধূমে ও আলোকে কৃষ্ণজ্যোতির্ম্ময় আমার এই সত্তা জন্মেছে। এর কাহিনী বলা কি সহজ? না, তার সব কয়টি পাতা এই ক্রুর জগতের সামনে খুলে দেখাবার জিনিস? রূপে ঢল ঢল কমল—বর্ণে গন্ধে সব কয়টি পাপড়িতে সমগ্র হয়েই না সে এমন অনুপম, এতখানি মনোহারী। তাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে শুষ্ক উদ্ভিদ-তাত্ত্বিকের দৃষ্টিতে দেখলে সে রক্তকমল কি তেমন অপার্থিব আনন্দ দিতে পারে? মানুষের অন্তরের আসল মানুষটির—গোপন পুরীর রাজকন্যার কথা যে সেই রকম। বইয়ের পাতায় বস্তুতান্ত্রিক প্রকাশকের আলমারীতে দপ্তরীর জ্বলজ্বলে বাঁধাইয়ের বাঁধনে মোড়া যে জীবন-কাহিনী তোমরা পড় তাতে কি সত্যিকার বিদ্যাসাগরকে, আসল দেশবন্ধুকে, খাঁটি রবীন্দ্রনাথকে পাও? সে রকম জীবনী আজও বাঙলা সাহিত্যে কেউ লেখে নি, আর সে খাঁটি জীবনের, মাত্র দু’চারখানা পাতা ছাড়া এই শত সংস্কারের ঠুলিপরা বর্ব্বর জগতের সামনে কিছু ধরা যায় না। মানুষ এখনও গোটা মানুষকে সাদা প্রেমের চোখে দেখতে শেখে নি, সে তাকে দেখে হয় নীতির ধোঁয়াটে চশমা দিয়ে আর নয় ধর্ম্মের বা সমাজের কিম্বা রাজনীতির নীল বাঁকা গগল্‌সের ভিতর দিয়ে। মানুষ আজও চায় না সহজ মানুষ, জীবনের রসে ছন্দে মাধুর্য্যে বিচিত্র প্রস্ফুট মানুষ, তারা চায় তাদের ধারণা ও সংস্কারের কাঁচিতে কাটা-ছাঁটা রঙীন কাগজের ফুল।