আমার আত্মকথা/দুই

উইকিসংকলন থেকে

দুই

 বাবার চেহারা এখনও আমার মনে আছে। শ্যামবর্ণ, বড় বড় ভাসা চোখ, মাইকেল মধুসূদনের মত মুখাকৃতি, নাতিদীর্ঘ ঋজু দৃঢ়পেশী শরীর, নতুন গুড়ের মত মিষ্টি স্বভাব, সদাপ্রসন্ন মূর্ত্তি, অথচ একরোখা শক্তিমান পুরুষ। ডাক্তারীতে তাঁর যশ ছিল প্রচুর, ঠাকুর দেবতার কাছে মানতের মত বেশী রোগী তাঁর কাছে এসে জীবন ও পরমায়ু ভিক্ষা করতো। টাকা তিনি উপার্জ্জন করতেন প্রচুর আর ব্যয়ও করতেন অপরিমিত ভাবে। তাঁর দয়া ও মমতার কাহিনী খুলনায় এখনও কিম্বদন্তির মত মানুষের মুখে মুখে রয়েছে। নারীর মত কোমল প্রাণ ও প্রেমপ্রবণ চিত্ত নিয়ে এই শক্তিধর মানুষটি সংসারের সুখের নীড় বাঁধতে এসেই আঘাত পেলেন নিদারুণ—কোথা থেকে ক্রূর বাজের মত উন্মাদ ব্যাধি এসে তাঁর অন্তরের মানুষ জীবনের সঙ্গিনীটিকে দিলে ক্ষেপিয়ে। প্রেমের একটা অকূল সাগর বুকে করে যে মানুষ মমতাময় প্রাণ নিয়ে জগতে এসেছে, তার একমাত্র ভালবাসার বস্তুকে কেড়ে নিলে সে যদি পথভ্রষ্ট হয় তা’ হ’লে তার দোষ দেওয়া চলে কি? সে ক্ষেত্রে অতখানি প্রেমের অতখানি উচ্ছল প্রাণণক্তি উন্মার্গগামী হওয়াই তো স্বাভাবিক। নীতিবাগীশ হচ্ছে পেচক জাতীয় জীব, সত্যের দিক্‌প্রকাশী আলোয়—দিনের বেলা সে কাণা, নীতির আধ আলো আধ-আঁধার রাত্রে তার চোখ ফোটে ভাল; তখন সে জগতের কল্যাণ খুঁজে খুঁজে ঘুরে বেড়ায় আর কর্ক্কশ বীভৎ ডাক ডাকে। মানুষের মন প্রাণ হৃদয় ও দেহ যে কি জটিল জিনিস, কি পর্য্যন্ত সূক্ষ্ম ও সুকুমার যন্ত্র তা’ নীতিবাগীশ ধরতে পারে না। কোথায় কতটুকু আঘাতে সে যন্ত্র বিকল হয় তা সে বুঝবে কি করে?

 মায়ের মত উদ্দাম পাগলের সঙ্গে সারা জীবন ঘর করা খুব ধৈর্য্যের ও সহিষ্ণুতার কথা, বাবা তা’ চেষ্টা করেও পারেন নি। তবু সে চেষ্টা কম দিন তিনি করেন নি, মার পাগল হতে আরম্ভ হবার পরও তাঁদের চার ছেলে ও এক মেয়ে হয়েছিল। বোধ হয় আমার জন্মের পর বিলাত থেকে ফিরেই দু’জনে পৃথক হন, মা এসে রোহিণীতে বাস করেন। মাকে বাবা মাসে মাসে আর্থিক সাহায্য করতেন, খুব সম্ভব সে সাহায্যের পরিমাণ ও তাঁর আসা যাওয়া ক্রমশঃ কমে এসেছিল, কারণ রেল লাইনের ধারের সেই সাহেবী বাড়ীর মত খানসামা, বাবুর্চ্চি, আয়া ও আড়ম্বর আর তারিণীবাবুর বাড়ীতে ছিল না। একটা চাকর দিত জল আর মা করতেন রান্না। শেষের দিকে টাকা আসতো দাদাবাবু রাজনারায়ণ বসুর হাতে, কারণ আমরা দেখতাম বাঁকে করে করে লোকে মাস কাবারের বাজার দাদাবাবুর বাড়ী থেকে নিয়ে মায়ের কাছে দিয়ে যেত।

 বাবার স্বভাব ছিল বেহিসেবী খরচে, টাকা তাঁর হাতে ভোজবাজীর সৃষ্ট জিনিসের মত দেখতে না দেখতে উড়ে যেত। দয়ার বশে যে নারীর অধিক অসহায় ও দুর্ব্বল, বন্ধুর জন্যে যে এক কথায় সর্ব্বস্ব দিয়ে দিতে পারে, পরিচিত অপরিচিতের যে মানুষ স্বভাবতঃ পরমাশ্রয়, সে মানুষ অমিতব্যয়ী হলে যা হয় এক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। ছেলে তিনটিকে বিলাতে শিক্ষার জন্যে রেখে এসে বাবা কিছু দিন নিয়মিত টাকা পাঠালেন, তার পর সেদিকেও বিশৃঙ্খলা এল। এই রকম মানুষ দুনিয়ায় অনেক আছে যারা দুঃস্থের জন্যে দানসত্র খুলে বসে আছে, আর তার নিজের পরমাত্মীয় উপবাসে মরছে!

 তিন দাদা প্রথমে পাঁচ বছর ম্যাঞ্চেস্টারের গ্রামার স্কুলে পড়লেন,তারপর দু’ এক বছর ড্রুইডের মায়ের কাছে লগুনে এসে রইলেন। কোন অভিভাবকের অধীনে থাকা এই তাঁদের শেষ। তিন জনে সেণ্ট পলস্ স্কুলে পড়ছিলেন, সেখান থেকে ৪০ পাউণ্ড স্কলার্শিপ পেয়ে অরবিন্দ গেলেন (খুব সম্ভবতঃ) কিংস কলেজ কেম্ব্রিজে ও মেজদা’ মনোমোহন গেলেন ক্রাইষ্ট চার্চ্চ কলেজ অক্সফোর্ডে। বাবা এ সময়ে টাকা পাঠাতেন এখন তখন, ড্রুইডও তাঁর কাছে অনেক টাকা পেত, পরে সে অষ্ট্রেলিয়া যাবার পথে ভারতে এসে বাবার কাছে নিজের প্রাপ্য টাকা নিয়ে গেল।

 বিলাতের জীবনে শেষ পাঁচ বছর দাদাদের বড়ই অর্থাভাব গেছে। বছরে ৩৬০ পাউণ্ড পাঠাবার কথা, এক বছর বাবা পাঠালেন মাত্র এক শ’ পাউণ্ড। বড়দা’র দর্জি ইত্যাদির দোকানে যে ঋণ হল তা তিনি পরে ভারতে এসে পরিশোধ করেছিলেন। শ্রীঅরবিন্দের মুখে শুনেছি অনেক দিন তিনি একটা কি দু’টো স্যাণ্ড উইচ্ খেয়েই কাটিয়েছেন। সেখানে প্রবাসী ভারতীয় ছাত্রদের আলোচনা-সভা ছিল, তার নাম ছিল ‘মজলিস’। সেই সভায় গরম গরম রাজনৈতিক বক্তৃতা দেওয়ায় শ্রীঅরবিন্দ সেই বয়সেই গভর্নমেণ্টের সুনজরে পড়েন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ছিলেন সেখানে শ্রীঅরবিন্দের সমসাময়িক। I. C. S পরীক্ষায় বেশ সম্মানের সঙ্গে পাশ করেও তুচ্ছ ঘোড়ায় চড়ায় যে তাঁকে অকৃতকার্য্য বিবেচনা করা হ’লো তার কারণ খুবই সম্ভব গভর্ণমেণ্টের ঐ সুনজর, সেই সময়ে এই নিয়ে ভারতে সংবাদপত্রে খুব আন্দোলন হয়েছিল।

 তিন ভাইএর মধ্যে শ্রীঅরবিন্দই প্রথম দেশে আসেন। ভারতে জনপ্রিয় সার হেনরী কটন ছিলেন দাদারাবু রাজনারায়ণ বসুর বিশেষ বন্ধু। বড়দা’ তাঁর ছেলে জেমস্ কটনের কাছে শ্রীঅরবিন্দকে নিয়ে যান; জেমস্ কটন তাঁকে গায়কবাড়ের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেওয়ায় গায়কবাড় তাঁকে প্রাইভেট সেক্রেটারী করে দেশে নিয়ে আসেন। তার পরে দেশে আসেন বড়দা’ ১৮৯৩ সালের এপ্রিল মাসে। কুচবেহার মহারাজ-কুমারের শিক্ষক হবার পর আজমিরে গিয়ে ১৫০০ টাকা ঋণ করে বড়দা’ যখন বিলাতে টাকা পাঠালেন তখন মেজদা’ মনোমোহন দেশে আসতে পারলেন। এইখানে পড়লো তাঁদের বিলাতের শিক্ষা জীবনের যবনিকা।

 I. C. S পরীক্ষায় অরবিন্দ অকৃতকার্য্য হবার পর বাবা নিরাশ হয়ে পড়েন, তাঁর বড় সাধ ছিল অরবিন্দ I. C. S হয়ে এসে তাঁর মুখোজ্জ্বল করবেন। আজ বাবা বেঁচে থাকলে তাঁর দেশ-বিশ্রুত সন্তানের পৃথিবীব্যাপী যশ কি ভাবে নিতেন জানি নে। সন্তানের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে মা বাপের সাধ আকাঙ্ক্ষার মূল্য এইটুকু, খুব কম পিতা মাতাই সন্তানকে তার নিজের পথে বিকাশ লাভ করতে দেয়, সংস্কার-বদ্ধ স্নেহ-অন্ধ তাদের মন ও প্রকৃতি অবোধ অবুঝ সন্তানকে গরু-তাড়ানো করে তাড়িয়ে নিয়ে চলে নিজের বাসনার সাধ আকাঙ্ক্ষার পথে। মায়ের ও বাপের ভালবাসা স্থূল দৃষ্টিতে দেখতে বেশ নিঃস্বার্থ ও উচ্চস্তরের বলে দেখায় বটে কিন্তু আসলে সে প্রেমও যথেষ্ট স্বার্থদুষ্ট। সাধারণ সংসারী মা বাপ চায় সন্তানকে দিয়ে অর্থ পেতে, সাংসারিক সুখ সুবিধা করে নিতে, যশ মান সম্ভ্রম কুলগৌরব বাড়াতে। কথায় কথায় তাদের ঐ এক অজুহাত, “আমরা যে এত কষ্টে ওকে মানুষ কল্লাম! সন্তানের প্রকৃত কল্যাণ—তার প্রকৃতিরই যথার্থ বিকাশ ও উন্মেষ খুব কম মা বাপই বোঝে বা তার সহায়তা করে। মা বাপের স্নেহ স্বার্থে পঙ্কিল, সংসারের লাভ লোকসান খতানো ভালবাসা, নইলে নিজের নাড়ীছেঁড়া ধনকে মানুষ এত সহজে ত্যাজ্যপুত্র ভ্যাজ্যকন্যা করে যত সহজে রাগী বাপ মা সংসারে সচরাচর করে থাকে?

 মানুষকে কতখানি শাসন করতে হবে, কতখানি মুক্তি ও কতখানি বন্ধন তার বিকাশের অনুকূল, কোন্‌খানে শাসন মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়ে তাড়নায় পরিণত হ’লো, মানুষকে ফোটাবার বদলে চেপে পঙ্গু করতে লাগল তা’ এখনও মানুষ ঠিক করে উঠতে পারে নি। এই সেদিন অবধি স্কুল পাঠশালা ছিল শিশুর কাছে ঠিক তেমনি ভয়াবহ প্রহার-তাড়না-কণ্টকিত কারাগার, যেমন ছিল তার কৈশোর ও যৌবনের সমাজ, তার প্রৌঢ়ত্বের রাষ্ট্র।

 মা বাপের তাড়না, গুরুমশাইয়ের বেত, বামুন পুরুতের অভিশাপ, সমাজপতির ভ্রুকুটি, দেবতার নরকাগ্নি, রাজার পুলিশ, এবং অবশেষে করাল যমরাজের দূত—ভয়তাড়িত সঙ্কুচিত আড়ষ্ট কি সে জীবন মানুষের বল দেখি? আর তারপরেও এতখানি পীড়ন শাসন তর্জ্জন গর্জ্জন প্রহার অপমান ও প্রাণবধ করেও কি এমন আদর্শ সমাজ বা রাষ্ট্র আমরা গড়েছি যার জন্যে মানর জাতি গর্ব্বে আজ মাথা উঁচু করে জগতের সামনে দাঁড়াতে পারে? মানুষ তার মানবতার গুটি (Crysalis) কেটে দেবত্বের ব্যাপক আকাশে ওড়বার কয়টি বর্ণ-সুরঞ্জিত চিত্রবিচিত্র ডানা আজ অবধি গজাতে পেরেছে?

 যাক সে কথা। কোন গতিকে দাদাদের পূর্ব্বজীবন সংক্ষেপে সেরে নিয়ে আবার আরম্ভ করি আমার শৈশব-কথা। লালা তারিণীচরণের বাড়ীতে আমার প্রায় আট বছর বয়স হবার পর আমাদের পালে বাঘ পড়লো। কোথা থেকে কি হল জানি নে; একদিন কারা যেন এসে দিদিকে নিয়ে চলে গেল আমাকে এই পাগল মাতৃস্নেহের কারাগারে একলা ফেলে। দিদিমাদের বাড়ী গিয়ে শুনলাম বাবা তার মেয়েকে নিজের কাছে রাখবার জন্যে চেয়ে পাঠিয়েছেন, পাগল মা ৪০০৲ টাকা নিয়ে দিদিকে ছেড়ে দিয়েছে। আগেই বলেছি দিদিকে মা দেখতে পারতেন না, একগুঁয়ে শক্ত মেয়ে দিদি সে বয়সে খুব কম লোকেরই মন বা হৃদয় আকর্ষণ করতে পারতেন। দিদির মত এসব শক্তির আধার দৃঢ় প্রকৃতি নমনীয় ও কোমলকেই শুধু স্নেহে ভালবাসায় আঁকড়ে ধরতে পারে, নিজের মত সমান শক্তিমানের সঙ্গে লেগে যায় তাদের সংঘর্ষ, ঠোকাঠুকি। এ জগতে আশ্রয়দাতাও এসেছে আর আশ্রিতের দলও এসেছে; প্রেমের জগতে একদল ক্ষত্রিয় ও অপর দল শূদ্র। একদলেরা ভালবেসে করে প্রভুত্ব, দেয় কোল, আর একদল আনন্দ পায় পূজা করে, আপনাকে বিলিয়ে দিয়ে—সেবায় প্রেমার্চ্চনায়। এ ছাড়া আবার এই দুই প্রকৃতির অসম মিশ্রণে এমন সব কিম্ভূত কিমাকার মানুষ এসেছে যারা না নেতা আর না নীত। শক্তি নেই অথচ প্রভুত্বের অহঙ্কার ও দুশ্চেষ্টা আছে, সেবার ও আত্মোৎসর্গের সামর্থ্য নেই অথচ নিজকে দেবার তীব্র আকুলি ব্যাকুলি আছে—এই চিত্রই সংসারে বেশী দেখতে পাওয়া যায়।

 দিদিকে যে কে কোথায় নিয়ে গেল যাদুমন্ত্রে উড়িয়ে তা’ ভাল করে বুঝলাম না, শুধু একলা পড়ে রইলাম সেই নির্ব্বান্ধব পুরীতে দুর্দ্দান্ত মাকে আশ্রয় করে। ছোট ছেলে মেয়ের জীবনের মত নিরুপায় অসামর্থ্যের এমন করুণ চিত্র আর আছে কি? ভাগ্যক্রমে প্রকৃতি মানুষের হৃদয়ে বাংলা প্রেমের এত খানি বেগ দিয়েছিল, নইপে জগতের এত কোটি কোটি শিশুর ভাগ্যে কি শোচনীয় পরিণাম যে ঘটতো।

 এর দু’ বছর পরে আবার পালে বাঘ দেখা দিল আমায় ছোঁ মেরে নেবার জন্যে। তখন আমার দশ বছর বয়স, জীর্ণ শীর্ণ চেহারা, অক্ষর পরিচয় অবধি হয় নি। বাহিরের জগতের সম্বন্ধে একেবারে অজ্ঞ আমাকে হঠাৎ মুখে করে কোন্ এক গড়ুর পক্ষী তুলে এনে ফেলে দিল আলাদিনের যাদুর মায়াপুরীতে। শুনেছি রিপ ভ্যান্‌ উইঙ্কল নাকি একটানা বিশ বছর ঘুমিয়েছিল, সেই কাল ঘুম থেকে জেগে সে দেখে তার চোখের সামনে এক অদ্ভুত অচেনা জগৎ। সব বদলে গেছে, তার জাগ্রত কালের সে সব মানুষ, সে রাজা প্রজা, সে নগর পল্লী কিছুই আর স্বস্থানে স্বমূর্ত্তিতে নেই। রিপ্ ভ্যান উইঙ্কলের বিস্ময় আমার সেই হঠাৎ দেখা অচিন্ত্যপূর্ব্ব অদৃষ্টপূর্ব্ব জগতের দর্শন জনিত বিশ্বয়ের চেয়ে অনেক কম। কোথায় বন-গাঁ রোহিণী, তার বুকে মায়ের কড়া শাসনের পাগলা গারদ, তারিণী বাবুর বাড়ীর কম্পাউণ্ড আর কোথায় আলো মানুষ যান বাহন রাস্তা ঘাট প্রাসাদ হর্ম্মের মহা অরণ্য কলকেতা! কিন্তু তার আগে বলি আমাকে রুক্মিণী-হরণ করে নিয়ে যাবার কথাটা।

 কিন্তু আমায় রুক্মিণী-হরণ করে নিয়ে যাবার কথা বলবার আগে শৈশবের আরও যে অনেক কিছু এখনও বলা হয় নি। বাল্যকালের সেই পাগলী মায়ের কড়া শাসনে রোহিণীর জীবন সে এক অপূর্ব্ব অভূতপূর্ব্ব কাণ্ড। আমার জীবনে যা কিছু ঘটেছে তা’ প্রায়ই এমনই অভিনব, যে, আর কারু কখনও সে রকমটি হয়নি। রোহিণীর বাড়ীখানি বাংলো প্যাটার্ণের, পূব ও পশ্চিম বারাণ্ডা, দুইখানি বড় পাশাপাশি হল ঘর, পূবের বারাণ্ডার খানিকটা ঘুরে দক্ষিণেও গেছে। উত্তরে একখানা পূব পশ্চিমে লম্বা ফালি ঘর, তিন ভাগে ভাগ করা, তার পূর্ব্ব ও উত্তর কোণে বাথ রুম ও ল্যাভেটরী। দক্ষিণের বারাণ্ডাটুকুর কোণেও একটা বাথ রুম ও আর একটা ছোট ঘর। বাড়ীখানি প্রকাণ্ড কম্পাউণ্ডের মধ্যে, তার পূব দিকে কলমের আমের বাগান, উত্তরে সবজীবাগান ও কূয়া, দক্ষিণে ফুল বাগান, পশ্চিমে নানান গাছের সঙ্গে একটি পিচ গাছ। মায়ের কড়া পাহারায় আমরা বাড়ী থেকে পঞ্চদশ হাতের পরিধির বাইরে যেতে পারতাম না। মা আমাদের বাইরে পূবের বারাণ্ডায় বার করে দিয়ে ঘরে দুয়ার দিয়ে আপন মনে বিড় বিড় করতেন আর আমরা দুই ভাই বোনে ভয়ে আশঙ্কায় ও বাল্যের সহজ স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দে খেলা করতাম। মা মাঝে মাঝে ভিতর থেকে হাঁকতেন “এই সরি” “এই রেরে” “আছিস তো?” আমরা “হাঁ মা” বলে সাড়া দিয়ে কিছুক্ষণ উৎকর্ণ আড়ষ্ট হয়ে থাকতাম। মা বেরুলেন না দেখে আবার চাপা গলায় আমাদের আবোল তাবোল কলরব আরম্ভ করতাম।

 সেই সময়ে চারিদিকের জগৎটা কত যে লোভনীয় জিনিসে ভরপুর ছিল তার ইয়ত্তা নেই। এখনও মনে পড়ে উত্তরের সবজী বাগানে একটা শিউলী ফুলের গাছ ভোরের শিশিরে ভিজে কূশমী রঙের বোঁটাওয়ালা সাদা সাদা ফুলের রাশি বিছিয়ে আমাদের কাছে তার সৌরভের প্রাণ পাগল করা আমন্ত্রণ লিপি পাঠাতো আর আমরা সেখানে যাবার জন্যে ছটফট করে মরতুম। পূব কোণে একটা পাতায় পাতায় কালো বিরাট জাম গাছ ছিল, তার থলো থলো গাছভরা কালো জাম আমাদের শিশু মনকে একেবারে পাগল করে তুলতো আর ঐ পূব-দক্ষিণ কোণের খেজুর গাছের গলায় রাঙা ফলের থলোর টান, পশ্চিমের পিচ গাছের পিচ ফলের লোভ, কলমের আম গাছে লম্বা লম্বা বড় বড় আমগুলি— উঃ! সে স্মৃতি কি ভোলবার? মালী মাঝে মাঝে ফলের উপঢৌকন নিয়ে মেম সাহেবকে তুষ্ট করতে এবং কিছু বক্‌সিস্ আদায় করতে আসতো, সে দিন আমাদের পড়ে যেত এক মহোচ্ছবের পালা।

 বাইরের জগতের কিছুই আমি জানতাম না দশ বছর অবধি। অথচ বাইরের জগৎ তার রহস্যে নিবিড় আঙুল বাড়িয়ে দিয়ে অহরহই ডাকতো এই সহজে কুতূহলী শিশু হৃদয় দু’টিকে। আমারই মা না হয় পাগল ছিলেন, কিন্তু এই সংসারের কত ঘরের কত মা কতই যে স্নেহের অত্যাচারে আগলে ঘিরে কত শত বুভুক্ষু শিশু হৃদয়কে প্রকৃতির কোল থেকে মাঠে মাঠে ধানের আলে ছুটাছুটি ও বন ভোজনের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করে রাখে! সে ব্যাকুল মন প্রাণগুলির তাতে কোন উপকারই হয় না, কারণ অবাধ প্রকৃতির কোলের মত একাধারে এত বড় স্কুল ও ক্রীড়াক্ষেত্র শিশু মনের জন্যে আর কি আছে? সেখানে প্রকৃতি-রাণী তার উদ্ভিদ জগতের মাটির জগতের ও জলের বুকে কত না পাতা মুড়ে খুলে আধ মোড়া করে রেখে দিয়েছে; সেখানে আকাশ সিন্ধু বিস্তৃত হয়ে রয়েছে তাদের নীল গভীরতা নিয়ে। মাঠে, বনে, পাথরের ফাটলে, পাতার ঢাকনীর আড়ালে তাদের টল্‌টলে কালো রাঙা প্রবালের ছাই রঙের কত না রকম চোখ নিয়ে ঘুরছে সতর্ক টিকটিকী, বহুরূপী নৃত্যশীল খঞ্জন, বুলবলী, ভীরু কাঠবেড়ালী, শশক, চঞ্চল ফিঙে, তির্য্যকগতি ডোরাকাটা বর্ণবিচিত্র ভুজঙ্গ, কদাকার গঙ্গাফড়িং, অলস শামুক, গুগলী, কুব্জপৃষ্ঠ কচ্ছপ, কত না অনুপম অভিনব জীব পরিবার! এই বিরাট অযত্ন-বিস্তীর্ণ সহজলভ্য জ্ঞানভাণ্ডারের দুয়ার রুদ্ধ করে বৃথা জ্ঞান-গর্ব্বে স্ফীত মুর্খ বাপ মা স্বভাবতঃ কুতূহলী শিশু মনগুলিকে আড়ষ্ট করে রাখে নিরস কঠোর খেলনায় ও বইয়ের পাতায় বেঁধে। তারা বোঝে মাতৃবৎসল পিতৃবৎসল সন্তান, বাপ মায়ের দাস, শৈশব থেকে উচিৎ অনুচিতের জুজুর ভয়ে জবুথবু ভয়ার্ত্ত শিরদাঁড়া-ভাঙা ভালছেলে।

 পাগল হয়েও আমাদের মা এড়াতে পারেন নি, অধিকন্তু তাঁর পাগলামীর খেয়ালে ও রাগে আমাদের চোখে মা আমাদের হয়ে ছিলেন ভয়ানাম্ ভয়ং ভীষণং ভীষণানাম্। একদিকে মায়ের নির্ম্মম মারের ভয় আর একদিকে খোলা মাঠের বাগানের ঝোপঝাড়ের ঝুপসীর কাশবনে ঢাকা সাদা খেজুর তলার টান। শেষে প্রকৃতিরই হতো জয়। আমি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মাকে শুনিয়ে এক কল্পিত দিদির সঙ্গে করতাম গল্পগুজব আর দিদি রুদ্ধশ্বাসে একছুটে চলে যেত খেজুর তলায় বা কলমের আম বাগানে বা পিচগাছের নীচে পাকা পাকা পিচফলের সন্ধানে। আবার দিদি এসে দিত গল্প জুড়ে এক কল্পিত সাজানো আমার সঙ্গে আর আমি দিতাম ভোঁ দৌড়।

 মাঝে মাঝে মা আমাদের পাল্কী করে নিয়ে যেতেন দেওঘরে দিদিমার বাড়ী। সেখানে বেহারাদের এহুম্ ওহুম্ রবে আকাশ পথ মুখরিত করে আমরা গিয়ে নামতুম একঝাঁক মামা মাসী মাসতুতো ভাই ও বোনের পালে, কত পিঠে চন্দ্রপুলী সন্দেশ ও লুচির রাজ্যে। রাজনারায়ণ বসুর পুরন্দাহার বাড়ী তৈরী হবার আগে দিদিমারা থাকতেন থানার সামনে রেল লাইনের ধারে একটা বাড়ীতে। তার অন্দরের দরজায় বাইরের দিকে ছিল একটা বাঁধানো রকের মত বসবার পৈঁটে, তারই ওপর ছেলে মেয়ে নাতী নাতনী নিয়ে ভিড় করে দিদিমা এসে আমাদের পাল্কী থেকে নামিয়ে নিতেন। আমাদের কাপড় ছিল পাগলী মায়ের নিজের হাতের কাটছাটের সেলাই করা সে এক অদ্ভুত নিকার বকার ও ফ্রক। ও আমরা ছিলাম অযত্নে পীড়নে অর্দ্ধাহারে লালিত জীর্ণ শীর্ণ কৃশকায় ভীরু ‘দুটি’ ছেলে মেয়ে। দিদিমার হাতে গড়া একখানা পূরো চন্দ্রপুলী পাওয়া আর প্রহার থেকে অব্যাহতি এই মহোচ্ছবের ছিল সব চেয়ে বড় অঙ্গ।

 রোহিণীর বাড়ীর প্রকাণ্ড কম্পাউণ্ডের ধার দিয়ে বাইরের পথ বেয়ে চলে যেত বছরে একদিন দশমীর ভাসানের মিছিল। তারিণী বাবুদের ক’ভাইএর বাড়ী থেকে ও রোহিণীর ঠাকুরদের (জমিদার) রাজবাড়ী থেকে বেরুত সারে সারে প্রতিমা—রাঙতার ও সোণারূপার সাজে ঝলমল করতে করতে মশাল আতসবাজী ধ্বজ পতাকা ও জরির সাজপরা হাতি ও ঘোড়া সমেত। আমরা কম্পাউণ্ডের Cactus বেড়ার ধার ঘেঁসে দাঁড়িয়ে বিস্ফারিত নেত্রে দেখতাম এই অপূর্ব্ব সমারোহ ও জনকোলাহল। পৃথিবীর কোথায় এত মানুষ থাকে, হঠাৎ কোথা হ’তে এসে জড়ো হয়; শিশু মন তার কোন মীমাংসাই, কোন কূলকিনারাই করে উঠতে পারতো না। ঠাকুর ভাসান হয়ে গেলে আসতে বাঁকে করে লালাবাবুদের ওখান থেকে ও রোহিণীর ঠাকুরবাড়ী থেকে ভারে ভারে মেঠাই জিলেবী, প্যাঁড়া, বালুসাই, খাজা, হালুয়া, পুরী ইত্যাদি লোভনীয় মিষ্টান্নের রাশি। এক একটা কমলা লেবুর মত বড় বড় মেঠাই দেখে আনন্দের আতিশয্যে আমাদের নিশ্বাস ফেলা দায় হতো।

 এই শৈশবের পাগলা গারদের জীবনে সব চেয়ে ভয়াবহ সময় ছিল যখন মা ক্ষেপতেন। পাগলের আসতো রাগের ঝড় আর আনন্দের ঝড় পালাপালি করে, আনন্দে আপন মনে খল খল করে হাসতেন আর অনর্গল বকে যেতেন, রাগে পিঁজরায় বদ্ধ বাঘিনীর মত ঘরে করতেন পায়চারী আর যেন কাদের উদ্দেশে তর্জ্জন গর্জ্জন। বাবা ও দাদাবাবুকে লক্ষ্য করে বলতেন, “শ্বশুর জামাইকে এক ফাঁসী কাঠে লটকাও।” রাগের মাত্রা বাড়লে আমাকে ও দিদিকে মারতেন নির্দ্দয় হয়ে, কিল ঘুসি, খিমচি, কাণমলা, চুলটানা, চ্যালা কাঠের বাড়ি যখন যা’ খুসী। দিদিকে মারতেন সবচেয়ে বেশী, কারণ ওরই মধ্যে কোলের ছেলে আমাকে একটু ভালবাসতেন দিদির চেয়ে বেশী। এখনও নির্দ্দয় দৃশ্য আমার মনে গাঁথা আছে, দিদি উপুড় হয়ে পড়ে আছেন আর মা তাঁর পিঠের উপর বসে গুম্ গুম্ করে কিলোচ্ছেন আপ্রাণ বেগে।

 আমার মা ছিলেন পাগল, পাগলামীর ঝোঁকে করতেন মারধর; কিন্তু অনেক মা বাপকে রাগের বশে দেখেছি ছোট ছোট কচি ছেলে মেয়েকে প্রায় এমনি নির্দ্দয় হয়েই ঠেঙাতে। রাগ কাম ও দর্পের বশে আমরা কত বারই যে পাগল হচ্ছি Temporary insanityর ছোঁয়াচ লেগে। কখন কখনও মার সহ্য করতে না পেরে দিদি ছুট দিতেন বাড়ীর কম্পাউণ্ড পেরিয়ে মাঠের পথে দিদিমাদের বাড়ীর দিকে। একটা পাগল বামুন মাঝে মাঝে আসতো ভিক্ষা করতে, তাকে মা দিতেন দিদিকে ধরে আনতে লেলিয়ে। দাড়োয়া নদীর বাঁক থেকে, মাঠের মধ্যে থেকে—এমনিতর আধ পথের কত না জায়গা থেকে পাগলটা আনতো দিদির চুলের মুঠি ধরে। তার পর চলতো আরও দুর্জ্জয় প্রহার। ছেলে পুলে পশুর জাত, তেমনি লোভী ও স্বার্থপর, তেমনি হিংসুটে ও সরল,— মায়ের মন পাবার জন্যে আমি কত রকমে লাগিয়ে ভাঙিয়ে দিদিকে আরও বেশি বেশি করে মার খাওয়াতাম যাতে আমার ভাগের মারটা কিছু কম পড়ে।

 অসহ্য ভয়ের ও দুঃখের শোণিত-রেখায় আঁকা শৈশবের এই রোহিণীর জীবন,—কালো জমাট দুঃখের মেঘের ফাঁকে ফাঁকে জরির পাড়ের মত বাল্যের স্বাভাবিক অনাবিল আনন্দের রশ্মি। এ রকম জীবনে মায়ের স্নেহ-কোল—সে অনুপম প্রেমবিধুর মাতৃছবি বুঝবার অবসর কোথায়? আসলে আমাদের মা থেকেও ছিল না। গল্পের রাক্ষসী বা জটে বুড়ীকে শিশু-মন যেমন ভয় করতে শেষে আমার কাছে মা ছিল তেমনি আতঙ্কের বস্তু। তবু এরই মাঝে পাগলী মা যে কতখানি ভাল আমায় বাসতেন তা’ পরের জীবনে বুঝেছি। বাবা তখন খুলনার সিভিল সার্জ্জন। দুঃস্থের ও দরিদ্র রোগীর সেবা, দু’হাতে দান খয়রাত আর মদ তাঁর ছিল নিত্য সঙ্গী; অর্থোপার্জ্জন করতেন বিস্তর এবং তা’ দু’হাতে ওড়াতেন পরের জন্য। প্রার্থী কখনও কিছু চেয়ে তাঁর কাছ থেকে নিরাশ হয়ে ফেরে নি, অত বড় হ্যাট কোট পরা মদ্যপ ডাক্তার সাহেব রাত বারোটায় এক হাঁটু জল কাদা ভেঙে গরীব চাষী রোগীকে দেখতে গেছেন বিনা পয়সায়। এত চরিত্রদোষ থাকতেও এই চিনির মত মিষ্টি মানুষটির শত্রু বলে ভূভারতে কেউ ছিল না। নিজের দুঃখের জীবন নিয়ে তিনি ছিনিমিনি খেলতেন বটে কিন্তু পরের জীবনের জন্য তাঁর ছিল মায়ের অধিক দরদ ও সমবেদনা। দোষে গুণে সুন্দর ও নিতান্তই human চরিত্রগুলির মাধুর্য্য দেখতে না পেয়ে মানুষ করে মরালিটির ভড়ং—একেই বলে prudery!

 সেই বাবা উদাসীন হয়ে আমাদের পাগল মায়ের কাছে ফেলে রেখে ছিলেন। রোহিণীর বাড়ীতে শুধু একবার মাত্র বাবা এসেছিলেন বলে আমার মনে আছে। একদিন আমি ও দিদি বাইরে খেলা করছি, কে জন হোমরা চোমরা গোছের মানুষ এলো। ভিতরে যখন আমাদের ডাক পড়লো তখন আমার এইটুকু মনে আছে, যে, লম্বা দাড়ীওয়ালা ভীষণদর্শন কার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যে আমি আর দিদি সারা ঘরটার দেয়ালের ধারে ধারে ছুটোছুটি করছি আর সেই মানুষটি দুই হাত বাড়িয়ে আমাদের বুকে নেবার জন্যে পাগলের মত আসছে। তারপর অজস্র খেলনা বিস্কুটের রমণীয় স্তুপের মাঝে কখন যেন আমাদের আত্মসমর্পণের পালা সুখের সিন্ধুর দোল খেয়ে সাঙ্গ হয়ে গেল, সে কথা আর স্পষ্ট মনে নেই। বাবার কোলে চড়ে বসেছিলুম, আর তাঁর লম্বা দাড়ী আমার গায়ে পড়ছিল এই রকম একটা ক্ষীণ স্মৃতি—অনেক কিছু আধভোলা সামগ্রীর স্তূপে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়। আহা! সে বাবা এখন তার শ্রান্ত উচ্ছৃঙ্খল ছেলেকে ভুলে কোথায় যে গেল!

 মাঝে মাঝে মেওয়াবেচা কাবলীওয়ালার আবির্ভাব হ’তো আর আমরা কিসমিস বাদাম আক্রোট খোবানী আনার পেস্তা খেতে পেতাম, এও সেই দুঃখের শৈশবকে সুখস্মৃতিতে কম উজ্জ্বল করে রাখে নি। কাবলীওয়ালারা বোধ হয় ছেলে পুলে ভালবাসে, সুদূর পাহাড়ের তুষার ঢাকা কোলে, নিজেদের ছেলেপুলে ফেলে এসে ওদের ক্ষুধিত প্রাণ শিশুর হরিণ চোখের ফাঁদে সহজেই ধরা পড়ে যায়, নইলে মায়ের কাছে মেওয়া বেচে বাইরে এসে আমাদের মুঠি মুঠি মেওয়া বিনা পয়সায় দিয়ে যাওয়ার অর্থ কি? আমার দাদার মেয়ে বুলারাণীর কাছেও শুনেছি ছেলেবেলায় অচেনা কাবলীওয়ালা রাস্তায় তার হাতে দশটাকার নোট গুঁজে দিয়ে চলে গেছে। ওদের মধ্যে কিন্তু বন্য পশুর ভাবও খুবই প্রবল। অশুদ্ধ শক্তিমান রাজস আধারে যা হয় আর কি। ও জাতি কখনও সভ্য ছিল কিনা জানি নে, প্রায় প্রাগৈতিহাসিক যুগে গ্রীস রোমেরও আগে হয়তো আর্য্য সভ্যতা ও শিক্ষাদীক্ষা ওখানে ছিল। ভারপর এতদিন অসংস্কৃত অশিক্ষিত অবস্থায় থেকে একটা কালচারে অনুশীলন (Background) হারিয়ে জাতটা বুনো মেরে গেছে। আন্দামানে আমাদের ৮০।৯০ জন রাজনীতিক বন্দীকে কঠোর শাসনে রাখবার জন্যে একমাত্র পাঠানই নিয়োগ করা হতো,— পেশোয়ারী ও কাবুলী পাঠান। কারণ ওরা নিষ্ঠুর ও ক্রূর প্রকৃতির, পয়সার লোভে না পারে এমন কুকর্ম্ম নেই। কামের দিক দিয়ে ওরা সচরাচর কামরাক্ষস বিশেষ, স্ত্রীর চেয়ে সুকুমার বালক ওরা কামচর্চ্চার জন্যে ভাল মনে করে। এ ব্যাধি পারস্যে, তুরস্কে— সব মুসলমানপ্রধান স্থানে একসময় ছিল, বর্ম্মায় আজও খুব প্রবল। অল্প বিস্তর এ কৃত্রিম কামব্যাধি সর্ব্বজাতির মধ্যে থাকলেও রাজসিক বন্য অসভ্য জাতির মধ্যেই বেশি। আরবে তুরস্কে পারস্যে আফগানিস্থানে এতদিন নতুন যুগের হাওয়া বয় নি, ওরা এতদিন ধরে চলছিল কোন্ এক অনৈতিহাসিক যুগকে আঁকড়ে। এ সব হচ্ছে জাতির আবদ্ধ জীবন-নদীর গতিহীনতার শৈবালদাম, তারই পঙ্ক, তারই আবর্জ্জনা।