আমার আত্মকথা/তের

উইকিসংকলন থেকে

তের

 দেওঘর স্কুল থেকে আমি প্রবেশিকা পরীক্ষা দিই ভাগলপুরে গিয়ে। এর মাঝে একবার মাত্র কলকেতায় এসেছিলুম, সেটা বোধ হয় তৃতীয় শ্রেণীতে কি চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময়ে। লরেন্স এণ্ড মেওর বাড়ী গিয়ে তাদেরই একজন সাহেব ডাক্তারকে দিয়ে চক্ষু পরীক্ষা করিয়ে দু’জোড়া চশমার অর্ডার দিয়ে আমি দেওঘর ফিরে এলুম; কারণ খুলনার সেই টাইফয়েড জ্বর ভোগের পর থেকে আস্তে আস্তে চোখ আমার খারাপ হয়েই চলেছিল, ক্লাসের পড়ায় দূরের বোর্ডে লেখা কিছুই স্পষ্ট দেখতে পেতুম না। ডাক্তার চশমা দিল ৭.৫ নম্বরের একটা, আর কিছু কম নম্বরের আর একটা। যে দিন প্রথম চশমা এলো, চশমা পরে ছেলেদের মধ্যে প্রথম বসার সুখ আমার এখনও মনে আছে, আমি যেন হঠাৎ বি-এ কি এম-এ পাশ করে একটা কেওকেটা হয়ে পড়েছি—সবার চোখই আমার দিকে, ছাত্রসমাজে আমার দাম ও ওজন যেন জ্বরের পারার মত হঠাৎ ১০৪° ডিগ্রি উঠে গেছে। নিজের দিকে অপর দশজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার লোভ মানুষের বুড়া বয়স অবধি থেকে যায়; এই লোভের বশেই তার অর্থ চাই, যশ চাই, প্রতিষ্ঠা চাই, কুলগৌরব চাই, এমন একটা বিশেষ বা অসাধারণ কিছু চাই যা’ আর দশ জনের নেই এবং নেই বলেই তাদের ঈর্ষা ও ঔৎসুক্য জাগায়। মানুষ সারা জীবনই নট, ফুটলাইটের সামনে লুব্ধ জনতার চোখের ওপর সারা জীবনই সে অভিনয় করে চলেছে,—নয় ট্রাজেডি, নয় কমেডি আর নয় প্রহসন।

 পরীক্ষার জন্য ভাগলপুরে যাওয়াই আমার এক রকম প্রথম একা বিদেশে যাওয়া বলতে হবে। বাবার মৃত্যুর পর এই আমার প্রথম কাকার বাড়ী গিয়ে ওঠা, তখন কাকা বেঁচে নেই, ভাগলপুরের বাড়ীতে কাকীমা আছেন আর একজন অবিবাহিতা খুড়তুত বোন্ আছেন। আমার মধ্যে কি একটা আকর্ষণী শক্তি ছিল, প্রথম দেখায়ই অনেককে টানতুম। পরীক্ষা দিতে গিয়ে ছুটির সময় একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছি, একটি ছেলে এসে গায়ে পড়ে আলাপ করলো। পরীক্ষার সেই কয়েকদিনে সে আমার একান্ত অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে পড়লো, ছায়ার মত আমার পিছু পিছু ঘুরতো। পরীক্ষাও হয়ে গেল আর তারও হঠাৎ কি যেন ব্যারাম হয়ে মৃত্যু ঘটলো। যে দিন রাত্রে মরণ তার শিয়রে, ঠিক সেই রাত্রে সেই সময়টিতে কাকার বাড়ীর দরজার কড়া নেড়ে নেড়ে তারই গলায় কে আমায় ডাকছিল। আমার খুড়তুত বোন্ নির্ম্মলাদি’ গিয়ে দরজা খুলে দেখলো কেউ কোথাও নেই, তার কয়েক মিনিট পরেই খবর এলো সে আমার নাম করতে করতে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য নিতান্তই অস্থির অবস্থায় মারা গেছে।

 পরীক্ষার ফল বের হলে দেখা গেল আমি দ্বিতীয় ডিভিশনে পাশ করেছি। তখন এফ্ এ বা ফার্ষ্ট আর্টস্ পড়তে গেলুম পাটনায়, সেখানে বিধান বোর্ডিংএ বাসা নিয়ে পাটনা কলেজে গিয়ে ভর্ত্তি হলুম। এর ঠিক আগেই মেজদা মনোমোহন ঘোষ সেখানকার ইংরাজীর প্রফেসর ছিলেন, সবে বদলী হয়ে তখন ঢাকা কলেজে গিয়েছেন। প্রসিদ্ধ এম ঘোষের ভাই বলে ছাত্রমহলে আমার আসায় খুব একটা চাপা চাঞ্চল্যের ঝড় বয়ে চলেছে বলে বুঝতে পারলুম কিন্তু ভাব আমার বড় একটা কারু সঙ্গেই হ’লো না। একা কলেজে যেতুম, একা ফিরে আসতুম্। বোর্ডিংএ গণেশ বাবু ছিলেন আচার্য্য ও অধ্যক্ষ, প্রতি সন্ধ্যায় ও সকালে সেখানে ছেলেদের নিয়ে হ’ত উপাসনা। আমি তখন কবিতা লিখতুম ও গম্ভীর বিষয় সব নিয়ে সাহিত্যিকদের মত আলোচনা করতুম। উপাসনার নিয়ম ছিল এক এক দিন এক একজন ছেলে আচার্য্যের গদীতে বসে প্রার্থনা করবে। গণেশ বাবু আমাকে প্রার্থনা করবার জন্যে অনুরোধ উপরোধ আরম্ভ করলেন এবং আমার অনিচ্ছা দেখে একদিন উপাসনান্তে হঠাৎ সবার সামনে উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করে দিলেন—“এইবার বারীন্দ্র কুমার প্রার্থনা করবেন”। আমি কবিত্বময় রাবীন্দ্রিক ভাষায় গদগদ কণ্ঠে এক বক্তৃতা পরম পিতার নিরাকার কর্ণের উদ্দ্যেশ্য ছেড়ে দিয়ে ছেলেদের মধ্যে এক পরম বিস্ময়ের বস্তু হয়ে উঠলুম। প্রার্থনা কিন্তু সে দিনের পর আর আমি করলুম না, এ রকম প্রার্থনা করার সমীচীনতা নিয়ে গণেশ বাবুর সঙ্গে আমার খুব এক চোট তর্ক হয়ে গেল। ভগবান যদি সর্ব্বজ্ঞই হন তা হলে তিনি পিঁপড়াটিরও মনের কথা টের পান। বক্তৃতা দিয়ে জগতের পরম শিল্পীকে কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য সম্বন্ধে উপদেশ দেবার বা অনুরোধ জানাবার কোন আবশ্যকতা থাকে না। আর ভগবৎ সাক্ষাৎকার যে করে নি তার পক্ষে ভগবানের সম্বন্ধে পঞ্চমুখ হয়ে বলা কতখানি হাস্যকর ব্যাপার। এই সব নিয়ে নিরীহ গণেশ বাবুকে আমি কিছুক্ষণ অতিষ্ঠ করে তোলায় তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাঁচলেন যে আর আমায় প্রার্থনা করতে অনুরোধ করা হবে না। সুতরাং সেই থেকে নিরাকার পরব্রহ্মও রক্ষা পেলেন, আমিও বাঁচলুম।

 পাটনা কলেজে তখন প্রথম বার্ষিক শ্রেণীতে আমার সঙ্গে একটি ছেলে পড়তো, তার নাম ছিল বঙ্কিম। তাকে আমার খুবই ভালো লাগতো, তবু তার সঙ্গে প্রাণ খুলে মিশতে আমি পারি নি। ক্লাসের ছেলেরা আমার অমিশুক ভাব দেখে আমাকে অহঙ্কারী ঠাউরে নিয়েছিল, পরস্পরের মধ্যে নাকি জল্পনা আলোচনায় ঠিক হয়েছিল, ষে, আমার গলায় ছেঁড়া জুতোর মালা পরিয়ে দেওয়া হবে। কাজে কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। একদিন কলেজ থেকে বিধান বোর্ডিংএ ফিরছি, একদল ছেলে আমার কাছাকাছি এসে অন্যদিকে চেয়ে বলতে বলতে চললো, “অ নবাব, নবাব, অ খাঞ্জা খাঁ।” আমি নির্ব্বিকার! পরম গম্ভীর ও নির্লিপ্ত ভাবে মা ধরিত্রীর বক্ষে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে চলেছি, আমাকে ঘাঁটায় কার বাপের সাধ্যি।

 পাটনা কলেজে পড়েছিলুম বোধ হয় ছয় মাস। তারপর গ্রীষ্মের ছুটিতে দেওঘরে দিদিমার কাছে এসে যখন আছি তখন সস্ত্রীক মেজদা ঢাকা থেকে প্রথম দেওঘরে এলেন। আগেই বলেছি দাদা বাবু (আমার মাতামহ) রাজনারায়ণ বাবু অসবর্ণ বিয়ের বিরোধী ছিলেন বলে মেজদার মুখ দেখবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তাই তিনি বেঁচে থাকতে আর মেজবৌদিকে আমার দেখা হয় নি। ভাল কথা, দাদা বাবুর অসুখ ও মৃত্যুর কথা এখনও বলা হয়নি, প্রসঙ্গক্রমে যখন কথাটা এসেই পড়লো তখন সেটাও এইখানে বলে নিই। বোধ হয় আমি ফার্ষ্ট ক্লাসে পড়বার সময় এ ঘটনাটা ঘটে।

 একদিন সকালে বেড়িয়ে ফিরে এসে দাদা বাবুর হঠাৎ এপোপ্লেক্সি হ’লো, তখনই অর্দ্ধ অঙ্গ তাঁর পক্ষাঘাতে পড়ে গেল। কত ডাক্তার বৈদ্য হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করানো হ’লো, সে অবশ অঙ্গ কিন্তু আর বশে এসে সচল হলো না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে বাহ্যে প্রস্রাব করতেন, শোয়া অবস্থায়ই খাইয়েও তাঁকে দিতে হ’তো। আমার ওপর ছিল তাঁর সেবার ভার। আমার এই অক্লান্ত সেবা দেখে হেডমাষ্টার যোগীন বাবু এত মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, দাদাবাবুর কাছে প্রস্তাবই করে বসলেন তাঁর মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে দেবেন। দাদাবাবু, বড় মামা সবাই হেসে তো গড়াগড়ি, যোগীন বাবুর আগ্রহ দেখে বললেন, “বারীন তো স্বাধীন, সে করতে চায় করুক না।” মেয়ে বেচারী ছিল কালো আর আমি ছিলুম রূপের উপাসক কবি। খুব জোরে মাথায় একটা ঝাঁকি দিয়ে অসম্মতি জানিয়ে আমি প্রজাপতি দেবতাকে সে যাত্রা রম্ভা দেখিয়ে বাঁচলুম বটে কিন্তু এর পর থেকে সে মেয়ে আমাদের বাড়ীতে বেড়াতে এলে আত্মীয়াদের ঠাট্টার চোটে আমার বাড়ী ছাড়তে হ’তো। বিয়ের কথায় কিন্তু কেমন একটা গোপন সুখও হতো আবার অনিচ্ছাও আসতো, রামচরণ বাবুদের বাড়ী কারু বিয়ের সানাই বাজলে চাঁদনী রাতের বুকে সে সুর কি উদাস মায়াই যে জাগাত তা’ আমার খাঁ খাঁ করা শূন্য বুকটাই কেবল জানতো ও বুঝতো। আশ্চর্য্য, এই বিয়ে বস্তুটা আমি চিরটা কাল চেয়েছি কিন্তু কখনও করি নি, যত রম্ভা তিলোত্তমারা আমার জীবনে এসে ঢুকেছেন ছানলাতলা মাড়িয়ে সোজা পথে নয় কিন্তু ‘দেয়া, বিজুরী’ ও কাঁটা বনের বাঁকা গহন পথে। নারী আমায় ভালবেসেছে চিরদিনই লুকিয়ে— শাস্ত্র ডিঙিয়ে, লোকাচারের পাচিল টপ্‌কে, অবৈধতার চোর-দরজা খুলে, খিড়কীর পথে; তাই সুন্দরীদের চরম দান আমার ভাগ্যে জুটতে এতখানি দেরী ঘটে গিয়েছিল।

 দাদাবাবুর রোগ প্রথমে এলোপ্যাথিতে সারাবার ব্যর্থ চেষ্টা চললো, তারপরে ভার নিলেন কবিরাজ বিজয়রত্ন সেন; ইনি আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক ছিলেন। সবাই বললেন আর একটা এপোপ্লেক্সির ধাক্কা এলে ইনি আর বাঁচবেন না। শেষে ধাক্কা যখন সত্যি সত্যিই এলো তখন মহেন্দ্রলাল সরকার হোমিওপ্যাথিতে দাদাবাবুর চিকিৎসা করছেন। হঠাৎ একদিন দেখি দাদাবাবুর বুক থেকে কি রকম ঘড় ঘড় ঘড় ঘড় শব্দ হচ্ছে আর মুখটা মাঝে মাঝে হাঁ হয়ে যাচ্ছে। ন-মেশোকে বলায় (কৃষ্ণকুমার মিত্র) তিনি দাদাবাবুর বিছানার কাছে এসে ছেলে মানুষের মত কাঁদতে লাগলেন, বড়মামাকে বাড়ীর মধ্যে খবর দেওয়ায় মেয়ে মহলে মড়া কান্নার রোল উঠলো। এই অবস্থায় কয়েক ঘণ্টা থেকে দাদাবাবু মারা গেলেন। আমি সারা রাত সেই ঘরে শুয়ে তাঁর মৃতদেহ আগলে রইলুম। পরদিন সকালে সবাই মিলে দাড়োয়া নদীর বুকে বালুচরে নিয়ে গিয়ে তাঁকে দাহ করা হ’লো। মৃত্যু দেবতা এই দ্বিতীয়বার আমার জীবনে এসে গুরুগম্ভীর পদে উঠান পার হয়ে গেলেন। কবে যে উপরের ছাড়পত্র নিয়ে আমাকেই ডাকতে এসে হাজির হন বলা যায় না।

 মেজবৌদির আমাকে দেখে এত ভাল লাগলো যে মেজদা’কে বলে আমাকে একরকম অনিচ্ছাসত্ত্বেও গ্রেপ্তার করে ঢাকা নিয়ে চললেন। এই আামার পূর্ব্ববঙ্গের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। ঢাকায় মেজদা’র বাড়ী ছিল কলেজেরই কাছে, ইংরাজী ধরণের বাঙলো প্যাটার্ণের বাড়ীখানি। সামনে গেট দিয়ে ঢুকে একটি মাঠ— সবুজ ঘাসে ঢাকা lawn, তার পরেই দু’ তিন ধাপ উঠে

বারাণ্ডা। ঘর এ-পাশে দু’খানি ও-পাশে দু’খানি এবং মাঝে হলের মত লম্বা ধরণের আরও দু’খানি। একটি ঘরে মেজদা শুতেন ও তাঁর রাশি রাশি বইএর মাঝে ডুবে থাকতেন কবিতার রস মাধুর্য্যে। বাইরের হলটি ছিল ড্রয়িং রুম, ভিতরেরটি ছিল বৌদির শোবার ঘর। এ পাশের মাঠের দিকের প্রথম ঘরটি ছিল আমার আর তার ভিতর দিকেরটি ছিল খাবার ঘর— dining room; ভিতর দিকে সারি সারি খোলার ঘরে ছিল বাথ রুম, রান্নাঘর ও ভাঁড়ার ঘর। ঢাকায় এসে আমার জীবনের অন্তঃপুরে ঢুকলেন তাঁর অনবদ্য লাবণ্যে যৌবন-কান্তিতে চারিদিক আলো করে আর একটি মেয়ে। তারও নাম ধাম বলার উপায় নেই।

 ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়ে আমার ভাব হলো সুসংএর ছোট তরফের ছেলে সুরেশ চন্দ্র সিংহের সঙ্গে। শুনেছি এখন সে ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট না ঐ রকম কি। তখন সে ছিল নারীর অধিক কোমল কবিপ্রকৃতির লাজুক ছেলে। আমার ও তার কবিতা লেখার বাই ছিল বলে ভাবটা হ’লো খুবই গাঢ় রকমের। সকালে বাড়ীতে কবিতা লেখা, দুপুরে কলেজ করা, বিকেলে সুরেশের সঙ্গে রমনার মাঠে বেড়াতে যাওয়া, রাত্রে গিয়ে সেই মেয়েটিকে পড়ানো—এই হলো আমার সারা দিনের কাজ। মেয়েটি ছিল তন্বী, কিশোরী, নাতিদীর্ঘ, বিপুলকুন্তলা, সত্য সত্যই হরিণনেত্রা যাকে বলে। রং ছিল তার গায়ের ঠিক দুধে আলতায়, চোখ দুটিতে কি যে অতল কালো গভীরতার ডাক ছিল তা’ বলে শেষ করা যায় না—সেই গভীর কালো চোখের পাতা দুটি উঠলে সারা প্রাণখানা আঁটু পাঁটু করে তার দিকে ছুটে যেতে চাইতো। ভ্রূ দু’টি তার ছিল কি অপূর্ব্ব রেখায় যে টানা, অমন আরক্ত টুকটাক রাঙা প্রবাল-নিবিড় ঠোঁট দু’টির শোভা কিন্তু নষ্ট করে দিয়েছিল সামনের উঁচু দু’টি দাঁতে; তবে মুখ বুজে থাকলে সে দোষ বড় একটা দেখা যেত না।

 পড়া নিতে এসে আমার কাঁধের ওপর ঝুঁকে পড়ে সুগন্ধী চুলের পরশ দিয়ে সে আমার সর্ব্বনাশটা করলো, মাথাটা ঘুরে যাবার যেটুকু বাকী ছিল তা শেষ করে দিল তার ঐ ভুবনবিজয়ী চোখের আড়ে আড়ে সলাজ সত্রাস চাহনি। বাস! সেই থেকে আমাদের দু’জনার সর্ব্বনাশ হয়ে গেল। তার পর থেকে ছয় মাস ধরে চললো দু’টি তৃষিত প্রেমার্দ্র দেহ প্রাণ মনের পরস্পরের ওপর ব্যাকুল হয়ে আছাড়ি পিছাড়ি। অবাধ প্রচুর অবসর, ভোগ করলেই হয়, তবু আমাদের কিসে যেন আটকাতে লাগল—দেহ সম্ভোগ হলো না, হলো শুধু দেহের বেলাভূমি ঘিরে দু’জনকে ছুঁয়ে বুকে নিয়ে প্রেমের পাগল ঢেউ তোলা। কি স্বপ্নের যে ঘুমঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে এই মাসগুলি কেটেছিল।

 তার মুখে শুনেছিলুম তার বিবাহিত জীবনের গোড়াটা ছিল ভারি দুঃখের। স্বামী পছন্দ করেও শেষটা বিয়ে করেন নি—তাঁকে একরকম জোর করেই মেয়ে গছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। স্পষ্ট করেই রাগের মাথায় তিনি বলতেন ‘নাক তোমার ছোট আর দাঁত বড় উঁচু।’ তার পরে কিন্তু স্ত্রীকে খুবই ভাল বেসেছিল, তখন কিন্তু সে বেচারী হৃদয়টি তার আমাকে দিয়ে সর্ব্বস্বান্ত হয়ে চুকেছে। স্বামীর সঙ্গে মানিয়ে তাঁকে ভালবেসে শ্রদ্ধাভক্তি করে সংসার ঘর গৃহস্থালী করা ছাড়া তার তখন আর কিই বা করবার শক্তি আছে, স্বামীর প্রণয়িনী হবার সাধ্য তার যে আমিই নিয়েছি হরণ করে। তার প্রকৃতিটি ছিল কোমল, নমনীয়, ভীরু, নিতান্তই মেয়েলী। স্বামীর প্রতি এই ধারণা তাকে কাঁটার মত বিঁধতো, নিজেকে আমার পায়ে ঢেলে দিয়ে ভাল না বেসেও তার উপায় ছিল না আর স্বামীকে গোপন করার লজ্জা ও অপরাধের বোঝা হাসি মুখে বইবারও তার সামর্থ্য ছিল না। এ রকম দোটানার কি যে নিদারুণ আঘাত তা কেবল শশকের মত কারণে অকারণে ভীত দুর্ব্বলচিত্ত নারীই জানে। স্নায়ু তার লক্ষ্যের অগোচরে দোটানার বেদনায় ও টানাপোড়েনের ধাক্কায় ধাক্কায় দিন দিন এলিয়ে পড়তে থাকে। তারপর যখন হঠাৎ সব ফুরিয়ে যায়, বিধাতার চরম আঘাত এসে দয়িতকে ছিনিয়ে নিয়ে সব সাঙ্গ করে দিয়ে যায় তখন এক দিন তার প্রাণ মন স্নায়ু পেশী সব হঠাৎ জবাব দিয়ে বসে, যন্ত্র বিকল হয়।

 আমার ঢাকায় আসার দু এক মাস পরেই বোধ হয় এক দিন হঠাৎ তার ঘন ঘন বমি হতে লাগল, মাথা ঘুরে শরীর কেমন করতে আরম্ভ করলো। সে বাড়ীতে একজন বুড়ী মুসলমানী রাঁধুনী ছিল, সে মিটি মিটি হাসছে দেখে আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলুম, “হাস্‌ছিস যে? বেচারীর অসুখ করেছে, আর তুই কিনা হাসছিস্!” রাঁধুনী চোখ টিপে আমাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বললো, “অসুখ কোথা? তুমি যেমন হাবা মনিষ্যি, দিদিমণির খোকা হবে গো, খোকা হবে।” শুনে হঠাৎ আমার ভিতরটা কি যেন আঘাত পেয়ে গুটিয়ে কুঁক্‌ড়ে গেল, ব্যথায় মনটা মূক হয়ে রইল। যে এমন ভাবে সর্ব্বস্ব ঢেলে নিবিড় প্রেমে আমার হয়েছে তার গর্ভে আর এক জনের সন্তান! এ যেন আমি কিছুতেই সইতে পারছি নে, অথচ আমি বেশ জানি তার স্বামী আছে, এই কোমল ভীরু অসহায় নারী সেই গুরু গম্ভীর স্বামীরই কথায় ওঠে বসে।

 তার পরদিন যখন তার দেখা পেলুম তখন তাকে যেমন রোগা ও ক্লান্ত তেমনি সুন্দর দেখাচ্ছিল। ক্ষয়িতকলা চাঁদের মত উজ্জ্বল তার রূপ ব্যথাতুর লাবণো যেন গলে পড়ছে। করুণায় আমার বুকখানা দুলে উঠলো, চোখে উছলে উঠলো আকুল আত্মহারা প্রেম; সেও আমার দিকে চেয়ে অসহায় শিশুর হাত বাড়িয়ে কোলে আসবার মত করে হাসিটুকু হাসলো। তখন সামনে তার স্বামী, কিছু বলবার উপায় নেই। এই ভালবাসা আমাদের এক বছর চলেছিল। তার কোলে একটি ফুটন্ত পদ্মের মত মেয়ে এলো, সেই অনবদ্যা কিশোরী হলো মা! তারপর আমাদের প্রেম সকল বা ভেঙ্গে চললো অনিবার্য্য গতিতে সব ক্ষুইয়ে ফেলবার—সব কেড়ে নিবার দিকে; একদিন গভীর রাত্রে কামনার বশে অসহায় হয়ে আমরা দেহ ভোরের খুব কাছাকাছি গিয়ে কোন গতিকে আত্মরক্ষা করলুম। আমিও বুঝলুম আর সেও বুঝলো এরকম করে আর বেশী দিন চলবে না, সংযমের বাঁধ আমাদের ভেঙে পড়ছে।

 তখন আমার এলো পরিণাম চিন্তা! তাইতো, এত অসহায় যে, এমন ভীরু ও দুর্ব্বল যে তার সুখের নির্ব্বিঘ্ন সংসার নীড়টুকু নষ্ট করে দেব? এক দিন না একদিন গোপন সম্বন্ধটুকু আমাদের ধরা পড়বেই পড়বে, তখন বেচারী সে লজ্জার আঘাত কি সইতে পারবে? আমি দু দিন ধরে তাকে বুঝিয়ে ঢাকা ত্যাগ করলুম, চক্ষের জলে বুক ভাসাতে ভাসাতে সে গাড়ী করে আমায় ট্রেণে তুলে দিয়ে গেল। কলকেতায় এসে তার প্রেমভিক্ষায় ভরা ২।৩ খানি চিঠি পেয়েছিলুম। তারপর তারই হাতের লেখা স্বাক্ষরহীন একখানি চিঠি এক দিন এলো, তাতে সে লিখেছে, “আমি আর এ দোটানা সইতে না পেরে ওঁকে সব বলেছি। আমায় আর চিঠি লিখো না, আমার দুর্ব্বলতার অপরাধ ক্ষমা করো। তোমার অভাগিনী—।” পরে শুনলুম সে পাগল হয়ে গেছে! দশ বারো বছর সে বেঁচে ছিল পাগল ও রুগ্ন অবস্থায়। আজ কয়েক বছর হ’লো সে সকল জ্বালার বোঝা নামিয়ে দিয়ে রূপের ও লাবণ্যের কোন অলক্ষ্য জগতে চলে গেছে—আমার প্রতি তার সে প্রেম ও স্মৃতির বোঝাও হয়তো এপারেই ফেলে দিয়ে। আরও একবার তাকে দেখেছিলুম, সে কথা পরে বলছি।