বিষয়বস্তুতে চলুন

আলালের ঘরের দুলাল (১৮৭০)/১৭

উইকিসংকলন থেকে

১৭ নাপিত ও নাপ্তেনীর কথোপকথন, বাবুরাম বাবুর

দ্বিতীয় বিবাহ করণের বিচার ও

পরে গমন।


 বৃষ্টি খুব এক পশলা হইয়া গিয়াছে —পথ ঘাট পেঁচ২ সেঁত২ করিতেছে —আকাশ নীল মেঘে ভরা —মধ্যে২ হড়্‌মড়্২ শব্দ হইতেছে, বেং গুলা আশে পাশে যাঁওকো২ করিয়া ডাকিতেছে। দোকানি পসারিরা ঝাঁপ খুলিয়া তামাক খাইতেছে —বাদলার জন্যে লোকের গমনাগমন প্রায় বন্ধ —কেবল গাড়োয়ান চিৎকার করিয়া গাইতে২ যাইতেছে ও দাসো কাঁদে ভার লইয়া “হাংগো বিসখা সে যিবে মথুরা” গানে মত্ত হইয়া চলিয়াছে। বৈদ্যবাটীর বাজারের পশ্চিমে কয়েক ঘর নাপিত বাস করিত। তাহাদিগের মধ্যে একজন বৃষ্টি জন্যে আপন দাওয়াতে বসিয়া আছে। এক২ বার আকাশের দিকে দেখিতেছে ও এক২ বার গুন২ করিতেছে, তাহার স্ত্রী কোলের ছেলেটি আনিয়া বলিল —ঘর-কন্নার কর্ম্ম কিছু থা পাইনে —হেদে! ছেলেটাকে একবার কাঁকে কর —এদিকে বাসন মাজা হয়নি, ওদিকে ঘর নিকন হয়নি, তার পর রাঁদা বাড়া আছে—আমি একলা মেয়েমানুষ এসব কি করে করব আর কোন্‌ দিগে যাব? —আমার কি চাট্টে হাত চাট্টে পা? নাপিত অমনি ক্ষুর ভাঁড় বগলদাবায় করিয়া উঠিয়া বলিল —এখন ছেলে কোলে করবার সময় নয় —কাল বাবুরাম বাবুর বিয়ে, আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে। নাপ্‌তিনী চমকিয়া উঠিয়া বলিল —ও মা আমি কোজ্জাব? বুড় ঢোস্কা আবার বে কর্‌বে। আহা! এমন গিন্নী —এমন সতী লক্ষ্মী —তার গলায় আবার একটা সতিন গেঁতে দেবে —মরণ আর কি! ওমা পুরুষ জাত সব করতে পারে! নাপিত আশাবায়ুতে মুগ্ধ হইয়াছে —ও সব কথা না শুনিয়া একটা টোকা মাথায় দিয়া সাঁ২ করিয়া চলিয়া গেল।

 সে দিবসটি ঘোর বাদলে গেল। পর দিবস প্রভাতে সূর্য্য প্রকাশ হইল —যেমন অন্ধকার ঘরে অগ্নি ঢাকা থাকিয়া হঠাৎ প্রকাশ হইলে আগুনের তেজ অধিক বোধ হয় তেমনি দিনকরের কিরণ প্রখর হইতে লাগিল —গাছপালা সকলই যেন পুনর্জীবন পাইল ও মাঠে-বাগানে পশু-পক্ষীর ধ্বনি প্রতিধ্বনি হইতে লাগিল। বৈদ্যবাটীর ঘাটে মেলা নৌকা ছিল। বাবুরাম বাবু, ঠকচাচা, বক্রেশ্বর, বাঞ্ছারামও পাকসিক লোকজন লইয়া নৌকায় উঠিয়াছেন এমত সময়ে বেণী বাবু ও বেচারাম বাবু আসিয়া উপস্থিত। ঠকচাচা তাহাদিগকে দেখেও দেখেন না —কেবল চিৎকার করিতেছেন —লা খোল্ দেও। মাজিরা তকরার করিতেছে —আরে কর্ত্তা অখন বাটা মরিনি গো —মোরা কি লগি ঠেলে, গুণ টেনে যাতি পার্‌বো? বাবুরাম বাবু উক্ত দুইজন আত্মীয়কে পাইয়া বলিলেন —তোমরা এলে হল ভাল, এসো সকলেই যাওয়া যাউক।

 বাঞ্ছারাম। বাবুরাম! এ বুড়ো বয়সে বে কর্‌তে তোমাকে কে পরামর্শ দিল?

 বাবুরাম। বেচারাম দাদা! আমি এমন বুড় কি? তোমার চেয়ে আমি অনেক ছোট, তবে যদি বলো আমার চুল পেকেছে ও দাঁত পড়েছে —তা অনেকের অল্প বয়সেও হইয়া থাকে। সেটা বড় ধর্ত্তব্য নয়। আমাকে এদিক ওদিক সব দিগেই দেখিতে হয়। দেখ একটা ছেলে বয়ে গিয়েছে আর একটা পাগল হয়েছে —একটি মেয়ে গত আর একটি প্রায় বিধবা। যদি এ পক্ষে দুই-একটি সন্তান হয় তো বংশটি রক্ষে হবে। আর বড় অনুরোধে পড়িয়াছি —আমি বে না করলে কনের বাপের জাত যায় —তাহাদিগের আর ঘর নাই।

 বক্রেশ্বর। তা বটে তো কর্ত্তা কি সকল না বিবেচনা করে একর্ম্মে প্রবর্ত্ত হইয়াছেন। উঁহার চেয়ে বুদ্ধি ধরে কে?

 বাঞ্ছারাম। আমরা কুলীন মানুষ —আমাদিগের প্রাণ দিয়ে কুল রক্ষা করিতে হয়, আর যে স্থলে অর্থের অনুরোধ সে স্থলে তো কোন কথাই নাই।

 বেচারাম। তোমার কুলের মুখেও ছাই —আর তোমার অর্থের মুখেও ছাই —জন কতক লোক মিলে একটা ঘরকে উচ্ছন্ন দিলে, দূঁর২! কেমন বেণী ভায়া কি বল?

 বেণী। আমি কি বল্‌ব? আমাদিগের কেবল অরণ্যে রোদন করা। ফলে এ বিষয়টিতে বড় দুঃখ হইতেছে।

 এক স্ত্রী সত্ত্বে অন্য স্ত্রীকে বিবাহ করা ঘোর পাপ। যে ব্যক্তি আপন ধর্ম্ম বজায় রাখিতে চাহে সে এ কর্ম্ম কখনই করিতে পারে না। যদ্যপি ইহার উল্ট কোন শাস্ত্র থাকে সে শাস্ত্রমতে চলা কখনই কর্ত্তব্য নহে। সে শাস্ত্র যে যথার্থ শাস্ত্র নহে তাহাতে কোন সন্দেহ নাই, যদ্যপি এমন শাস্ত্রমতে চলা যায় তবে বিবাহের বন্ধন অতিশয় দুর্বল হইয়া পড়ে। স্ত্রীর মন পুরুষের প্রতি তাদৃশ থাকে না ও পুরুষের মন স্ত্রীর প্রতিও চল বিচল হয়। এরূপ উৎপাত ঘটিলে সংসার সুধারা মতে চলিতে পারে না, এজন্য শাস্ত্রে বিধি থকলেও সে বিধি অগ্রাহ্য। সে যাহা হউক —বাবুরাম বাবুর এমন স্ত্রী সত্ত্বে পুনরায় বিবাহ করা বড় কুকর্ম্ম—আমি এ কথার বাষ্পও জানি না—এখন শুনিলাম।

 ঠকচাচা। কেতাবি বাবু সব বাতেতেই ঠোকর মারেন। মালুম হয় এনার দুসরা কোই কাম কাজ নাই। মোর ওমর বহুত হল —নুর বি পেকে গেল —মুই ছোকরাদের সাত হর ঘড়ি তকরার কি কর্‌ব? কেতাবি বাবু কি জানেন এ সাদিতে কেতনা রোপেয়া ঘর ঢুক্‌বে?

 বাঞ্ছারাম। আরে আবাগের বেটা ভূত! কেবল টাকাই চিনেছিস্‌ আর কি অন্য কোন কথা নাই? তুই বড় পাপিষ্ঠ —তোকে আর কি বল্‌বো —দূঁর২! বেণী ভায়া চল আমরা যাই।

 ঠকচাচা। বাতচিজ পিচু হবে —মোরা আর সবুর করতে পারিনে। হাবলি যেতে হয় তো তোমরা জল্‌দি যাও।

 বেচারাম বেণীবাবুর হাত ধরিয়া উঠিয়া বলিলেন —এমন বিবাহে আমরা প্রাণ থাকিতেও যাব না কিন্তু যদি ধর্ম্ম থাকে তবে তুই যেন আস্ত ফিরে আসিস্‌ নে। তোর মন্ত্রণায় সর্ব্বনাশ হবে —বাবুরামের স্কন্ধে ভাল ভোগ করছিস্‌ —আর তোকে কি বল্‌ব?— দূঁর২!!!