বিষয়বস্তুতে চলুন

উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/ছেলেদের মহাভারত/বনপর্ব

উইকিসংকলন থেকে

বনপর্ব

ল্ডবেরা সকলের নিকট বিদায় লইয়া, অস্ত্র হাতে ক্রমাগত উত্তর দিকে চলিতে লাগিলেন। ইন্দ্রসেন প্রভৃতি চৌদ্দজন চাকরও সপরিবারে গাড়ি চড়িযা তাঁহাদের সঙ্গে চলিল। তখন অনেক ধার্মিক ব্রাহ্মণ কৌববদিগের উপরে নিতান্ত বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “এই দুষ্টগণের রাজ্যে বাস করিতে নাই, আমরাও পাণ্ডবদিগের সঙ্গে যাইব৷”

 এই সকল ব্রাহ্মণকে সঙ্গে আসিতে দেখিয়া যুধিষ্ঠিরেব আনন্দও হইল, কষ্টও হইল। নিজেদেব এইরূপ অবস্থা, কি খাইবেন তাহার ঠিক নাই, তাহার মধ্যে রোজ এতগুলি ব্রাহ্মণের আহাব যোগান তো সহজ কথা নহে, তাই যুধিষ্ঠিব তাঁহাদিগকে বিনয করিযা বলিলেন, “আপনারা আমাদিগকে এত স্নেহ কবিয়া আমাদের সঙ্গে আসিয়াছেন, কিন্তু বনের ভিতরে আপনাদিগকে কি দিয়া খাওয়াইব, তাহা ভাবিয়া আমি অস্থির হইতেছি। আমাদের সঙ্গে আসিলে আপনাদের ক্লেশ হইবে, আপনারা ঘরে ফিরিয়া যান৷”

 ব্রাহ্মণেরা বলিলেন, “মহারাজ, আমরা আপনাকে ছাড়িযা থাকিতে পারিব না। আমাদের আহারের জন্য আপনার কোনো চিন্তা নাই, আমবা নিজে ভিক্ষা করিয়া খাইব৷”

 এইরূপ অবস্থা দেখিয়া যুধিষ্ঠির ধৌম্যকে বলিলেন, “ইহুদিগকে খাইতে দিবার শক্তি আমার নাই, অথচ ইহাদিগকে ছাড়িতেও পারিতেছি না! এখন উপায় কি, বলুন৷”

 ধৌম্য বলিলেন, “মহারাজ, সূর্যের পূজা করুন, ইহার উপায় হইবে৷”

 এ কথায় যুধিষ্ঠির সূর্যের পূজা আরম্ভ করিলে, সূর্যদেব সেখানে উপস্থিত হইয়া বলিলেন, “মহারাজ, আমি তোমার পূজায় তুষ্ট হইয়া এই থালি-খানা আনিয়াছি। আমার আশীর্বাদে এবং এই থালির গুণে, বারো বৎসর তোমার অন্নের চিন্তা থাকিবে না। প্রতিদিন, দ্রৌপদী যতক্ষণ না আহার করিবেন, ততক্ষণ এই থালির নিকট ফল, ফুলুরি, মাংস, মিঠাই যত চাও ততই পাইবে। তেরো বৎসর পরে তোমরা রাজা ফিরিয়া পাইবে৷” এই বলিয়া তিনি আকাশে মিলাইয়া গেলেন৷

 সে আশ্চর্য থালি পাইয়া আর যুধিষ্ঠিরের কোনো চিন্তা রহিল না। বারো বৎসর পর্যন্ত, যতক্ষণ দ্রৌপদীর খাওয়া না হইত, ততক্ষণ উহ নানারূপ খাবার জিনিসে পরিপূর্ণ থাকিত। যত লোকই আসুক না কেন, উহা শেষ করিতে পারিত না। কিন্তু দ্রৌপদীর খাওয়া শেষ হওয়া মাত্রই সব ফুরাইয়া যাইত৷

 পাণ্ডবেরা প্রথমে যে বনে বাস করেন, তাহার নাম কাম্যক বন। সেইখানে একদিন বিদুর আসিয়া তাঁহাদের নিকট উপস্থিত হইলেন। দূর হইতে বিদুরকে দেখিয়া যুধিষ্ঠিরের ভয় হইয়াছিল, বুঝি-বা আবার পাশা খেলিবার ডাক আসে। কিন্তু বিদুর সেজন্য আসেন নাই। পাণ্ডবদিগের সহিত বন্ধুতা করার কথা বলাতে, ধৃতরাষ্ট্র রাগিয়া তাঁহাকে বলিয়াছেন, “তুমি এখান হইতে চলিয়া যাও। খালি পাণ্ডবদের হইয়া কথা বল, তোমার মন বড় কুটিল।” তাই বিদুর পাণ্ডবদিগকে খুঁজিতে খুঁজিতে কামাক বনে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন।

 এদিকে বিদুর চলিয়া আসাতে ধৃতরাষ্ট্র বড়ই কাতর হইয়া পড়িলেন। বিদুরকে তিনি ভালোবাসিতেন, আর বিদুরের মতন একজন বুদ্ধিমান লোক পাণ্ডবদের দলে গেলে তাঁহাদের বল খুবই বাড়িয়া যাইবে, ইহা ভাবিয়া তাঁহার যথেষ্ট হিংসাও হইয়াছিল। সুতরাং তিনি সঞ্জয়কে ডাকিয়া বলিলেন, “সঞ্জয়! শীঘ্র বিদুরকে ফিরাইয়া আন, নহিলে আমি বাঁচিব না।”

 কাজেই আবার বিদুরকে ফিরাইয়া আসিতে হইল। তাহা দেখিয়া দুর্যোধন বলিলেন, “ঐ দেখ, আপদ আবার আসিয়াছে। বন্ধুসকল! শীঘ্র একটা কিছু কর, নহিলে এ কখন বাবাকে দিয়া পাণ্ডবদিগকে ফিরাইয়া আনে তাহার ঠিক কি!”

 কিন্তু কর্ণের এ কথা পছন্দ হইল না, তাঁহার ইচ্ছা, পাণ্ডবদিগকে এখনই গিয়া মারিয়া আসেন। কারণ, এখন তাঁহাদের দুঃখের অবস্থা, সহায় নাই, আর মনে কষ্ট, কাজেই তেজ কম। এইবেলা তাঁহাদিগকে মারিবার খুব সুবিধা।

 এ কথায় সকলেই যারপরনাই উৎসাহের সহিত রথ সাজাইয়া মধ্যে হঠাৎ ব্যাসদেব সেখানে আসিয়া তাহাদিগকে থামাইয়া দিলেন।

 এদিকে কাম্যক বনে পাণ্ডবদের কিরূপে দিন যাইতেছে? বনটি বড়ই ভয়ানক। রাক্ষসের ভয়ে মুনি-ঋষিরা সেখান হইতে পলাইয়া গিয়াছেন। পাণ্ডবেরা সেখানে গিয়াই দেখিলেন, ভয়ানক একটা রাক্ষস হাঁ করিয়া তাঁহাদের পথ আগলাইয়া গর্জন করিতেছে। দ্রৌপদী তো তাহাকে দেখিয়াই চক্ষু বুজিয়া প্রায় অজ্ঞান!

 যুধিষ্ঠির রাক্ষসটাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে? তোমর কি কাজ করিতে হইবে বল৷” রাক্ষস বলিল, “আরররে মুহি কিড়্ম্মিঢ়ঢ়্ রে! মোর নাম কিড়্ম্মিঢ়ঢ়্ আছে! বগের ভাই। তোরা কে বটেক্? তোন্দের্‌র্‌কে মুহি মজ্জাসে খাবো!”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “কীর্মির! আমরা পাণ্ডুর পুত্র। আমাদের নাম যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল, আর সহদেব৷” ভীমের নাম শুনিয়াই রাক্ষস বলিল, “হঁ—অ—অ? বভীম? কোন্ বেটা ব্‌ভীম্ রে? ওহার্‌র্‌কেই তো মুহি আগ্‌গেমে খাবো। বেট্টা মোর ভাইটাকে মারিলেক৷”

 ভীমের তাহাতে ভয় পাওয়ার কোনো কথাই নাই, তিনি ইহার পূর্বেই একটা গাছ লইয়া প্রস্তুত আছে। তারপর যুদ্ধটাও খুব জমাটরকমই হইল, তাহার কথা আর বাড়াইয়া বলিবার দরকার নাই। এ রাক্ষসটা খুব জোয়ান, হাত দিয়া, দাঁত দিয়া, পাথর ছুঁড়িয়া, সে অনেকক্ষণ যুদ্ধ করিল। শেষে ভীম তাহার হাত-পা মোচড়াইয়া ধরিয়া তাহাকে বন্ বন্ শব্দে ঘুরাইতে আরম্ভ করিলে সে চ্যাঁচাইতে চ্যাঁচাইতে অজ্ঞান হইয়া গেল। তারপর তাহার গলায় ভীমের হাতের দুই টিপ পড়িতেই কার্য শেষ৷

 পাণ্ডবদের বনবাসের সংবাদে সকলে নিতান্তই দুঃখিত হইলেন। কৃষ্ণ, ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি যদুবংশের আর পাঞ্চাল দেশের আত্মীয়েরা এবং আরো অনেকে তাঁহাদিগকে দেখিতে আসিয়া আক্ষেপ করিতে করিতে কৌরবদিগকে অনেক ধিক্কার দিলেন। উহারা সকলেই বলিলেন, “এই দুষ্টদিগকে মারিয়া আমরা আবার যুধিষ্ঠিরকে রাজা করিব৷”

 মুনি-ঋষিরা সর্বদাই পাণ্ডবদিগকে দেখিতে আসিতেন। সাধারণ লোকেরাও দলে দলে তাঁহাদিগকে দেখিতে আসিয়া তাঁহাদের সঙ্গে সেই বনেই থাকিয়া যাইত৷

 কাম্যক বনেই যে তাঁহারা আগাগোড়া ছিলেন, তাহা নহে, কখনো কাম্যক বনে, কখনো-বা নানা তীর্থে, এইরূপে ঘুরিয়া ফিরিয়া তাঁহারা সময় কাটাইতেন। একস্থানে অধিক দিন থাকিলে ফল-মূল মিলানো কঠিন হয়, শিকারও ফুরাইয়া যায়,কাজেই ঘুরিয়া বেড়াইবার বিশেষ দরকার ছিল৷

 বনে থাকায় খুবই কষ্ট তাহাতে সন্দেহ কি? আর শত্রুদিগকে সাজা দিবার ইচ্ছাও সকলেরই হয়। সুতরাং দ্রৌপদী যে পাণ্ডবদিগের দুঃখ দেখিয়া কাতর হইবেন, আর শত্রুদিগকে তাড়াইয়া নিজের রাজ্য লইবার জন্য যুধিষ্ঠিরকে বার বার পীড়াপীড়ি করিবেন, ইহা আশ্চর্য নহে। এসকল সময়ে ভীম সর্বদাই দ্রৌপদীর কথায় সায় দিতেন। কিন্তু যুধিষ্ঠির তাহাতে ব্যস্ত না হইয়া, মিষ্ট কথায় তাঁহাদিগকে বুঝাইয়া দিতেন যে, উহারা অন্যায় কাজ করিয়াছে বলিয়া পাণ্ডবদিগেরও তাহা করা উচিত নহে। ক্ষমা করাই যথার্থ ধর্ম, রাগের বশ হইয়া কাজ করিলে ধর্ম নষ্ট হয়৷

 তাহা ছাড়া, যুধিষ্ঠির বেশ জানতেন যে, দুর্যোধনের পক্ষে কর্ণ প্রভৃতি বড় বড় যে সকল বীর আছে, তাহাদিগকে ইচ্ছা করিলেই হারাইয়া দেওয়া যায় না। ইহার জন্য বিশেষ আয়োজন চাই। তাই তিনি ভীমকে বলিতেন, ‘ভাই! কর্ণ যে কত বড় যোদ্ধা, এ কথা ভাবিয়া আমার ঘুম হয় না৷’

 এ কথা উত্তর দেওয়া ভীমের পক্ষেও সহজ ছিল না। তাই তিনি মুখভার করিয়া চুপ করিয়া থাকিতেন৷

 এই সময় ব্যাসদেব পাণ্ডবদিগকে দেখিতে আসেন। তিনি যুধিষ্ঠিরকে বলিলেন, ‘তোমাকে প্রতিস্মৃতি নামক বিদ্যা শিখাইয়া দিতেছি। তুমি অর্জুনকে ইহা শিখাইবে। ইহার গুণে তিনি মহাদেব, ইন্দ্র, যম, বরুণ, কুবের প্রভৃতি দেবতাকে তপস্যায় তুষ্ট করিয়া সহজেই বড়-বড় অস্ত্রলাভ করিতে পারিবেন৷’

 এই বিদ্যা পাইয়া পাণ্ডবদের মনে খুবই আশা হইল। যুধিষ্ঠিরের নিকট ইহা শিখিবার পর অর্জুন তখনই তপস্যায় বাহির হইতে আর বিলম্ব করিলেন না। কবচ, গাণ্ডীব, অক্ষয় তূণ প্রভৃতি লইয়া তপস্যায় বাহির হইলেন। যাত্রা করিবার সময় সকলে তাঁহাকে প্রাণ ভরিয়া আশীর্বাদ করিলেন, ‘তোমার সিদ্ধিলাভ হউক৷’

 তারপর হিমালয় আর গন্ধমাদন পর্বত পার হইয়া ইন্দ্রকীল নামক পর্বতে উপস্থিত হইলেন। এমন সময় কোথা হইতে একটি কৃষ্ণকায় তপস্বী আসিয়া তাঁহাকে বাধা দিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন, ‘কে হে তুমি, ধনুর্বাণ লইয়া এখানে আসিয়াছ? এখানে ধনুর্বাণ দিয়া কি করিবে? উহা ফেলিয়া দাও৷’

 অর্জুন ইহাতে ধনুক বাণ না ফেলায় তপস্বী খুশি হইয়া বলিলেন, ‘বাছা, বর লও। আমি ইন্দ্র।’

 অর্জুন জোড়হাতে ইন্দ্রকে প্রণাম করিয়া বলিলেন, ‘আপনার নিকট অস্ত্রশিক্ষা করিতে আসিয়াছি। দয়া করিয়া সেই বর দিন৷’

 ইন্দ্র বলিলেন, ‘আগে শিবকে সন্তুষ্ট কর, তারপর অস্ত্র পাইবে৷’ এই বলিয়া ইন্দ্র চলিয়া গেলেন, অর্জুনও হিমালয়ের নিকটে আসিয়া শিবের তপস্যা আরম্ভ করিলেন৷

 ক্রমাগত চারিমাস ধরিয়া তিনি অতি ভয়ংকর তপস্যা করিয়াছিলেন। প্রথম মাসে তিনদিন অন্তর আহার করিতেন, দ্বিতীয় মাসে ছয়দিন অন্তর, তৃতীয় মাসে পনেরো দিন অন্তর। চতুর্থ মাসে কেবল বাতাস ভিন্ন আর কিছুই খান নাই, অঙ্গুষ্ঠমাত্র ভর করিয়া উধর্ব হস্তে, সারাটি মাস দাঁড়াইয়া, কেবলই তপস্যা করিয়াছিলেন৷

 এদিকে সেখানকার মুনি-ঋষিগণের মনে, বড়ই ভাবনা উপস্থিত! অর্জুনের সেই ভয়ানক তপস্যাব তেজে ইহারই মধ্যে চারিদিক ধোঁয়ার মতো হইয়া উঠিয়াছে। তাঁহারা সকলে ব্যস্তভাবে শিবের নিকট গিয়া বলিলেন, ‘প্রভো! আমরা অর্জুনের তপস্যার তেজ সহিতে পারিতেছি না। ইহাকে শীঘ্র থামাইয়া দিন!’

 মহাদেব কহিলেন, ‘তোমরা ব্যস্ত হইও না। আমি আজই অর্জুনকে সন্তুষ্ট করিয়া দিতেছি৷’ সুতরাং মুনিরা নিশ্চিন্ত মনে ঘরে ফিরিয়া গেলেন৷

 ততক্ষণে শিব আর দুর্গাও কিরাত-কিরাতিনীর বেশে অর্জুনের তপস্যার স্থানে গিয়া উপস্থিত হইয়াছে। ভূতগুলিও নানা সাজে সঙ্গে চলিয়াছে৷

 এদিকে আবার কোথাকার একটা দানব শূকর সাজিয়া অর্জুনকে মারিতে আসিয়াছে, অর্জুনও গাণ্ডীব টানিয়া তাহাকে বধ করিতে প্রস্তুত। এমন সময় ব্যাধের বেশে মহাদেব আসিয়া তাহাকে বাধা দিয়া বলিলেন, ‘আরে থামো ঠাকুর! আমি আগে নিশানা করিয়াছি (ধনুক উঠাইয়াছি)৷’

 সামান্য ব্যাধের কথা অর্জুনের গ্রাহই হইল না। তিনি তাহা তুচ্ছ করিয়া শুকরের উপর তীর ছুঁড়িলেন। ব্যাধও ঠিক তাহার সঙ্গে সঙ্গেই এক তীর ছুঁড়িল। এখন এই কথা লইয়া দুজনে ভয়ানক তর্ক উপস্থিত৷

 অর্জুন বলিলেন, ‘আমার শিকারে তুমি কেন তীর ছুঁড়িতে গেলে? দাঁড়াও, তোমাকে সাজা দিতেছি।’

 ব্যাধ হাসিতে হাসিতে বলিল, ‘আমি আগে নিশানা করিয়াছিলাম, আমার তীরেই শূকর মরিয়াছে! তুমি দেখিতেছি বেয়াদব! দাঁড়াও তোমাকে সাজা দিতেছি।’

 এ কথায় অর্জুন বিষম রাগিয়া ব্যাধের উপরে কতই বাণ মারিলেন। ব্যাধ বাণ খাইয়া খালি হাসে, আর বলে, ‘আরো মার্! দেখি তোর কত অস্ত্র আছে!’

 অর্জুনের যত বড়-বড় বাণ আর ভারি-ভারি অস্ত্র ছিল, তিনি তাহার কোনোটাই ছুঁড়িতে বাকি রাখিলেন না। ব্যাধ বাণ খায়, আর কেবলই হাসে। অর্জুনের এমন যে অক্ষয় তূণ, ক্রমে তাহাও খালি হইয়া গেল। কিরাত তাহার সকল বাণ গিলিয়া খাইয়া তখনো হাসিতেছে! বাণ ফুরাইলে অর্জুন গাণ্ডীব দিয়াই কিরাতকে মারিতে গেলেন, সে সর্বনেশে মানুষ তাহাও কাড়িয়া লইল। তারপর খড়্গ লইয়া দু হাতে কিরাতের মাথায় মারিলেন, খড়্গ দুখানা হইয়া গেল! সকল অস্ত্র শেষ হইলে গাছ পাথর ছুঁড়িতে লাগিলেন, তাহাতেও কিছু ফল হইল না। শেষে ভয়ানক রাগের ভরে কিরাতকে জড়াইয়া ধরিতে গেলে, সে তাঁহাকে ধরিয়া এমনি চাপিয়া দিল যে, তাহাতে তিনি একেবারে অজ্ঞান হইয়া গেলেন৷

 জ্ঞান হইলে অর্জুন মাটির শিব গড়িয়া, ফুলের মালা দিয়া তাহার পূজা করিতে বসিলেন। সেই ফুলের মালা অর্জুনের গড়া শিবে না পড়িয়া, একেবারে সেই কিরাতের মাথায় গিয়া উপস্থিত! তাহা দেখিয়া অর্জুনও তাড়াতাড়ি তাহার পায়ে গিয়া পড়িলেন। কারণ, তখন আর তাঁহার বুঝিতে বাকি রহিল না যে, ‘এ ব্যাধ নয়, স্বয়ং শিব৷’ অর্জুন বলিলেন, “প্রভো, না জানিয়া যুদ্ধ করিয়াছি, অপরাধ ক্ষমা করুন৷”

 মহাদেব বলিলেন, “অর্জুন! আমি বড়ই সন্তুষ্ট হইয়াছি। এই লও, তোমার গাণ্ডীব। তোমার তৃণও আবার অক্ষয় হইল। তুমি যথার্থ বীর পুরুষ, এখন বর লও৷”

 অর্জুন বলিলেন, “দয়া করিয়া আমাকে আপনার পাশুপত নামক অস্ত্র দান করুন৷”

 তখন মহাদেব তাঁহাকে সেই অস্ত্র দিয়া, তাহা ছাড়িবার এবং থামাইবার মন্ত্র শিখাইয়া দিলেন, সেই ভয়ংকর অস্ত্রের তেজে তখন ভূমিকম্প আর বজ্রপাতের মতো শব্দ হইয়াছিল৷

 অর্জুনকে অস্ত্র দিয়া মহাদেব চলিয়া গেলে পর, বরুণ, কুবের, যম আব ইন্দ্রও সেখানে আসিয়া তাঁহাকে নানারূপ অস্ত্র দিলেন। যমের দণ্ড, বরুণের পাশ, প্রভৃতি অতি আশ্চর্য এবং ভয়ংকর অস্ত্র। এ অস্ত্রসকল তো অৰ্জুন পাইলেনই, তারপর স্বর্গে গিয়া ইন্দ্রের এবং দেবতাদিগের নিকটে কত আদর কত মান্য, কত শিক্ষা পাইলেন, তাহা লিখিয়া শেষ করা যায় না। ইন্দ্রের নিকটে যে-সকল আশ্চর্য অস্ত্র পাইয়াছিলেন, তাহা দ্বারা অর্জুন নিবাত কবচ নামক দৈত্যদিগকে বধ করেন। তাহাতে দেবতাদের অনেক উপকার হয়। ইহা ছাড়া চিত্রসেন নামক গন্ধর্বের নিকট শিক্ষা করিয়া, তিনি সংগীত বিদ্যায় অসাধারণ পণ্ডিত হইয়াছিলেন, আর ইহাতে তাঁহার কত উপকার হইয়াছিল, তাহা শীঘ্রই দেখিতে পাইবে। এইরূপে স্বর্গে তাঁহার পাঁচ বৎসর পরম সুখে কাটিয়া যায়৷

 এদিকে কাম্যক বনে পাণ্ডবেরা অর্জুনের কথা ভাবিতে ভাবিতে নিতান্ত দুঃখিতভাবে দিন কাটাইতেছেন। তিনি কোথায় কিভাবে আছেন, কত দিনে ফিরিবেন, কিছুই তাঁহাদের জানা নাই, সুতরাং দুঃখ হইবার কথা। মাঝে মাঝে কোনো ধার্মিক মুনি-ঋষি আসিলে, তাঁহার সহিত কথাবার্তায় কয়েকদিন তাঁহাদের মন একটু ভালো থাকে। একবার বৃহদশ্ব মুনি অসিয়া তাঁহাদের নিকট কিছুদিন রহিলেন। ইনি আশ্চর্যরকম পাশা খেলা জানিতেন। এই সুযোগে তাঁহার নিকট খুব ভালো করিয়া সেই খেলা শিখিয়া লওয়ায়, যুধিষ্ঠিরের অনেক উপকার হইল৷

 ইহার কিছুদিন পরে লোমশ মুনি স্বর্গ হইতে অর্জুনের সংবাদ লইয়া কাম্যক বনে আসেন। তাঁহার নিকটে সকল কথা শুনিয়া অর্জুনের সম্বন্ধে পাণ্ডবদের ভয় দূর হইল৷

 লোমশ বলিলেন যে, ‘অর্জুন পাণ্ডবদিগকে নানারূপ তীর্থ দেখিয়া বেড়াইতে বলিয়াছেন৷’ সুতরাং তাঁহারা লোমশ মুনির সঙ্গেই তীর্থ ভ্রমণে বাহির হইলেন। ভারতবর্ষের প্রায় কোনো তীর্থই তাঁহারা দেখিতে বাকি রাখিলেন না। প্রভাস নামক তীর্থে কৃষ্ণ বলরাম প্রভৃতির সহিত তাঁহাদের দেখা হইল। সেই সময়ে যদুবংশের সকলে পাণ্ডবদিগের দুঃখে নিতান্ত দুঃখিত হইয়া প্রতিজ্ঞা করিলেন যে, যত শীঘ্র পারেন তাঁহারা কৌরবদিগকে মারিয়া পাণ্ডবদিগকে রাজা করিবেন। তাঁহারা তখনই যুদ্ধ আরম্ভ করিতে প্রস্তুত ছিলেন, কৃষ্ণ অনেক বলিয়া কহিয়া তাঁহাদিগকে থামাইয়া রাখিলেন। কারণ, পাণ্ডবেরা নিজের কথামত বনবাস শেষ না করিয়া কিছুতেই রাজ্য লইতে সম্মত হইতেন না৷

 এইরূপে তীর্থ দেখিতে দেখিতে ক্রমে তাঁহারা কৈলাস পর্বতে নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। এ-সকল স্থান অতি ভয়ানক। একে তো পর্বতের উপর দিয়া চলাই খুব কঠিন, তাহাতে আবার যক্ষ রাক্ষসেরা ক্রমাগত সেখানে পাহারা দেয়। সুতরাং ভয়ের কথাই বটে, এ সময়ে ভীম সকলকে সাহস দিয়া বলিলেন, “ভয় কি? চলিতে না পারিলে আমি পিঠে করিয়া লইব৷”

 পাণ্ডবেরা গন্ধমাদন পর্বতে উঠিবামাত্র ভয়ানক ঝড় উপস্থিত হইল। ঘোরতর গর্জনে হাওয়া চলিয়াছে পাথর ছুটিয়া আসিতেছে, চারিদিক অন্ধকার, প্রাণ থাকে কি যায। ভীম অনেক কষ্টে দ্রৌপদীকে লইয়া একটা গাছ ধরিয়া রহিলেন। অন্যেরাও কেহ গাছ ধরিয়া, কেহ উইটিপি আঁকড়াইয়া, কেহ-বা গুহার ভিতর ঢুকিয়া প্রাণ বাঁচাইলেন। এত শ্রম আর কষ্টের পর দ্রৌপদীর আর চলিবার শক্তি রহিল না। তাহার দুঃখে অন্য সকলেরও দুঃখের একশেষ হইল। তখন ভীম মনে মনে ঘটোৎকচকে ডাকিলেন। ডাকিবামাত্র ঘটোৎকচ অনেক রাক্ষস-সহ আসিয়া বলিল, “বাবা! কেন ডাকিতেছ? কি করিতে হইবে?”

 ভীম বলিলেন, “বাছা! দ্রৌপদী চলিতে পারিতেছেন না, তাঁহাকে বহিয়া লইয়া চল৷”

 ঘটোৎকচ তখনই দ্রৌপদীকে আর তাহার সঙ্গের রাক্ষসেরা অন্য সকলকে কাঁধে লইয়া চলিল। ইহাদের সাহায্য না পাইলে পাণ্ডবদিগের খুবই কষ্ট হইত, তাহাতে সন্দেহ নাই। উহারা তাঁহাদিগকে অনেক কঠিন স্থান পার করিয়া বদরী নামক তীর্থে পৌছাইয়া দিল। এই স্থানের নিকট হইতেই অর্জুন স্বর্গে গিয়াছিলেন, আর এখানেই তাঁহার ফিরিয়া আসিবার কথা। সুতরাং পাণ্ডবেরা এইখানে তাঁহার জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলেন৷

 ইহার মধ্যে একদিন কোথা হইতে এক আশ্চর্য পদ্মফুল আসিয়া দ্রৌপদীর নিকট পড়িল। সে ফুলের এমনি চমৎকার গন্ধ যে তাহা নাকে ঢুকিবামাত্র প্রাণ ঠাণ্ডা হইয়া যায়। দ্রৌপদী ফুলটি পাইয়া ভীমকে বলিলেন, “কি চমৎকার ফুল। আমাকে এইরূপ আরো অনেকগুলি ফুল আনিয়া দিতে হইবে। আমি কাম্যক বনে লইয়া যাইব৷”

 এ কথায় ভীম আহ্বাদের সহিত তখনই ফুল আনিতে চলিলেন, ফুলটি ঈশান কোন (অর্থাৎ উত্তর-পূর্ব কোণ) হইতে হাওয়ায় উড়িয়া আসিয়াছিল সুতরাং ভীম বুঝিতে পারিলেন যে, ঐদিকে গেলে আরো ফুল পাওয়া যাইবে। সেদিকে অনেক দূর গিয়া তিনি একটা প্রকাণ্ড সরোবরে উপস্থিত হইলেন। সরোবরে স্নান করিয়া তিনি আবার ফুলের খোঁজে চলিয়াছেন, এমন সময় দেখিলেন যে মস্ত একটা বানর তাঁহার পথের উপরে শুইয়া আছে৷

 বানরটাকে তাড়াইবার জন্য ভীম সিংহনাদ করিতে লাগিলেন, কিন্তু বানর তাহা বড়-একটা গ্রাহ্য করিল না। সে খালি একটু মিটিমিটি চাহিয়া বলিল, “আহা! এমন চ্যাঁচাইও না, একটু ঘুমাইতে দাও, আমার অসুখ করিয়াছে৷”

 ভীম বলিলেন, “আমি পাণ্ডুর পুত্র। লোকে আমাকে পবনের পুত্রও বলে। আমার নাম ভীম। তুমি কে?”

 বানর একটু হাসিয়া বলিল, “আমি বানর৷”

 ভীম বলিলেন, “পথ ছাড় নহিলে সাজা পাইবে৷”

 বানর বলিল, “বড় অসুখ করিযাছে উঠিতে পারি না। আমাকে ডিঙ্গাইয়া চলিয়া যাও৷”

 ভীম বলিলেন, “সকল প্রাণীর শরীরেই ভগবান আছে, তোমাকে ডিঙ্গাইলে তাঁহার অমান্য করা হইবে। আমি তাহা পারিব না৷”

 বানর বলিল, “বুড়া হইযাছি, উঠিতে পাবি না। আমার লেজটা সরাইয়া পাশ দিয়া চলিয়া যাও৷”

 ভীম মনে মনে বলিলেন, ‘বটে! আচ্ছা দাঁড়াও, এই লেজ ধরিয়া তোমাকে ধোপার কাপড় কাচা দেখাইতেছি৷’

 এই মনে কবিযা তিনি বাঁ হাতে বানরের লেজ ধরিলেন, কিন্তু তাহা নাড়িতে পারিলেন না! তারপর দু হাতে ধরিযা টানিলেন, তবুও নাড়িতে পারিলেন না। প্রাণপণ করিয়া টানিলেন, তাঁহার চোখ বাহির হইয়া আসিবার গতিক হইল, ভ্রু আব কপাল ভয়ানক কোঁচকাইয়া গেল, মুখ কালো হইয়া উঠিল, গা দিয়া ঘাম ঝরিতে লাগিল—তবুও লেজ নড়িল না। তখন তিনি নিতান্ত লজ্জিত হইযা জোড়হাতে বলিলেন, “মহাশয়, আমার অপ্রাধ হইয়াছে আমাকে ক্ষমা করুন। আপনি কে?”

 বানর বলিল, “আমি পবন পুত্র, আমার নাম হনুমান৷”

 তখন ভীম তাড়াতাড়ি হনুমানের পায়ের ধূলা লইতে পারিলে বাঁচেন। হনুমান বড় ভাই, ভীম ছোট ভাই, কাজেই দুজনে দুজনকে দেখিয়া যার পরনাই আনন্দিত হইলেন। ভীম বলিলেন, “দাদা শুনিয়াছি সমুদ্র পার হইবাব সময় আপনার বড় ভয়ংকর চেহারা হইয়াছিল। সেই চেহারটি আমি একবার দেখিতে চাই৷”

 হনুমান বলিলেন, “ভাই, ও চেহাবা দেখিয়া কাজ নাই, তুমি ভয় পাইবে৷”

 কিন্তু ভীম ছাড়িবেন কেন? তাঁহার যে বীর বলিয়া বেশ একটু অহংকার আছে। কাজেই শেষটা হনুমানকে সেই চেহারা দেখাইতে হইল।

 কি ভয়ংকর বিশাল চেহারা! কোথায়-বা তাহার মাথা, কোথায় বা তাহার লেজ। সে শরীর বন ছড়াইয়া, পর্বত ছাড়াইয়া আকাশ পর্যন্ত ঢাকিয়া ফেলিল। জ্বলন্ত সোনার মতো তাহার তেজে ভীমের চক্ষু আপনা হইতেই বুজিয়া আসিল। তাহা দেখিয়া হনুমান বলিলেন, “আর কাজ নাই, তাহা হইলে ভয় পাইবে৷”

 ভীম বলিলেন, “সত্যি দাদা, আমি আর তাকাইতে পারিতেছি না। এখন ওটাকে গুটাইয়া লউন৷”

 তখন হনুমান তাঁহার শরীর ছোট করিয়া ভীমের সহিত কোলাকুলি করিলেন, তারপর বলিলেন, “ভাই ঘরে যাও। দরকার হইলে আমাকে ডাকিও, আমি উপস্থিত হইব। যুদ্ধের সময় তুমি সিংহনাদ করিলে আমি তাহা বাড়াইয়া দিব, আর অর্জুনের রথের চূড়ায় বসিয়া এমন চিৎকার করিব যে, তাহাতেই শত্রু আধমরা হইয়া যাইবে৷”

 হনুমান ভীমকে এই কথা বলিয়া, আর তাঁহাকে পদ্মফুলের সন্ধান বলিয়া দিয়া সেখান হইতে চলিয়া গেলেন৷

 কৈলাস পর্বতের উপরে কুবেরের সরোবরে এই ফুল ফোটে। ফুলগুলি সোনার, তাহার বোঁটা বৈদূর্যমণির, আর তাহার গন্ধের কথা তো পূর্বেই বলিয়াছি। কুবেরের শত শত রাক্ষস প্রত্নী সরোবরে পাহারা দেয়। ইহারা ভীমকে নিষেধ করিয়া বলিল, “হারে ই কিমন লোক বটেক? কুবের্‌র্ মহারাজ্জকু বলিলেক্ নি, পুচ্ছিলেক্ নি, আউ ফুল লেবেকে চলিলেক্৷’

 ভীম বলিলেন, “কোথায় তোদের কুবের মহারাজ, যে তাহার নিকট জিজ্ঞাসা করিব? আমার নাম ভীম, পাণ্ডুর পুত্র। আমরা ক্ষত্রিয় কাহাকেও জিজ্ঞাসা করিয়া কাজ করি না। পাহাড়ের উপরে ফুল ফুটিয়াছে তাহা তোদের কুবেরের যেমন, আমারও তেমনি, জিজ্ঞাসা আবার কাহাকে করিব?”

 এই বলিয়া ভীম জলে নামিলেন। আর রাক্ষসেরাও অমনি “ধর! মার! কাট! বাঁধ! খা!” বলিতে বলিতে তোমর পট্টিশ হাতে দাঁত কড়মড়াইয়া তাঁহাকে আক্রমণ করিল। কিন্তু ভীমের গদা যে কেমন জিনিস তাহা তাহারা জানিত না! সেই গদা ঘুরাইয়া ভীম যখন নিমেষের মধ্যে একশোটা রাক্ষসের মাথা ফাটাইয়া ফেলিলেন, তখন আরগুলি অস্ত্র-শস্ত্র ফেলিয়া চ্যাঁচাইতে চ্যাঁচাইতে উধর্বশ্বাসে কুবেরের কাছে গিয়া উপস্থিত হইল। কুবের তাহাদের নিকট সকল কথা শুনিয়া বলিলেন, “আমি জানি, ভীম দ্রৌপদীর জন্য ফুল নিতে আসিয়াছে। উহার যত ইচ্ছা ফুল লইয়া যাইতে দাও৷”

 সুতরাং রাক্ষসেরা আর ভীমকে বাধা দিল না, তিনি সাধ মিটাইয়া ফুল লইলেন৷

 এদিকে পাণ্ডবেরা ভীমের বিলম্ব দেখিয়া তাহাকে খুঁজিতে খুঁজিতে ঘটোৎকচের সাহায্যে সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। কুবেরের কথায় কিছুদিন তাঁহাদিগকে সেই স্থানে থাকিতে হইল। তারপর সেখান হইতে বিদায় লইয়া আবার বদরিকাশ্রমে আসিয়া তাহারা অর্জুনের অপেক্ষা করিতে লাগিলেন৷

 এই সময়ে ভীম আর-একটা রাক্ষস মারেন। এটার নাম জটাসুর। হতভাগা এমনি চমৎকার ব্রাহ্মণ সাজিয়া আসিয়াছিল যে, পাণ্ডবেরা তাহাকে রাক্ষস বলিয়া চিনিতেই পারেন নাই। তাঁহারা তাহাকে ব্রাহ্মণ মনে করিয়া আদরের সহিত সঙ্গে রাখিয়াছেন, আর ইহার মধ্যে দুষ্ট কোন্ সুযোগে একদিন যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব আর দ্রৌপদীকে লইয়া ছুট দিয়াছে। তাহার সাজাটাও ভীমের হাতে সে তেমনি করিয়া পাইল!

 তারপর ক্রমে অর্জুনের ফিরিবার সময় কাছে আসিলে, পাণ্ডবেরা আবার গন্ধমাদন পর্বতে যান। ইহার কিছুদিন পরেই ইন্দ্রের রথে চড়িয়া অৰ্জুন স্বর্গ হইতে তাঁহাদের নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। অর্জুনকে পাইয়া পাণ্ডবদের এবং দ্রৌপদীর সুখের সীমা রহিল না৷

 ইহার পরে আবার পাণ্ডবেরা কাম্যক বনে ফিরিয়া আসিলেন। ফিরিবার সময় অবশ্য পথে অনেক ঘটনা হইয়াছিল, কিন্তু তাহার কথা বিশেষ করিয়া বলিবার দরকার নাই। কেবল ভীম একটা সাপের মুখে পড়িয়া কিরূপে নাকাল হইয়াছিল, তাহা একটু শুন৷

 বদরিকাশ্রম হইতে যাত্রা করিয়া কিছুদিন পরে পাণ্ডবেরা সুবাহু নামক এক কিরাত রাজার দেশে আসিয়া উপস্থিত হন। এই স্থানে যামুন নামক একটা পর্বত আছে, তাহার কাছে বনের ভিতরে নানারকম শিকার মিলে। ভীম খুবই উৎসাহের সহিত শিকার করিয়া বেড়ান। ইহার মধ্যে একদিন এক ভয়ংকর সাপ তাঁহাকে ধরিয়া বসিয়াছে। ধরিবামাত্রই ভীমের বল সাহস সব কোথায় যেন চলিয়া গেল, তিনি কিছুতেই সাপের বাঁধন এড়াইতে পারিলেন না৷

 সাপটা আবার মানুষেব মতো কথা কয়। সে বলিল যে বহুকাল পূর্বে পাণ্ডবদেরই বংশে সে নহুস নামে রাজা ছিল, অগস্ত্য মুনির শাপে এখন সাপ হইয়াছে। ভীমের পরিচয় পাইয়া সে বলিল, “দেখিতেছি, তুমি আমারই বংশের লোক। কিন্তু তথাপি তোমাকে না খাইয়া থাকিতে পারিতেছি না৷”

 ভীমের বড় ভাগ্য যে, সেই সময়ে যুধিষ্ঠির তাঁহাকে খুঁজিতে খুঁজিতে সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ভীমের দশা দেখিয়া তো তিনি একেবারে অবাক। তিনি তাঁহাকে ছাড়িয়া দিবার জন্য সাপকে অনেক মিনতি করিলেন, কিন্তু সে তাহাতে রাজি হইল না। শেষে যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হইলে তুমি ভীমকে ছাড়িতে পার?”

 সাপ বলিল, “আমার কথার উত্তর দিতে পার তো ইহাকে ছাড়িয়া দিই, কেননা, তাহা হইলে আমার শাপ দূর হইবে৷”

 যুধিষ্ঠির তাহাতেই সম্মত হইলেন। কিন্তু সে সর্বনেশে সাপ আবার এমনি ভয়ানক পণ্ডিত যে ব্রহ্মাণ্ডের যত উৎকট প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া সে যুধিষ্ঠিরকে ব্যস্ত করিয়া তুলিল। যাহা হউক, সে তাঁহাকে ঠকাইতে পারিল না। শেষে খুশি হইয়া বলিল, “তোমার বিদ্যা দেখিয়া আমি খুব সন্তুষ্ট হইয়াছি, সুতরাং তোমার ভাইকে খাইব না৷”

 বাস্তবিক যুধিষ্ঠির না আসিলে সেদিন সাপের হাতে পড়িয়া নিশ্চয় ভীমের প্রাণ যাইত৷

 পাণ্ডবেরা কাম্যক বন হইতে দ্বৈত বনে গিয়া একটি সুন্দর সরোবরের ধারে এক কুঁড়ে ঘরে বাস করিতে লাগিলেন। ইহার মধ্যে কি এক ঘটনা হইল শুন। দুষ্ট লোকেরা সাধুদিগকে কেবল ক্লেশ দিয়াই সন্তুষ্ট হয় না, ক্লেশটা কেমন হইতেছে, তাহা আবার দেখিতে চাহে। পাণ্ডবেরা নিতান্ত কষ্টে বনবাস করিতেছেন, এ কথা দুর্যোধন প্রভৃতিরা শোনেন, আর তাঁঁহাদের খালি দুঃখ হয়, আহা উহারা কেমন কষ্ট পাইতেছে, তাহার তামাশাটা একবার দেখিতে পাইলাম না, আর আমাদের জাঁকজমকটাও উহাদিগকে দেখাইতে পারিলাম না। যতই তাঁহারা এ কথা ভাবেন, ততই তাঁহাদের মনে হয় যে, এ কাজটা না করিলেই চলিতেছে না। কিন্তু তাহা কেমন করিয়া হইতে পারে? ধৃতরাষ্ট্র কি সহজে তাঁহাদিগকে দ্বৈত বনে যাইতে দিবেন?

 অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া শেষে তাঁহারা ইহার এক উপায় স্থির করিলেন। দ্বৈত বনে দুর্যোধনের অনেক গোয়ালা প্রজা বাস করে, রাজার গোরু-বাছুর রাখার ভার তাহাদের উপরে। এ সকল গোরুর খবর নেওয়া রাজার একটা কাজ, সুতরাং এই কাজের ছল করিয়া দুর্যোধন দ্বৈত বনে যাইতে চাহিলে ধৃতরাষ্ট্রের অমত হইবে না৷

 এই প্রস্তাব শুনিয়া ধৃতরাষ্ট্র প্রথমে বলিলেন, “ওখানে গিয়া কাজ নাই। ওখানে পাণ্ডবেরা আছেন, কি জানি, যদি কোনো কথায় তাঁহাদের সহিত ঝগড়া হয়৷”

 এ কথায় শকুনি বলিলেন, “রাম রাম! আমরা কি তাহাদের কাছে যাইব? আমরা গোরু দেখিয়া আর দুরে দুরে একটু শিকার করিয়াই চলিয়া আসিব উঁহাদের সঙ্গে আমাদের দেখাই হইবে না৷”

 কাজেই ধৃতরাষ্ট্র শেষে রাজি হইলেন। হুকুম পাওয়ামাত্র হাতি ঘোড়া, লোকজন, সৈন্য-সামন্ত, সাজিয়া প্রস্তুত। একলক্ষ গোরু দেখিতে হইবে, তাহার জন্য দশলক্ষ লোক পৃথিবী কাঁপাইয়া দ্বৈত বনে যাত্রা করিল। রাজপুত্রেরা নিজে গিয়া সন্তুষ্ট হইলেন না, আবার পরিবারদিগকেও সঙ্গে লইয়া চলিলেন৷

 গোরু দেখার কাজ দেখিতে দেখিতেই শেষ হইয়া গেল, শিকারেও খুব বেশি সময় লাগিল না। তারপর ক্রমে তাঁহারা সেই সরোবরের কাছে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, যাহার ধারে পাণ্ডবদিগের আশ্রম। সে সময়ে সেই সরোবরে গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন সপরিবারে স্নান করিতে আসিয়াছিলেন। তাঁহার সঙ্গের মেয়েদের স্নানের সুবিধার জন্য সরোবরটিকে বেড়া দিয়া ঘেরা হইয়াছিল৷

 গন্ধর্বের দরোয়ানেরা দুর্যোধনের লোকদিগকে সরোবরে যাইতে নিষেধ করে, দুর্যোধন আবার তাহা শুনিয়া গন্ধবদিগকে তাড়াইয়া দিবার হুকুম দেন। এইরূপে ক্রমে দুই দলে গালাগালি হইয়া শেষে ভয়ানক যুদ্ধ উপস্থিত হইল৷

 কৌরবদের সাহস খুব ছিল, আর কর্ণ, দুর্যোধন ইহারা যোদ্ধাও কম ছিলেন না, কাজেই প্রথমে তাঁহারা গন্ধর্বের লোকদিগকে বেশ একটু জব্দই করিয়া তোলেন। কিন্তু তারপর যখন চিত্রসেন নিজে অসংখ্য গন্ধর্ব লইয়া ক্রোধভরে যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন, তখন কৌরবদের আর দুর্দশার সীমাই রহিল না। সৈন্যেরা তো প্রাণপণে তাহাদের মা বাপের নাম লইয়া উধর্বশাসে ছুট দিলই, এমন যে কর্ণ, তিনিও শেষে আর দুর্যোধনের দিকে না চাহিয়াই তাহাদের পিছু পিছু পলায়ন করিলেন৷

 আর দুর্যোধন? সে লজ্জার কথা আর কি বলিব? গন্ধর্বেরা তাঁহাকে আর তাহার ভাইদিগকে তাদের সমস্ত জাঁকজমক সুদ্ধ সপরিবারে বাধিয়া লইয়া চলিল৷

 এদিকে যাহারা পলাইয়াছিল, তাহারা কাঁদিতে কাঁদিতে পাণ্ডবদিগের নিকট আসিয়া দুর্যোধনের দুর্দশার কথা জানাইল। তাহাদের কথা শুনিয়া ভীম বলিলেন, “বাঃ! আমরা অনেক কষ্টে যায় করিতাম, গন্ধর্বেরাই আজ আমাদের সে কাজ করিয়া দিল। যেমন দুষ্ট তাদের তেমনি সাজা হইয়াছে৷”

 যুধিষ্ঠির তখন একটা যজ্ঞ করিতেছিলেন। ভীমের কথা শুনিয়া তিনি বলিলেন, “ছি, ভীম! এমন সময় কি এরূপ কথা বলিতে আছে? উহাদের অপমান হইলে তো আমাদেরই বংশের অপমান। তাহা ছড়া উহারা এখন আমাদের আশ্রয় চাহিতেছে। তুমি, অর্জুন, নকুল আর সহদেব শীঘ্র গিয়া উহদিগকে এড়াইয়া আন। আমি যজ্ঞে ব্যস্ত আছি নহিলে আমি নিজে যাইতাম৷” কাজেই তখন অর্জুন, নকুল আর সহদেব ছুটিয়া চলিলেন৷

 তাঁহারা প্রথমে মিষ্টকথায় গান্ধর্বদিগকে বুঝাইতে চেষ্টা করেন। গন্ধর্বেরা তাহা না শুনাতে যুদ্ধ আরম্ভ হইল, আর অর্জুনের সহিত খানিক যুদ্ধ করিয়া তাহাদের এমনি দুর্দশা হইল যে, বেচারাদের টিকিবারও সাধ্য নাই, পলাইবারও পথ নাই, মাটি ছাড়িয়া আকাশে উঠিয়াও স্থির হইবার জো নাই। ইহা দেখিয়া তাহাদের রাজা বিষম রাগে যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। কিন্তু অর্জুনের কাছে বলিলেন, “অর্জুন! আমি যে তোমার বন্ধু চিত্রসেন৷”

 তখন অর্জুন দেখেন সত্যিই তো, এ যে চিত্রসেন—সেই স্বর্গে যাঁহার নিকট গান বাজনা শিখিয়াছিলেন। অমনি যুদ্ধ ঘড়িয়া দুই বন্ধুতে কোলাকুলি আরম্ভ হইল৷

 তারপর অর্জুন বলিলেন, “একি বন্ধু কৌরবদিগকে কেন বাঁধিয়া আনিলে?”

 চিত্রসেন বলিলেন, “হতভাগারা তোমাদিগকে অপমান করিতে আসিয়াছিল, তাই ইন্দ্রের কথায় ইহাদিগকে বাধিয়া দেওয়া হয়৷”

 অর্জুন বলিলেন, “তাহা হইবে না! দুর্যোধন আমাদের ভাই, যুধিষ্ঠিরের নিতান্ত ইচ্ছা, ইহাদিগকে ছাড়িয়া দেওয়া হয়৷”

 চিত্রসেন বলিলেন, “এমন দুষ্টকে কখনই ছাড়া উচিত নহে! চল আমরা গিয়া যুধিষ্ঠিরকে সকল কথা বলি, তারপর তিনি যাহা বলেন, তাহাই হইবে৷”

 যুধিষ্ঠির যে উহাদিগকে ছাড়িয়া দিলেন, তাহা বোধহয় আর না বলিলেও চলে। তাঁহাদের দুষ্টবুদ্ধির কথা শুনিয়া তিনি কেবল বলিলেন, “ভাই আর কখনো এমন সাহস করিও না, এখন সুখে বাড়ি যাও৷”

 হায় রে মহারাজ দুর্যোধন! যে পাণ্ডবদিগকে জব্দ করিবার জন্য এত জাঁকজমকের সহিত আসিলেন, এখন সেই পাণ্ডবদের কৃপায় প্রাণ লইয়া তিনি চোরের মতন ঘরে ফিরিতেছে। আর ঘরে ফিরিবেনই-বা কোন্ মুখে? তাহার চেয়ে বরং মৃত্যুই তাহার ভালো বোধ হইল। সঙ্গের লোকদিগকে তিনি বলিলেন, ‘আমার আর বাঁচিয়া কাজ কি? তোমরা ঘরে যাও, দুঃশাসন রাজা হউক, আমি এইখানেই পড়িয়া মরিব।’

 দুঃশাসন তাঁহার পায়ে ধরিয়া কাঁদিতে লাগিলেন, কর্ণ আর শকুনি তাঁহাকে বুঝাইয়া বলিলেন, ‘সে কি দুর্যোধন, তোমার কিসের লজ্জা? পাণ্ডবেরা তোমার রাজ্যে বাস করে, কাজেই তাহারা তোমার প্রজা, সুতরাং আপদ-বিপদে তোমাকে রক্ষা করা তো তাহাদের কাজ হইল! ইহাতে তাহাদেরই বাহাদুরী কি, আর তোমারই-বা লজ্জার কথা কি?’

 তবুও সহজে দুর্যোধন শান্ত হইতে পারেন নাই। তাঁহাকে বুঝাইতে দুটি দিন লাগিয়াছিল৷

 দুষ্টলোকের সাজা হয়, কিন্তু তাহাতে তাহার শিক্ষা হয় না। দুর্যোধন কোথায় ইহার পর হইতে পাণ্ডবদিগের সহিত ভালো ব্যবহার করিবেন, না তাঁহার হিংসা আরো বাড়িয়া চলিল৷

 ইহার মধ্যে একদিন দুর্বাশা মুনি দশহাজার শিষ্য সমেত হস্তিনায় আসিলেন। এমন বিষম বদরাগী সর্বনেশে মানুষ এই পৃথিবীতে আর জন্মায় নাই। কথায় কথায় তিনি যাহাকে তাহাকে শাপ দিয়া বসেন! রাত দুপুর হউক না কেন, ‘খাইব’ বলিতেই খাবার আনিয়া উপস্থিত করিতে না পারিলে নিশ্চয় শাপ দিয়া ভস্ম করিবেন। আবার তাড়াতাড়ি আনিতে পারিলে হয়তো বলিবেন, ‘খাইব না। সঙ্গে সঙ্গে দুটা গালি দেওয়াও আশ্চর্য নহে৷’

 দুর্যোধন প্রাণপণে এই দুর্বাশা মুনির সেবা করিয়া তাঁহাকে যারপরনাই খুশি করিয়া ফেলিলেন। দুর্বাশা বলিলেন, ‘আমি বড়ই সন্তুষ্ট হইয়াছি, তুমি কি চাহ?’  দুর্যোধন বলিলেন ‘আপনি যদি দয়া করিয়া একটিবার দ্রৌপদীর খাওয়া শেষ হইবার পব, আপনার এই দশহাজাব শিষ্য লইযা পাণ্ডবদিগের আশ্রমে আহাব কবিতে যান, তবেই আমার ঢেব হয়, আমি আর কিছু চাহি না৷’

 দুর্বাশা বলিলেন ‘আচ্ছা, আমি অবশ্য যাইব৷’

 এই বলিযা দুর্বাশা চলিযা গেলেন আব দুর্যোধনও এই ভাবিয়া বড়ই আনন্দিত হইলেন যে, ‘দ্রৌপদীব খাওয়া শেষ হইলে আর পাণ্ডবেরা দুর্বাশাকে খাইতে দিতে পাবিবে না, সুতং মুনি ৩াঁহাদিগকে শাপ দিযা ভস্ম কবিবেন৷’

 ইহাব পব একদিন সত্যসত্য দুবাশা গিয়া গণ্ডবদিগেব আশ্রমে উপস্থিত হইযাছেন। তখন দ্রৌপদীব খাওয়া শেষ হইয়া গিয়াছে, থালায আব খাবাব নাই। সে যাত্রা কৃষ্ণ পাণ্ডবদিগকে বক্ষা ন করিলে তাহাদের বড়ই বিপদ হইত। একজনেবও ভাত নাই, অথচ দশহাজাব শিষ্য লইয়া মুনি উপস্থিত। এখন উপায়? যুধিষ্ঠিব তাঁহাদিগকে স্নান-আহ্নিক কৰিবাব জণ গঙ্গায় পাঠ'ইয়া দিলে অব দ্রৗপদী মাথায় হাত দিয়া ভাবিতে লাগিলেন, ‘হায় হায়’ স্নান কবিয়া আসিলে ইহাদিগকে কি খাওযাইব?

 উপায় না দেখিয়া দ্রৌপদী মনে মনে কৃষ্ণকে ডাকিলেন। কৃষ্ণ সাধারণ মানুষ নহে, তিনি দেবতা, কাজেই দ্রৌপদীর দুঃখের কথা জানিতে পারি সেই মুহূতেই উপস্থিত হইলেন। কৃষ্ণ আসিয়াই বলিলেন, ‘দ্রৌপদী, বড় ক্ষুধা হইয়াছে, কিছু খাইতে দাও।’

 দ্রৌপদী লজ্জিত হইয়া বলিলেন, ‘থালায় তো কিছুই নাই, কি খাইতে দিব।’

 কৃষ্ণ বলিলেন, ‘অবশ্য, কিছু আছে থালাখানি আন তো।’

 কাজেই দ্রৌপদী থালা আনিয়া উপস্থিত কবিলেন। উহাব একপাশে এখনো এক কণা শক-ভাত লাগিযাছিল। কৃষ্ণ সেই এক বিন্দু শাক-ভাত মুখে দিয়া বলিলেন ‘ইহাতেই বিশ্বাত্মা তুষ্ট হউন৷’ তারপর ভীমকে বললেন, ‘মুনিদিগকে ডাক৷’

 এ সকল কথা বলিতে যত সময় লাগিল, কাজেও তাহাব চেয়ে বড় বেশি লাগে নাই মুনিবা এতক্ষণে সবে স্নান শেষ কৰিছেন ইহার মধ্যে হঠাৎ তাঁহাদেব পেট ভবিয়া গেল। সকলে আশ্চর্য হইযা মুখ চাওয়া চাওযি কবিতে লাগিলেন। পেটে আব একটি হজমিগুলিও স্থান নাই। এদিকে যুধিষ্ঠির হয়তো কত কষ্ট কবিয়া আহারের আযোজন করিয়াছে, তাহাব নিকট গিযা কি করিয়া মুখ দেখাইবেন ভাবি চিন্তিযা দুর্বাশা বলিলেন, ‘এ যাত্রা আমবা বড়ই বেল্লিক হইয়া গেলাম। এখন যুধিষ্ঠিবের নিকট যাইতে অতিশয় লজ্জাবোধ হইতেছে, চল এখান হইতেই পলায়ন কবি৷’ কাজেই বিপদ কাটিয়া গেল৷

 এই সময়ে পাণ্ডবে কাম্যক বনে বাস কবিতেছিলেন। সেখানে আর-একটা ঘটনা হয় তাহাব কথা এখন বলিতেছি৷

 দুর্যোধনের ভগিনী দুঃশলাকে যে বিবাহ কবিয়াছিল, তাহাব নাম জয়দ্রথ। এই হতভাগা একদিন অনেক সৈন্য আর বন্ধু বান্ধব লইয়া পাণ্ডবদিগেব আশ্রমের নিকট দিয়া যাইতেছিল। পাণ্ডবেরা তখন শিকাব কবিতে গিয়াছেন, দ্রৌপদীর নিকট এক ধৌম্য ছাড়া আর কেহই নাই। দ্রৌপদীকে দেখিবামাত্র জয়দ্রথ ‘কেমন আছ? সব ভালো তো?' বলিয়া তাঁহার সহিত কথাবার্তা আবম্ভ কবিল৷

 একজন ভদ্রলোক বাড়িতে আসিলে তাহাব আদব যত্ন না কবিলে নয়। কাজেই দ্রৌপদী জযদ্রথকে বসিবাব জাযগা আল পা ধুইবাব জল দিয়া বলিলেন, ‘জলযোগ কবিয়া বিশ্রাম করুন, পাণ্ডবেবা শীঘ্রই আসিবেন।’ কিন্তু জযদ্ৰথ বসিবাব জনো আসে নাই। দুষ্ট ভাবিযাছে, পাগুবেরা আসিলার পূর্বেই দ্রৌপদীকে লইয়া প্রস্থান কবিবে।

 সে প্রথমে দ্রৌপদীকে অনেক মিনতি কবিল, তারপর লোভ দেখাইল, শেষে ভব, দেখাইতে ও ছাডিল না। দ্রৌপদী বাগে, ভযে, ঘূণায ৩াহাকে গালি দিতে দিতে ধৌম্যকে ডাকিতে লাগিলেন। কিন্তু দুবাত্মা তাহা গ্রাহ্য না কবিয়া দ্রৌপদীকে টানিয়া লইয়া চলিল দ্রৌপদী তাঁহাল গায হাত দিতে বাব বাব নিষেধ কবিলেন৷ ওহি শুনিল না দেখিযা ভযানক বাগব ভবে তাহাকে টানিযা মাটিতে ফেলিযা দিলেন৷ কিন্তু সেই দসাব সহিত যুদ্ধ করা কি তাঁহাব কাজ? পাপিষ্ঠ ধৌমোব সম্মুখেই তাঁহাকে পথে তুলিয়া লইযা চলিল৷

 ধৌম্য পুরুত মানুষ তিনি আব কি কবিবেন? তিনি তাহাকে গালি দিতে দিতে বথের পিছু পিছু চলিলেন৷

 এদিকে পাণ্ডবদিগের আব শিকাব ভালো লাগিতেছে না আর ৩াঁহাদেব মনেও যে, কেমন একটা ভয় আসিযাছে – যেন তাঁহাদেব কোনো বিপদ উপস্থিত। তাঁহাবা তডিাতাড়ি আশ্রমে ফিবিযা দেখিলেন, দাসী ধাত্রেয়িকা কাঁদিতেছে। সে কাঁদিতে কাঁদিতে তাঁহাদিগকে সকল কথাই ও নাইল। পাঁচ ভাই ৩াহ শুনিয়া আর এক মুহূর্ত ও বিলম্ব কবিলেন না ।

 কোথায় সে দুবাত্মা গু আজ ৩াহাব মাথাটা না জানি কয টুকবা হয়। পাঁচ ভাই গজ, কবিতে কবিতে বথ হাঁকাইযা চলিযাছেন। কোথায় সে দুবাত্মা ? ঐ ধূলা উডিতেছে। ঐ পথে দুষ্ট পলায়ন করিতেছে। ঐ গুন ধৌম্যের গলাব শব্দ । মাব মব ! কাট, কাট। হতভাগ্যদেব একটাও বুঝি অব মাথা থাকিবে না। ইহাব মধ্যে কত সৈন। কাটা গিযাছে, তাহাব সাখ্য' নাই একটা প্রকাণ্ড হাতি শুণ্ড উঠাইযা নকুলকে মাবিতে আসিল, নকুল খডগ দিয়া তাহাব দাঁতসুদ্ধ শুণ্ড কাটিযা ফেলিলেন।

 কিন্তু দুবাত্মা জযদ্রব্থ কোথায ? ঐ দেখ পাষগু দ্রৌপদীকে ফেলিযা পলাইতেছে। যুধিষ্ঠিব দ্রৌপদ ধৌম আৰ নকুলকে বথে তুলিযা লইযাছেন। কিন্তু সেই দুবাত্মা পলাইযা গেল নাকি? কোথায যাইবে চ ভীম আব অর্জুন যাহাৰ পিছু ছুটিযাছেন তাহাব কি আব পলাইবাব জো আছে? এখনই ৩াহাবা পাপিষ্ঠেব চলেৰ মুঠি ধবিবেন। আব তাহাকে কি আস্ত বাখিবেন ?

 যুধিষ্ঠিবও ভাবিতেছেন যে, ভীমাৰ্জুনেব হাতে পড়িলে আব হ৩ ভাগা আস্ত থাকিবে না। তাই তিনি বলিতেছেন, “উহাকে মাবিও না যেন, তাহা হইলে দুঃশলাব আব জ্যাঠাইমাব বড়ই কষ্ট হইবে।”

 কিন্তু সে দুবাত্মা গেল কোথায? দুষ্ট বনেব ভিতবে লুকাইযছিল। সেইখানে গিযা ভীম তাহার চুলেব মুঠি ধবিযা তাহাকে কি আছডান আছডাইলেন। আছাড খাইযা উঠিতে না উঠিতেই আবাব তাহাব মাথায বিষম লাথি। তাবপব বুকে হাঁটু দিযা, উঃ কি ভযানক সাজা। হতভাগা চ্যাঁচাইতে চ্যাঁচাইতে শেষে অজ্ঞান হইযা গেল।

 অৰ্জুন দেখিলেন যে, জযদ্রথ মাবা যায, তাই তিনি ভীমকে তাড়াতাডি যুধিষ্ঠিবের কথা মনে কবাইয়া দিলেন। তখন ভীম তাহাকে আব মাবিলেন না বটে, কিন্তু অর্ধচন্দ্র বাণ দিযা তাহাব মাথার খানিক মুডাইযা আব পাঁচ জাযগায পাঁচটি ঝুঁটি বাখিযা তাহাকে এমনি উৎকট সঙ সাজাইলেন যে, দেখিলে বুঝিতে। তারপর তাহাকে দুই ধমক দিয়া বলিলেন, ‘খবরদার! ভুলিস না যেন—সকলের কাছে বলিবি তুই আমাদের গোলাম।’

 জয়দ্রথ কাঁপিতে কাঁপিতে তাহাতেই রাজি৷

 এইভাবে তাহাকে আনিয়া যুধিষ্ঠিরের সামনে উপস্থিত করা হইল। তাহার চেহারা দেখিয়া কি আর কেহ হাসি থামাইয়া রাখিতে পারে? যুধিষ্ঠির অবধি হাসিয়া অস্থির! ভীম বলিলেন, ‘মহারাজ, এই হতভাগা আমাদের গোলাম হইয়াছে! এখন ইহাকে ছাড়িব কিনা, দ্রৌপদীকে জিজ্ঞাসা করুন৷’

 সাজাটা যে ভালোরকমই হইয়াছে, তাহাতে আর ভুল নাই! কাজেই উহাকে ছাড়িয়া দেওয়াই মত হইল। যুধিষ্ঠির বলিলেন, যাও এমন কাজ আর করিও না৷

 সেখান হইতে বিদায় হইয়াই জয়দ্রথ শিবের তপস্যা আরম্ভ করিল। তপস্যায় তুষ্ট হইয়া যখন শিব বর দিতে আসিলেন তখন সে বলিল, ‘আমি পাঁচ পাণ্ডবকে যুদ্ধে পরাজয় করিব৷’

 শিব বলিলেন, ‘তুমি চারিজনকে পরাজয় করিবে, কিন্তু অর্জুনকে পারিবে না। অর্জুনকে পরাজয় করিবার শক্তি দেবতাদিগেরও নাই।’ এই বলিয়া শিব চলিয়া গেলেন, জয়দ্রথ বাড়ি ফিরিল৷

 এই সময়ে আর-একটা ঘটনা ঘটে। কর্ণ কেমন বীর ছিলেন, তাহা শুনিয়াছ। কর্ণ কানে অতি আশ্চর্য কুণ্ডল আর শরীরে কবচ (বর্ম) লইয়া জন্মগ্রহণ করেন। এই কুণ্ডল আর কবচ শরীরে থাকিতে তাঁহাকে মারিবার ক্ষমতা কাহারো ছিল না। অর্জুনকে ইন্দ্র বিশেষ স্নেহ করিতেন, আর কর্ণের সহিত যুদ্ধ উপস্থিত হইলে তাঁহার বড়ই বিপদের আশংকা দেখিয়া দুঃখিত থাকিতেন। তাই তিনি ভাবিলেন, এই কুণ্ডল আর কবচ লইয়া আসিব৷

 কর্ণ গঙ্গায় স্নান করিয়া সূর্যের স্তব করিতেন। সে সময়ে কেহ তাঁহার নিকট কিছু চাহিলে, তিনি তাহাকে ফিরাইতেন না, এই তাঁহার নিয়ম ছিল। একদিন ঠিক এইরূপ সময়ে, ইন্দ্র ব্রাহ্মণের বেশে তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলেন৷

 ইন্দ্র যে কর্ণকে ফাঁকি দিয়া কুণ্ডল আর কবচ আনিতে যাইবেন, এ কথা সূর্যদেব আগেই জানিতে পারিয়া কর্ণকে সাবধান করিয়া দেন, আর উহা দিতে নিষেধ করেন। কিন্তু কর্ণ কখনো নিয়ম ভঙ্গ করিতেন না, কাজেই তিনি বলিলেন, আমার যখন নিয়ম আছে, তখন না দিয়া পারিব না৷

 এ কথায় সূর্য বলিলেন, তাহাই যদি হয়, তবে কুণ্ডল আর কবচের বদলে ইন্দ্রের নিকট হইতে ‘এক পুরুষ-ঘাতিনী’ নামক শক্তি চাহিয়া লইবে৷

 কর্ণ প্রথমে ইন্দ্রকে সামান্য ব্রাহ্মণ মনে করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ঠাকুর, আপনার কি চাই?”

 ব্রাহ্মণ বলিলেন, ‘তোমার ঐ কুণ্ডল আর কবচ আমাকে দাও।’

 কর্ণ কুণ্ডল আর কবচের বদলে কত কিছু দিতে চাহিলেন—ধনরত্ন, গোরু বাছুর, এমন-কি, রাজ্যের কথা পর্যন্ত বাকি রাখিলেন না। ব্রাহ্মণ কি তাহা শোনে? তিনি কেবলই বলেন, ‘আমার ঐ কুণ্ডল আর কবচটি চাই৷’

 তখন কর্ণ বুঝিতে পারিলেন, এ ব্রাহ্মণ যে-সে ব্রাহ্মণ নহে স্বয় ইন্দ্র। কাজেই তিনি বলিলেন, ‘আমি যদি কুণ্ডল আর কবচ দিই তাহা হইলে আমাকে আপনার ‘এক পুরুষ ঘাতিনী’ শক্তি দিতে হইবে৷

 ইন্দ্র বলিলেন, ‘আচ্ছা তাহাই হউক। এই আমার ‘এক-পুরুষ-ঘাতিনী’ শক্তি তোমাকে দিতেছি, কিন্তু ইহার একটা নিয়ম আছে। যেখানে আর কোনো অস্ত্রেই কাজ হইবার নহে, কেবল সেই স্থলেই এ অস্ত্র ছুঁড়িলে নিশ্চয় মৃত্যু। যেখানে-সেখানে ছুঁড়িয়া বসিলে ইহা তোমারই গায়ে পড়িবে। এ অস্ত্রে এক জনের বেশি লোক মরে না। সেই একজন শত্রু যত বড় যোদ্ধাই হউক, তাহাকে মারিয়া আমার শক্তি আমার নিকটে চলিয়া আসিবে৷

 কর্ণ তাহাতেই রাজি হইয়া ইন্দ্রের নিকট হইতে শক্তি লইলেন, এবং নিজের কুণ্ডল আর কবচ তাঁহাকে খুলিয়া দিলেন৷

 ইন্দ্র কর্ণের কুণ্ডল আর কবচ লইয়া গিয়াছে, এ কথা শুনিয়া দুর্যোধনের দলের যেমন দুঃখ হইল, পাণ্ডবেরা তেমনই আনন্দ পাইলেন৷

 এই সময়ে পাণ্ডবেরা কাম্যক বন হইতে দ্বৈত বনে চলিয়া আসেন। ইহার কিছুদিন পরে একটি অতি আশ্চর্য ঘটনা হইয়াছিল৷

 কাঠে কাঠে ঘষিলে আগুন বাহির হয়। এই উপায়ে পূর্বকালের মুনি-ঋষিরা অনেক সময় আগুন জ্বালিতেন। যাহাদের গৃহে প্রত্যহ অগ্নির পূজা হইত, তাঁহাদের যখন-তখন আগুনে জ্বালিবার একটা ব্যবস্থা না রাখিলেই চলিত না। তাঁহাদের সকলেরই ‘অরণী’ নামক দুখানি কাঠ থাকিত। এই কাঠ দুখানি ঘষিয়া তাঁহারা আগুনে জ্বালিতেন৷

 ইহার মধ্যে হইয়াছিল কি—দ্বৈত বনের এক তপস্বী ব্রাহ্মণ একটা গাছে তাঁহার অরণীটি কুলাইয়া রাখিয়াছিলেন। একটা হরিণ আসিয়া সেই গাছে গা ঘষিতে আরম্ভ করে। ঘষিতে ঘষিতে ব্রাহ্মণের অরণীখানি কেমন করিয়া তাহার শিঙে আটকাইয়া যায়, তাহাতে হরিণও ভয় পাইয়া সেই অরণীসুদ্ধ বেগে পলায়ন করে৷

 তখন ব্রাহ্মণটি অতিশয় ব্যস্ত হইয়া পাণ্ডবদিগকে তাঁহার অরণী আনিয়া দিতে বলায়, পাঁচ ভাই মিলিয়া সেই হরিণের পিছু পিছু তাড়া করিলেন। কিন্তু তাহাকে তাঁহারা ধরিতে বা মারিতে তো পারিলেনই না, লাভের মধ্যে এই হইল, যে, পিপাসা আর পরিশ্রমে তাহাদের প্রাণ যায়-যায়। তখন তাঁহারা বিশ্রামের জন্য একটা গাছের তলায় বসিয়া নকুলকে জল আনিতে পাঠাইলেন৷

 নিকটেই একটি জলাশয় ছিল। নকুল তাহাতে নামিয়া জল খাইতে যাইতেছে, এমন সময় এক যক্ষ আকাশ হইতে তাঁহাকে বলিল, “বাছা নকুল। ও জল আগে আমি দখল করিয়াছি। আমার কথার উত্তর দিয়া, তবে জল খাও৷”

 নকুল যক্ষের কথা গ্রাহ্য না করিয়া জল তুলিয়া মুখে দিলেন। সে জল পান করিবামাত্র তাঁহার মৃত্যু হইল৷

 এদিকে যুধিষ্ঠির নকুলের বিলম্ব দেখিয়া, সহদেবকে বলিলেন, “নকুলের কেন এত বিল হইতেছে? তুমি শীঘ্র তাহার অনুসন্ধান কর৷”

 সহদেব নকুলকে খুঁজিতে খুঁজিতে সেই জলাশয়ে উপস্থিত হইয়া তাঁহার মৃতদেহ দেখিবামাত্র কাঁদিয়া অস্থির হইলেন, তারপর ভয়ানক পিপাসা হওয়াতে, তিনিও জলাশয়ে নামিয়া জল খাইতে গেলেন। তখন সেই যক্ষ তাঁহাকেও বাধা দিয়া বলিল, “আগে আমার কথার উত্তর দাও তারপর জল খাইতে পাইবে।”

 যক্ষের সে কথা অমান্য করিয়া সহদেব যেই জল খাইলেন অমনি তাহারও মৃত্যু হইল।

 এইরূপে ক্রমে সহদেবকে খুজিতে আসিয়া, অৰ্জুন, এবং অর্জুনকে খুজিতে আসিয়া ভীম সেই যক্ষের নিষেধ আমানা করিয়া জলাশয়ের জল খাওয়ায় প্রাণত্যাগ করিলেন৷

 সর্বশেষে যুধিষ্ঠিরও তাহাদের অন্বেষণে সেই জলাশয়ের ধারে আসিয়া তাঁহাদের মৃত শরীর দর্শনে অনেক দুঃখ করার পর, জল পান করিতে উদ্যত হওয়ায়, একটা বক তাঁহাকে বাধা দিয়া বলিল, “বাছা যুধিষ্ঠির! আমিই তোমার ভাইদিগকে মারিয়াছি। আমার কথার উত্তর দিয়া তবে জল খাও।”

 বকের কথা শুনিয়া যুধিষ্ঠির বলিলেন, “এ সকল মহাবীবকে বধ করা পাখির কর্ম নহে! আপনি কে?”

 তখন সেই বক তালগাছ প্রায় বিশাল যক্ষরূপ ধরিয়া বলিল, “আমি যক্ষ । তোমার ভ্রাতারা আমার কথা অবহেলা করিয়া জল পান করাতে, তাহাদিগকে বধ করিয়াছি। তুমি আগে আমার কথায় উত্তর দিয়া, তাবপর জল খাও।”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “আপনার প্রশ্ন কি বলুন, যথাসাধ্য উত্তর দিতে চেষ্টা করিব।”

 এ কথায় যক্ষ যুধিষ্ঠিরকে অনেক প্রশ্ন করিল, যুধিষ্ঠিব তাহার সকল গুলিরই উওর দিলেন সকল প্রশ্নের কথা লিখিবার স্থান এ পুস্তকে নাই, দু-একটি কথা মাত্র বলিতেছি।

 যক্ষ জিজ্ঞাসা করিল, “পৃথিবীব চেয়ে ভারি কে? স্বগের চেয়ে উচু কে? বাতাসের চেয়েও দ্রুতগামী কে? তৃণের চেয়েও কাহার সংখ্যা বেশি?”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “মাতা পৃথিবীর চেয়ে ভারি, পিতা আকাশের চেয়ে উচ, মন বাতাসের চেয়েও দ্রতগামী, আর চিন্তার সংখ্যা তৃণের চেয়েও বেশি।"

 যক্ষ জিজ্ঞাসা করিল, “কে ঘুমাইলে চোখ বোজে না? কে জন্মিয়া ন৬ে চড়ে না? কাহার হৃদয় নাই? কে নিজের বেগেতেই বড় হয়?”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “মাছ ঘুমাইলে চোখ বোজে না, ডিম জন্মিয়া নড়ে-চড়ে না, পাথরের হৃদয় নাই, নদী নিজের বেগের দ্বারা বড় হয়৷”

 যক্ষ জিজ্ঞাসা করিল, ”সুখী কে? আশ্চর্য কি? পথ কি? সংবাদ কি?”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “যাহার ঋণ নাই, আর নিজের ঘরে থাকিয়া দিনের শেষে যে চারিটি শাক-ভাত খাইতে পায়, সেই সুখী৷ প্রতিদিন জীবের মৃত্যু হইতেছে, তথাপি যে, লোকে চিরদিন বাঁচিতে চায়, ইহাই আশ্চর্ষ৷ মহাপুরুষেবা যে পথে যান, তাহাই পথ৷ সময় যেন পাচক, সে যেন প্রাণীদিগকে দিয়া ব্যঞ্জন রাধিতেছে ইহাই সংবাদ৷”

 যুধিষ্ঠিরের উত্তরে সস্তুষ্ট হইয়া যক্ষ বলিল, “তোমার ইচ্ছামত একটি ভাইকে বাঁচাইতে পার৷”

 এ কথায় যুধিষ্ঠির বলিলেন, “তবে দয়া করিয়া নকুলকে বাঁচাইয়া দিন৷”

 যক্ষ জিজ্ঞাসা করিল, “ভীম আর অর্জুনকে ছাড়িয়া তুমি নকুলকে বাঁচাইতে বলিলে, ইহার কারণ কি?”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, "মাতা কুন্তীর এক পুত্র আমি জীবিত রহিয়াছি, এখন নকুল বাঁচিলে মাতা মাদ্রীরও একটি পুত্র থাকে, এইজন্য আমি নকুলকে বাঁচাইতে বলিয়াছি৷”

 এ কথায যক্ষ অতিশয় তুষ্ট হইয়া, ভীম, অৰ্জুন, নকুল, সহদেব চারিজনকেই বাঁচাইয়া দিল৷ তারপব সে নিজের পরিচয় দিয়া বলিল, “বাছা৷ আমি ধর্ম৷ তোমার মহত্ত্ব দেখিয়া বডই সন্তুষ্ট হইলাম, তুমি বর লও৷”

 যুধিষ্ঠির বলিলেন, “তবে সেই ব্রাহ্মণ যাহাতে তাঁহার অরণীখানি পান, তাহা করুন৷”

 ধর্ম বলিলেন, ‘তোমাকে পবীক্ষা কবিবাব জন্য আমিই হরিণ সাজিযা অরণী হরণ করিযাছিলাম, ব্রাহ্মণ তাহ পাইবেন৷ এক্ষণে তুমি অন্য বব চাহ৷’

 যুধিষ্ঠিব বলিলেন, “আমাদের বনবাসের বারো বৎসর শেষ হইয়াছে, ইহার পরে আরএক বৎসর অজ্ঞাতবাস কবিতে হইবে৷ সে সময়ে যেন কেহ আমাদিগকে চিনিতে না পারে, দয়া করিয়া এই বর দিন৷”

 ধর্ম বলিলেন, “বাছা! তোমবা ছদ্মবেশ না করিয়াও যদি পৃথিবীময় ঘুরিয়া বেড়াও, তথাপি তোমাদিগকে কেহ চিনিতে পরিবে না৷ এখন আর একটি বর চাহ৷”

 যুধিষ্ঠিব বলিলেন, “আমার যেন পাপে মতি না হয়, সর্বদা যেন ধর্মপথে চলিতে পারি৷”

 ধর্ম বলিলেন, “এ সকল তো তোমাব আছেই, এখন তাহা আরো বেশি করিয়া হইবে৷” এই বলিযা তিনি আকাশে মিলাইয়া গেলেন৷ তাহার পূর্বে ব্রাহ্মণের অরণীখানি ফিরিয়া দিতে ভুলিলে না৷

 এইরূমে পাণ্ডবদিগের বনবাসেল বাবো বৎসব কাটিয়া গেল৷ আর একটি বৎসর ভালোয়-ভালোয় কাটিলেই তাঁহাদেব দুঃখেব শেষ হয৷ কিন্তু এই শেষের বৎসরটি অতি ভয়ানক বৎসব৷ এই সময়টুকু এমনভাবে কটিাইতে হইবে, যেন কেহই তাঁহাদের খবর জানিতে না পাবে, জানিতে পাবিলে আবার বারো বৎসর বনবাস৷ এ সময়ে দুযোধনেব লোকেবা নিশ্চয়ই তাঁহাদিগকে খুঁজিযা বাহির কবিতে প্রাণপণে চেষ্টা কবিবে৷ এই-সকল ধূর্তকে ফাঁকি দিয়া,একটা বৎসর কিরূপে কাটানো যায়, সকলে মিলিয়া সাবধানে তাহার পরামর্শ করিতে লাগিলেন৷