বিষয়বস্তুতে চলুন

এপিক্‌টেটসের উপদেশ/ভয় ও অভয়

উইকিসংকলন থেকে

ভয় ও অভয়।

 ১। “কান ব্যক্তি ভীরু ও নির্ভীক একসঙ্গে উভয়ই হইতে পারে” —তত্ত্বজ্ঞানীদের এই কথাটি কাহারও কাহারও নিকট পরস্পর-বিরুদ্ধ উক্তি বলিয়া মনে হয়। ভাল, একবার আলোচনা করিয়া দেখা যাক্, ইহা আমাদের পক্ষে সম্ভব কি না। ইহা সহজেই মনে হয় বটে, যেহেতু ভয় নির্ভীকতার বিপরীত, অতএব এই দুইটি পরস্পর-বিরোধী ভাব কখনই এক সঙ্গে থাকিতে পারে না। কিন্তু অনেকেরই নিকট যাহা পরম্পরবিরুদ্ধ বলিয়া মনে হয়, আমি তাহা এইরূপ ভাবে দেখি:—

 ইতিপূর্ব্বে অনেকবার প্রতিপাদিত হইয়াছে—যে সকল বিষয় আমাদের ইচ্ছাধীন ও সাধ্যায়ত্ত তাহারই উপযুক্ত প্রয়োগের উপর আমাদের ভাল-মন্দ নির্ভর করে, যাহা আমাদের ইচ্ছাধীন ও সাধ্যায়ত্ত নহে— যাহা অনিবার্য্য—যাহা দুরতিক্রম্য, তাহা আমাদের পক্ষে ভালও নহে, মন্দও নহে”। এই কথাটি যদি সত্য হয়, তাহা হইলে যদি কোন তত্ত্বজ্ঞানী বলেন;—“যে সকল বিষয় আমাদের ইচ্ছাধীন নহে, সেই সকল বিষয়ে নির্ভীক হইবে এবং যে সকল বিষয় আমাদের ইচ্ছাধীন, সেই সকল বিষয়েই ভয় করিবে”—এই কথায় অসঙ্গতি কি আছে? যদি মন্দ ইচ্ছার উপরেই আমাদের মন্দ নির্ভর করে, তাহা হইতে শুধু সেই বিষয়েই আমাদের ভীত হওয়া উচিত; এবং যাহা আমাদিগের ইচ্ছাধীন ও সাধ্যায়ত্ত নহে, সেই বিষয়েই আমাদিগের নির্ভীক হওয়া কর্ত্তব্য। শুধু তাহা নহে, এই স্থলে আমরা ভয়ের ভাব হইতেই সাহস অর্জ্জন করিয়া থাকি; যাহা বাস্তবিক মন্দ তাহা করিতে আমরা ভয় পাই বলিয়াই যাহা মন্দ নহে তাহাতে আমরা নির্ভয় হই।

 ২। আমরা কিন্তু ইহার বিপরীতে, হরিণের ন্যায় অনর্থক ত্রস্ত হইয়া বিপদগ্রাসে পতিত হই। হরিণেরা যখন ভয় পায় এবং ভয় পাইয়া পলাইবার চেষ্টা করে, তখন তাহারা নিরাপদ স্থান মনে করিয়া কোথায় গিয়া আশ্রয় গ্রহণ করে?—ব্যাধ যে জাল পাতিয়া রাখিয়াছে সেই জালের মধ্যে। এইরূপেই তাহারা মৃত্যুগ্রাসে পতিত হয়। কারণ, তাহারা জানে না,— কোন্ স্থলে ভয় করিতে হয়, কোন স্থলে নির্ভয় হইতে হয়। আমরা না বুঝিয়া সচরাচর কোন্ বিষয়ে ভয় পাইয়া থাকি?—না, যে বিষয়টি আমাদের ইচ্ছা-শক্তির অতীত। আর বিপদের সম্ভাবনা নাই মনে করিয়া কোন্ বিষয়ে আমরা নির্ভয় হই?—না, যে বিষয় আমাদের ইচ্ছার অধীন। কোন প্রলোভনে মুগ্ধ ও বিড়ম্বিত হওয়া, কোন অবিবেচনার কাজ কিম্বা লজ্জাজনক গর্হিত কাজ করা, অথবা নীচ লোভের বশবর্ত্তী হইয়া কোন বস্তুর অনুসরণ করা—এ সমস্ত প্রকৃত ভয়ের বিষয় কি না সে-পক্ষে আমরা একবারও ভাবিয়া দেখি না। যাহা আমাদের ইচ্ছাশক্তির অতীত, সেই বিষয়েই আমাদের যত কিছু ভয়।

 যে মৃত্যু অপরিহার্য্য, যে সকল দুঃখ দুরতিক্রমণীয়, তাহা হইতেই আমরা ভয় পাই, ভয় পাইয়া পলায়নের চেষ্টা করি। আমাদের স্বাভাবিক সাহসকে আমরা অস্থানে নিয়োগ করিয়া, কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞানশূন্য হইয়া, অতি নির্লজ্জভাবে সম্পূর্ণরূপে পাপের হস্তে আত্মসমর্পণ করি এবং উহাকে ভীরুতা, নীচতা, অন্ধ-আতঙ্ক, ও দুঃখকাতরতায় পরিণত করি। যদি আমাদের ভয়ের ভাবকে ইচ্ছারাজ্যের মধ্যে আনিয়া ফেলিতে পারি, তাহা হইলে আমাদের ভয়ের বিষয়কে ইচ্ছাপূর্ব্বক পরিহারও করিতে পারি। কিন্তু যে বিষয় আমাদের ইচ্ছায়াত্ত নহে, তাহাতে ভয় পাইলে, আমরা ইচ্ছা করিলেও পরিহার করিতে পারি না। সুতরাং বৃথা ভয়ে বিচলিত হইয়া অনর্থক কষ্ট পাই।

 কেন না, মৃত্যুও ভয়ঙ্কর নহে, দুঃখও ভয়ঙ্কর নহে, পরন্তু দুঃখ ও মৃত্যুর ভয়ই ভয়ঙ্কর। এই নিমিত্ত আমরা সেই কবিকে প্রশংসা করি যিনি বলিয়াছিলেন:—

“মরিতে কোরো না ভয়, কেবল করিও ভয় ভীরুর মরণে”।

 ৩। অতএব মৃত্যুকে ভয় না করিয়া মৃত্যুভয়কেই ভয় করা উচিত। কিন্তু আমরা ইহার ঠিক বিপরীত আচরণ করি। মৃত্যু হইতে আমরা পলায়ন করি, কিন্তু মৃত্যুটা যে কি জিনিস সে বিষয় একটুও বিবেচনা করিয়া দেখি না;— সে বিষয়ে আমরা একেবারেই উদাসীন। সক্রেটিস্ এই জিনিসগুলাকে “জুজু” বলিয়া অভিহিত করিয়াছিলেন। তিনি ঠিক্ কথাই বলিয়াছেন। কেননা, কদাকার মুখগুলা, অবোধ শিশুদিগের নিকটেই ভীষণ ও ভয়ঙ্কর বলিয়া মনে হয়; এই “জুজু” দেখিয়া শিশুরা যেরূপ ভয় পায়, আমরাও ঠিক্ সেইরূপ সংসারের কোন কোন ঘটনায় ভয়-বিহ্বল হইয়া পড়ি। শিশু কি?—শিশু মূর্ত্তিমান অজ্ঞানেরই নামান্তর মাত্র। যে কিছুই শিক্ষা করে নাই, সেই শিশু। কেন না, শিশু যদি শিক্ষিত হয়, অভিজ্ঞ হয়, তাহা হইলে সে আর শিশু থাকে না, তখন সে আমাদেরই সমকক্ষ। মৃত্যু কি?—মৃত্যু একটা “জুজু”। উহাকে নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখ—পরীক্ষা করিয়া দেখ, উহা তোমাকে কামড়ায় কি না দেখ।— শীঘ্রই হউক, বিলম্বেই হউক, এক সময়ে এই শরীর আত্মা হইতে বিযুক্ত হইবে;—পূর্ব্বেও হইয়াছিল। এখনই যদি বিযুক্ত হয়, তাহাতে তোমার এত রাগ কেন? কেন না, এখন যদিও না হয়, কিছুকাল পরে তো হইবেই। আচ্ছা। এইরূপ বিযুক্ত হইবার কারণটা কি?—উদ্দেশ্য কি?—কাল-চক্রের ভ্রমণকাল যাহাতে সম্পূর্ণ হয়,—ইহাই উদ্দেশ্য। কেন না,—বর্ত্তমান, ভবিষ্যৎ, অতীত এই তিনই জগতের পক্ষে আবশ্যক।

 দুঃখ কি?—দুঃখও একটা “জুজু”! উহাকে নাড়িয়া চাড়িয়া দেখ, পরীক্ষা করিয়া দেখ। এই শরীর-বেচারাকে কখন মৃদুভাবে, কখন কঠোরভাবে প্রকৃতি এক একবার নাড়াইয়া ঝাঁকাইয়া দেন। যদি ইহাতে কোন ফল না পাও, মৃত্যুর দ্বার তো খোলাই আছে। যদি ফল আছে বোধ কর, তবে সহ্য করিয়া থাক। সব সময়েই দরজাটা খোলা রাখাই ভাল, তাহা হইলে আর কোন কষ্ট পাইতে হয় না।

 ৪। তবে কি, আমার অস্তিত্ব থাকিবে না?—অবশ্যই থাকিবে, কিন্তু বিশ্বের প্রয়োজন-অনুসারে রূপান্তরে থাকিবে। তুমি নিজে আপনার সময়-অনুসারে এই পৃথিবীতে আইসো নাই; বিশ্বের যখন প্রয়োজন হইল তখনই তুমি আসিয়াছ।

 ৫। এই মতটি অনুসরণ করিলে কি ফল লাভ হইবে? যাঁহারা প্রকৃত শিক্ষা লাভ করিয়াছেন—তাঁহাদের নিকট যাহা সর্ব্বাপেক্ষা সুন্দর ও উপাদেয়—সেই শান্তি সেই অভয়, সেই স্বাধীনতারূপ ফললাভ হইবে। সাধারণ লোকের ধারণা,—যাহারা দাস-শ্রেণীর অন্তর্গত নহে, যাহারা স্বাধীন, কেবল তাহাদিগকেই শিক্ষা দেওয়া কর্ত্তব্য; কিন্তু তত্ত্বজ্ঞানীরা বলেন, যাহারা সুশিক্ষা লাভ করিয়াছে তাহারাই কেবল স্বাধীন। ইহার অর্থ কি? ইহার অর্থ এই —নিজের ইচ্ছা-অনুসারে থাকিতে পারা, কাজ করিতে পারা—ইহা ভিন্ন স্বাধীনতার কি আর কোন অর্থ আছে? না, আর কোন অর্থ ই নাই। আচ্ছা তবে পাপ কার্য্যে রত থাকাই কি তোমাদের ইচ্ছা? না, আমাদের সে ইচ্ছা নয়।

 তাই বলিতেছি, তাহারা কখনই স্বাধীন নহে যাহারা ভয়-বিহ্বল, শোক কাতর, অথবা উদ্বিগ্ন-চিত্ত। তাহারাই প্রকৃত স্বাধীন যাহারা দুঃখ শোক, ভয় উদ্বেগ, পাপ তাপ হইতে মুক্ত হইয়াছে।