বিষয়বস্তুতে চলুন

কথা ও কাহিনী/কথা/ব্রাহ্মণ

উইকিসংকলন থেকে

ব্রাহ্মণ

ছান্দোগ্যোপনিষৎ

৪ প্রপাঠক। ৪ অধ্যায়

অন্ধকার বনচ্ছায়ে সরস্বতীতীরে
অস্ত গেছে সন্ধ্যাসূর্য; আসিয়াছে ফিরে
নিস্তব্ধ আশ্রম-মাঝে ঋষিপুত্রগণ
মস্তকে সমিধভার করি আহরণ
বনান্তর হতে; ফিরায়ে এনেছে ডাকি
তপােবনগােষ্ঠগৃহে স্নিগ্ধশান্ত-আঁখি
শ্রান্ত হােমধেনুগণে; করি সমাপন
সন্ধ্যাস্নান সবে মিলি লয়েছে আসন
গুরু গৌতমেরে ঘিরি, কুটিরপ্রাঙ্গণে
হােমাগ্নি-আলােকে। শূন্যে অনন্ত গগনে
ধ্যানমগ্ন মহাশান্তি; নক্ষত্রমণ্ডলী
সারি সারি বসিয়াছে স্তব্ধ-কুতূহলী
নিঃশব্দ শিষ্যের মতাে। নিভৃত আশ্রম
উঠিল চকিত হয়ে; মহর্ষি গৌতম
কহিলেন, “বৎসগণ, ব্রহ্মবিদ্যা কহি,
করাে অবধান।”

  হেনকালে অর্ঘ্য বহি
করপুট ভরি’, পশিলা প্রাঙ্গণতলে
তরুণ বালক; বন্দি’ ফলফুলদলে
ঋষির চরণপদ্ম, নমি ভক্তিভরে
কহিলা কোকিলকণ্ঠ সুধাস্নিগ্ধ স্বরে,
“ভগবন, ব্রহ্মবিদ্যা-শিক্ষা-অভিলাষী
আসিয়াছি দীক্ষা-তরে কুশক্ষেত্রবাসী,
সত্যকাম নাম মাের।”

  শুনি স্মিতহাসে
ব্রহ্মর্ষি কহিলা তারে স্নেহশান্ত ভাষে,
“কুশল হউক সৌম্য। গােত্র কী তােমার
বৎস, শুধু ব্রাহ্মণের আছে অধিকার
ব্রহ্মবিদ্যালাভে।”

  বালক কহিলা ধীরে,
“ভগব, গােত্র নাহি জানি। জননীরে
শুধায়ে আসিব কলা, করাে অনুমতি।”

এত কহি ঋষিপদে করিয়া প্রণতি
গেল চলি সত্যকাম, ঘন-অন্ধকার

বনবীথি দিয়া পদব্রজে হয়ে পার
ক্ষীণ স্বচ্ছ শান্ত সরস্বতী বালুতীরে
সুপ্তিমৌন গ্রামপ্রান্তে জননীকুটিরে
করিলা প্রবেশ।


  ঘরে সন্ধ্যাদীপ জ্বালা;
দাঁড়ায়ে দুয়ার ধরি জননী জবালা
পুত্রপথ চাহি; হেরি তারে বক্ষে টানি
আঘ্রাণ করিয়া শির কহিলেন বাণী
কল্যাণকুশল। শুধাইল। সত্যকাম,
“কহাে গাে, জননী, মোর পিতার কী নাম,
কী বংশে জনম। গিয়াছিনু দীক্ষা-তরে
গৌতমের কাছে; গুরু কহিলেন মােরে,
বৎস, শুধু ব্রাহ্মণের আছে অধিকার
ব্রহ্মবিদ্যালভে। মাতঃ, কী গােত্র আমার।”

শুনি কথা মৃদুকণ্ঠে অবনতমুখে
কহিলা জননী, “যৌবনে দারিদ্র্যদুখে
বহুপরিচর্যা করি পেয়েছিনু তােরে,
জন্মেছিস ভর্তৃহীনা জবালার ক্রোড়ে-
গােত্র তব নাহি জানি তাত।”

    পরদিন
তপােবনতরুশিরে প্রসন্ন নবীন
জাগিল প্রভাত; যত তাপসবালক
শিশিরসুস্নিগ্ধ যেন তরুণ আলােক,
ভক্তি-অশ্রু-ধৌত যেন নব পুণ্যচ্ছটা,
প্রাতঃস্নাত স্নিগ্ধচ্ছবি আর্ভসিক্তজটা
শুচিশোভা সৌম্যমূর্তি সমুজ্জ্বলকায়ে
বসেছে বেষ্টন করি বৃদ্ধবটচ্ছায়ে
গুরু গৌতমেরে। বিহঙ্গকাকলিগান,
মধুপগুঞ্জনগীতি, জলকলতান,
তারি সাথে উঠিতেছে গম্ভীর মধুর
বিচিত্র তরুণকণ্ঠে সম্মিলিত সুর-
শান্ত সামগীতি।

  হেনকালে সত্যকাম
কাছে আসি ঋষিপদে করিলা প্রণাম -
মেলিয়া উদার আঁখি রহিলা নীরবে।
আচার্য আশিস্ করি শুধাইলা তবে,
“কী গােত্র তােমার সৌম্য, প্রিয়দরশন।”

তুলি শির কহিল বালক, “ভগবন,
নাহি জানি কী গােত্র আমার। পুছিলাম

জননীরে; কহিলেন তিনি, সত্যকাম,
বহুপরিচর্যা করি পেয়েছিনু তােরে,
জন্মেছিস ভর্তৃহীনা জবালার ক্রোড়ে-
গােত্র তব নাহি জানি।”

   শুনি সে বারতা
ছাত্রগণ মৃদুস্বরে আরম্ভিল কথা
মধুচক্রে লােষ্ট্রপাতে বিক্ষিপ্ত চঞ্চল
পতঙ্গের মতাে- সবে বিস্ময়বিকল,
কেহ বা হাসিল, কেহ করিল ধিক্কার
লজ্জাহীন অনার্যের হেরি অহংকার।

উঠিলা গৌতম ঋষি ছাড়িয়া আসন;
বাহু মেলি বালকেরে করি আলিঙ্গন
কহিলেন, “অব্রাহ্মণ নহ তুমি তাত,
তুমি দ্বিজোত্তম, তুমি সত্যকুলজাত।”

৭ ফাল্গুন ১৩০১