বিষয়বস্তুতে চলুন

কপালকুণ্ডলা (১৮৭০)/প্রথম খণ্ড/অষ্টম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

অষ্টম পরিচ্ছেদ।

আশ্রয়ে।

“And that very night——————
Shall Romeo bear thee to Mantua.“

Romeo and Juliet.

সেই অমাবস্যার ঘোরান্ধকার যামিনীতে দুই জনে ঊর্দ্ধশ্বাসে বন মধ্যে প্রবেশ করিলেন। বন্য পথ নবকুমারের অপরিজ্ঞাত; কেবল সহচারিণী ষোড়শীকে লক্ষ্য করিয়া তদ্বর্ত্মসম্বর্ত্তী হওয়া ব্যতীত তাঁহার অন্য উপায় নাই। কিন্তু অন্ধকারে বন মধ্যে রমণীকে সকল সময় দেখা যায় না; যুবতী এক দিকে ধাবমানা হইলে, নবকুমার অন্য দিকে যান; রমণী কহিলেন, “আমার অঞ্চল ধর।” নবকুমার তাঁহার অঞ্চল ধরিয়া চলিলেন। ক্রমে তাঁহারা পাদক্ষেপ মন্দ করিয়া চলিতে লাগিলেন। অন্ধকারে কিছুই লক্ষ্য হয় না; কেবল কখন কোথায় নক্ষত্রালোকে কোন বালুকাস্তূপের শুভ্র শিখর অস্পষ্ট দেখা যায়—কোথাও খদ্যোতমালাসম্বৃত বৃক্ষের অবয়ব জ্ঞানগোচর হয়।

 কপালকুণ্ডলা পথিককে সমভিব্যাহারে লইয়া, নিভৃত কাননাভ্যন্তরে উপনীত হইলেন। তখন রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর। সম্মুখে অন্ধকারে বন মধ্যে এক অত্যুচ্চ দেবালয়চূড়া লক্ষিত হইল; তন্নিকটে ইষ্টকনির্ম্মিতপ্রাচীরবেষ্টিত একটি গৃহও দেখা গেল। কপালকুণ্ডলা প্রাচীর দ্বারের নিকটস্থ হইয়া তাহাতে করাঘাত করিতে লাগিলেন; পুনঃ পুনঃ করাঘাত করাতে ভিতর হইতে এক ব্যক্তি কহিল, “কেও কপালকুণ্ডলা বুঝি?” কপালকুণ্ডলা কহিলেন, “দ্বার খোল।”

 উত্তরকারী আসিয়া দ্বার খুলিয়া দিল। যে ব্যক্তি দ্বার খুলিয়া দিলেক, সে ঐ দেবালয়াধিষ্ঠাত্রী দেবতার সেবক বা অধিকারী; বয়সে পঞ্চাশৎ বৎসর অতিক্রান্ত করিয়াছিল। কপালকুণ্ডলা তাহার বিরলকেশমস্তক কর দ্বারা আকর্ষিত করিয়া আপন অধরের নিকট তাহার শ্রবণেন্দ্রিয় আনিলেন। এবং দুই চারি কথায় নিজ সঙ্গীর অবস্থা বুঝাইয়া দিলেন। অধিকারী বহু ক্ষণ পর্য্যন্ত করতললগ্নশীর্ষ হইয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন। পরিশেষে কহিলেন “এ বড় বিষম ব্যাপার। মহাপুৰুষ মনে করিলে সকল করিতে পারেন। যাহা হউক মায়ের প্রসাদে তোমার অমঙ্গল ঘটিবে না। সে ব্যক্তি কোথায়?”

 কপালকুণ্ডলা, “আইস” বলিয়া নবকুমারকে আহ্বান করিলেন। নবকুমার অন্তরালে দাঁড়াইয়াছিলেন, আহূত হইয়া গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিলেন। অধিকারী তাঁহাকে কহিলেন, “আজি এই খানে লুকাইয়া থাক, কালি প্রত্যূষে তোমাকে মেদিনীপুরের পথে রাখিয়া আসিব।”

 ক্রমে কথায় কথায় অধিকারী জানিতে পারিলেন যে এপর্য্যন্ত নবকুমারের আহারাদি হয় নাই। ইহাতে অধিকারী তাঁহার আহারের আয়োজন করিতে প্রবৃত্ত হইলে, নবকুমার আহারে নিতান্ত অস্বীকৃত হইয়া কেবল মাত্র বিশ্রামস্থানের প্রার্থনা জানাইলেন। অধিকারী নিজ রন্ধনশালায় নবকুমারের শয্যা প্রস্তুত করিয়া দিলেন। নবকুমার শয়ন করিলে, কপালকুণ্ডলা সমুদ্রতীরে প্রত্যাগমন করিবার উদ্‍যোগ করিলেন। অধিকারী তাঁহার প্রতি সস্নেহ নয়নে দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন।

 “যাইও না, ক্ষণেক দাঁড়াও, এক ভিক্ষা আছে।”

 কপালকুণ্ডলা। “কি?”

 অধিকারী। “তোমাকে দেখিয়া পর্য্যন্ত মা বলিয়া থাকি, দেবীর পাদ স্পর্শ করিয়া শপথ করিতে পারি, যে মাতার অধিক তোমাকে স্নেহ করি। আমার ভিক্ষা অবহেলা করিবে না?”

 কপা। “করিব না।”

 অধি। “আমার এই ভিক্ষা, তুমি আর সেখানে ফিরিয়া যাইও না।”

 কপা। “কেন?”

 অধি। “গেলে তোমার রক্ষা নাই।”

 কপা। “তাহা ত জানি?”

 অধি। “তবে আবার জিজ্ঞাসা কর কেন?”

 কপা। “না গিয়া কোথায় যাইব?”

 অধি। “এই পথিকের সঙ্গে দেশান্তরে যাও।”

 কপালকুণ্ডলা নীরব হইয়া রহিলেন। অধিকারী কহিলেন, “মা কি ভাবিতেছ?”

 কপা। “যখন তোমার শিষ্য আসিয়াছিল, তখন তুমি কহিয়াছিলে, যে, যুবতীর এরূপ যুবা পুৰুষের সহিত যাওয়া অনুচিত; এখন যাইতে বল কেন?”

 অধি। “তখন তোমার জীবনের আশঙ্কা করি নাই, বিশেষ যে সদুপায়ের সম্ভাবনা ছিল না, এখন সে সদুপায় হইতে পারিবেক। আইস মায়ের অনুমতি লইয়া আসি।”

 এই বলিয়া অধিকারী দীপহস্তে দেবালয়ের দ্বারে গিয়া দ্বারোদ্ঘাটন করিলেন। কপালকুণ্ডলাও তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে গেলেন। মন্দির মধ্যে মানবাকারপ্রমাণা করালকালীমূর্ত্তি সংস্থাপিতা ছিল। উভয়ে ভক্তিভাবে প্রণাম করিলেন। অধিকারী, আচমন করিয়া পুষ্পপাত্র হইতে একটি অচ্ছিন্ন বিল্বপত্র লইয়া মন্ত্রপুত করিলেন, এবং তাহা প্রতিমার পাদোপরি সংস্থাপিত করিয়া তৎপ্রতি চাহিয়া রহিলেন। ক্ষণেক পরে, অধিকারী কপালকুণ্ডলাকে কহিলেন,

 মা, দেখ, দেবী অর্ঘ্য গ্রহণ করিয়াছেন; বিল্বপত্র পড়ে নাই; যে মানস করিয়া অর্ঘ্য দিয়াছিলাম, তাহাতে অবশ্য মঙ্গল। তুমি এই পথিকের সঙ্গে সচ্ছন্দে গমন কর; কিন্তু আমি বিষয়ী লোকের রীতি চরিত্র জানি। তুমি যদি গলগ্রহ হইয়া ইহার সঙ্গে যাও, তবে এ ব্যক্তি অপরিচিত যুবতী সঙ্গে লইয়া লোকালয়ে লজ্জা পাইবেক। তোমাকেও লোকে ঘৃণা করিবেক। তুমি বলিতেছ এ ব্যক্তি ব্রাহ্মণসন্তান, গলাতেও যজ্ঞোপবীত দেখিতেছি। এ যদি তোমাকে বিবাহ করিয়া লইয়া যায়, তবে সকল মঙ্গল। নচেৎ আমিও তোমাকে ইহার সহিত যাইতে বলিতে পারি না।”

 “বি—বা—হ!” এই কথাটি কপালকুণ্ডলা অতি ধীরে ধীরে উচ্চারণ করিলেন। বলিতে লাগিলেন, “বিবাহের নাম ত তোমাদিগের মুখে শুনিয়া থাকি, কিন্তু কাহাকে বলে সবিশেষ জানি না। কি করিতে হইবেক?”

 অধিকারী ঈষন্মাত্র হাস্য করিয়া কহিলেন, “বিবাহ স্ত্রীলোকের এক মাত্র ধর্ম্মের সোপান; এই জন্য স্ত্রীকে সহধর্ম্মিণী বলে। জগন্মাতাও শিবের বিবাহিতা।”

 অধিকারী মনে করিলেন সকলই বুঝাইলেন। কপালকুণ্ডলা মনে করিলেন সকলই বুঝিলেন। বলিলেন,

 “তাহাই হউক। কিন্তু তাঁহাকে ত্যাগ করিয়া যাইতে আমার মন সরিতেছে না। তিনি যে আমাকে এত দিন প্রতিপালন করিয়াছেন।”

 অধি। “কি জন্য প্রতিপালন করিয়াছেন তাহা জান না। স্ত্রীলোকের সতীত্ব নাশ না করিলে যে তান্ত্রিক সিদ্ধ হয় না তাহা তুমি জান না। আমিও তন্ত্রাদি পাঠ করিয়াছি। মা জগদম্বা জগতের মাতা। ইনি সতীর সতীত্ব—সতী প্রধানা। ইনি সতীত্বনাশ সংযুক্ত পূজা কখন গ্রহণ করেন না। এই জন্যই আমি মহাপুৰুষের অনভিমত সাধিতেছি। তুমি পলায়ন করিলে কদাপি কৃতঘ্ন হইবে না। কেবল এ পর্য্যন্ত সিদ্ধির সময় উপস্থিত হয় নাই বলিয়া তুমি রক্ষা পাইয়াছ। আজি তুমি যে কার্য্য করিয়াছ—তাহাতে প্রাণেরও আশঙ্কা। এই জন্য বলিতেছি পলায়ন কর। ভবানীরও এই আজ্ঞা। অতএব যাও। আমার এখানে রাখিবার উপায় থাকিলে রাখিতাম; কিন্তু সে ভরসা যে নাই তাহা ত জান।”

 কপা। “বিবাহই হউক।”

 এই বলিয়া উভয়ে মন্দির হইতে বহির্গত হইলেন। এক কক্ষ মধ্যে কপালকুণ্ডলাকে বসাইয়া অধিকারী নবকুমারের শয্যা সন্নিধানে গিয়া তাঁহার শিওরে বসিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন “মহাশয় নিদ্রিত কি?”

 নবকুমারের নিদ্রা যাইবার অবস্থা নহে। নিজ দশা ভাবিতেছিলেন। বলিলেন “আজ্ঞা না।”

 অধিকারী কহিলেন, “মহাশয় পরিচয়টা লইতে একবার আসিলাম। আপনি ব্রাহ্মণ?”

 নব। “আজ্ঞা হাঁ?”

 অধি। “কোন্ শ্রেণী?”

 নব। “রাঢ়ীয় শ্রেণী।”

 অধি। “আমরাও রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ—উৎকল ব্রাহ্মণ বিবেচনা করিবেন না। বংশে কুলাচার্য্য, তবে এক্ষণে মায়ের পদাশ্রয়ে আছি। মহাশয়ের নাম?”

 নব। “নবকুমার শর্ম্মা।”

 অধি। “নিবাস?”

 নব। “সপ্তগ্রাম।”

 অধি। “আপনারা কোন্ গাঁই।”

 নব। “বন্দ্যঘাটি।”

 অধি। “কয় সংসার করিয়াছেন?”

 নব। “এক সংসার মাত্র।”

 নবকুমার সকল কথা খুলিয়া বলিলেন না। প্রকৃত পক্ষে তাঁহার এক সংসারও ছিল না। তিনি রামগোবিন্দ ঘোষালের কন্যা পদ্মাবতীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। বিবাহের পর পদ্মাবতী কিছু দিন পিত্রালয়ে রহিলেন। মধ্যে মধ্যে শ্বশুরালয়ে যাতায়াত করিতেন। যখন তাঁহার বয়স ত্রয়োদশ বৎসর, তখন তাঁহার পিতা সপরিবারে পুৰুষোত্তম দর্শনে গিয়াছিলেন। এই সময়ে পাঠানেরা আকবর শাহ কর্ত্তৃক বঙ্গদেশ হইতে দূরীভূত হইয়া উড়িষ্যায় সদলে বসতি করিতেছিল। তাহাদিগের দমনের জন্য আকবর শাহ বিধিমতে যত্ন পাইতে লাগিলেন। যখন রামগোবিন্দ ঘোষাল উড়িষ্যা হইতে প্রত্যাগমন করেন, তখন মোগল পাঠানের যুদ্ধ আরম্ভ হইয়াছে। আগমন কালে তিনি পথিমধ্যে পাঠান সেনার হস্তে পতিত হয়েন। পাঠানেরা তৎকালে ভদ্রাভদ্রবিচারশূন্য; তাহারা নিরপরাধী পথিকের প্রতি অর্থের জন্য বল প্রকাশের চেষ্টা করিতে লাগিল। রামগোবিন্দ কিছু উগ্রস্বভাব; পাঠানদিগের কটু কহিতে লাগিলেন। ইহার ফল এই হইল যে, সপরিবারে অবৰুদ্ধ হইলেন; পরিশেষে জাতীয় ধর্ম্ম বিসর্জ্জন পূর্ব্বক সপরিবারে মুসলমান হইয়া নিষ্কৃতি পাইলেন।

 রামগোবিন্দ ঘোষাল সপরিবারে প্রাণ লইয়া বাটী আসিলেন বটে, কিন্তু মুসলমান বলিয়া আত্মীয় জনসমাজে এককালীন পরিত্যক্ত হইলেন। এ সময় নবকুমারের পিতা বর্ত্তমান ছিলেন, তাঁহাকে সুতরাং জাতিভ্রষ্ট বৈবাহিকের সহিত জাতিভ্রষ্টা পুত্রবধূকে ত্যাগ করিতে হইল। আর নবকুমারের সহিত তাঁহার স্ত্রীর সাক্ষাৎ হইল না।

 স্বজনত্যক্ত ও সমাজচ্যুত হইয়া রামগোবিন্দ ঘোষাল অধিক দিন স্বদেশে বাস করিতে পারিলেন না। এই কারণেও বটে, এবং রাজপ্রসাদে উচ্চপদস্থ হইবার আকাঙ্ক্ষায়ও বটে, তিনি সপরিবারে রাজপাট ঢাকানগরে গিয়া বসতি করিতে লাগিলেন। ধর্ম্মান্তর গ্রহণ করিয়া তিনি সপরিবারে মহম্মদীয় নাম ধারণ করিয়াছিলেন। ঢাকায় যাওয়ার পরে শ্বশুরের বা বনিতার কি অবস্থা হইল তাহা নবকুমারের জানিতে পারিবার কোন উপায় রহিল না এবং এ পর্য্যন্ত কখন কিছু জানিতেও পারিলেন না। নবকুমার বিরাগবশতঃ আর দারপরিগ্রহ করিলেন না। এই জন্য বলিতেছি নবকুমারের “এক সংসারও” নহে।

 অধিকারী এ সকল বৃত্তান্ত অবগত ছিলেন না। তিনি বিবেচনা করিলেন “কুলীনের সন্তানের দুই সংসারে আপত্তি কি?” প্রকাশ্যে কহিলেন, “আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছিলাম। এই যে কন্যা আপনার প্রাণরক্ষা করিয়াছে—এ পরহিতার্থ আত্মপ্রাণ নষ্ট করিয়াছে। যে মহাপুৰুষের আশ্রয়ে ইহার বাস, তিনি অতি ভয়ঙ্করস্বভাব। তাঁহার নিকট প্রত্যাগমন করিলে, তোমার যে দশা ঘটিতেছিল ইহার সেই দশা ঘটিবেক। ইহার কোন উপায় বিবেচনা করিতে পারেন কি না?”

 নবকুমার উঠিয়া বসিলেন। কহিলেন, “আমিও সেই আশঙ্কা করিতেছিলাম। আপনি সকল অবগত আছেন,—ইহার উপায় কৰুন। আমার প্রাণদান করিলে যদি কোন প্রত্যুপকার হয়,—তবে তাহাতেও প্রস্তুত আছি। আমি এমত সঙ্কল্প করিতেছি যে আমি সেই নরঘাতকের নিকট প্রত্যাগমন করিয়া আত্মসমর্পণ করি। তাহা হইলে ইহার রক্ষা হইবেক।” অধিকারী হাস্য করিয়া কহিলেন, “তুমি বাতুল। ইহাতে কি ফল দর্শিবে? তোমারও প্রাণ সংহার হইবে—অথচ ইহার প্রতি মহাপুৰুষের ক্রোধোপশম হইবেক না। ইহার এক মাত্র উপায় আছে।”

 নব। “সে কি উপায়?”

 অধি। “তোমার সহিত ইহার পলায়ন। কিন্তু সে অতি দুর্ঘট। আমার এখানে থাকিলে দুই এক দিন মধ্যে ধৃত হইবে। এ দেবালয়ে মহাপুৰুষের সর্ব্বদা যাতায়াত। সুতরাং কপালকুণ্ডলার অদৃষ্টে অশুভ নিশ্চিত দেখিতেছি।”

 নবকুমার আগ্রহ সহকারে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমার সহিত পলায়ন দুর্ঘট কেন?”

 অধি। “এ কাহার কন্যা,—কোন্ কুলে জন্ম, তাহা আপনি কিছুই জানেন না। কাহার পত্নী,—কি চরিত্রা, তাহা কিছুই জানেন না। আপনি ইহাকে কি সঙ্গিনী করিবেন? সঙ্গিনী করিয়া লইয়া গেলেও কি আপনি ইহাকে নিজ গৃহে স্থান দিবেন? আর যদি স্থান না দেন তবে এ অনাথিনী কোথা যাইবে?”

 ধন্য রে কুলাচার্য্য!

 নবকুমার ক্ষণেক চিন্তা করিয়া কহিলেন “আমার প্রাণ রক্ষয়ত্রীর জন্য কোন কার্য্য আমার অসাধ্য নহে। ইনি আমার আত্মপরিবারস্থা হইয়া থাকিবেন।”

 অধি। “ভাল। কিন্তু যখন আপনার আত্মীয় স্বজন জিজ্ঞাসা করিবে যে এ কাহার স্ত্রী, কি উত্তর দিবেন?”

 নবকুমার পুনর্ব্বার চিন্তা করিয়া কহিলেন, “আপনিই ইহাঁর পরিচয় আমাকে দিন। আমি সেই পরিচয় সকলকে দিব।”

 অধি। “ভাল। কিন্তু এই পক্ষান্তরের পথ যুবক যুবতী অনন্যসহায় হইয়া কি প্রকারে যাইবে? লোকে দেখিয়া শুনিয়া কি বলিবে? আত্মীয় স্বজনের নিকট কি বুঝাইবে? আর আমিও এই কন্যাকে মা বলিয়াছি, আমিই বা কি প্রকারে ইহাকে অজ্ঞাতচরিত্র যুবার সহিত একাকী দূরদেশে পাঠাইয়া দিই?”

 আবার বলি, ধন্য রে কুলাচার্য্য!

 নবকুমার কহিলেন, “আপনি সঙ্গে আসুন।”

 অধি। “আমি সঙ্গে যাইব? ভবানীর পূজা কে করিবে?”

 নবকুমার ক্ষুব্ধ হইয়া কহিলেন, “তবে কি কোন উপায় করিতে পারেন না?”

 অধি। “এক মাত্র উপায় হইতে পারে,—সে আপনার ঔদার্য্যগুণের অপেক্ষা করে?”

 নব। “সে কি? আমি কিসে অস্বীকৃত? কি উপায় বলুন।”

 অধি। “শুনুন। ইনি ব্রাহ্মণকন্যা। ইহাঁর বৃত্তান্ত আমি সবিশেষ অবগত আছি। ইনি বাল্যকালে দুরন্ত খ্রীষ্টিয়ান তস্কর কর্ত্তৃক অপহৃত হইয়া তাহাদিগের দ্বারা যানভগ্ন কালে এই সমুদ্রতীরে ত্যক্ত হয়েন। সে সকল বৃত্তান্ত পশ্চাৎ ইহাঁর নিকট আপনি সবিশেষ অবগত হইতে পারিবেন। কাপালিক ইহাঁকে প্রাপ্ত হইয়া আপন যোগসিদ্ধিমানসে প্রতিপালন করিয়াছেন। অচিরাৎ আত্মপ্রয়োজন সিদ্ধ করিতেন। ইনি এ পর্য্যন্ত অনূঢ়া; ইহাঁর চরিত্র পরম পবিত্র। আপনি ইহাঁকে বিবাহ করিয়া গৃহে লইয়া যান। কেহ কোন কথা বলিতে পারিবেক না। আমি যথাশাস্ত্র বিবাহ দিব।”

 নবকুমার শয্যা হইতে দাঁড়াইয়া উঠিলেন। অতি দ্রুতপাদ বিক্ষেপে ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। কোন উত্তর করিলেন না। অধিকারী কিয়ৎক্ষণ পরে কহিলেন,

 “আপনি এক্ষণে নিদ্রা যান। কল্য প্রত্যূষে আপনাকে আমি জাগরিত করিব। ইচ্ছা হয়, একাকী যাইবেন। আপনাকে মেদিনীপুরের পথে রাখিয়া আসিব।”

 এই বলিয়া অধিকারী বিদায় হইলেন। গমন কালে মনে মনে করিলেন, “রাঢ়দেশের ঘটকালী কি ভুলিয়া গিয়াছি না কি?”

 গ্রন্থকার কহেন, “ফলেন পরিচীয়তে।”