কপালকুণ্ডলা (১৮৭০)/প্রথম খণ্ড/নবম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

নবম পরিচ্ছেদ।


দেবনিকেতনে।

 কণ্ব। অলং ৰুদিতেন; স্থিরাভব, ইতঃপন্থানমালোকয়।

শকুন্তলা।

পুৰুষ পাঠক, আমাকে মার্জ্জনা করিবেন। আপনি যদি কপালকুণ্ডলাকে সমুদ্রতীরে দেখিতেন, তবে এক দিন তৎপ্রতি আসক্তচিত্ত হইতেন কি না বলিতে পারি না। প্রাণরক্ষা মাত্র উপকারের অনুরোধে তাহার পাণিগ্রহণে সম্মত হইতেন কি না বলিতে পারি না। বোধ করি নহে, কেন না কপালকুণ্ডলা ৰুক্ষকেশী সন্ন্যাসিনী মাত্র। কিন্তু নবকুমার পরের জন্য কাষ্ঠাহরণ করেন;—এ পৃথিবীর কাঠুরিয়ারা সন্ন্যাসিনীদিগের মর্ম্ম বুঝে। কৃতঘ্ন সহযাত্রীদিগের জন্য নবকুমার মাথায় কাষ্ঠভার বহিয়াছিলেন,—কৃতোপকারিণী সন্ন্যাসিনীর জন্য যে অতুল রূপরাশি হৃদয়ে বহিতে চাহিবেন, তাহার বিচিত্র কি?

 প্রাতে অধিকারী তাঁহার নিকট আসিলেন। দেখিলেন, এখনও নবকুমার শয়ন করেন নাই। জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন কি কর্ত্তব্য?”

 নবকুমার কহিলেন, “আজি হইতে কপালকুণ্ডলা আমার ধর্ম্মপত্নী। ইহার জন্য সংসার ত্যাগ করিতে হয়, তাহাও করিব। কে কন্যা সম্প্রদান করিবে?”

 ঘটক চূড়ামণির মুখ হর্ষোৎফুল্ল হইল। মনে মনে ভাবিলেন, “এত দিনে জগদম্বার কৃপায় আমার কপালিনীর বুঝি গতি হইল।” প্রকাশ্যে বলিলেন, “আমি সম্প্রদান করিব।”

 অধিকারী নিজ শয়নকক্ষমধ্যে পুনঃপ্রবেশ করিলেন। একটী খুঙ্গির মধ্যে কয়েক খণ্ড অতিজীর্ণ তালপত্র ছিল। তাহাতে তাঁহার তিথি নক্ষত্রাদি নির্দ্দিষ্ট থাকিত। তৎসমুদায় সবিশেষ সমালোচনা করিয়া আসিয়া কহিলেন, “আজি যদিও বৈবাহিক দিন নহে—তথাচ বিবাহে কোন বিঘ্ন নাই। গোধূলিলগ্নে কন্যা সম্প্রদান করিব। তুমি অদ্য উপবাস করিয়া থাকিবা মাত্র। কৌলিক আচরণ সকল বাটী গিয়া করাইও। এক দিনের জন্য তোমাদিগের লুকাইয়া রাখিতে পারি, এমত স্থান আছে। আজি যদি তিনি আসেন তবে তোমাদিগের সন্ধান পাইবেন না। পরে বিবাহান্তে কালি প্রাতে সপত্নী বাটী যাইও।”

 নবকুমার ইহাতে সম্মত হইলেন। এ অবস্থায় যত দূর সম্ভবে তত দূর যথাশাস্ত্র কার্য্য হইল। গোধূলি লগ্নে নবকুমারের সহিত কাপালিকপালিত সন্ন্যাসিনীর বিবাহ হইল।

 কাপালিকের কোন সম্বাদ নাই। পরদিন প্রত্যূষে তিন জনে যাত্রার উদ্‍যোগ করিতে লাগিলেন। অধিকারী মেদিনীপুরের পথ পর্য্যন্ত তাঁহাদিগের রাখিয়া আসিবেন।

 যাত্রাকালে কপালকুণ্ডলা কালী প্রণামার্থ গেলেন। ভক্তিভাবে প্রণাম করিয়া, পুষ্পপাত্র হইতে একটা অভিন্ন বিল্বপত্র প্রতিমার পাদোপরি স্থাপিত করিয়া তৎপ্রতি নিরীক্ষণ করিয়া রহিলেন। পত্রটী পড়িয়া গেল।

 কপালকুণ্ডলা নিতান্ত ভক্তিপরায়ণা। বিল্বদল প্রতিমাচরণচ্যুত হইল দেখিয়া ভীতা হইলেন;—এবং অধিকারীকে সম্বাদ দিলেন। অধিকারীও বিষণ্ণ হইলেন। কহিলেন,

 “এখন নিৰুপায়। এখন পতিমাত্র তোমার ধর্ম্ম। পতি শ্মশানে গেলে তোমাকে সঙ্গে সঙ্গে যাইতে হইবে। অতএব নিঃশব্দে চল।”

 সকলে নিঃশব্দে চলিলেন। অনেক বেলা হইলে মেদিনীপুরের পথে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন অধিকারী বিদায় হইলেন। কপালকুণ্ডলা কাঁদিতে লাগিলেন। পৃথিবীতে যে জন তাঁহার একমাত্র সুহৃৎ সে বিদায় হইতেছে।

 অধিকারীও কাঁদিতে লাগিলেন। চক্ষের জল মুছিয়া কপালকুণ্ডলার কাণে কাণে কহিলেন, “মা! তুই জানিস পরমেশ্বরীর প্রসাদে তোর সন্তানের অর্থের অভাব নাই। হিজলীর ছোট বড় সকলেই তাঁহার পূজা দেয়। তোর কাপড়ে যাহা বাঁধিয়া দিয়াছি তাহা তোর স্বামীর নিকট দিয়া তোকে পালকী করিয়া দিতে বলিস।—সন্তান বলিয়া মনে করিস্।”

 অধিকারী এই বলিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে গেলেন। কপালকুণ্ডলাও কাঁদিতে কাঁদিতে চলিলেন।

ইতি প্রথমঃ খণ্ডঃ সমাপ্তঃ।