কপালকুণ্ডলা (১৮৭০)/প্রথম খণ্ড/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

উপকূলে।

Ingratitude! Thou marble hearted fiend!—

King Lear.

আরোহীদিগের স্ফূর্ত্তিব্যঞ্জক কথা সমাপ্ত হইলে, নাবিকেরা প্রস্তাব করিল যে জোয়ারের আরও কিঞ্চিৎ বিলম্ব আছে;—এই অবকাশে আরোহীগণ সম্মুখস্থ সৈকতে পাকাদি সমাপন কৰুন; পরে জলোচ্ছাস আরম্ভেই স্বদেশাভিমুখে যাত্রা করিতে পারিবেন। আরোহীবর্গেও এই পরামর্শে সম্মতি দিলেন। তখন নাবিকেরা তরী তীরলগ্ন করিলে আরোহীগণ অবতরণ করিয়া স্নানাদি প্রাতঃকৃত্য সম্পাদনে প্রবৃত্ত হইলেন।

 স্নানাদির পর পাকের উদ্‍যোগে আর এক নূতন বিপত্তি উপস্থিত হইল,—নৌকায় পাকের কাষ্ঠ নাই। ব্যাঘ্রভয়ে উপর হইতে কাষ্ঠ সংগ্রহ করিয়া আনিতে কেহই স্বীকৃত হইল না। পরিশেষে সকলের উপবাসের উপক্রম দেখিয়া প্রাচীন প্রাগুক্ত যুবাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “বাপু নবকুমার! তুমি ইহার উপায় না করিলে আমরা এত গুলিন লোক মারা যাই।”

 নবকুমার কিঞ্চিৎ কাল চিন্তা করিয়া কহিলেন, “আচ্ছা, আমিই যাব; কুড়ালি দাও, আর দা লইয়া এক জন আমার সঙ্গে আইস।”

 কেহই নবকুমারের সহিত যাইতে চাহিল না।

 “খাবার সময় বুঝা যাবে” এই বলিয়া নবকুমার কঙ্কাল বন্ধন পূর্ব্বক একক কুঠার হস্তে কাষ্ঠাহরণে চলিলেন।

 তীরোপরি আরোহণ করিয়া নবকুমার দেখিলেন যে, যতদূর দৃষ্টি চলে তত দূর মধ্যে কোথাও বসতির লক্ষণ কিছুই নাই। কেবল বন মাত্র। কিন্তু সে বন, দীর্ঘ বৃক্ষবলিশোভিত বা নিবিড় বন নহে;—কেবল স্থানে স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্ভিজ্জ মণ্ডলাকারে কোন কোন ভূমিখণ্ড ব্যাপিয়াছে। নবকুমার তন্মধ্যে আহরণযোগ্য কাষ্ঠ দেখিতে পাইলেন না; সুতরাং উপযুক্ত বৃক্ষের অনুসন্ধানে নদীতট হইতে অধিক দূর গমন করিতে হইল। পরিশেষে ছেদনযোগ্য একটি বৃক্ষ পাইয়া তাহা হইতে প্রয়োজনীয় কাষ্ঠ সমাহরণ করিলেন। কাষ্ঠ বহন করিয়া আনা আর এক বিষম কঠিন ব্যাপার বোধ হইল। নবকুমার দরিদ্রের সন্তান ছিলেন না, এ সকল কর্ম্মে অভ্যাস ছিল না; সম্যক্ বিবেচনা না করিয়া কাষ্ঠ আহরণে আসিয়াছিলেন, কিন্তু এক্ষণে কাষ্ঠভার বহন বড় ক্লেশকর হইল। যাহাই হউক, যে কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, তাহাতে অল্পে ক্ষান্ত হওয়া নবকুমারের স্বভাব ছিল না, এজন্য তিনি কোন মতে কাষ্ঠভার বহিয়া আনিতে লাগিলেন। কিয়দ্দূর বহেন, পরে ক্ষণেক বসিয়া বিশ্রাম করেন, আবার বহেন; এইরূপে আসিতে লাগিলেন।

 এই হেতুবশতঃ নবকুমারের প্রত্যাগমনে বিলম্ব হইতে লাগিল। এ দিকে সমভিব্যাহারিগণ তাঁহার বিলম্ব দেখিয়া উদ্বিগ্ন হইতে লাগিল; তাহাদিগের এইরূপ আশঙ্কা হইল, যে নবকুমারকে ব্যাঘ্রে হত্যা করিয়াছে। সম্ভাব্য কাল অতীত হইলে এই রূপেই তাহাদিগের হৃদয়ে স্থিরসিদ্ধান্ত হইল। অথচ কাহারও এমত সাহস হইল না যে তীরে উঠিয়া কিয়দ্দূর অগ্রসর হইয়া তাঁহার অনুসন্ধান করেন।

 নৌকারোহীগণ এইরূপ কল্পনা করিতেছিল ইত্যবসরে জলরাশি মধ্যে ভৈরব কল্লোল উত্থাপিত হইল। নাবিকেরা বুঝিল যে “জোয়ার” আসিতেছে। নাবিকেরা বিশেষ জানিত যে এ সকল স্থানে জলোচ্ছ্বাসকালীন তটদেশে এরূপ প্রচণ্ড তরঙ্গাভিঘাত হয় যে তখন নৌকাদি তীরবর্ত্তী থাকিলে তাহা খণ্ড খণ্ড হইয়া যায়। এজন্য তাহারা অতিব্যস্তে নৌকার বন্ধন মোচন করিয়া নদী-মধ্যবর্ত্তী হইতে লাগিল। নৌকা মুক্ত হইতে না হইতেই সম্মুখস্থ সৈকত ভূমি জলপ্লুত হইয়া গেল, যাত্রিগণ কেবল মাত্র ত্রস্তে নৌকায় উঠিতে অবকাশ পাইয়াছিল; তণ্ডুলাদি যাহা যাহা চরে স্থিত হইয়াছিল, তৎসমুদায় ভাসিয়া গেল। দুর্ভাগ্যবশতঃ নাবিকেরা সুনিপুন নহে; নৌকা সামলাইতে পারিল না; প্রবল জলপ্রবাহবেগে তরণী রসুলপুর নদীর মধ্যে লইয়া চলিল। এক জন আরোহী কহিল, “নবকুমার রহিল যে?” একজন নাবিক কহিল “আঃ তোর নবকুমার কি আছে? তাহাকে শিয়ালে খাইয়াছে।”

 জলবেগে নৌকা রসুলপুরের নদীর মধ্যে লইয়া যাইতেছে, প্রত্যাগমন করিতে বিস্তর ক্লেশ হইবে, এই জন্য নাবিকেরা প্রাণ পণে তাহার বাহিরে আসিতে চেষ্টা করিতে লাগিল। এমন কি, সেই মাঘ মাসে তাহাদিগের ললাটে স্বেদস্রুতি হইতে লাগিল। এরূপ পরিশ্রমদ্বারা রসুলপুর নদীর ভিতর হইতে বাহিরে আসিতে লাগিল বটে, কিন্তু নৌকা যেমন বাহিরে আসিল, অমনি তথাকার প্রবলতর স্রোতে উত্তরমুখী হইয়া তীরবৎ বেগে চলিল, নাবিকেরা তাহার তিলার্দ্ধ মাত্র সংযম করিতে পারিল না। নৌকা আর ফিরিল না।

 যখন জলবেগ এমত মন্দীভূত হইয়া আসিল যে নৌকার গতি সংযত করা যাইতে পারে, তখন যাত্রীরা রসুলপুরের মোহানা অতিক্রম করিয়া অনেক দূর আসিয়াছিলেন। এখন, নবকুমারের জন্য প্রত্যাবর্ত্তন করা যাইবে কি না, এবিষয়ের মীমাংসা আবশ্যক হইল। এই স্থানে বলা আবশ্যক যে নবকুমারের সহযাত্রীরা তাঁহার প্রতিবেশী মাত্র, কেহই আত্মবন্ধু নহে। তাঁহারা বিবেচনা করিয়া দেখিলেন, যে তথা হইতে প্রতিবর্ত্তন করা আর এক ভাঁটার কর্ম্ম। পরে রাত্রি আগত হইবে, আর রাত্রে নৌকা চালনা হইতে পারিবে না, অতএব পরদিনের জোয়ারের প্রতীক্ষা করিতে হইবেক। একাল পর্য্যন্ত সকলকে অনাহারে থাকিতে হইবেক। দুই দিন নিরাহারে সকলের প্রাণ ওষ্ঠাগত হইবেক। বিশেষ নাবিকেরা প্রতিগমন করিতে অসম্মত; তাহারা কথার বাধ্য নহে। তাহারা বলিতেছে যে নবকুমারকে ব্যাঘ্রে হত্যা করিয়াছে। তাহাই সম্ভব। তবে এত ক্লেশ স্বীকার কিজন্য?

 এইরূপ বিবেচনা করিয়া যাত্রীরা নবকুমার ব্যতীত স্বদেশ গমনই উচিত বিবেচনা করিলেন। নবকুমার সেই ভীষণ সমুদ্রতীরে বনবাসে বিসর্জ্জিত হইলেন।

 পাঠক! তুমি শুনিয়া প্রতিজ্ঞা করিতেছ তুমি কখন পরের উপবাস নিবারণার্থ কাষ্ঠাহরণে যাইবে না? যদি এমত মনে কর, তবে তুমি পামর—এই যাত্রীদিগের ন্যায় পামর। আত্মোপকারীকে বনবাসে বিসর্জ্জন করা যাহাদিগের প্রকৃতি, তাহারা চিরকাল আত্মোপকারীকে বনবাস দিবেক—কিন্তু যতবার বনবাসিত কৰুক না কেন, পরের কাষ্ঠাহরণ করা যাহার স্বভাব, সে পুনর্ব্বার পরের কাষ্ঠাহরণে যাইবে। তুমি অধম—তাই বলিয়া আমি উত্তম না হইব কেন?