কপালকুণ্ডলা (১৮৭০)/প্রথম খণ্ড/প্রথম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

কপালকুণ্ডলা।

প্রথম খণ্ড।

প্রথম পরিচ্ছেদ।


সাগরসঙ্গমে।

“Floating straight obedient to the stream”.

Comedy of Errors.

সার্দ্ধ দ্বিশত বৎসর পূর্ব্বে এক দিন মাঘ মাসের রাত্রিশেষে এক খানি যাত্রীর নৌকা গঙ্গাসাগর হইতে প্রত্যাগমন করিতেছিল। পর্ত্তুগিস নাবিক দস্যুদিগের ভয়ে যাত্রীর নৌকা দলবদ্ধ হইয়া যাতায়াত করাই তৎকালে প্রথা ছিল; কিন্তু এই নৌকারোহীরা সঙ্গিহীন। তাহার কারণ এই যে রাত্রিশেষে ঘোরতর কুজ্ঝটিকা দিগন্ত ব্যাপ্ত করিয়াছিল; নাবিকেরা দিঙ্‌নিরূপণ করিতে না পারিয়া বহর হইতে দূরে পড়িয়াছিল। এক্ষণে কোন্ দিকে কোথায় যাইতেছে তাহার কিছুই নিশ্চয় ছিল না। নৌকারোহিগণ কেহ কেহ নিদ্রা যাইতেছিলেন, এক জন প্রাচীন এবং এক জন যুবা পুৰুষ এই দুই জন মাত্র জাগ্রৎ অবস্থায় ছিলেন। প্রাচীন যুবকের সহিত কথোপকথন করিতেছিলেন। বারেক কথাবার্ত্তা স্থগিত করিয়া বৃদ্ধ নাবিকদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মাঝি, আজ কত দূর যেতে পারবি?” মাঝি কিছু ইতস্ততঃ করিয়া বলিল, “বলিতে পারিলাম না।”

 বৃদ্ধ ক্রুদ্ধ হইয়া মাঝিকে তিরস্কার করিতে লাগিলেন। যুবক কহিলেন, “মহাশয়, যাহা জগদীশ্বরের হাত তাহা পণ্ডিতে বলিতে পারে না—ও মূর্খ কি প্রকারে বলিবে? আপনি ব্যস্ত হইবেন না।”

 বৃদ্ধ উগ্রভাবে কহিলেন, “ব্যস্ত হব না? বল কি, বেটারা দু দশ বিঘার ধান কাটিয়া লইয়া গেল, ছেলে পিলে সম্বৎসর খাবে কি?”

 এ সম্বাদ তিনি সাগরে উপনীত হইলে পরে, পশ্চাদঃগত অন্য যাত্রীর মুখে পাইয়াছিলেন। যুবা কহিলেন, “আমি ত পূর্ব্বেই বলিয়াছিলাম, মহাশয়ের বাটীতে অভিভাবক আর কেহ নাই—মহাশয়ের আসা ভাল হয় নাই।”

 প্রাচীন পূর্ব্ববৎ উগ্রভাবে কহিলেন, “আসব না? তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে। এখন পরকালের কর্ম্ম করিবনা ত কবে করিব?”

 যুবা কহিলেন, “যদি শাস্ত্র বুঝিয়া থাকি, তবে তীর্থ দর্শনে যেরূপ পরকালের কর্ম্ম হয়, বাটী বসিয়াও সেরূপ হইতে পারে।”

 বৃদ্ধ কহিলেন, “তবে তুমি এলে কেন?”

 যুবা উত্তর করিলেন, “আমি ত আগেই বলিয়াছি, যে সমুদ্র দেখিব বড় সাদ ছিল, সেই জন্যই আসিয়াছি।” পরে অপেক্ষাকৃত মৃদুস্বরে কহিতে লাগিলেন, “আহা! কি দেখিলাম! জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না!

‘দূরাদয়শ্চক্রনিভস্য তন্বী
তমালতালীবনরাজিনীলা।
আভাতি বেলা লবণাম্বুরাশে-
র্দ্ধারানিবন্ধেব কলঙ্করেখা।’”

 বৃদ্ধের শ্রুতি কবিতার প্রতি ছিল না, নাবিকেরা পরস্পর যে কথোপকথন করিতেছিল তাহাই একতানমনঃ হইয়া শুনিতেছিলেন।

 এক জন নাবিক অপরকে কহিতেছিল “ও ভাই—এত বড় কাজটা খারাবি হলো—এখন যে মহাসমুদ্রে পড়লেম—কি কোন দেশে এলেম তাহা যে বুঝিতে পারি না।”

 বক্তার স্বর অত্যন্ত ভয়সূচক। বৃদ্ধ বুঝিলেন যে কোন বিপদ্ আশঙ্কার কারণ উপস্থিত হইয়াছে। সশঙ্কচিত্তে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মাঝি কি হয়েছে?” মাঝি উত্তর করিল না। কিন্তু যুবক উত্তরের প্রতীক্ষা না করিয়া বাহিরে আসিলেন। বাহিরে আসিয়া দেখিলেন, যে প্রায় প্রভাত হইয়াছে। চতুর্দ্দিক অতি গাঢ় কুজ্ঝটিকায় ব্যাপ্ত হইয়াছে; আকাশ নক্ষত্র চন্দ্র উপকূল কোন দিকে কিছুই দেখা যাইতেছে না। বুঝিলেন, নাবিকদিগের দিগ্‌ভ্রম হইয়াছে। এক্ষণে কোন্ দিকে যাইতেছে, তাহার নিশ্চয়তা পাইতেছে না—পাছে বাহির সমুদ্রে পড়িয়া অকূলে মারা যায়, এই আশঙ্কায় ভীত হইয়াছে।

 হিম নিবারণ জন্য সম্মুখে আবরণ দেওয়া ছিল, এজন্য নৌকার ভিতর হইতে আরোহিরা এ সকল বিষয় কিছুই জানিতে পারেন নাই। কিন্তু নব্য যাত্রী অবস্থা বুঝিতে পারিয়া বৃদ্ধকে সবিশেষ কহিলেন; তখন নৌকা মধ্যে মহাকোলাহল পড়িয়া গেল। যে কয়েকটী স্ত্রীলোক নৌকা মধ্যে ছিল, তন্মধ্যে কেহ কেহ কথার শব্দে জাগিয়াছিল; শুনিবামাত্র তাহারা আর্ত্তনাদ করিয়া উঠিল। প্রাচীন কহিল, “কেনারায় পড়! কেনারায় পড়! কেনারায় পড়।”

 নব্য ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “কেনারা কোথা তাহা জানিতে পারিলে এত বিপদ্ হইবে কেন?”

 ইহা শুনিয়া নৌকারোহীদিগের আরও কোলাহল বৃদ্ধি হইল। নব্য যাত্রী কোন মতে তাহাদিগের স্থির করিয়া নাবিকদিগকে কহিলেন, “আশঙ্কার বিষয় কিছুই নাই, প্রভাত হইয়াছে—চারি পাঁচ দণ্ডের মধ্যে অবশ্য সূর্য্যোদয় হইবেক। চারি পাঁচ দণ্ডের মধ্যে নৌকা কদাচ মারা যাইবে না। তোমরা এক্ষণে বাহন বন্ধ কর, স্রোতে নৌকা যথায় যায় যাক্; পশ্চাৎ রৌদ্র হইলে পরামর্শ করা যাইবে।”

 নাবিকেরা এই পরামর্শে সম্মত হইয়া তদনুরূপ আচরণ করিতে লাগিল।

 অনেক ক্ষণ পর্য্যন্ত নাবিকেরা নিশ্চেষ্ট হইয়া রহিল। যাত্রীরা ভয়ে কণ্ঠাগতপ্রাণ। বায়ুমাত্র নাই, সুতরাং তাঁহারা তরঙ্গান্দোলনকম্প কিছুই জানিতে পারিলেন না। তথাপি সকলেই মৃত্যু নিকট নিশ্চিত করিলেন। পুৰুষেরা নিঃশব্দে দুর্গানাম জপ করিতে লাগিলেন, স্ত্রীলোকেরা সুর তুলিয়া বিবিধ শব্দ বিন্যাসে কাঁদিতে লাগিলেন। একটী স্ত্রীলোক গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জ্জন করিয়া আসিয়াছিল—সেই কেবল কাঁদিল না।

 প্রতীক্ষা করিতে করিতে অনুভবে বেলা প্রায় এক প্রহর হইল। এমত সময়ে অকস্মাৎ নাবিকেরা দরিয়ার পাঁচ পীরের নাম কীর্ত্তন করিয়া মহাকোলাহল করিয়া উঠিল। যাত্রীরা সকলেই জিজ্ঞাসা করিয়া উঠিল “কি! কি! মাঝি কি হইয়াছে?” মাঝিরাও একবাক্যে কোলাহল করিয়া কহিতে লাগিল, “রোদ উঠেছে! রোদ উঠেছে! ডাঙ্গা! ভাঙ্গা! ডাঙ্গা!” যাত্রীরা সকলেই ঔৎসুক্য সহকারে নৌকার বাহির আসিয়া কোথায় আসিয়াছেন কি বৃত্তান্ত দেখিতে লাগিলেন। দেখিলেন, সূর্য্য প্রকাশ হইয়াছে। কুজ্ঝটিকার অন্ধকার রাশি হইতে দিঙ্‌মণ্ডল একেবারে বিমুক্ত হইয়াছে। বেলা প্রায় প্রহরাতীত হইয়াছে। যে স্থানে নৌকা আসিয়াছে, সে প্রকৃত মহাসমুদ্র নহে, নদীর মোহানা মাত্র, কিন্তু তথায় নদীর যেরূপ বিস্তার সেরূপ বিস্তার আর কোথাও নাই। নদীর এক কূল নৌকার অতি নিকটবর্ত্তী বটে—এমন কি পঞ্চাশৎ হস্তের মধ্যাগত; কিন্তু অপর কূলের চিহ্ন দেখা যায় না। যে দিকেই দেখা যায়, অনন্ত জলরাশি চঞ্চলরবিরশ্মিমালা হইয়া গগন প্রান্তে গগন সহিত মিশাইয়াছে। নিকটস্থ জল, সচরাচর সকর্দ্দম নদী জল বর্ণ; কিন্তু দূরস্থ বারিরাশি নীলপ্রভ। আরোহীরা নিশ্চিত সিদ্ধান্ত করিলেন যে তাঁহারা মহাসমুদ্রে আসিয়া পড়িয়াছেন, তবে সৌভাগ্য এই যে উপকূল নিকটে, আশঙ্কার বিষয় নাই। সূর্য্য প্রতি দৃষ্টি করিয়া দিক্ নিরূপিত করিলেন। সম্মুখে যে উপকূল দেখিতেছিলেন, সে সহজেই সমুদ্রের পশ্চিম তট বলিয়া সিদ্ধান্ত হইল। তটমধ্যে নৌকার অনতি দূরে এক নদীর মুখ মন্দগামী কলধৌতপ্রবাহবৎ আসিয়া পড়িতেছিল। সঙ্গম স্থলে দক্ষিণ পার্শ্বে বৃহৎ সৈকত ভূমিখণ্ডে টিট্টিভাদি পক্ষিগণ অগণিত সংখ্যায় ক্রীড়া করিতেছিল। এই নদী এক্ষণে “রসুলপুরের নদী” নাম ধারণ করিয়াছে।