কলিকাতার ইতিহাস/দ্বিতীয় অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় অধ্যায়।

কলিকাতার প্রাচীন বিবরণ।

 কিঞ্চিদধিক দুই শতাব্দী হইল, কলিকাতা ইতিহাসে স্থান লাভ করিয়াছে। ঐ সময় হইতেই কলিকাতার উন্নতির প্রান্ত। ১৭৫২ অব্দে হলওয়েল সাহেব জমিদারের পদ গ্রহণ করিলেন, এই সময়ে তিনি ১৭৩৭ খৃষ্ট কৈর পূর্ববর্তী মালের কোনও দলিল দস্তাবেজ ও কাগজ পত্রাদি না পাই অত্যন্ত বিরক্ত হইলেন। এইরূপ করিত আছে যে, ১৭৩৮ সালের প্রবল ঝটিকাবর্ত্তে ও বন্যায় প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান্ দলিলপত্র সমস্ত নষ্ট হইয়া গিয়াছিল এবং উই পোকাতেও অনেক মূল্যবান কাগজপত্র খাইয়া নষ্ট করিয়া ফেলিয়াছিল। কেহ কেহ এমন কথা বলিয়াও অনুযোগ করেন যে, অধস্তন কর্মচারীদিগে তাচ্ছীল্য ও অনবধানতায় মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নষ্ট হইয়াছিল। যে অবস্থা বা কারণ পরম্পরায় ঐ সকল বহু মূল্য কাগজ পত্র নষ্ট হইয়া থাকুক না কেন, কোনরূপ হেতুবাদেই তাহার মার্জনা হইতে পারে না। পরন্তু ইহাও অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে যে, উর্ধতন কর্মচারীদিগের অনুচিত প্রশ্রয়প্রদান এবং তাঁহাদের অনবধানতা এই গুরুতর ক্ষতির অন্যতম প্রধান কারণ। সে যাহা হউক, হলওয়েল সাহেব বলেন, যে, ১৭৩২ সাল হইতে তিনি কাগজপত্র রক্ষার দিকে প্রকৃতপ্রস্তাবে আন্তরিকভাবে দৃষ্টি রাখিতে আরম্ভ করেন। তিনি লিখিয়াছেন ঃ এদিকে দৃষ্টি করিবার আমার অধিক অবসর ছিল না। কিন্তু তথাপি যে কিছু সামান্য অবসর পাইয়াছি, তাহাতে যতদূর হইয়া উঠে, আমি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত অবশিষ্ট পুরাতন দলিলপত্র গুছাইবার সময়ে, যে সকল কাগজপত্রে ইহার পুর্ব্ব-ইতিহাসের কিঞ্চিৎ আভাস পাওয়া যাইতে পারে, সেগুলি খুঁজিয়া বাহির করিতে সাধ্যানুসারে চেষ্টা করিয়াছি। পরন্তু কাগজপত্রগুলি বহু বৎসর ধরিয়া আফিসে বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়িয়া আছে। আবার আর্দ্রতায় উই পোকার এবং অনবধাততায় ক্রমশঃ উহার অনেক নষ্ট হইয়া গিয়াছে।”

 কলিকাতার ইতিবৃত্তের উপাদান সংগ্রহের অভিলাষী হইলে প্রধানত ভারতীয় আফিসের লাইব্রেরীতেই অনুসন্ধান করা আবশ্যক। জনৈক লেখক লিখিয়াছেন;—লণ্ডন নগরের ইণ্ডিয়ান হাউস নামক কার্য্যালয়ে গবর্ণমেণ্টের কাগজপত্রগুলি পুস্তকাকারে খণ্ডে খণ্ডে বাঁধাইয়া রাখা হইয়াছে; ঐ সকল খণ্ড গণনায় এক লক্ষ হইবে, এবং সেগুলি কলিকাতার ইতিহাসলেখকের পক্ষে অতি বিশাল জ্ঞান-ভাণ্ডার-স্বরূপ। উক্ত লেখক বলেন যে, ১৭১৭ অব্দে কলিকাতা নদীয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত একটি সামান্য পল্লীগ্রাম বলিয়া পরিচিত। তথায় কেবল কতকগুলি কৃষিজীবী চাষা এবং মৎস্য জীবী জেলের বাস ছিল। ঐ সকল সরল ও নিরীহ লোক তৃণাচ্ছাদিত কুটীরে বাস করিত, এবং স্থানে স্থানে তাহাদের ১০/১২টি কুটীরের একত্র সমাবেশ ছিল। বাসের এইরূপ ব্যবস্থা বঙ্গের সুদূর পল্লীগ্রামসমূহে অদ্যাপি দেখিতে পাওয়া যায়। তৎকালে কলিকাতা জঙ্গলময় ছিল, সুতরাং ঐ স্থান যে সে সময়ে সুন্দরবনেরই একাংশ ছিল, একথা বলিলে নিতান্ত অসঙ্গত হয় না। কলিকাতা তখন একটা জলাময় স্থান ছিল। তৎকালে স্থানে স্থানে যে সকল জঞ্জাল আবর্জনা স্থূপকার করা থাকিত এবং যে সকল জলকুণ্ড নিঃসরণভাবে পড়িয়া পচিত, তাহাতে যে স্থানীয় অস্বাস্থ্যকর শতগুণে বর্ধিত করিবে, তাহাতে আর বিস্ময়ের বিষয় কি আছে? পূর্বোক্ত শ্রেণীর অসভ্য অধিবাসীরা সেই স্থানের স্বাস্থ্যোন্নতি কল্পে কোনও রূপ সদুপায় অবলম্বন করিবে, এরূপ আশা করা বিড়ম্বনামাত্র। স্থানে স্থানে যে সকল পুষ্করিণী ছিল, সেগুলি রোগের আগারস্বরূপ ছিল। বনজঙ্গল, মৃত্তিকার আর্দ্রতা, সুন্দরবন হইতে অবিশুদ্ধ বায়ু কলিকাতার সন্নিহিত লবণ-জলের হ্রদ এগুলি সমস্তই উহার অস্বাস্থ্যকরতার মুলীভূত কারণ ছিল। সুতরাং কলিকাতা তৎকালে অস্বাস্থ্যকরতার মুক্তিমান্ প্রতিরূপ বলিয়া প্রতীয়মান হইত।

 যে সকল স্থান বর্তমান সময়ে শিয়ালদহ ও বউবাজার বলিয়া প্রসিদ্ধ, ঐ সমস্ত স্থান পর্যন্ত লবণ-জলের হ্রদটি বিস্তৃত ছিল। এই সকল ভৌতিক পদার্থ অপেক্ষা নানাপ্রকার জীবজন্তুও অল্প ভীতির কারণ ছিল না। বন্য শুকর, কুম্ভীর, হাঙ্গর, নানাজাতীয় সরীসৃপ ও ব্যাঘ্র বিস্তর ছিল।: তদ্ভিন্ন দস্যুতস্করের অত্যন্ত প্রাদুর্ভাব থাকায় ইতর প্রাণীর ন্যায় মনুষ্যও মনুষ্যের পরম শত্রু ছিল। এই সকল বিষম অসুবিধা সত্বেও কিজন্য জবচার্ণক সাহেব ইহাকে বাঙ্গালার প্রধান বাণিজ্যস্থানরূপে মনোনীত করিয়াছিলেন, তাহা এক্ষণে ভাবিতে গেলেও বিস্ময়াভিভূত হইতে হয়। উত্তরকালে ইহা বিশাল নগরে পরিণত হইয়া গৌরব-গরিমায় উদ্ভাসিত হইয়া উঠিবে, এইরূপ ভবিষ্যৎ, ভাবিয়া তিনি এই স্থানটা নির্বাচন করিয়াছিলেন, এই কথা বলিয়া তাহার দূরদর্শিতার প্রশংসা করিতে যাওয়া এক প্রকার বাতুলতা মাত্র; বরং ইহাতে এইরূপ অনুমান করাই অধিকতর সঙ্গত যে, যন্ত্র যেরূপ নিজে বোধশক্তিহীন হইয়া যন্ত্রীর পরিচালনা-কৌশলে তাহার ইচ্ছানুরূপ কার্য্যের সমাধা কবে, জবচার্ণকও সেইরূপ দুর্বোধ্য ঐশিক বিধানের পরিচালনাধীনে বোধশক্তিহীন যন্ত্রের ন্যায় সেই ইচ্ছাময়ের ইচ্ছাই পূর্ণ করিয়াছেন মাত্র। তাহার এই নির্ব্বাচনের হেতু যাহাই হউক না কেন, ইহার উত্তরকালীন পরিণাম তাঁহার সুবুদ্ধিই পরিচয় দিতেছে। সুতরাং আজ তাহাকে “সুপ্রসিদ্ধ জবচার্ণক,—প্রাচ্য ভূখণ্ডে ইংরেজদিগের মধ্যে প্রথম খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তি” এইরূপ বলিয়া বর্ণনা করা নিতান্ত অসঙ্গত।

 তিনটি মৃত্তিকাময় গ্রাম (দিল্লী কলিকাতা, গোবিন্দপুর ও সূতামুটি) হইতে বর্ত্তমান কলিকাতা উৎপন্ন হইয়াছে। ১৭৫২ খৃষ্টাব্দে হলওয়েল সাহেব গ্রামত্রয়ের পরিমাণফল এইরূপ নির্দ্দেশ করিয়াছেন, যথা,—

 দিল্লী কলিকাতা ... বিঘা ১,৭০৪৴৩ কাঠা।

 সূতানুটী ... “১৮৬১ ৹২॥ কাঠা।

 গোবিন্দপুর ... “১,৭৪১॥৩॥ কাঠা।

 “১৭৫৭ অব্দে কলিকাতার চতুঃসীমা এইরূপ নিদিষ্ট ছিল;—বর্ত্তমানে যে স্থানে বেঙ্গল ব্যাঙ্ক ও চাঁদপাল ঘাট অবস্থিত, সেইখান হইতে আরম্ভ করিয়া চৌরঙ্গি রোড ভেদ করিয়া লবণ জলের হ্রদ পর্য্যন্ত যে খাড়ি বিস্তৃত ছিল, সে খাড়ির উত্তর; লালবাজার ও চিৎপুর রোডের পশ্চিম; বড়বাজারের দক্ষিণ; এবং ভাগীরথী নদীর পূর্ব্ব। এই চতুঃসীমার বহির্ভূত তাবৎ স্থানকে মহাদেশ-বলিত, কেননা খাড়ি, নদী ও মার্হাট্টা খাত দ্বারা পরিবেষ্টিত হইয়া কলিকাতা একটি দ্বীপস্বরূপ ছিল।”

 "১৬৯৮ খৃষ্টাব্দে ইহা যখন জমিদারীরূপে ক্রীত হয় তৎকালে ইহার পরিমাণ-ফল ১৷৷৹ বর্গ মাইল মাত্র ছিল। কলিকাতা সে সময়ে একটী বাণিজ্যিক উপনিবেশ বলিয়া প্রসিদ্ধ ছিল।”

 নগরের যে অংশের মধ্য দিয়া চিৎপুর রোড বিস্তৃত তাহাই পুর্ব্বকালের সূতানুটী। যে ঘাট এক্ষণে হাটখোলা ঘাট নামে পরিচিত, তাহাই প্রায় এক শতাব্দীকাল সূতানুটী ঘাট নামে প্রসিদ্ধ ছিল, এবং তাহারই অতি নিকটে সূতানুটী বাজার নামে একটী প্রকাণ্ড বাজার ছিল। ১৮৫০ সালের ২৩ আইন অনুসারে সমস্ত কলিকাতা যখন জরিপ করা হয়, তখন সূতানুটীর চতুঃসীমা এইরূপ নিদিষ্ট হয়: বাগবাজার খালের (মার্হাট্টা খাতের) দক্ষিণ, অপার সার্কুলার রোডের পশ্চিম, রতন সরকারের গার্ডেন ষ্ট্রীট নামক রাস্তার উত্তর, ভাগীরথী নদীর পূর্ব্ব গোবিন্দপুর একটা শৃঙ্খলা অদ্ভুতদৃশ্য গ্রাম ছিল-স্থানে স্থানে কতকগুলি করিয়া কুটীরের সমাবেশ, আর সেই কুটীরসমষ্টির মধ্যে মধ্যে বনজঙ্গল। বর্তমান ফোর্ট উইলিয়াম নামক দুর্গ ও তৎসহিত ময়দান গোবিন্দপুরের স্থান অধিকার করিয়াছে।

 বাঙ্গালায় কোম্পানীর প্রথম বাণিজ্যিক উপনিবেশ হুগলী। ১৬৪৬ (১৬৪৮?) খৃষ্টাব্দে অথবা তাহার কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে বা পরে ইংরেজরা তথায় একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। কোনও সাময়িক পরে জনৈক লেখক এ রূপ লিখিয়াছেন:—‘রাণী এলিজাবেথের রাজত্বের প্রথম ভাগে অক্সফোর্ড নগরের নিউ কলেজের ষ্টিফেন্স নামক জনৈক ইংরেজ ছাত্র একাকী পর্যটন করিয়া প্রবল প্রতাপ সুপ্রসিদ্ধ মোগল সম্রাটের রাজধানীতে উপস্থিত হইয়াছিলেন। প্রাচ্য রাজসভার যে সকল ঐশ্বর্য্য আড়ম্বরের কথা ঐতিহাসিকেরা লিখিয়া গিয়াছেন এবং কবিরা গাহিয়া গিয়াছেন, সেই সকল স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করাই তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল। ঐ অক্সফোর্ডবাসী যুবক যে সকল বিবরণ স্বদেশে লিখিয়া পাঠাইয়াছিলেন, তৎপঠে পর্য্যটকগণ সুদূর প্রাচ্য ভূখণ্ডে পরিভ্রমণ করিবার নিমিত্ত নবানুরাগে উদ্দীপিত হইয়া উঠেন। ১৫৮৩ খ্রীষ্টাব্দে নিউবেরি ও ফিচ নামক দুইজন সাহেব মহারাণী এলিজাবেথের নিকট হইতে সম্রাট আকবরের নামে একখানি পত্র লইয়া স্থলপথে সায়িরা দিয়া ভারতবর্ষে উপনীত হন। ফিচ সাহেব যে সকল বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন, তাহা অদ্যাপি বর্তমান আছে। সেই বিবরণ হইতে ষোড়শ শতাব্দীতে এই দেশের ও ইহার অধিবাসীবর্গের অবস্থা কিরূপ ছিল, তাহার অনেক প্রয়োজনীয় কথাই আমরা জানিতে পারি।

 ইংরেজদিগের হুগলীতে অবস্থান কালে দুর্ভাগ্যক্রমে সামান্য একটা বাজারে ঝগড়া লইয়া নবাবের ফৌজের সহিত ইংরেজদিগের বিবাদ উপস্থিত হয় এবং সেই সূত্রে কোম্পানীকে হুগলী পরিত্যাগ করিয়া আসিতে হয়। ঘটনাটা এই হুগলী তৎকালে ফৌজদারি উপাধিধারী জনৈক মুসলমান রাজকর্মচারীর শাসনাধীন ছিল। ঐ ব্যক্তি স্বেচ্ছানুসারে কার্য্য করিবার ক্ষমতা পাইয়াছিল, তাহার উপর তাহার লোকবলও যথেষ্ট ছিল, এজন্য সে বিদেশীদিগকে অত্যন্ত অবজ্ঞা করিত এবং তাহাদের নিকট হইতে যাহা লইতে পারিত, তাহাই লইয়া আপনার অর্থলালসা চরিতার্থ করিত। ইংরেজদিগের সংখ্যা অতি অল্প ছিল; সুতরাং ফৌজদার তাহাদের সেই অসহায় অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করিয়া আপনার স্বার্থসাধন করিতে লাগিল। তাহার এই সকল অন্যায় অত্যাচার ও জুলুম জবরদস্তিতে ডিরেক্টরসভা অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া উঠিলেন। তাঁহারা তাহাদের হুগলীস্থ এজেণ্টকে এইরূপ আদেশ করিয়া পাঠাইলেন যে, তাহাদের মালগুদাম নির্মাণ করিবার জন্য ও গড় দুর্গাদি দৃঢ় করিবার নিমিত্ত নবাবের নিকট যেন কিছু ভূমি প্রার্থনা করা হয়, এবং সমস্ত বিষয় যেন মোগল সম্রাটের নিকট নিবেদন করা হয়। ক্রমশঃ ফৌজদার ইংরেজদিগের প্রতি জুলুম করি আরও অধিক অর্থের দাবী করায় অবস্থা চরম উঠিল এবং পূর্বোক্ত বিবাদ উপস্থিত হইল। অনন্তর নবাবের নিকট এবং তৎপরে মোগল সম্রাটের নিকট আপীল করা হইল, কিন্তু তাহাতে কোনও ফলোদয় হইল না। ইতিমধ্যে ইংরেজদিগের বাণিজ্য রহিত হইয়া গেল, এবং তাহাদিগের জাহাজগুলি অর্থপূর্ণ অবস্থাতেই তথা হইতে পঠাইয়া দেওয়া হইল।

 ইংলণ্ডের দ্বিতীয় জেমস ভারতবর্ষে ইংরেজ বণিকদিগের দুর্দ্দশার কথা শুনিয়া কোম্পানীর পক্ষ অবলম্বন করিলেন, এবং সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সহিত তাঁহাদের সময়ে প্রবৃত্ত হইবার প্রার্থনায় অনুমোদন করিলেন। ইংলণ্ডের সামরিক নৌ-বিভাগ হইতে দশ খানি জাহাজ কাপ্তেন নিকলসন নামক জনৈক সেনাপতির নেতৃত্বাধীনে প্রেরিত হইল। জাহাজগুলিতে ১২ হইতে ৭০টি পর্যন্ত কামান সজ্জিত ছিল। নিকলসনের প্রতি এই অনুমতি ছিল যে, বন্দরে পহুছান পর্যন্ত তিনি পোতবহরের কর্তৃত্ব করিবেন, কিন্তু পোতবহর বন্দরে উপস্থিত হইবামাত্র হুগলীর প্রধান ইংরেজ কর্ম্মকর্ত্তা তাঁহার পদ গ্রহণ করিয়া প্রধান নৌ-সেনাপতিরূপে সমস্ত বহরের অধ্যক্ষতা করিবেন, আর জাহাজে যে ছয় দল পদাতি সৈ ছিল, কাউন্সিলের সদস্যগণ তাহাদের নেতৃত্ব করিবেন। নকল সনের প্রতি আদেশ ছিল যে, তিনি ক্ষতিপূরণ স্বরূপ ৬৬ লক্ষ টাকার দাবি করিবেন এবং আবশ্যক হইলে বলপ্রকাশ করিয়া কামানের মুখে সেই টাকা আদায় করিয়া লইবেন। এই পোতবহরের কয়েক খানি মাত্র জাহাজ হুগলীতে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে, এজেণ্ট সাহেব সোদ্বেগে অবশিষ্ট জাহাজের আগমন প্রতীক্ষা করিতেছেন, এমন সময়ে ঐ জাহাজের তিনজন নাবিকের মদমত্ত অবস্থার সামান্য ঝগড়া লইয়া উভয় পক্ষে প্রকাশ্য যুদ্ধ উপস্থিত হইল।

 কাপ্তেন নিকলসন এইরূপ সুন্দর ছল পাইয়া নগরের উপর গোলাবর্ষণ করিতে লাগিলেন এবং ৫০০ গৃহে আগুন লাগাইয়া দিলেন। বলা বাহুল্য, এরূপ অবস্থায় গোলযোগের আপোষ নিস্পত্তির সম্ভাবনা সুদূরপরাহত হল। পরন্তু ফৌজদার ভয় পাইয়া যুদ্ধ স্থগিত মাখিবার প্রার্থনা করিল এবং সেই সঙ্গে নিকলসন সাহেবের দাবী সম্রাটের বিবেচনার্থ তাঁহার গোচর করিবে বলিয়া অঙ্গীকার করিল। অতঃপর ইংরেজের হুগলী পরিত্যাগ করিয়া প্রথমতঃ বরানগরের ওলন্দাজ উপনিবেশের পূর্ব্বদিকস্থ[১] সূতানুটী নামক গ্রামে আগমন করিলেন। ইতিমধ্যে নবাবের সৈন্য ঘটনাস্থলে আসিয়া উপস্থিত হইলে চার্নক সাহেব এই কার্য্যকে সন্ধির নিয়ম ভঙ্গ মনে করিয়া টান্না ও ইঞ্জেলি (হিজলি) নামক স্থানদ্বয়ের মধ্যবর্তী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপগুলিতে দাঙ্গা হাঙ্গামা ও লুটপাট আরম্ভ করিয়া দিলেন, এবং শেষোক্ত স্থানটী গ্রহণ করিয়া গড়বন্দি করিয়া ফেলিলেন। ষ্টাণ্ডেল সাহেব হিজলিকে যতদূর সম্ভব কদর্য স্থান বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন, উহা একটি নিম্ন জলাভূমি, সর্বত্রই লম্বা লম্বা বাসে সমাচ্ছন্ন, ঐ স্থানে জোয়ারের ও বানের লোনা জল উঠিত, এবং উহাতে এক বিন্দুও ভাল জল পাইবার উপায় ছিল না। এইরূপ কার্য্য স্থানে ইংরেজদিগের অর্ধেক সৈন্য নষ্ট হইল। এবং নবাবের ফৌজও প্রায়ই মধ্যে মধ্যে তাহাদিগকে আক্রমণ করিতে লাগিল।

 এদিকে নিকলসন সাহেব হুগলী লুণ্ঠন না করিয়া ফৌজদারের সহিত সন্ধি করায় ডিরেক্টর সভা তাহার প্রতি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইলেন, এবং ডিফায়েন্স নামক একখানি ছোট জাহাজে ১৬০ জন লোক পূর্ণ করিয়া হাথ সাহেবের নেতৃত্বাধীনে পাঠাইয়া দিলেন। হাথ সাহেবের উপর আদেশ হল যে, হয় তিনি যুদ্ধে সহায়তা করিবেন, অথবা শত্রুপক্ষের সহিত আপোষ নিষ্পত্তি হইয়া গিয়া থাকিলে কোম্পানীর যাবতীয় লোকজন ও দ্রব্যসামগ্রী জাহাজে তুলিয়া লইয়া আসিবেন। ১৬৮৮ সালে হীথ আসিয়া উপস্থিত হইলেন, এবং বালেশ্বরে অবতীর্ণ হইয়া তথাকার কামানের আড্ডা আক্রমণ করিয়া নগর লুণ্ঠন করিলেন। অনন্তর তিনি কোম্পানীর যাবতীয় কর্মচারী ও ভৃত্যগণকে লইয়া চট্টগ্রামের অভিমুখে যাত্রা করিলেন, এবং জনৈক আরাকাণী রাজার সহিত সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হইবার পর তিনি সহসা মাদ্রাজ অভিমুখে প্রস্থান করিলেন এবং তথায় উপস্থিত হইয়া কোম্পানির লোকজনকে নামাইয়া দিলেন। অতঃপর কয়েক বৎসর ইংরেজদিগের নানাপ্রকার অভূতপূর্ব ভাগ্যবিপর্যয় ঘটিল-কোম্পানির অস্ত্রবলে বাঙ্গালার স্থানাধিকারের সর্ব্বপ্রকার চেষ্টাই বিফল হইল এবং তাহাতে তাঁহাদের বাণিজ্য ও বাণিজ্যিক উপনিবেশগুলি সমস্তই সম্পূর্ণ ধ্বংসমুখে পতিত হইবার সম্ভবনা হইয়া উঠিল। অবশেষে ইংরেজেরা বাধ্য হইয়া নবাবের সহিত সন্ধি করিলেন, এবং তাহার অনুমতিক্রমে উলুবেড়িয়ার দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। তৎকালে ইব্রাহিম খাঁঁ বাঙ্গালার সুবাদার ছিলেন। পরন্তু এই নূতন স্থানও অসুবিধাজনক বিবেচিত হওয়ায় চার্ণক সাহেব কোনও দুর্বোধ্য হেতুতে সূতানুটী মনোনীত করিলেন, এবং অবশেষে তথায় কুঠি স্থাপন করিলেন। ইহার নিমিত্ত তিনি মোগল রাজসরকারে বাণিজ্য শুল্কের পরিবর্তে বার্ষিক ৩,০০০ টাকা পেসকশ দিবেন, এইরূপ স্থির হইল।

 এ, ষ্টিফেন নামক একজন সাহেব লিখিয়াছেন যে, বাঙ্গালারবসুবাদার ইব্রাহিম খাঁ চার্ণক সাহেবকে তাহার পূর্ব বাণিজ্যস্থানে প্রত্যাবৃত্ত হইবার নিমিত্ত পুনঃ পুনঃ সনির্বন্ধ অনুরোধ করিয়া পাঠাইতে লাগিলেন। অবশেষে চার্ণক সাহেব এই অনুরোধ রক্ষা করিলেন এবং রাশি রাশি পণ্যদ্রব্য লইয়া সূতানুটীতে অবতীর্ণ হইলেন। ২৭শে এপ্রেল তারিখে তিনি একটী ফর্ম্মান (সনদ) প্রাপ্ত হইলেন। তাহাতে সম্রাট এইরূপ অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়াছিলেন যে, ইংরেজরা যে তাঁহাদের পূর্ব্ব অন্যায় আচরণ ও কার্য্যের জন্য অনুতাপ করিয়াছেন, ইহা তাঁহাদের পরম সৌভাগ্যের বিষয়, এই জন্যই তাঁহাদিগকে বাণিজ্য করিবার অনুমতি প্রদত্ত হইল।

 অপর একজন লেখকের মত এই যে, ইংরেজদিগের যে সকল দ্রব্যাদি লুণ্ঠিত হইয়াছিল, তাহার ক্ষতিপূরণস্বরূপ সম্রাট ঔরঙ্গজেব ৬০ হাজার টাকা দিতে স্বীকৃত হন এবং তদনুসারে ১৬৯০ সালের ২৪শে আগষ্ট তারিখে চার্ণক সাহেব ভাগীরথীর তীরে ইংলণ্ডের পতাকা প্রোথিত করিয়া কলিকাতা মহানগরীর ভিত্তিস্থাপন করেন।

 ১৬৯২ সালের জানুয়ারি মাসে জব চার্ণক কালগ্রাসে পতিত হইলে সার জন গুল্‌ড্‌স্‌বরো নামক জনৈক সম্ভ্রান্ত ইংরেজ কলিকাতার প্রধান এজেণ্ট নিযুক্ত হন। তৎকালে সমুদায় ব্যাপারই এরূপ বিশৃঙ্খল ও কদর্য্য অবস্থাপন্ন ছিল যে, কোনও লোককেই বিশ্বাস করিয়া চলিবার উপায় ছিল না। সে যাহা হউক,১৬৯৪-৯৫ অব্দে ডিরেক্টর সভা সূতানুটীকেই তাঁহাদের বাঙ্গালার প্রধান বাণিজ্যস্থান বলিয়া ঘোষণা করিলেন এবং উহার নিকটবর্ত্তী অন্যান্য গ্রামগুলিও বন্দোবস্ত করিয়া লইবার নিমিত্ত তাঁহাদেয় প্রধান প্রধান এজেণ্টের প্রতি আদেশ প্রেরণ করিলেন। ১৬৯৬-৯৭ অব্দে বর্দ্ধমানের জমিদার শোভাসিংহ যৎকালে বিদ্রোহ উপস্থিত করেন, তৎকালে ইংরেজরা সেই সুযোগে আপনাদের বাণিজ্য-স্থানগুলি শত্রুর আক্রমণ হইতে রক্ষা করিবার উদ্দেশ্যে দুর্গাদি নির্ম্মাণদ্বারা সেগুলিকে সুদৃঢ় করিবার নিমিত্ত মোগল সরকারের অনুমতি গ্রহণ করেন। তদনুসারে কলিকাতায় সেই পূর্ব্ব ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ নির্ম্মিত হয়, এবং ১৬৯৯ অব্দে উহার নির্ম্মাণকার্য্য সমাপ্ত হইলে ইংলণ্ডের তদানীন্তন রাজা তৃতীয় উইলিয়মের অনুমতি ক্রমে তাঁহার নামানুসারে উহার নামকরণ করা হয়। প্রায় ইহারই সমকালে ওলন্দাজেরা চুঁচুড়ায় ফোর্ট গষ্টভাস নামক দুর্গ নির্ম্মাণ করেন এবং ফরাসীরাও চন্দ্রনগরে (ফরাসডাঙ্গায়) তাঁহাদের একটি দুর্গ নির্ম্মাণ করেন। নবাবও সূতানুটীতে ইংরেজদিগের স্বত্ব সাব্যস্থ করিয়া দিবার নিমিত্ত একটি “নিসান” প্রেরণ করেন, এবং তাহারই বলে ইংরেজরা সূতানুটীর সন্নিহিত কলিকাতা ও গোবিন্দপুর নামক গ্রামদ্বয় জমা করিয়া লন।

 ইংরেজদিগের বাণিজ্যিক উপনিবেশরূপে কলিকাতার নির্ব্বাচন ব্যাপার সম্বন্ধে গ্ল্যাড উইন সাহেবের “বেঙ্গল” নামক পুস্তকে আর এক প্রকার বিবরণ দেখিতে পাওয়া যায়। তাহার মর্ম্ম এইরূপ:—যৎকালে ইংরেজরা মাধ্যাহ্নিক আহারে (খানায়) বসিয়াছিলেন, সেই দিবা দ্বিপ্রহরে হুগলীস্থিত ইংরেজদেগের কুঠি সহসা সশব্দে নদীগর্ভে বসিয়া যাওয়ায় কয়েকজন লোক মারা গেল, এবং অবশিষ্ট কয়েকজন অতি কষ্টে প্রাণরক্ষা করিল, কিন্তু তাহদের পণ্যদ্রব্য ও অর্থাদি সমস্তই বিনাশ প্রাপ্ত হইল। এই দুর্ঘটনা হেতু গবর্ণর চার্ণক আর একটি স্থান অনুসন্ধান করতে লাগিলেন। তিনি হুগলীর নিকটেই একটি স্থান মনোনীত করিলেন এবং তথায় কুঠি নির্ম্মাণ করিয়া দুর্গাদি দ্বারা তাহা সুদৃঢ় করিতে আরম্ভ করিলেন। কিন্তু দেশীয় বণিকেরা অনুযোগ করিতে লাগিল যে, ইংরেজদিগের অনেকগুলি গৃহ দ্বিতল এবং সেই উচ্চ গৃহ হইতে তাঁহারা দেশীয়দিগের পুরাঙ্গনার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া থাকেন। অনন্তর দেশীয়েরা মুর্শিদাবাদে যাইয়া অভিযোগ উপস্থিত করিলে নবাব হুকুম করিয়া পাঠাইলেন যে, ইংরেজদিগের কুঠিনির্ম্মাণ কার্য্য যেন সমাপ্ত করা না হয়। এই কথা শুনিয়া মজুরেরা কাজ করিতে অস্বীকার করিল। তখন চার্ণক সাহেব নদীর সেই পার্শ্বের যাবতীয় গৃহে অগ্নি সংযোগ করিয়া একখানি জাহাজে আরোহণ করিলেন। ফৌজদার (কলিকাতার নিকটস্থ) মুকুয়া থানার থানাদারকে সেই জাহাজ ধরিবার জন্য আদেশ করিয়া পাঠাইলেন। ইতিপূর্ব্বে আরাকানী ও মগ বোম্বেটেরা ভাগীরথী নদীতে যারপর নাই দৌরাত্ম্য ও লুণ্ঠনাদি করিত বলিয়া তাহাদের গতিরোধ করিবার নিমিত্ত একটী প্রকাণ্ড ও সুদৃঢ় লৌহশৃঙ্খল নির্ম্মিত হইয়াছিল। নদীর এপার হইতে ওপার পর্যন্ত সেই শৃঙ্খল বিস্তৃত করিয়া দিল, কিন্তু ইংরেজরা শৃঙ্খল ভগ্ন করিয়া চলিয়া গেলেন। ইংরেজদিগের জাহাজ একবার দুর্ভিক্ষের সময়ে আলমগিরের শিবিরে শস্য সরবরাহ করায় মোগল সম্রাট চার্ণকের প্রতি প্রসন্ন ও অনুকূল হইলেন এবং তাহাকে কলিকাতায় কুঠি নির্ম্মাণ করিতে অনুমতি প্রদান করিলেন।

 ১৬৯৮ খৃষ্টাব্দে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি কেবলমাত্র ১৬ হাজার টাকা মূল্যে সূতানুটী, গোবিন্দপুর, ও কলিকাতা এই তিনখানি গ্রাম ও তৎসংলগ্ন ভূমি ক্রয় করেন। উক্ত ভূমি ভাগীরথীর পূর্ব্ব পারে নদীর ধার দিয়া দৈর্ঘ্যে প্রায় তিন মাইল এবং প্রস্থে প্রায় এক মাইল বিস্তৃত হইল। প্রোক্ত গ্রামত্রয় ঠিক কোন্ সময়ে কেবল “কলিকাতা” আখ্যায় আখ্যাত ও পরিচিত হইতে আরম্ভ করে, তাহা নির্ণয় করা সুকঠিন। কখনও উহা “পরগণা কলিকাতা” বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে; আবার ১৭৭৮ খৃষ্টাব্দের দলিলপত্রে “কলিকাতার অন্তর্গত সূতানুটী প্রভৃতি গ্রামসমূহ” এইরূপ উল্লেখও দেখিতে পাওয়া যায়। আজি কালি গোবিন্দপুর এবং সূতানটীর নাম আর শুনিতে পাওয়া যায় না। “আর্ম্মানীদিগের ইতিহাস” নামক এক খানি সুন্দর ক্ষুদ্র পুস্তিকায় লিখিত আছে যে, খোজা সরহিড ইজরেল নামক একজন আর্ম্মানী সম্রাট্‌ ঔরঙ্গজেবের পৌত্র ও বাঙ্গালার সুবাদার কুমার আজিম ওশমানের নিকট এই তিনখানি গ্রামের পুর্ব্বাধিকারীদিগের নিকট হইতে উহা ক্রয় করিবার অনুমতি লাভ করিবার নিমিত্ত প্রভূত শ্রম স্বীকার করিয়াছিলেন। ইতিপূর্ব্বে বিদ্রোহী পাঠান সর্দ্দার রহিম খাঁকে দর্শন করিবার নিমিত্ত সম্রাট ঔরঙ্গজেব যৎকালে তাঁহার সুপ্রসিদ্ধ নির্ভীক সেনাপতি জবরদস্ত খাঁকে প্রেরণ করেন, সেই সময়ে উক্ত আর্ম্মানী ইংরেজদিগের পলিটিকাল এজেণ্ট (রাজনৈতিক প্রতিনিধি) রূপে জবরদস্ত খাঁর সভায় উপস্থিত হইয়া ইংরেজদিগের সপক্ষে এই গ্রামগুলি লাভ করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু তৎকালে কৃতকার্য হইতে পারেন নাই। সুবিখ্যাত ঐতিহাসিক মালিসন বলেন, ষ্টানলি নামক একজন সাহেব পূর্ব্বোক্ত গ্রাম তিনখানি এবং ভাগীরথীর উভয় পার্শ্বস্থ ও তৎসন্নিহিত অন্যান্য ভূমি প্রাপ্ত হইবার নিমিত্ত সুবাদারের রাজসভায় ইংরেঙ্গপক্ষের প্রতিনিধিরূপে প্রেরিত হইয়াছিলেন। পরন্তু তাঁহার আবেদনে ঈপ্সিত ফললাভ হইয়াছিল কিনা সন্দেহ। প্রত্যুত গ্যাব্রিয়েল হ্যামিলটন নামক জনৈক স্কটলণ্ডবাসী ডাক্তারের নিকট ইংরেজেরা এ বিষয়ের নিমিত্ত প্রভূতপরিমাণে ঋণী। এই ডাক্তার সাহেবের বিশিষ্টরূপ আনুকূল্যে ইংরাজেরা কেবল যে পূর্ব্বোক্ত গ্রামত্রয় প্রাপ্ত হইয়াছিলেন এমন নহে, প্রত্যুত তাঁহারই সহায়তায় ভাগীরথীর উভয়-পার্শ্বস্থ আরও ৩৭।৩৮ খানি গ্রাম ইংরেজরা লাভ করিয়াছিলেন। বস্তুতঃ ইহা বড়ই আনন্দের বিষয় যে, চিকিৎসকদিগের চিকিৎসা-নৈপুণ্যের গুণেই ইংরেজরা প্রকৃতপক্ষে ভারতে দাঁড়াইবার স্থান লাভ করিতে পারিয়াছিলেন। ডাক্তার বাউটন[২] কর্ত্তৃক সম্রাট শাহ জাহাঁর কন্যার চিকিৎসা সফলতা ও হ্যামিল্টন কর্ত্তৃক সম্রাট ফরকসিয়ারের অস্ত্রচিকিৎসা যে নীতি শিক্ষা দিতেছে, তাহা উপেক্ষা করিবার নহে।

 বাঙ্গালার শাসনকর্ত্তা নবাব জাফর খাঁ ইংরেজদিগের প্রতি অত্যন্ত বিরূপ এবং তাঁহাদের স্বার্থসাধনের নিতান্ত প্রতিকূল ছিলেন। সম্রাট ঔরঙ্গজেব ইংরেজদিগকে যে সকল অধিকার প্রদান করিয়াছিলেন, জাফর খাঁ প্রকাশ্যে তাহার কোনরূপ বিরুদ্ধাচরণ না করিয়া তাঁহাদিগকে কষ্ট দিবার নিমিত্ত নানাপ্রকার কূট কৌশল অবলম্বন করিতে লাগিলেন। কোম্পানী শীঘ্রই দেখিলেন যে, এতদ্দেশে তাঁহাদের অবস্থা বড় সুবিধাজনক নহে। অবশেষে ১৭১৩ অব্দে তাঁহারা দিল্লীতে মোগল রাজসভায় আবেদন সহ দূত প্রেরণ করাই পরামর্শাসিদ্ধ বলিয়া স্থির করিলেন। তৎকালে হজেস সাহেব কলিকাতার গভর্ণর ছিলেন। দিল্লীতে ইংরেজপক্ষের দুঃখদুর্দ্দশার কথা নিবেদন করিবার নিমিত্ত যে সরম্যান্‌, ই ষ্টিফেন্সন নামক দুইজন সাহেব এবং আর্ম্মানী খোজা সর্হেড দূতরূপে নির্ব্বাচিত হইলেন। তাঁহারা উপঢৌকনস্বরূপ নানাপ্রকার অতি সুদৃশ্য ও মনোহর কাচের জিনিষ, ঘড়ি, খেলেনা, কিঙখাপ, এবং সর্ব্বোৎকৃষ্ট সূক্ষ্ম পশমী ও রেশমী কাপড় সঙ্গে লইলেন। এই দূতদল দিল্লীর উদ্দেশে যাত্রা করিয়া পথে থাকিতে থাকিতে সম্রাট্‌ ফরুকশিয়ার এরূপ একটি উৎকট রোগে আক্রান্ত হইলেন যে, তাহাতে অস্ত্র-চিকিৎসকের সহায়তা আবশ্যক হইয়া উঠিল। খা ঁদুরন নামক সম্রাটের এক বিশ্বস্ত অমাত্য ইংরেজদিগের প্রতি অনুকূল ছিলেন। তাঁহারই অনুগ্রহে ও যত্নে ডাক্তার হ্যামিল্‌টনকে সম্রাটের চিকিৎসার্থে আহ্বান করা হইল। ডাক্তার সাহেবের অস্ত্রচিকিৎসার গুণে সম্রাট্‌ অচিরে আরোগ্যলাভ করিলেন। ইহাতে তিনি সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া ইংরেজ ডাক্তারকে যথোচিত পারিতোষিক প্রদান করিবার অভিলাষ প্রকাশ করিলেন। ডাক্তার হ্যামিল্‌টন সেই সময়ে প্রার্থনা করিলেন যে, সম্রাট্‌ যেন অনুগ্রহ করিয়া ইংরেজ দূত দলের আবেদন পূর্ণ করেন। অতঃপর দূতগণ ১৭১৫ অব্দে দিল্লীতে উপিস্থত হইলেন। সম্রাট্‌, হ্যামিল্‌টন সাহেবের এইরূপ নিঃস্বার্থ-পরতায় বিমুগ্ধ হইয়া দূতদলের আবেদন বিশেষরূপ অনুকুলভাবে বিবেচনা করিবেন, এ কথা তৎক্ষণাৎ সন্তুষ্টচিত্তে স্বীকার করিলেন। এই সময় মারওয়ার-অধিপতি অজিতসিংহের কন্যা ইন্দ্রকুমারীর সহিত সম্রাটের বিবাহ ব্যাপার উপস্থিত হইল। সুতরাং সম্রাটের দূতদলের আবেদন শ্রবণে কিঞ্চিৎ বিলম্ব ঘটিয়া যাইল। অবশেষে ১৭১৬ খ্রীষ্টাব্দে সম্রাটের নিকট আবেদন পেশ করা হইল। ১৭১৭ খৃষ্টাব্দে সম্রাট্‌ ইংরাজগণকে ৩৭ বা ৩৮ খানি গ্রাম ক্রয় করিবার অনুমতি প্রদান করিলেন। এই সঙ্গে সঙ্গে ইংরাজগণকে অন্যান্য নানাপ্রকার ব্যবসায়সম্বন্ধীয় সুযোগসুবিধাও প্রদত্ত হইল।

 উন্নতিমার্গে অগ্রসর হইতে হইতে কলিকাতাকে নানাপ্রকার ভাগ্য-বিপর্যয়ের অধীন হইতে হইয়াছে। ইংরেজ-বণিক্‌গণ কিরূপ ক্লেশসাধ্য আয়াসপরম্পরা স্বীকার করিয়া এবং কিরূপ দুরতিক্রম্য বাধাবিঘ্নসমুহ অতিক্রম করিয়া এদেশে কুঠি নির্ম্মাণ করিতে ও বাণিজ্যব্যবসায় চালাইতে সমর্থ হইয়াছিলেন, তাহা আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি। বস্তুতঃ ইংরেজ উপনিবেশের উপচীয়মান সৌভাগ্যদর্শনে ঈর্ষ্যাকলুষিত হৃদয়ে মোগলকর্ত্তৃপক্ষীয়েরা ইংরেজদিগের উন্নতিপথে যে সকল বিষম অন্তরায় সংস্থাপন করিয়াছিলেন, তাহা ইতিহাস পাঠকমাত্রেই বিদিত আছেন। কলিকাতাকে যে সকল উৎকট উৎপাত সহ্য করিতে হইয়াছিল, তাহার মধ্যে ১৭৩৭ সালের ঝড় সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। উহার সহিত আবার ভূমিকম্পও ছিল। এই দুর্ঘটনায় নদীতীরস্থ বহু গৃহ (অনেকে বলেন, প্রায় দুইশত) ভূমিসাৎ হইয়াছিল, এবং ইংলিশ চর্চ্চ নামক গির্জার সমুচ্চ সুন্দর চুড়াটী বিচ্যুত হইয়া পড়িয়া গিয়াছিল; তদ্ভিন্ন, ভিন্ন ভিন্ন জাতির দুই সহস্র জাহাজ, বোট, বজরা, ডিঙ্গি প্রভৃতি তাহাদের নোঙ্গর ও কাছি হইতে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় তাহাদের কতকগুলি জলমগ্ন হইয়াছিল এবং অবশিষ্টগুলি ভাঙ্গিয়া চুরিয়া গিয়াছিল। গঙ্গার জল সাধারণতঃ যেরূপ উচ্চ হইয়া থাকে, স্ফীত হইয়া তাহা অপেক্ষা ৪০ ফুট অধিক উচ্চ হইয়া উঠিয়াছিল। কথিত আছে যে, এই নিদারুণ অনর্থপাতে তিন লক্ষ মনুষ্য প্রাণ হারাইয়াছিল। পরন্তু দুর্বোধ্য অদৃষ্টচক্রের পরিবর্ত্তনে এই দারুণ দুর্ব্বৎসরই আবার সাতিশয় সৌভাগ্যসূচক হইয়াছিল। জনৈক প্রাচীন ঐতিহাসিক এই বৎসরের উল্লেখ করিয়া বলিয়াছেন;—‘এই সময়ে আমাদের বণিকগণ সাতিশয় ধনাঢ্য হইয়াছিলেন,—এই সময়ে সুবর্ণ অপর্য্যাপ্ত ছিল, সামান্য পারিশ্রমিক প্রদানে শ্রমজীবী পাওয়া যাইত, এবং সমস্ত কলিকাতায় একজনও নিঃস্ব ইউরোপীয় ছিল না।’

 ১৭৪২ অব্দে বা তৎসমকালে একটা জনরব প্রচার হইয়া পড়িল যে, মার্হাট্টা দস্যুরা শীঘ্রই কলিকাতা লুণ্ঠন করিতে আসিবে। এই জনরবে কলিকাতার সর্ব্বশ্রেণীর লোকেই দারুণ ভয়ে ও আতঙ্কে বিহ্বল হইয়া পড়িল। এই সময়ে স্থির হইল যে, ইংরেজ উপনিবেশটিকে রক্ষা করিবার জন্য উহার চতুর্দ্দিকে একটী পরিখা খনন করা হইবে। ইহাও স্থির হইল যে, ঐ পরিখা সূতানুটীর উত্তরাংশ হইতে গোবিন্দপুরের দক্ষিণভাগ পর্য্যন্ত খনন করা হইবে। যে স্থান দিয়া এক্ষণে সার্কুলার রোড বিস্তৃত, ঠিক সেই স্থান দিয়া ঐ পরিবাটী বিস্তৃত ছিল। মার্হাট্টাদিগের উৎপাত নিবারণোদ্দেশ্যে উহা খাত হইয়াছিল বলিয়া লোকে উহাকে মার্হাট্টা-খাত বলে। ছয় মাসে দৈর্ঘ্যে তিন মাইল মাত্র খাত হইলে ঐ কার্য্য পরিত্যাগ করা হইল। উহার খননকার্য্য সমাপ্ত হইলে উহা অর্ধবৃত্তাকারে সাত মাইল বিস্তৃত হইল। কথিত আছে যে, এই কার্য্যে ৬০০ পেয়াদা ও ৩০০ ইউরোপীয় নিযুক্ত হইয়াছিল। খাত হইতে যে মৃত্তিকা উত্তোলিত হইল, তদ্দ্বারা নগরের দিকে একটি রাস্তা নির্ম্মিত হইল। অতঃপর কলিকাতার ইতিহাস সম্পর্কে যে সকল ঘটনা ঘটে, তন্মধ্যে দুশ্চরিত্র নবাব সিরাজুদ্দৌলা কর্ত্তৃক ১৭৫৬ খৃষ্টাব্দে নগরলুণ্ঠনই সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই সময়ে যে একটি অতি বিষম লোমহর্ষণ কাণ্ড সংঘটিত হইল, তাহারই ফলে কিছু কাল পরে দেশের শাসনভার মোগলদিগের হস্তচ্যুত হইয়া ইংরেজদিগের করতলগত হইল।

 যৌবনের উন্মেষ হইতে না হইতেই নবাব সিরাজুদ্দৌলা অত্যন্ত অসচ্চরিত্র ও লম্পটস্বভাব হইয়া উঠিলেন। তাঁহার ঔদ্ধত্য ও দুশ্চরিত্রতায় বঙ্গদেশের ধনাঢ্য লোকেরা সর্ব্বদা সশঙ্ক অবস্থায় কালযাপন করিতে লাগিলেন। কখন্‌ কাহার কি বিপদ্‌ ঘটে, কখন্‌ কাহার ধন, মান, বা প্রাণ যায়, এই দুর্ভাবনায় সকলকে সতত উদ্বিগ্ন থাকিতে হইত। এই সময়ে ঢাকার শাসনকর্ত্তা রাজা রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাস নবাবের ভয়ে উড়িষ্যায় জগন্নাথ দেবের দর্শনোদ্দেশে তীর্থ ভ্রমণের ব্যপদেশে সমস্ত ধনসম্পত্তি সহিত কলিকাতায় পলাইয়া আঁসিলেন। তৎপূর্ব্বেই ইংরাজদিগের সহিত তাঁহার বন্দোবস্ত হইয়াছিল যে, যদি তিনি কলিকাতায় আসেন, তাহা হইলে ইংরেজরা সাহায্য করিয়া তাঁহাকে রক্ষা করিবেন। সিরাজুদ্দৌলা যখন শুনিলেন যে, কৃষ্ণদাস ঢাকা হইতে পলায়ন করায়, তাঁহাকে “জবাই” করিতে পারা যায় নাই, তখন তিনি ক্রোধে অধীর হইয়া ইংরেজদিগের প্রতি আদেশ করিলেন যে, তাঁহারা যেন অবিলম্বে কৃষ্ণদাসকে তাঁহার যাবতীয় সম্পত্তি সহিত নবাবের লোকের হস্তে অর্পণ করেন। ইংরেজরা অবশ্য এ কথায় কর্ণপাত করিলেন না। সিরাজ বাল্যকাল হইতেই ইংরেজদিগের বিষম বিদ্বেষ্টা ছিলেন। কৃষ্ণদ সসম্পর্কীয় এই ঘটনায় তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইলেন এবং স্থির করিলেন যে, ইংরেজদিগকে কেবল কাঠার শাস্তি প্রদান করিয়াই ক্ষান্ত হইবেন না, পরন্তু তাহাদিগকে একেবারে বাঙ্গালা হইতে দূরীভূত করিয়া দিবেন। নবাবের এইরূপ ভাব দেখিয়া ইংরেজরা অত্যন্ত ভয়াভিভূত হইয়া পড়িলেন, কিন্তু ঢাকার শাসনকর্ত্তা রাজা রাজবল্লভ তাঁহাদিগকে এই বলিয়া আশ্বস্ত করিলেন যে, নবাবের যাবতীয় সর্দ্দার ও অমাত্যবর্গ নবাবের প্রতিকূলে ইংরেজদিগকে সাহায্য করিবেন। ইতোমধ্যে নবাবের অমাত্য ও সর্দ্দারদিগের সহিত অতি গোপনে পত্র লেখালেখি ও কথাবার্ত্তা চলিতে আরম্ভ হইল, আর এই দুষ্কর কার্য্য সংসাধন জন্য নবকৃষ্ণ দেবকে নিযুক্ত করা হইল।

 সিরাজুদ্দৌলা বিপুল সেনাবল-সমভিব্যাহারে কলিকাতা আক্রমণ করিলেন। গভর্ণর ড্রেক সাহেব ও অপরাপর বহু ইংরেজ একখানি জাহাজে আরোহণ করিয়া ফলতায় পলায়ন করিলেন। এই দুর্দ্দশার সময়ে, নবাবের নিষেধ সত্ত্বেও, নবকৃষ্ণ ফলতায় ইংরেজ-পলাতকদিগকে গোপনে খাদ্য সামগ্রী সরবরাহ করিতে লাগিলেন এবং নবাবের গতিবিধি-সংক্রান্ত অতি প্রয়োজনীয় সংবাদসমূহ তাঁহাদিগকে প্রদান করিতে লাগিলেন। অবশিষ্ট ইংরেজের নবাবের আক্রমণে বাধা দিতে লাগিলেন; কিন্তু পরিশেষে পরাজিত হইয়া বন্দী হইলেন। বন্দিগণ একটি ক্ষুদ্র কারাগৃহে নিক্ষিপ্ত হইলেন; উহা এক্ষণে “অন্ধকৃপ” নামে খ্যাত। সেই সঙ্গে নবাব ‘কলিকাতা’ এই নাম পরিবর্ত্তিত করিয়া ‘আলিনগর’ নাম রাখিলেন এবং রাজা মাণিকচন্দ্রকে ঐ স্থানের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিলেন। ১৭৫৮ অব্দের জানুয়ারী মাসে মিরজাফরের সনন্দ অনুসারে আলিনগরের পরিবর্ত্তে নগরের নাম আবার কলিকাতা রাখা হইল।

 এস্থলে অন্ধকূপের ভীষণ যন্ত্রণার বর্ণনা করা আবশ্যক। সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ও লেখক মেকলে সাহেব “লর্ড ক্লাইভ” প্রবন্ধে এ সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছেন, তাহার মর্ম্ম উদ্ধৃত করিলেই যথেষ্ট হইবে। তিনি লিখিয়াছেন:— ‘অতঃপর সেই ভয়ঙ্কর অপরাধ অনুষ্ঠিত হইল —যাহা অসামান্য লোমহর্ষণ নিষ্ঠুরতার জন্য, তাহার যথোপযুক্ত ভীষণ প্রায়শ্চিত্তর নিমিত্ত চিরস্মরণীয় হইয়া রহিয়াছে। ইংরেজবন্দিগণ প্রহরীদিগের কৃপার হস্তে পরিত্যক্ত হইল, অর প্রহরীরা স্থির করিল যে, তাহারা বন্দীদিগকে সে রাত্রির মত দুর্গের কারাকক্ষে আবদ্ধ করিয়া রাখিবে—সেই কক্ষটি অন্ধকূপরূপ ভীষণ নামে পরিচিত। সেই কারাকক্ষটি এরূপ সঙ্কীর্ণ ও বায়ুসমাগমশুন্য ছিল যে, এই গ্রীষ্মপ্রধান দেশে কেবলমাত্র একজন ইউরোপীয়ের পক্ষেও উহা অসহ্য হইত। উহার আয়তন দৈর্ঘ্যে ও বিস্তারে ২০ ফুট মাত্র। বায়ুপ্রবেশের নিমিত্ত যে কয়েকটি গবাক্ষ-ছিদ্র ছিল, সেগুলি অতি ক্ষুদ্র ও ব্যাহত। তখন অত্যন্ত গ্রীষ্ম,—ওরূপ সময়ে সমুচ্চ গবাক্ষ ছিদ্র ও তালবৃন্তের অনুক্ষণ বায়ুসঞ্চালন সত্ত্বেও বাঙ্গালার প্রচণ্ড গ্রীষ্ম ইংল্যাণ্ডবাসীদিগের পক্ষে এক প্রকার অসহ্যই বলিতে হইবে। বন্দীরা সংখ্যায় ১৪৬ জন ছিল। যখন তাহাদিগকে ঐ কারাকক্ষে প্রবেশ করিতে হয়, তখন তাহারা প্রথমে মনে করিয়াছিল যে, নবাবের সৈন্যেরা তামাসা করিতেছে; আর ইতঃপূর্ব্বে নবাব তাহাদের জীবনে হস্তক্ষেপ করিবেন না বলিয়া প্রতিজ্ঞা করায় তাহারা সাতিশয় প্রফুল্লচিত্ত ছিল, এজন্য তাহারা এরূপ অসঙ্গত প্রস্তাবে হাস্য ও ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করিতে লাগিল। কিন্তু অচিরেই তাহারা আপনাদের ভ্রম বুঝিতে পারিল। তাহারা প্রতিবাদ করিল —তাহারা অনুনয় বিনয় করিল—কিন্তু সমস্তই বিফল হইল!! প্রহরীরা এই বলিয়া ভয় দেখাইল যে, যে কেহ ইতস্ততঃ করিবে, তাহাকেই কাটিয়া ফেলা হইবে। বন্দিগণ তরবারির মুখে সেই কারাকক্ষমধ্যে তাড়িত হইল এবং অবিলম্বে তাহার দ্বার রুদ্ধ করিয়া তালাচাবি দিয়া বন্ধ করা হইল!!!

 অনন্তর ১৭৫৭ অব্দে নবাব সিরাজুদ্দৌলা পুনর্ব্বার কলিকাতা আক্রমণ করিলেন এবং আমির চাঁদের (উমিচাঁদের) উদ্যানে শিবির সন্নিবেশ করিলেন। ঐস্থান এক্ষণে হালসিবাগান নামে খ্যাত। এই সময়ে কর্ণেল ক্লাইভ্‌, নবাব ও তদীয় অনুচরবর্গের সহিত সন্ধির প্রস্তাব করিবার ও উপঢৌকন প্রেরণ করিবার ব্যপদেশে জনৈক ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ার (সম্ভবতঃ মিষ্টার আমিয়াথ) সমভিব্যাহারে মুন্সি নবকৃষ্ণকে প্রতিনিধিস্বরূপ প্রেরণ করিলেন। ইংরেজ পক্ষের এই দুইজন কর্ম্মচারী নবাবের শিবির-ব্যবস্থার সবিশেষ সূক্ষ্ম বিবরণ লিখিয়া লইয়া আসিলেন। অনন্তর ক্লাইভ্‌, আপনার সেনাদল লইয়া রজনীর শেষভাগে নবাবের শিবিরে উপস্থিত হইলেন এবং কামানের প্রথম আওয়াজেই নবাবের ও তাঁহার সর্দ্দারগণের পট্টাবাস উড়াইয়া দিলেন। পরন্তু নবাব দূরদর্শিতা প্রদর্শনপূর্ব্বক রাত্রিকালে তাঁহার নিজ পট্টাবাস পরিত্যাগ করিয়া অন্য এক তাম্বুতে আশ্রয় লইয়াছিলেন; সুতরাং তাঁহার প্রাণহানি হইল না,—তিনি পলায়ন করিলেন; কিন্তু তাঁহার অধিকাংশ সৈন্য বিনষ্ট হইল। ক্লাইভ্‌ তাঁহার অনুসরণ করিয়া পলাশীক্ষেত্রে উপস্থিত হইলেন। তথায় নবাবের প্রধান সেনাপতির সহিত তাঁহার তুমুল যুদ্ধ হইল। সেই যুদ্ধে নবাবের সেনাপতি হত হইলেন এবং তাঁহার সৈন্যগণ সম্পূর্ণরূপে পরাজিত ও ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল।

 এ সম্বন্ধে আর এক প্রকার বিবরণ দৃষ্ট হয়। তাহাতে দেখা যায় যে, ইংরেজেরা পূর্ব্বোক্ত প্রকারে নবাব সিরাজুদ্দৌলার শিবির আক্রমণ করিয়া জয়লাভ করিলে, নবাব ১৭৫৯ খৃষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে ইংরেজদিগের সাতিশয় সুবিধাজনক সর্ত্তে তাঁহাদের সহিত সন্ধিস্থাপন করিতে বাধ্য হন। পরন্তু এই বিবাদের পরিসমাপ্তি হইতে কলিকাতার ইতিহাস। না হইতে সংবাদ আসিল যে, ইউরোপে ইংল্যাণ্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে সমর ঘোষিত হইয়াছে; সুতরাং এদেশে ফরসীদিগের শক্তির ক্ষয়সাধন করা ইংরেজদিগের একটি প্রধান উদ্দেশ্য হইয়া পড়িল। সিরাজুদ্দৌলা কলিকাতার কাউন্সিলে বলিয়া পাঠাইলেন যে, যদি ইংরেজরা তাঁহার রাজ্যে যুদ্ধ পরিচালনা করেন, তাহা হইলে তিনি যথাসাধ্য ফরাসীদিগের সহায়তা করিবেন। সে যাহা হউক, ইংরেজরা প্রবল আক্রমণের পর চন্দননগর অধিকার করিলেন এই ব্যাপারে নবাব অসন্তোষের চিহ্ন প্রকাশ করায় স্থির হইল যে, সিরাজুদ্দৌলার পুর্ব্বাধিকারী (মাতামহ) আলিবর্দ্দি খাঁর ভগিনীপতি মিরজাফর আলি খাঁর পক্ষসমর্থন করিয়া সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করা হইবে। অতঃপর পলাশীক্ষেত্রে একটী চূড়ান্ত যুদ্ধ হইল। সেই যুদ্ধে নবাবের সৈন্যগণ পরাজিত হইয়া চতুর্দ্দিকে ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল এবং নবাব নিজে ফকিরের বেশে রাজধানী হইতে পলায়ন করিতে বাধ্য হইলেন। কিন্তু তিনি অচিরে ধৃত হইয়া মুর্শিদাবাদে আনীত হইলেন। মিরজাফরের জ্যেষ্ঠ পুত্র, নবাব সিরাজুদ্দৌলার মস্তক ছেদন করিলেন। ইতঃপূর্ব্বে জাফর আলি খাঁর সহিত মুন্সি নবকৃষ্ণের পত্র লেখালেখি হওয়ায় জাফর আলি এই যুদ্ধে যোগদান করেন নাই। তিনি এক্ষণে কর্ণেল ক্লাইভের সহিত মিলিত হইলে, ক্লাইভ্‌ মুর্শিদাবাদ অধিকার করিয়া জাফর আলি খাঁকে বাঙ্গালার প্রকৃত নবাব বলিয়া ঘোষণা করিলেন। কর্ণেল ক্লাইভের অনুমোদনক্রমে মুন্সি নবকৃষ্ণ[৩] নবাব জাফর আলি খাঁর সহিত সুবাদারী সন্ধির যাবতীয় নিয়মাদি স্থির করিলেন।

 বড়ই কৌতুকের বিষয় এই যে, আজিকালি এমত এক শ্রেণীর কতকগুলি লেখক অভ্যুদিত হইয়াছেন যে, তাহারা অন্ধকূপহত্যার ব্যাপারটা একেবারে উড়াইয়া দিতে চাহেন। তাহারা প্রকারান্তরে এরূপ কথা বলিতেও কুণ্ঠিত নহেন যে, হলওয়েল সাহেব আপনাকে অন্ধকূপহত্যা ব্যাপারের একজন উত্তরজীবী বণিয়া জনসমাজে প্রচার করিয়া ছিল, এই ঘটনার কথাটা সেই হলওয়েলের কপোল-কল্পনা ব্যতীত আর কিছুই নহে। এই সকল লেখক তাদের উক্তির সমর্থনার্থ যে সকল যুক্তির অবতরণ করিয়াছেন, তাহা নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর। তাহারা বলেন যে, দৈর্ঘ্যে প্রস্থে ২০ ফুট একটা ঘরে ১৪৬ জন লোক কখনও ধরিতে পারে না, সুতরাং এই ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য নহে। যে গল্প শ্রবণমাত্রে সহজেই অতীব লোমহর্ষণ ও বীভৎস বলিয়া প্রতীয়মান হয়, সেরূপ একটা মিথ্যা গল্প হলওয়েল সাহেব কি উদ্দেশ্যে রচনা করিলেন, সে বিষয়ের বিচার করিবার কোনরূপ চেষ্টা এই সকল লেখক করেন নাই। তাঁহারা এমন কথাও বলেন যে, নবাব সিরাজুদ্দৌলা একজন সবলবুদ্ধি, নিরীহ ও অনভিজ্ঞ যুবক ছিলেন, এবং মোটের উপর বড় অপকৃষ্ট শ্রেনীর শাসনকর্ত্তা ছিলেন না। পরন্তু কোনও ঐতিহাসিক তত্ত্ব কেবল মনোভাব দ্বারা অথবা সম্ভব অসম্ভবের বিচারণা দ্বারা মীমাংসা করা উচিত নয়,—স্পষ্ট প্রমাণ প্রদর্শনপূর্ব্বক মীমাংসা করা কর্ত্তব্য। এ বিষয়ে যে কিছু প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে, তাহাতে অন্ধকূপহত্যা ব্যাপার যে যথার্থই ঘটিয়াছিল, এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হইতে হয়।

 কলিকাতার ইতিবৃত্তে আর একটা অতি বিষম শোচনীয় দুর্ঘটনা সংঘটিত হইয়াছিল। সে ঘটনা ১১৭৬ বঙ্গাব্দের ভীষণ মন্বন্তর। ১৭৭০ খৃষ্টাব্দে যে ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ ও তদানুষঙ্গিক মহামারী উপস্থিত হইয়াছিল, তজ্জন্য উক্ত অব্দটি ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে; কারণ তাহাতে কেবল কলিকাতা নহে, সমস্ত বঙ্গদেশই উৎসন্নপ্রায় হইয়া উঠিল। “ছিয়াত্তরের মন্বন্তর” অদ্যাপি প্রবাদবাক্য হইয়া রহিয়াছে,—এখনও লোকে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কথা স্মরণ করিয়া আতঙ্কে শিহরিয়া উঠে। হিকী সাহেবের মতে, উক্ত অব্দের ১৫ই জুলাই হইতে ১০ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৭৬ হাজার লোক কলিকাতার রাস্তাতেই মরিয়া পড়িয়াছিল।[৪] নগরের ভিতর এমন একটা কোণ ছিল না, বা কলিকাতার নিকটে এমন কোনও গুপ্তস্থান ছিল না, যেখানে জীবিত, মুমূর্ষু ও মৃত মানবগণ বিশৃঙ্খলভাবে একত্র মিশ্রিত বা পুঞ্জীভূত হইয়া অতি বীভৎস ও শোচনীয় দৃশ্য প্রদর্শন না করিয়াছিল। কার্য্যোপলক্ষেই হউক বা বায়ুসেবনার্থই হউক, যে কোন পথে বহির্গত হইয়া দেখিলেই অপ্রীতিকর ও হৃদয়বিদারক দৃশ্যসকল দৃষ্ট হইবে। মৃতদেহসমূহ যতই জীবিতদিগের ন্যক্কারজনক ও অনিষ্টকর হইয়া উঠিতে লাগিল, ততই সেই সকল শবদেহ দূরীকৃত করিবার নিমিত্ত প্রত্যহ শত শত লোকে ঐ কার্য্যে নিয়োজিত হইতে লাগিল। ঐ সমস্ত শবদেহের কোনওরূপ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বা ধম্মানুষ্ঠান হইল না, কেবল গাড়ী গাড়ী বোঝাই দিয়া নদীতে ঝুপঝাপ ফেলিয়া দেওয়া হইতে লাগিল। এইরূপ ক্রমবর্দ্ধমান অশ্রুতপূর্ব্ব মড়কে, নগর ও নগরোপকণ্ঠ এরূপ কলুষিত হইয়া পড়িল যে, সর্ব্বসাধারণের মন এমন একটা গুরুতর আতঙ্কে উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল যে, গ্রীষ্মের প্রচণ্ডউত্তাপ, অপ্রোথিত শবদেহসমূহ হইতে অনুক্ষণ উত্থিত দূষিত বাষ্পরাশি, এবং বায়ুর প্রখর উত্তপ্ত অবস্থার জন্য শীঘ্রই এক প্রকার ইনফ্লুয়েঞ্জা উদ্ভুত হইয়া দেশব্যাপী মড়ক আনয়ন করিবে। স্বর্গীয় স্যার উইলিয়ম হণ্টার লিখিয়াছেন:—“এই দুর্ভিক্ষের দুই বৎসর পরে ওয়ারেন্‌ হেষ্টিংস বঙ্গদেশের অবস্থা সম্বন্ধে একটি সুবিস্তৃত রিপোর্ট লিপিবদ্ধ করেন। তিনি দেশের অনেক স্থানে ভ্রমণ করিয়াছিলেন। এবং পথে পথে এ বিষয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান করিয়াছিলেন। তৎপরে তিনি বহু বিচার বিতর্কের পর লিখিয়াছেন যে, এই দুর্ঘটনায় অন্ততঃ অধিবাসিবর্গের এক তৃতীয়াংশ পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইয়াছিল।”

  1. বুজা বাহাদুর এই টীকা করিয়া বলিয়াছেন পূর্ব্ব না হইয়া আর হইবে; কিন্তু আমাদের বিবেচনায় দক্ষিণ হওয়াই অধিক সঙ্গত বলিয়া বোধ হয়।—অনুবাদক।
  2. ১৬৪৫ অব্দে সম্রাট শাহজাহাঁ তাঁহার প্রিয়তমা তনয়ার চিকিৎসার নিমিত্ত হোপ হল নামক জাহাজের ডাক্তার গ্যাব্রিয়েল বাউটনকে লইয়া যান এবং তাঁহার চিকিৎসায় রাজকুমারী আরোগ্য লাভ করিলে, সম্রাট কোম্পানীকে বহু সুবিধাজনক অধিকার প্রদান করেন। আবার ১৬৪৬ সালে বাঙ্গালার সুবাদারও বাউটন সাহেবের দ্বারা চিকিৎসিত হন। এই সকল মহোপকার সাধনের ফলে ইংরেজদিগের বালেশ্বর ও হুগলীর কুঠিগুলি অনেকটা বিঘ্নশূন্য হইয়া উঠে। এস্থহে বলা আবশ্যক যে, হুগলির কুঠি ১৬৪০ অব্দে এবং বালেশ্বরের কুঠি ১৬৪২ অব্দে নির্ম্মিত হইয়াছিল।
  3. সরকারি কাগজপত্রে দেখা যায় যে, মিরজাফর জগৎশেঠকে তাঁহ’র প্রতিনিধিরূপে নিযুক্ত করিয়াছিলেন, কিন্তু নবকৃষ্ণ ১৭৭৭ সালের ১৪ই নভেম্বর তারিখে বাঙ্গালার রেভিনিউ কাউন্সিলে যে দরখাস্ত করেন, তাহাতে এইরূপ বলিয়াছিলেন:—
    “কলিকাতার অধিকার ও তৎপরে সিরাজুদ্দৌলার যে পরাজয় ব্যাপার সংঘটিত হয়, তাতে এ অধীন মাননীয় লর্ড ক্লাইভ (তৎকালে কর্ণেল ক্লাইভ) সাহেবের অধীনে অনেক কাজ করিয়াছিল; সে সময়ে আবেদনকারী (অর্থাৎ নবকৃষ্ণ) এস মুন্সি ও অনুবাদকরূপে কার্য্য করিয়াছিল এবং যাবতীয় অতি গোপনীয় কর্ম্মে নিযুক্ত হইয়াছিল।
    নবকৃষ্ণ ১৭৬৭ সালের ১৬ই মার্চ তারিখে মাননীয় হ্যারি কোয়েলেষ্টের নিকট যে আবেদন করেন, তাহাতেও তিনি এ বিষয়ের উল্লেখ করিয়াছিলেন।
  4. সে আজ ১৩৫ বৎসর পূর্ব্বেকার কথা। সে সময়ে কলিকাতার আয়তন ও লোকসংখ্যা যে বর্ত্তমান সময়াপেক্ষা পরিমাণে অল্প ছিল, একথা বলা বাহুল্য। সেই এক কলিকাতাতেই ৪৭।৪৮ দিনের মধ্যে ৭৬ হাজার মানুষ আহারাভাবে কালকবলিত হইয়া রাজপথে পতিত। তদ্ভিন্ন আরও কত লোক অনশনে গৃহে মরিয়া পড়িয়াছিল। তাহাদের সংখ্যা অবশ্য এ হিসাবে নাই। একবার ভাবিয়া দেখুন, কি শোচনীয় ব্যাপার!!