কাব্যগ্রন্থ (তৃতীয় খণ্ড)/চিত্রা/শীতে ও বসন্তে

উইকিসংকলন থেকে

শীতে ও বসন্তে

প্রথম শীতের মাসে
শিশির লাগিল ঘাসে,
হুহু করে’ হাওয়া আসে,
হিহি করে’ কাঁপে গাত্র।
আমি ভাবিলাম মনে,
এবার মাতিব রণে,
বৃথা কাজে অকারণে
কেটে গেছে দিনরাত্র।
লাগিব দেশের হিতে
গরমে বাদলে শীতে,
কবিতা নাটকে গীতে
করিব না অনাসৃষ্টি;
লেখা হবে সারবান,
অতিশয় ধার-বান,
খাড়া র’ব দ্বারবান
দশদিকে রাখি’ দৃষ্টি।
এত বলি’ গৃহকোণে
বসিলাম দৃঢ় মনে
লেখকের যােগাসনে,
পাশে ল’য়ে মসীপাত্র।

নিশিদিন রুধি’ দ্বার,
স্বদেশের শুধি ধার,
নাহি হাঁফ ছাড়িবার
অবসর তিলমাত্র।
রাশি রাশি লিখে লিখে
একেবারে দিকে দিকে
মাসিকে ও সাপ্তাহিকে
করিলাম লেখাবৃষ্টি।
ঘরেতে জ্বলে না চূলাে
শরীরে উঠিছে ধূলাে,
আঙুলের ডগাগুলাে
হ’য়ে গেল কালীকৃষ্টি

খুঁটিয়া তারিখ মাস
করিলাম রাশ রাশ,
গাঁথিলাম ইতিহাস,
রচিলাম পুরাতত্ত্ব।
গালি দিয়া মহারাগে
দেখালেম দাগে দাগে
যে যাহা বলেছে আগে
কিছু তা’র নহে সত্য।

পুরাণে বিজ্ঞানে গােটা
করিয়াছি সিদ্ধি-ঘোঁটা,
যাহা-কিছু ছিল মােটা
হ’য়ে গেছে অতি সূক্ষ্ম।
করেছি সমালােচনা,
আছে তাহে গুণপণা,
কেহ তাহা বুঝিল না,
মনে র’য়ে গেল দুঃখ।
মেঘদূত—লােকে যাহা
কাব্যভ্রমে বলে “আহা,”—
আমি দেখায়েছি, তাহা
দর্শনের নব সূত্র।
নৈষধের কবিতাটি
ডারুয়িন-তত্ত্ব খাঁটি,
মাের আগে এ কথাটি
বল কে বলেছে কুত্র?
কাব্য কহিবার ভাণে
নীতি বলি কানে কানে
সে কথা কেহ না জানে,
না বুঝে হতেছে ইষ্ট।
নভেল লেখার ছলে
শিখায়েছি সুকৌশলে

শাদাটিরে শাদা বলে,
কালাে যাহা তাই কৃষ্ণ

কত মাস এই মত
একে একে হ’ল গত
আমি দেশহিতে রত
সব দ্বার করি’ বন্ধ।
হাসি গীত গল্পগুলি
ধুলিতে হইল ধূলি,
বেঁধে দিয়ে চোখে ঠুলি
কল্পনারে করি অন্ধ।
নাহি জানি চারি পাশে
কি ঘটিছে কোন্ মাসে,
কোন্ ঋতু কবে আসে,
কোন্ রাতে উঠে চন্দ্র।
আমি জানি, রুশিয়ান
কতদূরে আগুয়ান
বজেটের খতিয়া
কোথা তা’র আছে রন্ধ্র।
আমি জানি কোন্ দিন
পাশ, হ’ল কি আইন,

কুইনের বেহাইন
বিধবা হইল কল্য;
জানি সব আটঘাট;—
গেজেটে করেছি পাঠ
আমাদের ছােটলাট
কোথা হ’তে কোথা চল্ল।

একদিন বসে’ বসে’
লিখিয়া যেতেছি কসে’
এদেশেতে কার দোষে
ক্রমে কমে’ আসে শস্য;
কেনই বা অপঘাতে
মরে লােক দিবারাতে,
কেন ব্রাহ্মণের পাতে
নাহি পড়ে চর্ব্ব্য চোষ্য।
হেনকালে দুদ্দাড়
খুলে গেল সব দ্বার,
চারিদিকে তােলপাড়
বেধে গেছে মহাকাণ্ড।
নদীজলে, বনে, গাছে
কেহ গাহে কেহ নাচে,

উলটিয়া পড়িয়াছে
দেবতার সুধাভাণ্ড।
উতলা পাগল-বেশে
দক্ষিণে বাতাস এসে
কোথা হ’তে হা হা হেসে
প’ল যেন মদমত্ত।
লেখাপত্র কেড়েকুড়ে—
কোথা কি যে গেল উড়ে,—
ওই রে আকাশ জুড়ে
ছড়ায় “সমাজ-তত্ত্ব।”
“রুশিয়ার অভিপ্রায়”
ওই কোথা উড়ে যায়,
গেল বুঝি হায় হায়
“আমিরের ষড়যন্ত্র।”
“প্রাচীন ভারত” বুঝি
আর পাইব না খুঁজি,
কোথা গিয়ে হ’ল পুঁজি
“জাপানের রাজতন্ত্র।”

গেল গেল, ও কি কর,
আরে আরে ধর ধর!—

হাসে বন মর-মর,
হাসে বায়ু কলহাস্যে!
উঠে হাসি নদীজলে
ছলছল কলকলে,
ভাসায়ে লইয়া চলে
“মনুর নূতন ভাষ্যে।”
বাদ প্রতিবাদ যত
শুকনাে পাতার মত
কোথা হ’ল অপগত,—
কেহ তাহে নহে ক্ষুন্ন।
ফুলগুলি অনায়াসে
মুচকি মুচকি হাসে,
সুগভীর পরিহাসে
হাসিতেছে নীল শূন্য।
দেখিতে দেখিতে মাের
লাগিল নেশার ঘাের,
কোথা হ’তে মন-চোর
পশিল আমার বক্ষে;
যেমনি সমুখে চাওয়া
অমনি সে ভূতে-পাওয়া
লাগিল হাসির হাওয়া
আর বুঝি নাহি রক্ষে।

প্রথমে প্রাণের কূলে
শিহরি শিহরি দুলে,
ক্রমে সে মরমমূলে
লহরী উঠিল চিত্তে।
তা’র পরে মহা হাসি
উছসিল রাশি রাশি,
হৃদয় বাহিরে আসি’
মাতিল জগৎ-নৃত্যে

এস এস বঁধু এস,
আধেক আঁচরে বস’,
অবাক্ অধরে হাস
ভুলাও সকল তত্ত্ব।
তুমি শুধু চাহ ফিরে,—
ডুবে যাক ধীরে ধীরে
সুধাসাগরের নীরে
যত মিছা যত সত্য।
আনগাে যৌবনগীতি,
দূরে চলে’ যাক নীতি,
আন পরাণের প্রীতি,
থাক্ প্রবীণের ভাষ্য।

এসহে আপনাহারা,
প্রভাত সন্ধ্যার তারা,
বিষাদের আঁখিধারা
প্রমােদের মধুহাস্য।
আন বাসনার ব্যথা,
অকারণ চঞ্চলতা,
আন কানে-কানে কথা
চোখে চোখে লাজ-দৃষ্টি।
অসম্ভব, আশাতীত,
অনাবশ্য, অনাদৃত,
এনে দাও অযাচিত
যত কিছু অনাসৃষ্টি।
হৃদয়-নিকুঞ্জমাঝ
এস আজি ঋতুরাজ,
ভেঙে দাও সব কাজ
প্রেমের মােহন মন্ত্রে।
হিতাহিত হােক দূর,—
গাব গীত সুমধুর,
ধর তুমি ধর সুর
সুধাময় বীণাযন্ত্রে।

১৮ই আষাঢ়, ১৩০২।