কাব্যগ্রন্থ (প্রথম খণ্ড)/প্রভাত-সঙ্গীত/অনন্ত মরণ

উইকিসংকলন থেকে


অনন্ত মরণ


কোটি কোটি ছোট ছোট মরণেরে লয়ে
বসুন্ধর ছুটিছে আকাশে,
হাসে খেলে মৃত্যু চারি পাশে।
এ ধরণী মরণের পথ,
এ জগৎ মৃত্যুর জগৎ।

যতটুকু বর্ত্তমান, তারেই কি বল প্রাণ?
সে ত শুধু পলক নিমেষ।
অতীতের মৃত ভার পৃষ্ঠেতে রয়েছে তার,
না জানি কোথায় তার শেষ!

যত বর্ষ বেঁচে আছি তত বর্ষ মরে গেছি,
মরিতেছি প্রতি পলে পলে,
জীবন্ত মরণ মোরা, মরণের ঘরে থাকি,
জানিনে মরণ কারে বলে।

এক মুঠ মরণেরে জীবন বলে কি তবে,
মরণের সমষ্টি কেবল?

একটি নিমেষ তুচ্ছ শত মরণের গুচ্ছ,
নাম নিয়ে এত কোলাহল!
মরণ বাড়িবে যত জীবন বাড়িবে তত,
পলে পলে উঠিব আকাশে,
নক্ষত্রের কিরণ-নিবাসে।

ভাবিতেছি কল্পনায়, কত কাল গেছে চলে,
বয়ঃক্রম সহস্র বরষ,
মরণের স্তরে স্তরে অতি দীর্ঘ—দীর্ঘ প্রাণ
কোন্ শূন্য করেছে পরশ!
হয়ত গিয়েছি আমি জ্যোতিষ্কের পথ বেয়ে
কোন্ দূর গ্রহের মাঝারে,
জীবনের সূত্রখানি পৃথিবীরে পরশিয়া
চলে গেছে বৃহস্পতি-পারে।
শুধু দেখিতেছি চেয়ে সুদীর্ঘ ভ্রমণ-ক্ষেত্রে,
অতীতের দিগন্তের পানে,
অতিক্ষীণ দেখা যায় পৃথিবী জ্যোতির কণা
জড়িত রয়েছে সেইখানে।
তারি পানে কতক্ষণ চাহিয়া চাহিয়া শেষে
হয়ত সহসা কি কারণে,
আজিকার যে মুহূর্তে এত কথা ভাবিতেছি
এ মুহূর্ত্ত পড়িবে স্মরণে।

পৃথিবীর কত খেলা, পৃথিবীর কত কথা
পরাণেতে বেড়াইবে ভেসে,
পৃথিবীর সহচর না জানি কোথায় তারা
গেছে কোন্ তারকার দেশে!
হয়ত পড়িবে মনে, পৃথিবীর প্রান্তে বসি
গেয়েছিনু যে কয়টি গান,
সে গানের বিম্বগুলি হয়ত এখনো ভাসে
ধরার স্রোতের মাঝখান।

সহস্র বরষ পরে সেই গ্রহমাঝে বসি
না জানি গাহিব সে কি গান;
কি অনন্ত মন্দাকিনী না জানি ছুটিবে, যবে
খুলে যাবে সে বিশাল-প্রাণ,
মরণের সঙ্গীত মহান্।
হয়ত বা সে নিশীথে কবি এক পৃথিবীতে
চেয়ে আছে মোর গ্রহপানে;
কি মহা-সঙ্গীত-ধারা গ্রহ হতে গ্রহে ঝরি
পশিবেক তাহার পরাণে।
বিস্ফারিত করি আঁখি শিহরিত কলেবরে
শুনিবে সে আধ-শোনা গান,
কত কি উঠিবে মনে ব্যক্ত করিবার তরে
আকুল ব্যাকুল হবে প্রাণ।

আপনার কথা শুনে আপনি বিস্মিত হবে,
চাহিয়া রহিবে অবিরত
নিদ্রাহীন স্বপ্নটির মত।
নয়নে পড়িবে অশ্রুজল,
বুঝিবে না, শুনিবে কেবল।
মরণ বাড়িবে যত কোথায় কোথায় যাব,
বাড়িবে প্রাণের অধিকার,
বিশাল প্রাণের মাঝে কত গ্রহ কত তারা
হেথা হোথা করিবে বিহার।
উঠিবে জীবন মোর কতনা তাকাশ ছেয়ে
ঢাকিয়া ফেলিবে রবি শশী,
যুগ যুগান্তর যাবে নব নব রাজ্য পাবে
নব নব তারায় প্রবেশি।
কবেরে আসিবে সেই দিন
উঠিব সে আকাশের পথে,
আমার মরণ-ডোর দিয়ে
বেঁধে দেব’ জগতে জগতে।
আমার মরণ-ডোর দিয়ে
গেঁথে দেব’ জগতের মালা,
রবি শশী একেকটি ফুল,
চরাচর কুসুমের ডালা।



তোরাও আসিবি ভাই, উঠিবিরে দশ দিকে,
এক সাথে হইবে মিলন,
ডোরে ডোরে লাগিবে বাঁধন।
আমাদের মরণের জালে
জগৎ ফেলিব আবরিয়া
এ অনন্ত আকাশ-সাগরে
দশ দিক্ রহিব ঘেরিয়া।
পড়িবে তপন, তায় চন্দ্রমা জড়ায়ে যাবে,
পড়িবেক কোটি কোটি তারা
পৃথ্বী কোথা হয়ে যাবে হারা।
আয় ভাই সব যাই ভুলি,
সকলে করিরে কোলাকুলি।
সে কিরে আনন্দ-মহোৎসব,
জগতেরে ফেলিব ঘেরিয়া,
আমাদের মরণের মাঝে
চরাচর বেড়াবে ঘুরিয়া।

জয় হোক্ জয় হোক্, মরণের জয় হোক্,
আমাদের অনন্ত মরণ,
মরণের হবে না মরণ।
এ ধরায় মোরা সবে শতাব্দীর ক্ষুদ্র শিশু
লইলাম তোমার শরণ,

এস তুমি এস কাছে, স্নেহ-কোলে লও তুমি
পিয়াও তোমার মাতৃস্তন,
আমাদের করহে পালন।
বাড়িব তোমার স্নেহে, নব বল পাব দেহে,
ডাকিব হে জননী বলিয়া,
তোমার অঞ্চল ধরি জগতের খেলাঘরে
অবিরাম বেড়াব খেলিয়া।
হেথা নাবি হোথা উঠি করিব রে ছুটাছুটি,
বেড়াইব তারায় তারায়,
সুকুমার বিদ্যুতের প্রায়।
আনন্দে পূরেছে প্রাণ, হেরিতেছি এ জগতে
মরণের অনন্ত উৎসব,
কার নিমন্ত্রণে মোরা মহাযজ্ঞে এসেছিরে
উঠেছে বিপুল কলরব!

যে ডাকিছে ভালবেসে, তারে চিনিসনে শিশু?
তার কাছে কেন তোর ডর,
জীবন যাহারে বলে মরণ তাহারি নাম,
মরণ ত নহে তোর পর।
আয় তারে আলিঙ্গন কর,
আয়, তার হাত খানি ধর।