কাব্যগ্রন্থ (প্রথম খণ্ড)/প্রভাত-সঙ্গীত/পুনর্ম্মিলন

উইকিসংকলন থেকে


পুনর্ম্মিলন


কিসের হরষ-কোলাহল,
শুধাই তোদের, তোরা বল্!
আনন্দ-মাঝারে সব উঠিতেছে ভেসে ভেসে,
আনন্দে হতেছে কভ লীন।
চাহিয়া ধরণীপানে নব আনন্দের গানে
মনে পড়ে আর একদিন।
সে তখন ছেলেবেলা—রজনী প্রভাত হলে
তাড়াতাড়ি শয্যা ছাড়ি ছুটিয়া যেতেম চলে;–
সারি সারি নারিকেল বাগানের একপাশে,
বাতাস আকুল করে আম্র-মুকুলের বাসে—
পথপাশে দুই ধারে
বেল ফুল ভারে ভারে
ফুটে আছে, শিশুমুখে প্রথম হাসির প্রায়—
বাগানে পা দিতে দিতে
গন্ধ আসে আচম্বিতে,
নরগেশ কোথা ফুটে খুজে তারে পাওয়া দায়।
মাঝেতে বাঁধানে বেদী, যুঁই গাছ চারি ধারে;–
সূর্য্যোদয় দেখা দিত প্রাচীরের পরপারে।

নবীন রবির আলো,
সে যে কি লাগিত ভালো,
সর্ববাঙ্গে সুবর্ণ সুধা অজস্র পড়িত ঝরে,
প্রভাত-ফুলের মত ফুটায়ে তুলিত মোরে

এখনো সে মনে আছে
সেই জানালার কাছে
বসে থাকিতাম এক জনহীন দ্বিপ্রহরে।
অনন্ত আকাশ নীল,
ডেকে চলে যেত চিল
জানায়ে সুতীব্র তৃষা সুতীক্ষ করুণস্বরে।

পুকুর গলির ধারে,
বাঁধাঘাট এক পারে,
কত লোক যায় আসে, স্নান করে, তোলে জল;
রাজহাঁস তীরে তীরে
সারাদিন ভেসে ফিরে,
ডানা দুটি ধুয়ে ধুয়ে করিতেছে নিরমল।

পূর্ববধারে বৃদ্ধবট,
মাথায় নিবিড় জট,
ফেলিয়া প্রকাণ্ড ছায়া দাঁড়ায়ে রহস্যময়।



আঁকড়ি শিকড়-মুঠে
প্রাচীর ফেলেছে টুটে,
খোপেখাপে ঝোপেঝাপে কত না বিস্ময় ভয়!
বসি শাখে পার্থী ডাকে সারাদিন একতান,
চারিদিক স্তব্ধ হেরি কি যেন করিত প্রাণ!
মৃদু তপ্ত সমীরণ গায়েতে লাগিত এসে,
সেই সমীরণস্রোতে কত কি আসিত ভেসে।
কোন্ সমুদ্রের কাছে
মায়াময় রাজ্য আছে,
সেথা হতে উড়ে আসে পাখীর ঝাঁকের মত
কত মায়া, কত পরা, রূপকথা কত শত।

আরেকটি ছোট ঘর মনে পড়ে নদীকূলে,
সম্মুখে পেয়ারাগাছ ভরে আছে ফলেফুলে।
বসিয়া ছায়াতে তারি ভুলিয়া শৈশবখেলা
জাহ্নবী-প্রবাহপানে চেয়ে আছি সারাবেলা।
ছায়া কাঁপে আলো কাঁপে ঝুরুঝুরু বহে যায়—
ঝরঝর মরমর পাতা ঝরে পড়ে যায়।

সাধ যেত যাই ভেসে
কত রাজ্যে কত দেশে,
দুলায়ে দুলায়ে ঢেউ নিয়ে যাবে কত দূর—



কত ছোট ছোট গ্রাম,
নূতন নূতন নাম,
অভ্রভেদী শুভ্র সৌধ কত নব রাজপুর।
কত গাছ, কত ছায়া, জটিল বটের মূল;–
তীরে বালুকার পরে
ছেলেমেয়ে খেলা করে,
সন্ধ্যায় ভাসায় দীপ, প্রভাতে ভাসায় ফুল।
ভাসিতে ভাসিতে শুধু দেখিতে দেখিতে যাব
কত দেশ, কত মুখ, কত কি দেখিতে পাব।
কোথা বালকের হাসি,
কোথা রাখালের বাঁশি,
সহসা সুদূর হতে অচেনা পাখীর গান।
কোথাও বা দাঁড় বেয়ে
মাঝি গেল গান গেয়ে,
কোথাও বা তীরে বসে পথিক ধরিল তান।
শুনিতে শুনিতে যাই আকাশেতে তুলে আঁখি,
আকাশেতে ভাসে মেঘ—আকাশেতে ওড়ে পাখী।
হয়ত বরষা কাল—ঝরঝর বারি ঝরে,
পুলক-রোমাঞ্চ ফুটে জাহ্নবীর কলেবরে;
থেকে থেকে ঝনঝন,
ঘন বাজ বরিষণ,
থেকে থেকে বিজলীর চমকিত চকমকি।



বহিছে পূরব-বায়
শীতে শিহরিছে কায়
গহন জলদে দিবা হয়েছে আঁধার-মুখী।

সেই—সেই ছেলেবেলা,
আনন্দে করেছি খেলা
প্রকৃতি গো—জননী গো—কেবলি তোমারি কোলে।
তার পরে কি যে হল—কোথা যে গেলেম চলে!

হৃদয় নামেতে এক বিশাল অরণ্য আছে,
দিশে দিশে নাহিক কিনারা,
তারি মাঝে হ’নু পথহারা।

সে বন আঁধারে ঢাকা,
গাছের জটিল শাখা
সহস্ৰ স্নেহের বাহু দিয়ে
আঁধার পালিছে বুকে নিয়ে।
নাহি রবি, নাহি শশী, নাহি গ্রহ, নাহি তারা,
কে জানে কোথায় দিগ্বিদিক।
আমি শুধু একেলা পথিক।
তোমারে গেলেম ফেলে,
অরণ্যে গেলেম চলে,



কাটালেম কত শত দিন
ম্ৰিয়মাণ সুখশান্তিহীন।

আজিকে একটি পাখী পথ দেখাইয়া মোরে
আনিল এ অরণ্য-বাহিরে,
আনন্দের সমুদ্রের তীরে।
সহসা দেখিলু রবিকর,
সহসা শুনিলু কত গান,
সহসা পাইলু পরিমল,
সহসা খুলিয়া গেল প্রাণ।

দেখিলু ফুটিছে ফুল, দেখিলু উড়িছে পাখী,
আকাশ পূরেছে কলস্বরে।
জীবনের ঢেউগুলিওঠে পড়ে চারিদিকে,
রবিকর নাচে তার পরে।
চারিদিকে বহে বায়ু, চারিদিকে ফুটে আলো,
চারিদিকে অনন্ত আকাশ,
চারিদিকপানে চাই, চারিদিকে প্রাণ ধায়,
জগতের অসীম বিকাশ।
কেহ এসে বসে কোলে, কেহ ডাকে সখা বলে,
কাছে এসে কেহ করে খেলা,
কেহ হাসে, কেহ গায়, কেহ আসে, কেহ যায়,
এ কি হেরি আনন্দের মেলা!

যুবক যুবতী হাসে, বালক বালিকা নাচে,
দেখে যে রে জুড়ায় নয়ন।
ও কে হেথা গান গায়, প্রাণ কেড়ে নিয়ে যায়,
ও কি শুনি অমিয়-বচন!
কেরে তুই কচি মেয়ে, বুকের কাছেতে এসে
কি কথা কহিস্ ভাঙা ভাঙা,
প্রভাতে প্রভাত ঢালে হাসির প্রবাহ তোর,
আধফুটো ঠোট রাঙা রাঙা।


তাই আজি শুধাই তোমারে,
কেন এ আনন্দ চারিধারে।
বুঝেছি গো বুঝেছি গো—এতদিন পরে বুঝি,
ফিরে পেলে হারানো সন্তান।
তাই বুঝি দুই হাতে জড়ায়ে লয়েছ বুকে,
তাই বুঝি গাহিতেছ গান।
তাই বুঝি ছুটে আসে সমীরণ মোর পাশে,
বারবার করে আলিঙ্গন,
আকাশ আনন্দভরে আমার মাথার 'পরে
করিছে প্রভাত বরিষণ।
তাই বুঝি মেঘমালা পূরব-দুয়ার হতে
স্নেহদৃষ্টে মোর মুখে চায়!
 



তাই বুঝি চরাচর তাহার বুকের মাঝে
বার বার ডাকিছে আমায়!

ওই শোন পাখী গায়—শতবার করে গায়,
ঐ দেখ ফুটে ওঠে ফুল।
আমি কে গো, জননী গো, আমারে হেরিয়া কেন
এরা এত হাসিয়া আকুল!
ছোট ছোট ফুলগুলি ওদের হেরিয়ে হাসি
প্রাণমন পূরিল উল্লাসে।
প্রভাতের শিশুগুলি কেমনে চিনিল মোরে,
মোরে কেন এত ভালবাসে?
মরি মরি কচিহাসি স্নেহের বাছনি তোরা
মোরে যদি এত লাগে ভালো
প্রতিদিন ভোর হলে আসিব তোদের কাছে
না ফুটিতে প্রভাতের আলো।
বায়ুভরে ঢলি ঢলি করিবিরে গলাগলি,
হেরিব তোদের হাসিমুখ,
তোদের শোনাব গান, তোদের দেখাব প্রাণ
উঘাটিয়া পরাণের সুখ।

ভালবাসা খুঁজিবারে গেছিনু অরণ্যমাঝে
হৃদয়ে হইনু পথহারা,
বরষিনু অশ্রুবারিধারা।



ভ্রমিলাম দূরে দূরে—কে জানিত বল দেখি
হেথা এত ভালবাসা আছে।
যে দিকেই চেয়ে দেখি সেই দিকে ভালবাসা
ভাসিতেছে নয়নের কাছে।
মা আমার, আজ আমি কতশত দিন পরে
যখনিরে দাঁড়ানু সম্মুখে,
অমনি চুমিলি মুখ, কিছু নাই অভিমান,
অমনি লইলি তুলে বুকে।
ছাড়িব না তোর কোল, র’ব হেথা অবিরাম,
তোর কাছে শিখিবরে স্নেহ,
সবারে বাসিব ভালো; কেহ না নিরাশ হবে
মোরে ভালবাসিবে যে কেহ।