কাব্যগ্রন্থ (প্রথম খণ্ড)/প্রভাত-সঙ্গীত/সাধ

উইকিসংকলন থেকে

সাধ


অরুণময়ী তরুণী উষা
জাগায়ে দিল গান।
পূরব মেঘে কনক-মুখী
বারেক শুধু মারিল উঁকি
অমনি যেন জগৎ ছেয়ে
বিকশি উঠে প্রাণ।
কাহার হাসি বহিয়া এনে
করিলি সুধা দান।
ফুলের সব চাহিয়া আছে
আকাশ-পানে মগন-মনা,
মুখেতে মৃদু বিমল হাসি
নয়নে দুটি শিশির-কণা।
আকাশপারে কে যেন বসে,
তাহারা যেন দেখিতে পায়
বাতাসে দুলে বাহুটি তুলে
মায়ের কোলে ঝাঁপিতে যায়।
কি যেন দেখে, কি যেন শোনে,
কে যেন ডাকে, কে যেন গায়,
ফুলের সুখ ফুলের হাসি
দেখিবি তোরা আয়রে আয়।



আ-মরি মরি অমনি যদি
ফুলের মত চাহিতে পারি।
বিমল প্রাণে বিমল সুখে,
বিমল প্রাতে বিমল মুখে,
ফুলের মত অমনি যদি
বিমল হাসি হাসিতে পারি।

দুলিছে, মরি, হরষ-স্রোতে,
অসীম স্নেহে আকাশ হতে
কে যেন তারে খেতেছে চুমো,
কোলেতে তারি পড়িছে লুটে!
কে যেন তারি নামটি ধরে
ডাকিছে তারে সোহাগ করে
শুনিতে পেয়ে ঘুমের ঘোরে
মুখটি ফুটে হাসিটি ফোটে;
শিশুর প্রাণে সুখের মত
সুবাসটুকু জাগিয়া ওঠে।

আকাশপানে চাহিয়া থাকে
না জানি তাহে কি সুখ পায়।
বলিতে যেন শেখেনি কিছু
কি যেন তবু বলিতে চায়।



আঁধার কোণে থাকিস্ তোরা,
জানিস্ কি রে কত সে সুখ
আকাশপানে চাহিলে পরে,
আকাশপানে তুলিলে মুখ।
সুদূর দূর সুনীল নীল,
সুদূরে পাখী উড়িয়া যায়।
সুনীল দূরে ফুটিছে তারা
সুদূর হতে আসিছে বায়।
প্রভাত-করে করিরে স্বান,
ঘুমাই ফুল-বাসে,
পাখীর গান লাগেরে যেন
দেহের চারিপাশে।
বাতাস যেন প্রানের সখা,
প্রবাসে ছিল,নতুন দেখা,
ছুটিয়া আসে বুকের কাছে
বারতা শুধাইতে;
চাহিয়া আছে আমার মুখে,
কিরণময় আমারি সুখে,
আকাশ যেন আমারি তরে
রয়েছে বুক পেতে।
মনেতে করি আমারি যেন
আকাশ-ভরা প্রাণ



আমারি প্রাণ হাসিতে ছেয়ে
জাগিছে উষা তরুণ-মেয়ে,
করুণ আঁখি করিছে প্রাণে
অরুণ-সুধা দান।
আমারি বুকে প্রভাতবেলা
ফুলের মিলি করিছে খেলা,
হেলিছে কত, তুলিছে কত,
পুলকে ভরা মন,
আমারি তোরা বালিকা মেয়ে
আমারি স্নেহধন।
আমারি মুখে চাহিয়া তোর
আঁখিটি ফুট্‌ফুটি!
আমারি বুকে আলয় পেয়ে
হাসিয়া কুটিকুটি!
কেনরে বাছা,কেনরে হেন
আকুল কিলিবিলি,
কি কথা যেন জানাতে চাস্
সবাই মিলি মিলি।
হেথায় আমি রহিব বসে,
আজি সকাল-বেলা,
নীরব হয়ে দেখব চেয়ে
ভাই বোনের খেলা।



বুকের কাছে পড়িবি ঢলে
চাহিবি ফিরে ফিরে,
পরশি দেহে কোমল-দল
স্নেহেতে চোখে আসিবে জল,
শিশির সম তোদের 'পরে
ঝরিবে ধীরে ধীরে।


হৃদয় মোর আকাশ-মাঝে
তারার মত উঠিতে চায়,
আপন সুখে ফুলের মত
আকাশ পানে ফুটিতে চায়।
নিবিড় রাতে আকাশে উঠে
চারিদিকে সে চাহিতে চায়,
তারার মাঝে হারায়ে গিয়ে
আপন মনে গাহিতে চায়।
মেঘের মত হারায়ে দিশা
আকাশ-মাঝে ভাসিতে চায়;
কোথায় যাবে কিনারা নাই,
দিবসনিশি চলেছে তাই,
বাতাস এসে লাগিছে গায়ে,
জোছনা এসে পড়িছে পায়ে,

উড়িয়া কাছে গাহিছে পাখী,
মুদিয়া যেন এসেছে আঁখি,
আকাশ-মাঝে মাথাটি খুয়ে
আরামে যেন ভাসিতে যায়,
হৃদয় মোর মেঘের মত
আকাশ-মাঝে ভাসিতে চায়।
ধরার পানে মেলিয়া আঁখি
উষার মত হাসিতে চায়।
জগৎ-মাঝে ফেলিতে পা
চরণ যেন উঠিছে না,
সরমে যেন হাসিছে মৃদু হাস,
হাসিটি যেন নামিল ভুঁয়ে,
জাগায়ে দিল ফুলেরে ছুঁয়ে
মালতী বধু হাসিয়া তারে
করিল পরিহাস।
মেঘেতে হাসি জড়ায়ে যায়,
বাতাসে হাসি গড়ায়ে যায়,
ঊষার হাসি, ফুলের হাসি
কানন-মাঝে ছড়ায়ে যায়।
হৃদয় মোর আকাশে উঠে
উষার মত হাসিতে চায়।