কাব্যগ্রন্থ (প্রথম খণ্ড)/প্রভাত-সঙ্গীত/চেয়ে থাকা

উইকিসংকলন থেকে

চেয়ে থাকা


মনেতে সাধ যে দিকে চাই
কেবলি চেয়ে র’ব।
দেখিব শুধু—দেখিব শুধু
কথাটি নাহি কব।
পরাণে শুধু জাগিবে প্রেম,
নয়নে লাগে ঘোর।
জগতে যেন ডুবিয়া র’ব
হইয়া র’ব ভোর।
তটিনী যায়—বহিয়া যায়
কে জানে কোথা যায়;
তীরেতে বসে রহিব চেয়ে
সারাটি দিন যায়।
সুদূর জলে ডুবিছে রবি
সোনার লেখা লিখি,
সাঁঝের আলো জলেতে শুয়ে
করিছে ঝিকিমিকি।
সুধীর-স্রোতে তরণীগুলি
যেতেছে সারি সারি,



বহিয়া যায়, ভাসিয়া যায়,
কত না নরনারী।
না জানি তারা কোথায় থাকে
যেতেছে কোন দেশে;
সুদুর তীরে কোথায় গিয়ে
থামিবে অবশেষে।
কত কি আশা গড়িছে বসে
তাদের মনখানি,
কত কি সুখ, কত কি দুখ,
কিছুই নাহি জানি।


দেখিব পাখী আকাশে ওড়ে,
সুদূরে উড়ে যায়,
মিশায়ে যায় কিরণ-মাঝে
আঁধার-রেখাপ্রায়।
তাহারি সাথে সারাটি দিন
উড়িবে মোর প্রাণ;
নীরবে বসি তাহারি সাথে
গাহিব তারি গান।
তাহারি মত মেঘের মাঝে
বাঁধিতে চাহি বাসা,



তাহারি মত চাঁদের কোলে
গড়িতে চাহি আশা।
তাহারি মত আকাশে উঠে,
ধরার পানে চেয়ে
ধরায় যারে এসেছি ফেলে
ডাকিব গান গেয়ে।
তাহারি মত, তাহারি সাথে
ঊষার দ্বারে গিয়ে
ঘুমের ঘোর ভাঙায়ে দিব
উষারে জাগাইয়ে।

পথের ধারে বসিয়া র’ব
বিজন তরুছায়,
সমুখ দিয়ে পথিক যত
কত না আসে যায়।
ধূলায় বসে আপন মনে
ছেলেরা খেলা করে
মুখেতে হাসি সখারা মিলে
যেতেছে ফিরে ঘরে।

পথের ধারে, ঘরের দ্বারে
বালিকা এক মেয়ে



ছোট ভায়েরে পাড়ায় ঘুম
কত কি গান গেয়ে।
তাহার পানে চাহিয়া থাকি
দিবস যায় চলে
স্নেহেতে ভরা করুণ আঁখি,
হৃদয় যায় গলে।
এতটুকু সে পরাণটিতে
এতটা সুধারাশি!
কাছেতে তাই দাঁড়ায়ে তারে
দেখিতে ভালবাসি।


কোথা বা শিশু কাঁদিছে পথে
মায়েরে ডাকি ডাকি,
আকুল হয়ে পথিক-মুখে
চাহিছে থাকি থাকি।
কাতর স্বর শুনিতে পেয়ে
জননী ছুটে আসে,
মায়ের বুক জড়ায়ে শিশু
কাঁদিতে গিয়ে হাসে।
অবাক্ হয়ে তাহাই দেখি
নিমেষ ভুলে গিয়ে,



দুইটি ফোঁটা বাহিরে জল
দুইটি আঁখি দিয়ে।

যায়রে সাধ জগৎপানে
কেবলি চেয়ে রই
অবাক্ হয়ে, আপনা ভুলে,
কথাটি নাহি কই।