কাব্যগ্রন্থ (প্রথম খণ্ড)/প্রভাত-সঙ্গীত/স্রোত

উইকিসংকলন থেকে


স্রোত


জগৎ-স্রোতে ভেসে চল, যে যেথা আছ ভাই।
চলেছে যেথা রবি শশী চলরে সেথা যাই।
কোথায় চলে কে জানে তা, কোথায় যাবে শেষে,
জগৎ-স্রোত বহে গিয়া কোন্ সাগরে মেশে!
অনাদি কাল চলে স্রোত অসীম আকাশেতে,
উঠেছে মহা কলরব অসীমে যেতে যেতে।
উঠিছে ঢেউ, পড়ে ঢেউ, গণিবে কেবা কত।
ভাসিছে শত গ্রহ তারা, ডুবিছে শত শত।
ঢেউয়ের পরে খেলা করে আলোকে আঁধারেতে,
জলের কোলে লুকোচুরি জীবনে মরণেতে।
শতেক কোটি গ্রহ তারা যে স্রোতে তৃণপ্রায়,
সে স্রোতমাঝে অবহেলে ঢালিয়া দিব কায়।
অসীম কাল ভেসে যাব অসীম আকাশেতে,
জগৎ-কল-কলরব শুনিব কান পেতে।
দেখিব ঢেউ, উঠে ঢেউ, দেখিব মিশে যায়,
জীবনমাঝে উঠে ঢেউ মরণ গান গায়।
দেখিব চেয়ে চারিদিকে, দেখিব তুলে মুখ,
কত না আশা, কত হাসি, কত না সুখ দুখ,



বিরাগ দ্বেষ ভালবাসা, কত না হায় হায়,
তপন ভাসে, তারা ভাসে, তা'রাও ভেসে যায়।
কত না যায়, কত চায় কত না কাঁদে হাসে,
আমি ত শুধু ভেসে যাব দেখিব চারিপাশে।

অবোধ ওরে, কেন মিছে করিস্ আমি আমি?
উজানে যেতে পারিবি কি সাগর-পথ-গামী?
জগৎ-পানে যাবিনেরে, আপনা-পানে যাবি,
সে যে রে মহা মরুভূমি কি জানি কি যে পাবি।
মাথায় করে আপনারে, সুখদুখের বোঝা,
ভাসিতে চাস প্রতিকূলে সে ত রে নহে সোজা।
অবশ দেহ, ক্ষীণ বল, সঘনে বহে শ্বাস।
লইয়া তোর সুখ দুখ এখনি পাবি নাশ।

জগৎ হয়ে র’ব আমি একেলা রহিব না।
মরিয়া যাব একা হলে একটি জলকণা।
আমার নাহি সুখ দুখ, পরের পানে চাই,
যাহার পানে চেয়ে দেখি তাহাই হয়ে যাই।
তপন ভাসে, তারা ভাসে, আমিও যাই ভেসে,
তাদের গানে আমার গান, যেতেছি এক দেশে।
প্রভাত সাথে গাহি গান সাঁঝের সাথে গাই,
তারার সাথে উঠি আমি তারার সাথে যাই।



ফুলের সাথে ফুটি আমি, লতার সাথে নাচি,
বায়ুর সাথে ঘুরি শুধু ফুলের কাছাকাছি।
মায়ের প্রাণে স্নেহ হয়ে শিশুর পানে ধাই,
দুখীর সাথে কাঁদি আমি, সুখীর সাথে গাই।
সবার সাথে আছি আমি, আমার সাথে নাই,
জগৎ-স্রোতে দিবানিশি ভাসিয়া চলে যাই।